হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ বনাম লা-রশফুকোর ম্যাক্সিম

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৫/০৭/২০১৫ - ৫:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জনৈক শিবলি আজাদ দাবী করেছেন, হুমায়ুন আজাদের বইগুলো নাকি বিদেশি বইয়ের নকল। তার দাবীর প্রেক্ষিতে আমরা সবাই প্রমাণ চাইলেও তিনি প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। তার অনেকগুলো দাবীর মাঝে একটা দাবী ছিলঃ

"আজাদের লেখা প্রবাদ ও প্রবচন যে আসলে ফরাসী দার্শনিক লা রশফুকোর “ম্যাক্সিম” থেকে নেয়া বইদুটো পাশাপাশি পড়লেই তা বোঝা যায়।"

যে বইগুলো নিয়ে এমন দাবী করা হয়েছে তার মাঝে প্রবাদ-প্রবচনের বইটাই সবচেয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত। অর্থাৎ আসলেই চুরি করে লেখা কিনা সেটা মিলিয়ে দেখা এইক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ। শি-আ দাবী করেছেন হু-আ ও রশফুকোর বইদুটোর পাশাপাশি পড়লেই নাকি বোঝা যাবে। আমি তাই মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছি।

হু-আর যে বইটি নিয়েছি সেটি ২০০৭ এর শোভন সংস্করণ (প্রথম প্রকাশঃ ১৯৯৩)। শি-আ বইটির নাম ভুল লিখেছেন, তিনি লিখেছেন 'প্রবাদ ও প্রবচন'। কিন্তু হু-আর বইটির নাম আসলে 'প্রবচনগুচ্ছ'।
আর রশফুকোর মূল বইটি ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা(১৬৬৫ সালে প্রকাশিত)। আমি রশফুকোর বইটির দুইটা ভার্সন নিয়েছি।
একটা হচ্ছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত ভার্সন (Collected Maxims and Other Reflections; Translated by BLACKMORE & GIGUÈRE)
আরেকটা হচ্ছে Bund & Friswell অনূদিত ভার্সন যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭১ সালে (Reflections; or Sentences and Moral Maxims)।
আজাদের বইটা প্রকাশ হবার আরও ১৪ বছর পরে যেহেতু অক্সফোর্ডের বইটা প্রকাশিত সেহেতু আজাদ চুরি করলেও সেটা ১৮৭১ সালের ভার্সন থেকেই চুরি করতে বাধ্য।
১৮৭১ সালের ভার্সনটা প্রজেক্ট গুটেনবার্গের স্ক্যান থেকে সরাসরি পড়া যাবে এই লিংক থেকেঃ

http://www.gutenberg.org/files/9105/9105-h/9105-h.htm#linkmaxims

পাশাপাশি রেখে পড়ার পর যা দেখলাম, যা বুঝলামঃ

১/ আজাদের বইটি বাঙলায় লেখা, রাশফুকোর মূল বইটি ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা অর্থাৎ সরাসরি কপি করার কোনও সুযোগ নেই বা ফ্রেঞ্চ বইটা 'পাশাপাশি রাখলেই বুঝে ফেলা' যায় না। হু-আ কপি করলেও হয় তাকে ফ্রেঞ্চ থেকে অথবা ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে নিতে হয়েছে।

২/ হু-আ তার বইটির ভূমিকায় প্রবচনের অর্থ, উৎপত্তি, সর্বপ্রথম প্রচবন বই হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত রশফুকোর বইটির পরিচয় সেখানে দিয়েছেন, সাথে ভবনার্গ, হ্যালিফ্যাক্স, পাস্কাল আর শাতোব্রিয়ের বইগুলোর কথা লিখেছেন। প্রবচন লেখক হিসেবে আরও ৩০ জন লেখকের, সাথে আমাদের ভারতচন্দ্র, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীর নাম ও উল্লেখ করেছেন।
আমাদের কপাল ভালো শিবলি বাকি বইগুলো থেকে চুরির দাবী করেননি, তাহলে maxim তো বটেই, বাকিগুলোও পড়তে হত। শিবলির মত লোকেরা প্রমাণ ছাড়া দাবী করেই খালাস, আর প্রত্যুত্তর করতে যেয়ে আমাদের পড়তে হয় হাজার পৃষ্ঠার বই!

৩/ আজাদের বইতে প্রবচন আছে ২০০ টি আর রশফুকোর প্রবচন আছে ৫০৪ টি (ভার্সন অনুযায়ী পার্থক্য আছে)।
অর্থাৎ প্রবচন সংখ্যার পার্থক্য থেকেই প্রমাণ হয় হু আ 'লাইন-বাই লাইন কপি' করেননি।
হু-আ ভূমিকায় লিখেছেন তার প্রকাশক তার কাছে কমপক্ষে ৫০০ প্রবচন চেয়েছিল, তিনি সময় করে উঠতে পারেননি বলে কম লিখেছেন।

৪/ এবার দেখা যাক প্রবচনগুলোতে মিল আছে কিনা।
আজাদের প্রবচনগুলোর মাঝে অধিকাংশই হচ্ছে সরাসরি বাঙলা/বাঙলাদেশ প্রেক্ষাপটে কিংবা আধুনিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে লেখা। অর্থাৎ রশফুকোর বই থেকে সেগুলো কপি করার সম্ভবই না। এমন কিছু প্রবচন হচ্ছেঃ

> ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের আধুনিক উৎস মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। (১৯৬ নং প্রবচন)। ১৯৫ নং প্রবচন ও গান্ধীকে নিয়ে লেখা। রশফুকো বই লেখার আরও প্রায় ২০০ বছর পরে গান্ধীর জন্ম হয়। অর্থাৎ কপি করা সম্ভবই না।

> শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখা ৫ নং প্রবচনের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য।

>১৬৬ আর ১৬৭ নং প্রবচন হচ্ছে সত্যজিৎ আর বিভূতিভূষণকে নিয়ে।

>রবীন্দ্রনাথ আছেন ৬৭, ১৩৫ , ১১৭ নং প্রবচনে। ৪৭ নং লেখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়া নিয়ে যা কিনা রশফুকোর আড়াই শো বছর পরের ঘটনা।

>নজরুল আছেন ২০ ও ১০৩ নং প্রবচনে।

>এরশাদ আছেন ৫৭ নং এ।

> কার্ল মার্ক্স জন্ম নিয়েছেন রশফুকোর দেড় শতাব্দী পরে। মার্ক্সকে নিয়ে হু-আ প্রবচনগুলো হচ্ছে ১২৫, ১৩৩, ১৪৩,১৪৪।

> রশফুকো জন্ম নিয়েছিলেন রাজপরিবারে, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে। পুঁজিবাদ তার আরও অনেক পরে বিকশিত হয়েছে পৃথিবীতে। হু-আ পুঁজিবাদ নিয়ে প্রবচন লিখেছেন ২, ৩০ এ। অথচ ক্যাপিটালিজম নিয়ে রশফুকোর প্রবচন নেই।

> অভিজাতদের গণতন্ত্র শুরু হয় এথেন্সে কিন্তু আধুনিক ডেমক্রেসির উৎপত্তি ইংল্যান্ডে, রশফুকোর সময়কালের পরে। ৮৬, ৩০, ২৫ তে লিখেছেন হু-আ, কিন্তু রশফুকো লেখেননি।

>তৃতীয় বিশ্ব কনসেপ্টের শুরু রশফুকোর আরও তিনশ বছর পরে, আমেরিকা বনাম সোভিয়েতের কোল্ড ওয়ারের সময়কালে। হু-আঃ ৬৯নং প্রবচন এই নিয়েই।

>শিবলি আজাদ যিনি কাজ করেছেন বাংলাপিডিয়ার সম্পাদনায়, BA ডিগ্রি নিয়েছেন আমেরিকার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে, MA করেছেন নিউ-ইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে, বাংলাদেশে যিনি ছিলেন ইউডার (University of Development Alternative) এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এবং এখন Lehman College এর লেকচারার। তিনি কি জানেন না, পিএইডি ডিগ্রি কবে থেকে দেয়া শুরু হয় পৃথিবীতে? রশফুকোর সময়কালের আরও ২০০ বছর পরে ১৮৬১ সালে আমেরিকায়, শিবলি এখন যে দেশে থাকেন সেখানেই। হু-আ পিএইডি নিয়ে প্রবচন লিখেছেন ১১১ নং এ।

>প্রফেশনাল সাংবাদিকতা তথা জার্নালিজমের শুরু হয় রশফুকোর আরও ১০০ বছর পরে। আর হু-আ সাংবাদিকদের নিয়ে প্রবচন লিখেছেন ১০৮ নং এ।

>বিজ্ঞাপন তথা এডভারটাইজমেন্টের যদিও শুরু হয় প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে প্রাচীন মিশর - চীনে ও ভারতে কিন্তু আধুনিকভাবে শুরু হয় রশফুকোর আরও শতবর্ষ পরে। (হু-আঃ৭০)। প্রচার মাধ্যম তথা মিডিয়া নিয়ে হু-আ লিখেছেন ২২ নং এ।

>১৭৩ নং প্রবচন টেলিভিশন নিয়ে। রশফুকোর বই লেখার আরও আড়াই শতাব্দী পরে ১৯৩০ সালের দিকে টিভি আবিষ্কার হয়। ২৬, ৫০, ৫৩ ও ৮৩ তেও টিভির উল্লেখ। ১৭২ নং প্রবচনে উল্লেখ আছে টিভি, প্লেন, স্পেসশিপ, কম্পিউটারের। ১১৬ নং প্রবচন হচ্ছে বাংলাদেশ টেলিভিশন তথা বিটিভি নিয়ে। ৮৯ নং এ আছে টেলিফোন আর হুইস্কি নিয়ে।
>বিবর্তনের কনসেপ্ট আমরা পেয়েছি রশফুকোর আরও দেড়শ বছর পরে। হু-আ লিখছেন ১৭১ নং প্রবচন এই নিয়ে।

>২৪, ১৩৯-১৪২ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধোত্তর সময়কাল নিয়ে। বাংলা, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সরকার আর বাঙালি নারী নিয়েও হু-আ আরও কিছু প্রবচন লিখেছেন।

>হিন্দুদের নিয়ে রশফুকো কোনও প্রবচন লেখেননি কিন্তু হু-আ লিখেছেন (৯৮)। জন্মাতরবাদ নিয়ে হু-আ লিখেছেন ৪৬ নং এ।

>'হিন্দুরা মুর্তিপূজারী; মুসলমানেরা ভাবমুর্তিপূজারী। মুর্তিপূজা নির্বুদ্ধিতা; আর ভাবমুর্তিপূজা ভয়াবহ।' হু-আ এমন কথা লিখেছেন তার ৫ নং প্রবচনে। ১৯৪ নং প্রবচনে হু-আ লিখেছেন, 'মুসলমানের মুক্তি ঘটেনি। কারণ তারা অতীত ও তাদের মহাপুরুষদের সম্পর্কে কোনও সত্যনিষ্ঠ আলোচনা করতে দেয় না।' বাঙালি মুসলমান নিয়ে লিখেছেন ২০, ৬২ নং প্রবচনে।

১৫৯ নং প্রবচনে হু-আ লিখেছেন, "মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা, মন্দির ভাঙে ধার্মিকেরা, তারপরও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক, আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক।" ১৬০, ১৬১, ১৬২ প্রবচনগুলোও মসজিদ নিয়ে।

>নারী নেতৃত্ব নিয়ে হু-আ লিখেছেন ৯২ নং।

>৪৪ ও ৭৪ নং প্রবচন হু-আজাদের নিজেকে নিয়ে ও তার নারী বই নিয়ে লিখেছেন।
>বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে লিখেছেন ১০ নং এ। রশফুকো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছুই লেখেননি।

এমন আরও অনেকগুলো প্রচবন রয়েছে যেগুলো সরাসরি অমিল। বইদুটোর সবগুলো প্রবচন তুলে ধরা এই প্রবন্ধের মাঝে সম্ভবপর নয়। প্রিয় পাঠক, গণনা করে দেখলে হু-আর ২০০ টির মাঝে অন্তত ১৭০টি বা তারও বেশী প্রবচন রশফুকোর সাথে সরাসরি অমিল হবে বলেই মনে করি। শিবলির বক্তব্য "দুই বই পাশাপাশি রেখেই বুঝে ফেললেন রশফুকো থেকে আজাদ নিয়েছেন" সেটা যে নির্জলা মিথ্যা কথা এবার আশা করি বোঝা যাচ্ছে।

এখন আসি মিল থাকতে পারে কোনও প্রবচনগুলোতেঃ ফিলোসফি, রাজনীতি, প্রেম, দুঃখবোধ, প্রতারণা এসব নিয়ে। এগুলোর কনটেক্সটের মিল থাকা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রেমের কবিতা-গানে মিল মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক (যেহেতু একই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ)। ইংরেজিতে 'I Love You' বলা মানে নিশ্চয়ই বাংলা 'আমি তোমায় ভালোবাসি' থেকে চুরি করা না। এইসব বিষয়ে পার্থক্য হয় মূলত প্রকাশভঙ্গিতে। এই প্রকাশভঙ্গি আর শব্দের যোজনাই প্রতিটা কবির নিজস্বতা, লেখকের মৌলিকত্ব।

হু-আ এবং রশফুকোর প্রবচনগুলোর মাঝে সরাসরি মিল নেই। (কেউ যদি মিল এনে দেখানও তবে সেই মিল সর্বোচ্চ ৫% এর বেশী হবে বলে মনে করিনা। একথা বললাম কারণ অল্প হলেও আমার ভুল হতে পারে যেহেতু দুই বইয়ের সবগুলো প্রবচন মুখস্থ না করে বা পাশাপাশি টেবিল আকারে সাজিয়ে না লিখলে একদম নির্ভুল মন্তব্য করা সম্ভব না। )। পরোক্ষ মিল দেখানো এই আলোচনায় আনাই যাবেনা কারণ আমরা কথা বলছি প্লেইজারিজম নিয়ে। প্রভাবিত হয়ে লেখাকে প্লেইজারিজম বলে না।

সারমর্ম হিসেবে যা বোঝা গেল, শিবলি আজাদ যিনি কিনা একজন খুবই উচ্চশিক্ষিত-ডিগ্রিধারী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি হুমায়ুন আজাদের বই ও রশফুকোর বই কোনটাই পড়েননি। পড়ে থাকলে এতবড় বোগাস দাবী তিনি করতেন না। সম্ভবত তিনি হুমায়ুন আজাদের বইটির ভূমিকায় রশফুকোর নামটুকু পড়েছেন ও তা থেকেই ভেবে নিয়েছেন আজাদ রশফুকো থেকে চুরি করেছেন।
না পড়েই হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে লেখা চুরির অভিযোগ তথা দাবী করার কারণেই শিবলির কাছে প্রমাণ চাইবার পরেও তিনি তার দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে পারেননি।

শিবলি আজাদের মত এইসব ডিগ্রিধারী-মিথ্যাবাদীদের নিয়ে লিখে গিয়েছেন রশফুকোঃ

"There are persons whose only merit consists in saying and doing stupid things"

আর হুমায়ুন আজাদ তার প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন তার নিজেরই প্রবচনঃ

'শয়তানের প্রার্থনায় বৃষ্টি নামে না, ঝড় আসে; তাতে অসংখ্য সৎ মানুষের মৃত্যু ঘটে।'

অর্থাৎ এই পোড়া দেশে 'অসতেরা জনপ্রিয়, আর সৎ মানুষেরা আক্রান্ত'। শিবলি আজাদ, ইমতিয়াজ মির্জারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই সৎ মানুষদের নামে মিথ্যা-মিথ্যা কলঙ্ক আরোপের চেষ্টা করেন, ক্ষতি করার চেষ্টা করেন প্রগতিশীলতার, কারণ এরা আসলে উচ্চডিগ্রিধারী হলেও 'এক বইয়ের অনুসারী'

পুনশচঃ শিবলি আজাদের বাকি দাবীগুলোও চাইলে এভাবে রিফিউট করতে পারব। কিন্তু এত সময় আমরা নষ্ট করব কেনও? বইদুটো আগে পড়া থাকা সত্ত্বেও এই লেখাটা লিখতে যেয়ে আমার কয়েক ঘন্টা সময় লেগেছে, সেখানে ইবনে ওয়ারাকের বই তো ১২০০ পৃষ্ঠার। সেটা নিয়ে লিখতে গেলে তো সপ্তাহখানেক লাগবে।
কেউ প্রমাণ ছাড়া ড্রাগনের অস্তিত্ব দাবী করলেই বারবার আমরাই ড্রাগন খুঁজতে বেরিয়ে পরার কোনও মানে নাই। যারা দাবী করবে তারা পারলে প্রমাণ নিয়ে আসুক। হুমায়ুন আজাদ আমাদের পীর না, নবীও না। প্রমাণ পেলে আজাদকে খারাপ ভাবতে আমাদের কোনও দ্বিধা নাই।

লেখক - আহমদ রনি


মন্তব্য

সাইদ এর ছবি

আজকাল পেচডি শুনলেই কেন যেন পিলে চমকে যায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

শিবলী আজাদ লোকটা যে কিছুটা হলেও আজাত তা জীবদ্দশায় এ অভিযোগ না এনে হুমায়ুন আজাদ সাহেব মারা যাবার পর এমন অভিযোগ এনেই তিনি পরোক্ষভাবে জানান দিয়েছেন। আমি বলছি না যে হুমায়ুন আজাদ সাহেব মারা গিয়েছেন বলেই সকল অভিযোগের উর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন। তবে উনার মত একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক, যার বিষয়ে তার কোন জাদরেল নিন্দুক বা প্রতিপক্ষও অদ্যাবধি কোন গ্রহনযোগ্য পর্যায়ের টুকলিফাইং-এর অভিযোগ আনতে সক্ষম হননি তার বিষয়ে মৃত্যুর এত বছর পরে এমন সস্তা অভিযোগ আনার প্রয়াশ, আনয়নকারীর আজাতত্বই প্রমান করে। যারা প্রকৃতভাবে উনার লেখা পড়েছেন, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের ভিতর থেকেই অনুভব করতে পারেন যে উনার সাহিত্য উনারই মৌলিক সৃষ্টি।
আপনার সাথে দ্বিমত করে বলতে চাই, হুমায়ুন আজদ আমাদের পীর বা নবী হলেও কেউ যদি নিরপেক্ষ বিচারে গ্রহনযোগ্য কোন প্রমান হাজির করতে পারেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই তাকে বর্জন করব। আমরা তার সত্যিকার দুর্বলতা বিষয়ে সমালোচনাকারীদের দিকে তো নয়ই, এমনকি শিবলী আজাতের মত মিছেমিছি অভিযোগকারীদের দিকেও চাপাতি হস্ত হব না।
সুন্দর, পরিশ্রমশ্রাদ্ধ লেখার জন্য ধন্যবাদ।

- পামাআলে

Emran  এর ছবি

পশ্চিমবঙ্গের একজন গবেষকের রেফারেন্স দিয়ে আহমদ ছফা (সজারুবিষয়ক বিতর্কের সময়) দাবী করেছিলেন হুমায়ুন আজাদের বাক্যতত্ত্ব বইটা নাকি পুরোটাই চৌর্যবৃত্তির ফসল। মনে হয় এই বছরের গোঁড়ার দিকে সচলায়তনের কোন এক পোস্টের মন্তব্যে ছফার পুরো লেখাটাই তুলে দেয়া হয়েছিল।

হিমু এর ছবি

সেই গবেষক বা ছফার অভিযোগ যে শিবলি আজাদের অভিযোগের চেয়ে গুণগত দিক দিয়ে ভিন্ন, এ ব্যাপারে কি নিশ্চিত হওয়া যায়?

অতিথি লেখক এর ছবি

বইয়ের নাম ভুল লিখেছিলাম; ওটা বাক্যতত্ত্ব না, সম্ভবতঃ বাঙলা ভাষা। আর পশ্চিমবঙ্গের সেই গবেষকের নাম ডঃ মিলন কান্তি নাথ। ডঃ নাথের সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলি যোগাড় করতে পারলে তাঁর অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে।

Emran

হিমু এর ছবি

আপনি ইচ্ছা করলে ছফার প্রবন্ধের প্রাসঙ্গিক অংশটা কোট করে দিতে পারেন। আহমদ ছফার সেই প্রবন্ধের আগে পিছে ছাগুদের টীকাটীপ্পনীর লিঙ্ক প্রোমোট না করাই ভালো।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

কল্যাণ এর ছবি

পশ্চিমবঙ্গের সেই গবেষকের নাম ডঃ মিলন কান্তি নাথ

নাকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মৃনাল কান্তি নাথ? এইটা যাচাই করার মত কোন রেফারেন্স কি জানা আছে আপনার?

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি এই গবেষকের নাম আহমদ ছফার লেখার মধ্যেই পেয়েছি; কখনও আসলে ইন্ডিপেন্ডেন্টলি ভেরিফাই করিনি। আর ছফার মতে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নিচে আমার এক মন্তব্যে আহমদ ছফার বক্তব্য তুলে দিয়েছি।

Emran

হিমু এর ছবি

ছফা লোকটা নিজেও মনে হয় মৃণালকান্তি নাথের লেখা বা হুমায়ুন আজাদের বইটা পড়ে দেখেনি। অভিযোগকারীর নামটাই ঠিকমতো বলতে পারেনি সে, আবার লম্বা লম্বা কথা বলে।

হাসিব এর ছবি

ব‍্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারছি না এই ইস‍্যুতে। হুমায়ুন আজাদ বিষয়ে অনেকের পরাণ ও অন‍্যান‍্য বিবিধ গহীণে বিবিধ কারণে অনেক রাগ, ক্ষোভ ও কষ্ট জমে আছে। এর রাজনৈতিক কারণ বোঝা কঠিন কিছু না। তাদের এইসব ইস‍্যু নিয়ে নাচানাচিতে হুমায়ুন আজাদের ঢুকিয়ে দেয়া বাঁশের গায়ে কিছু লুব্রিকেন্ট পড়লেও বাঁশ বাঁশের জায়গাতেই থাকবে।

সুবোধ অবোধ এর ছবি
কল্যাণ এর ছবি

চলুক

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

ঈয়াসীন এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

অতিথি লেখক এর ছবি

১ ডিসেম্বর ১৯৯৮ তারিখে মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ তোলেন আহমদ ছফা। হিমু ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী ছফার সেই নিবন্ধের প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে কোট করলামঃ

একবার হুমায়ুন আজাদ ভাষাবিজ্ঞানের ওপর থান ইটের মত প্রকান্ড একখানা কেতাব লিখে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশ করলেন এবং যত্রতত্র বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতে লাগলেন যে, আমার সমান ভাষাবিজ্ঞানী বাংলাভাষায় কস্মিনকালেও আর একজন জন্মাননি। তার অনতিকাল পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মিলন কান্তি নাথ নামে আর একজন অধ্যাপক প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লিখে অকাট্য প্রমাণ হাজির করে দেখালেন যে, হুমায়ুন আজাদের এ ঢাউস বইটা আগাগোড়াই চৌর্যবৃত্তির ফসল। ওই রচনা যাঁরা পড়েছেন, বাংলা একাডেমীর কাছে কৈফিয়ৎ চেয়ে বসলেন, আপনারা এমন একটা বই কেন প্রকাশ করলেন, যার আগাগোড়া চৌর্যবৃত্তিতে ঠাসা? বাংলা একাডেমী হুমায়ুন আজাদের বই বাজার থেকে পত্যাহার করে নিলেন এবং বিক্রয় বন্ধ করলেন আর হুমায়ুন আজাদের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করলেন, আপনি দায়িত্বশীল ব্যক্তি হয়েও কেন আগাগোড়া একটি নকল গ্রন্থ একাডেমীকে দিয়ে প্রকাশ করিয়ে একাডেমীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেললেন?

হুমায়ুন আজাদের 'নারী' বহুল আলোচিত গ্রন্থ। আমি নিজেও এক কপি কিনেছিলাম। কিন্তু কিনে মুশকিলে পড়ে গেলাম। বইটি এতই জীবন্ত যে, মাসে মাসে রক্তশ্রাব হয়। অগত্যা আমাকে বইটি শেলফ থেকে সরিয়ে রাখতে হল। হুমায়ুন আজাদ দাবি করেছেন, এটা তাঁর মৌলিকগ্রন্থ। আমার একটুখানি সংশয় জন্ম নিয়েছিল তাহলে সিমোন দ্যা বোভেয়ার কী করছিলেন? পরবর্তী গ্রন্থ 'দ্বিতীয় লিঙ্গ' প্রকাশিত হওয়ার পরে আমার সব সংশয় ঘুচে গেল। হুমায়ুন আজাদ অত্যন্ত বিশ্বস্ততারসহকারে সিমোন দ্যা বোভেয়ারের বই বাংলাভাষায় নিজে লিখেন। সমস্ত মাল-মসলা সিমোন দ্যা বোভেয়ারের। হুমায়ুন আজাদ এই বিদূষী দার্শনিক মহিলার পরিচ্ছন্ন রুচি এবং দার্শনিক নির্লিপ্ততা কোথায় পাবেন? কুরুচি এবং অশ্লীলতাটুকুই এই গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদের ব্যক্তিগত বিনিয়োগ। এ বিষয়ে আরো একটা কথা উল্লেখ করতে চাই। 'নারী' গ্রন্থটি যখন বাজেয়াপ্ত করা হল আমরা লেখকরা মিলে প্রস্তাব করলাম এ ধরসের গ্রন্থ নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে মিছিল করে প্রতিবাদ জানাব। আদালতে মামলা করব। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ পিছিয়ে গেলেন। তখন ধরে নিয়েছিলাম হুমায়ুন আজাদের সৎসাহসের অভাব আছে। 'দ্বিতীয় লিঙ্গ' প্রকাশিত হওয়ার পর আসল রহস্য বুঝতে পারলাম। মামলায় লড়ে 'নারী' গ্রন্থটি বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করা গেলেও আর্থিকভাবে হুমায়ুন আজাদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা অল্প। কারণ এই লেখার যতটুকু চমক প্রথম বছরেই তা নিঃশেষ হয়েছিল। নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হলেও পাঠকের বিশেষ চাহিদা থাকবে না। 'নারী' গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে হুমায়ুন আজাদ নতুন একটা জালিয়াতি করলেন। সে একই বই ভিন্ন নামে ভিন্ন মোড়কে প্রকাশ করলেন। বাংলাদেশে মহাজ্ঞানী-মনীষী হতে হলে এই ধরনের কত রকম ফন্দি-ফিকির করতে হয়! কত রকম ফন্দি-ফিকির শিখতে হয়!

হুমায়ুন আজাদ একটা দাবি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে করে আসছেন, তিনি পশ্চিমা ঘরানার পন্ডিত। এতদঞ্চলের নকলবাজ, অনুকরণসর্বস্ব পল্লবগ্রাহী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। তাঁর 'আমার অবিশ্বাস' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর এই দাবির যথার্থতা প্রমাণিত হল। প্রয়াত বৃটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ঊনত্রিশ বছর বয়সে যে গ্রন্থটি 'Why I am not a christian' লিখেছিলেন, তার বঙ্গীয় সংস্করণ প্রকাশ করে সর্বত্র আস্ফালন করে বেড়াতে লাগলেন এটা তার মৌলিক কীর্তি। কী করে পশ্চিমা ঘরানার পন্ডিত হতে হয়, এ সময়ের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ তার এক সহজ ফর্মুলা উদ্ভাবন করে ফেলেছেন। স্বর্গত পশ্চিমা লেখকদের লেখা আপনার মাতৃজবানে অনুবাদ করবেন এবং তার সঙ্গে খিস্তি-খেউর মিশিয়ে দেবেন। তাহলেই আপনি পশ্চিমা ঘরানার পন্ডিত বনে যাবেন।

Emran

অতিথি লেখক এর ছবি

যে পত্রিকায় আহমদ ছফা‘র কলাম ছাপা হয়েছিল সে পত্রিকা প্রারম্ভ থেকে যে পক্ষকে সমর্থন দিয়ে আসছে বলে আমার মনে হয়েছে সে পক্ষের প্রতি আমার সমর্থন নেই। সে কারণে পত্রিকাটি আমার কেনা বা পড়া হয়নি। তাই উনার আলোচ্য কলামটিও আমার পড়া হয়নি। আপনার কর্তৃক উপস্থাপিত অংশটি পড়ে আমার কাছে গঠনমূলক নয় বরং আক্রমনাত্মক মনে হয়েছে। তবে তারা দু’জনেই পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণের অভিযোগে অভিযুক্ত। তাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তিনি তো তার কলাপে দু‘একটি উদারহরণ টেনে প্রমান দেননি কিভাবে হুমায়ুন আজাদের ‘নারী‘ বইটি সিমোন দ্যা বোভেয়ারের বইটির হুবহু নকল বা কিভাবে উনার ‘আমার অবিশ্বাস’ গ্রন্থটি বার্ট্রান্ড রাসেলেটির। আমি যতদূর জানি, উনার নারী বইয়ের বিষয়ে কেউ কেউ নকলের অভিযোগ আনার কারণেই উনি দ্বিতীয় লিঙ্গ বইটি লিখেছিলেন। লেখক সিমোনের বইতে কি আছে তা দেখানোর জন্যই উনি ‍দ্বিতীয় লিঙ্গ বইটি লিখেছেন। উনি দেখাতে চেয়েছেন যে সিমোনের বই তার নারী বই থেকে ভিন্ন। আহমদ ছফা’র লেখা থেকে মনে হয়, হুমায়ুন আজাদ বুঝতে পারেননি যে দ্বিতীয় লিঙ্গ বই প্রকাশিত হলে এটা উন্মোক্ত হয়ে যাবে যে উনার নারী বই সিমোনের বইয়ের নকল। এ জায়গাটাতে আমার ঘোরতর আপত্তি। হুমায়ুন আজাদকে আর যা অপবাদই দেয়া হোক, এ অপবাদ কেউ দিতে পারবে না যে উনি কম বুঝতেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোন কোন না কোন লেখার মাধ্যমে হুমায়ুন আজাদ আহম্মদ ছফার কলামের অভিযোগ গুলোর জবাব দিয়েছিলেন। কারও সে বিষয়ে জানা থাকলে, বিষয়টি এখানে উল্লেখ করার এবং সম্ভব হলে ঐ লেখাটি এক্সট্রাক্ট সংযোজন করার অনুরোধ রইল।
ভাষাতত্ত্বের বইটি বা ঐ বইয়ের সম্বন্ধে লেখা ডঃ নাথের প্রবন্ধ আমার পড়া হয়নি এবং বলতে দ্বিধা নেই যে ওগুলো পড়ার কোন সম্ভাবনাও নেই। কাজেই ঐ বিষয়ে কিছু উল্লেখে করা আমার অনুচিত।

- পামাআলে

কুঙ্গ থাঙ এর ছবি

০১
ছফার নিজের কোন অভিযোগ ছিল না, তিনি মৃণালকান্তি নাথ নামে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের লেখার কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে বাক্যতত্ত্ব'র বিরুদ্ধে প্ল্যাজারিজমের অভিযোগ ছিল (চতুরঙ্গ, জুলাই ১৯৮৯ সংখ্যা, কলিকাতা)। ছফার লেখা থেকে স্পষ্ট তিনি নিজেও বইটি পড়ে দেখেননি। ছফা ও হুমায়ুন কেউই বাকসংযমী ছিলেন না, এ্ই সুযোগে তখনকার মানবজমিন তাদের হিট বাড়িয়ে নেয় ৷ ঐলেখার প্রতিউত্তর হুমায়ুন আজাদও দিয়েছিলেন ছফাকে আক্রমণ করে। ক্রোধান্ধ মানুষ যুক্তি প্রমাণের ধার ধারে না, ছফা ও হুমায়ুন আজাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল বলা যায় । তবে আমাদের ভাগ্য ভাল যে ছফানিজে পাঠকদের প্রতি দুঃখপ্রকাশ করে বাকযুদ্ধের ইতি টেনেছিলেন । এরকম বিতর্কের সূত্র ধরে আমরা আহমদ ছফা বা হুমায়ুন আজাদ কাউকেই বাতিল করতে পারি না ৷

০২
মৃণালকান্তির মুল অভিযোগটি ছিল সাইটেশন না দেয়ার অভিযোগ, সেটা অবশ্যই সুনীতিকুমার বার সুকুমার সেন বিষয়ে নয়। তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, আজাদ সুনীতিকুমার বার সুকুমার সেনের সূত্র দেবার বেলায় কার্পন্য করেননি (পৃষ্ঠা ১২)। তার অভিযোগ মুলত এন্থনি আরলোট্রো, বেন জ্যাকবসেন ও রাস্কোভস্কির রেফারেন্স দেবার বেলায় আজাদ উদার ছিলেন না সে বিষয়ে । হুমায়ুন আজাদের ৫০০ পৃষ্ঠার বইটি থেকে তিনি দেখিয়েছেন ১৩ নং পৃষ্ঠায় ২টি বাক্য আরলোট্রো থেকে অনুবাদ করা আর, ২৪ নং পৃষ্ঠার ২টি বাক্য রাস্কোভস্কির লেখার ভাবানুবাদ। এছাড়া এক ভাষা থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার কিভাবে জন্ম হয় তা নিয়ে আরলোট্রোর বই থেকে কয়েকটি ডায়াগ্রাম দিয়েছেন (ডায়গ্রামগুলো আরলোট্রোর নিজেরও ছিল না)। মৃণালকান্তি নাথ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এগুলি বের করেছেন। অন্যদিকে 'বাক্যতত্ত্ব' বইটি যারা পড়েছেন তাদের জানার কথা, বইটা ছিল প্রাচীন ভারত এবং আধুনিক পশ্চিমা ব্যকরন (বিশেষভাবে চমস্কি), দুটোকে অধিগত করে বাক্য ও ভাষাতত্ত্বে ব্যাখ্যাধর্মী কাজ । হুমায়ুন আজাদের ব্যাখ্যাতে পশ্চিমা লেখকরা বিশেষ করে আরলোট্রো, ল্যামেন, ভাট, হ্যালডেন, জেসপারসন, মিলাট, রাস্কোভস্কি এসেছেন প্রাসঙ্গিকভাবেই । ভাষাাগ গবেষণায় অগ্রজদের করা সার্ভে ও তত্ত্ব ভাষা অহরহ ধার করা হয়। অনেকসময় পৌণপুণিকতা এড়াতে অনেক গবেষক কিছু ক্ষেত্রে সাইটেশন বা তথ্যনির্দেশ এড়িয়ে যান। মৃণালকান্তির বিভ্রান্তির জায়গাটা ছিল হুমায়ুন আজাদের লেখার ইন্টারপ্রিটেশানধর্মী বৈশিষ্ঠ্যের সাথে কোন বিষয় সম্পর্কে তার নিজস্ব মতামত দেবার বৈশিষ্ঠ্য বা প্রবণতাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলার কারণে, যে প্রবণতা হুমায়ুন আজাদের প্রতিটা গবেষনাধর্মী রচনার ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় ।

০৩
মৃণালকান্তির অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমি বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয় বলে প্রচার চালানো হচ্ছে, যদিও এই ঘটনার সলিড কোন প্রমাণ নাই ৷ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে কোন এক ব্লগার ফোন দিয়েছিল ঐটাই আপাতত এভিডেন্স । যাহোক প্রত্যাহার যদি হয়েও তাকে সেটা সাময়িক ছিল বলা যায় কারণ বাংলা একাডেমির গ্রন্থ তালিকায় বইটি এখনও আছে ৷ তারপরে বইটির অনেকগুলো সংস্করন হয়েছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বেরিয়েছে। ২য় সংস্করন বের হয় ১৯৯৪ সালে সেখানে কোন সংশোধন ছিল না তবে আরলোট্রোর ডায়গ্রামগুলো বাদ দেয়া হয়। সর্বশেষ বের হয় আগামী প্রকাশনী থেকে ২০১০ সালে । এর অর্থ হলো মৃণালকান্তির অভিযোগ কেউ আমলে নেয়নি, ধোপে টেকেনি । মৃণালকান্তির যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বইটি ভাষাবিজ্ঞানের রেফারেন্স বই এখনও পড়ানো হয় । সর্বশেষ আনিসুজ্জামান, পবিত্র সরকার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো লেখকদের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমির সাম্প্রতিক প্রকাশিত 'প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ'- এর অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স নেয়া হয়েছে 'বাক্যতত্ত্ব' থেকে ।

হিমু এর ছবি

ইন্টারেস্টিং।

কুঙ্গ থাঙ এর ছবি

মৃণাল নাথ তার লেখায় 'বাক্যতত্ত্ব' এবং 'ঐতিহাসিক ও তুলনামুলক ভাষাবিজ্ঞান' দুইটা বইকেই একইসাথে আক্রমণ করেছেন । সেখানেও সাইটেশনের একইরকমের অভিযোগ। তবে 'ঐতিহাসিক ও তুলনামুলক ভাষাবিজ্ঞান' ছাত্রদের উপযোগি করে লেখা নোটবই টাইপের বই ছিল । ছফার বর্ণানুযায়ী 'থান ইটের মত প্রকান্ড' ছিল না, মাত্র একশ আশি পৃষ্ঠার বই । ছফা আসলে দুটো বইয়ের কোনোটাই পড়েননি ।

অতিথি লেখক এর ছবি

মৃণাল নাথ সরাসরি বলেছেন যে হুমায়ুন আজাদের পুরো কাজটিই লাইন বাই লাইন নকল কারণ তিনি কোনো রকমেরই সাইটেশন এর ধার ধারেন নি। তার বক্তব্যের যুক্তিগুলোকে এভাবে দায়সারা ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার কোনোই অবকাশ নেই। তার প্রবন্ধটি পড়ে দেখলাম। যদি তার বক্তব্য সঠিক হয় তবে হুমায়ুন আজাদ পৃথিবীর অন্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্লেজারিজমের জন্য তার চাকরী চলে যেতো। বাংলাদেশ বলেই মনে হয় সেটার সত্যতা যাচাই না করেই তাকে রক্ষা করতে কিংবা গালাগালি দিতে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। লেখার চেয়ে এখানে লেখার পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের অবসেশন বেশি।

মৃণাল নাথের প্রবন্ধটি পড়তে চাইলে এখানে দেখুন-

অতিথি লেখক এর ছবি

তার বক্তব্যের যুক্তিগুলোকে এভাবে দায়সারা ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার কোনোই অবকাশ নেই।

৩য় ব্যক্তির রসনায় ঝাল আস্বাদন করে আপনি যদি এতই "দায়"-বোধ করে থাকেন, তাহলে ঐ দায়, দায়বোধ আর সেকেণ্ড-হ্যান্ডে আস্বাদিত ঝালটি অন্যের ঘাড়ে চালান না করে নিজেই বরং আসল কাজটা করে দেখান না। অত্যন্ত দায়িত্বের পরিচয় দিয়ে সচলে একটা পোস্টের মাধ্যমে মূল লেখা, হুমায়ুনের লেখা (প্রথম দু'টি ক্ষেত্রে দায়িত্বপূর্ণভাবে বইয়ের পৃষ্ঠার স্ক্যান্‌ড ইমেজ সাথে সংযুক্ত করলে ভাল হয়) আর মৃণাল নাথের লেখা বিস্তারিত ভাবে পাশাপাশি সাজিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখিয়ে দিন না কিভাবে মৃণাল নাথের দাবি সত্য বা অসত্য এবং কিভাবে হুমায়ুন "লাইন বাই লাইন নকল" করেছেন কি করেননি। এত দায়বোধ করা সত্ত্বেও এই কাজটি যদি নিজেই করতে না পারেন বা না করেন, তাহলে অন্যকে "দায়সারা ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার" অভিযোগে অভিযুক্ত করতে গিয়ে আপনার নিজেরই ভাষায় -

বাংলাদেশ বলেই মনে হয় সেটার সত্যতা যাচাই না করেই.... লেখার চেয়ে এখানে লেখার পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের অবসেশন বেশি।

-- এই দোষে আপনি নিজেও বেশি বৈ কম দুষ্ট নন বলে প্রমাণিত হন।

তাই আমার আহবান রইলো, আসুন, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের অনর্থক গালাগালি না করে তাদের জাতীয় চরিত্রের সম্মানরক্ষার মহান দায়িত্ব নিতে (যদি আপনি বাংলাদেশি হন) অথবা আপনি যে বাংলাদেশিদের চেয়ে ভালো তা প্রমাণ করতে (যদি আপনি বাংলাদেশি না হন বা এদেশে বসবাসকারী বা পরিচয়ধারী ছদ্মবেশী বাংপাকি হন), নিদেনপক্ষে নিজের দায়বোধের দায়দায়িত্ব নিজেই নেয়ার ও পালন করার সৎসাহস যে আছে সেটা প্রমাণ করে আত্নসম্মানরক্ষার্থে এবং

লেখার চেয়ে এখানে লেখার পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের অবসেশন বেশি

- জাতীয় অবসেশনে আপনি নিজেই যে আসলে আক্রান্ত নন সেটা প্রমাণ করতে - উপরে যেমন বলেছি সেরকম একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলনামূলক পর্যালোচনা করে সচলে পোস্ট করুন না কেন।

এবং এই সুযোগে আমরাও একটা দারুন লেখা পড়ে আনন্দিত, অবহিত ও শিহরিত হই! কিভাবে আসলে দায় সারতে হয় বা হয় না সেই শিক্ষালাভ করি।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

কল্যাণ এর ছবি

হাততালি চলুক

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হুমম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

রানা মেহের এর ছবি

আবারো বলি, আপনার এই কাজটা খুব ভালো হয়েছে রনি।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

কল্যাণ এর ছবি

হ।

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

কল্যাণ এর ছবি

হাততালি চলুক

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

নজমুল আলবাব এর ছবি

এই পোস্ট প্রথমে দেখে বিরক্ত হয়ে ভেবেছিলাম মেটাব্লগিং। পড়ে সেই ভ্রম ভাংলো। ধন্যবাদ রনি সচলে এটি লেখার জন্য।

বহুদিন পরে কুঙ্গ থাঙ কে সচলে দেখে ভালো লাগলো। মন্তব্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করেছেন। ধন্যবাদ।

চলমান জ্বলুনিবিতর্ক সম্পর্কে হাসিব্বাইর বক্তব্য পছন্দ হয়েছে। এইসব বিতর্কের ধুয়া একটু হয়তো লুব্রিকেশনের কাজ দেবে, কিন্তু হুমায়ুনের বাশটা ঠিক যায়গাতেই লেগে থাকবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।