হুমায়ুন আজাদের শিল্পকলার বিমানবিকরণ বনাম অর্তেগা গাসেতের “Dehumanization of art”

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৯/০৭/২০১৫ - ৩:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শিল্পকলার বিমানবিকরন বইটির ভূমিকায় হুমায়ুন আজাদ নিজেই লিখেছেন, যে বইটি ওর্তেগা ই গাসেতের ভাবানুবাদ। অনুবাদকর্মকে কুম্ভলকবৃত্তি, চোর্জবৃত্তি, প্লেইজারিজম বলা যায় কি? উত্তর হচ্ছেঃ না। তাই বইটি নিয়ে খুব বেশী লেখার আপাতত কোনও দরকার দেখছি না, তবে কিছু আলোচনার দরকার আছে।

শিবলি আজাদ লিখেছিলেন,

“আজাদের কুম্ভীলকবৃত্তি নিয়ে অনেককেই মন্তব্য করলেও ওর প্ল্যাজারাইজড্ বইগুলোর মূল উৎস সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল নন। আজাদের কিছু কিছু বই যেমন “শিল্পকলার বিমানবিকরন,” “বাক্যতত্ত্ব,” বা “নারী”র প্রথম দিকের এডিশনগুলো ছিলো লাইন বাই লাইন হুবহু অনুবাদ। এদের লেখকরা, বিশেষ করে শিল্পকলার বিমানবিকরনের লেখক অর্তেগা ঈ গ্যাসেত বিশ্ববিখ্যাত স্প্যানিশ দার্শনিক।”

প্লেইজারিজমের উদাহরণ দিতে যেয়ে শিবলি শিল্পকলার বিমানবিকরন এর কথা টেনেছেন। লেখার শেষে অর্তেগা গাসেতের বইটি কেনার জন্য একটা লিংকও দিয়েছেন।

অথচ হুমায়ুন আজাদ নিজে বইটির ভূমিকাতে লিখেছেন,

“খুব ভালো হতো যদি এ-দীর্ঘ রচনাটির একটি বিশ্বস্ত অনুবাদ প্রকাশ করা যেত , কিন্তু সে-উদ্যমের বিশেষ অভাব আমার । তাই এখানে আমি অর্তেগার বক্তব্য-ব্যাখ্যার সারাংশ লিপিবদ্ধ ক’রেই তৃপ্তি পেতে চাই । এ-সারাংশও হবে আমার রুচি-অনুসারী , হয়তো ওর্তেগার ব্যক্তিগতভাবে প্রিয় অনেক অংশ বাদ প’ড়ে যাবে , এবং কোথাও কোথাও প্রবল হয়ে উঠবে আমার নিজেরই ব্যাখ্যা । [ হুমায়ুন আজাদ , শিল্পকলার বিমানবিকীকরন ও অন্যান্য প্রবন্ধ , ‘ শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ‘ , দ্বিতীয় মুদ্রণ , ঢাকা , আগামী প্রকাশনী ,২০০৫ , পৃ . ১১ ]”

হুমায়ুন আজাদ নিজেই ‘ শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ’কে ভাবানুবাদ বলে যাবার পরও এই বইটি চুরি করে লেখা বই বলাটা শিবলি, ইমতিয়াজ মির্জা গংদের স্রেফ ভন্ডামি।

ওর্তেগার বইটা স্পেনিশ ভাষায় প্রথম প্রকাশ হয় ১৯২৫ সালে, তারপর এর ইংরেজি অনুবাদ বের হয় ১৯৪৮ সালে। আরও তিনটি প্রবন্ধ বাড়িয়ে প্রিস্টন ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে।পৃষ্ঠা সংখ্যা:২০৪ । ইংরেজি ভার্সনটার পুরো নাম হচ্ছেঃ The Dehumanization of Art and Other Essays on Art, Culture, and Literature।
আর আজাদের বইটি ৮৮ সালে ইউপিএল (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড) থেকে, পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৩৫। আজাদের বইটির পুরো নাম হচ্ছেঃ শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ।আজাদের এই বইটি পরবর্তীতে রিপ্রিন্ট হয় ২০০৫ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে। পাঠক রিপ্রিন্ট শব্দটা খেয়াল করেন, ছাগুরা নাহলে আবার দাবী করবে ‘ফার্স্ট এডিশনে পার্থক্য ছিল’। এমন দাবীর সম্মুখিন আমি হয়েছি অলরেডি, অবশ্য যিনি দাবী করেছেন তিনি যথারীতি তার দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে পারেননি।

এ গ্রন্থে সংকলিত আটটি প্রবন্ধে হুমায়ুন আজাদের সৃষ্টি ও মননশীলতার অনন্য প্রকাশ ঘটেছে। শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ নামক প্রবন্ধটিতে, বাঙলা ভাষায় প্রথমবারের মত আলোচিত হয়েছে স্পেনীয় দার্শনিক অর্তেগা ঈ গাসেতের বিমানবিকীকরণ তত্ত্ব, আধুনিক শিল্প-সাহিত্য উপভোগের জন্যে যার সাথে পরিচয় অপরিহার্য। মধ্যাহ্নের অলস গায়ক: রোম্যানটিক বহিরস্থিত রবীন্দ্রনাথ নামক একটি অনবদ্য প্রবন্ধে তিনি উদঘাটন করেছেন রবীন্দ্রনাথের অর্ন্তগত বহিরস্থিত সত্ত্বাটিকে, যা প্রথাগত সমালোচকদের চোখ এড়িয়ে গেছে। জসীমউদ্দীন সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধে তিনি আধুনিক দৃষ্টিতে বিচার করেছেন ভাষা-আন্দোলন-পূর্ব সাহিত্যের শৈল্পিক ও সামাজিক চারিত্র্য। ভাষা বিজ্ঞান বিষয়ে রয়েছে দু’টি প্রবন্ধ, একটি প্রবন্ধে বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করেছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নামক কিংবদন্তিকে, অন্যটিতে নির্দেশ করেছেন মান বাঙলা ভাষার সর্বজনীন রৌপ কাঠামো। সুলিখিত গদ্যের দুর্ভিক্ষের কালে হুমায়ুন আজাদ এ প্রবন্ধগুচ্ছে, তাঁর প্রাতিস্বিক গদ্যে প্রকাশ করেছেন এমন কিছু বক্তব্য, যা অভিনব ও অন্তর্গুঢ়; মনোরঞ্জন নয় যার লক্ষ্য পৃথিবীর এক অন্ধকারাবৃত খন্ডের ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি।

আরিফুল হোসাইন তুহিন(Ariful Hossain Tuhin) ক’দিন আগে তার লেখায় শিল্পকলার বিমানবিকরন বইটি নিয়ে লিখেছিলেন,

“শিল্পকলার বিমানবিকরণ” , “The dehumanization of art” এর ভাবানুবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটা সবচেয়ে শক্তিশালী। এ বিষয়ে আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। প্রবন্ধ দুইটি পাশাপাশি পড়লেই বিষয়টি চোখে পরে। হুমায়ন আজাদ কোথাও উল্লেখ করেননি তিনি অনুবাদ করছেন। আগের দুই ক্ষেত্রে তাকে কিছু বেনিফিট অফ ডাউট দেয়া গেলেও, এই ক্ষেত্রে কিছুই ছাড় দেয়া সম্ভব নয়। হুমায়ন আজাদ পশ্চিমের পুজা করতেন। কিন্তু পশ্চিমে এই ধরনের কাজ করলে তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরী চলে যেত।”

শিল্পকলার বিমানবিকরণ নিয়ে অনলাইনে বা অফলাইনে আর কেউ কিছু লিখেছেন বলে আমার চোখে এখনও চোখে পরেনি। আরিফুলের লেখার এই অংশটুকু পুরোপুরি ভুল বলে জানতাম এবং তার সাথে দ্বিমতের জায়গা দেখে ভেবেছিলাম শিল্পকলার বিমানবিকরণ আর অর্তেগা ই গাসেতের বই দুটো নিয়ে একটা পর্ব লিখবো। তবে পরে দেখলাম, আরিফুল তার লেখাটিকে সংশোধন করেছেন। তিনি পরবর্তীতে লিখেছেন,

“শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ আমি পড়েছি হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধের একটি সংকলন থেকে। ওখানে এই ভূমিকাটি আমি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। বাসায় গিয়ে বই খুলে দেখতে হবে। যাই হোক, Ahmed Lipu এর সৌজন্যে শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ এবং অন্যান্য প্রবন্ধ বই থেকে ভূমিকা পাওয়া গেল ......
সুতরাং শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ সম্পর্কে আমি আমার বক্তব্য প্রত্যাহার করলাম। এবং আমার অসতর্কতার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”

আরিফুল হোসাইন তুহিন প্রথমে অসতর্কতার কারণে ঠিকমত চেক না করেই আজাদের এই বইটিকে প্লেইজারাইজড বলে রায় দিয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদের মত লেখকের ক্ষেত্রে এই ধরণের অসতর্কতা নিন্দার যোগ্য। তবে তিনি পরবর্তীতে, ভুমিকায় অনুবাদের কথা লেখা আছে জেনে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করেছেন ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আরিফুলের এই আচরণ অত্যন্ত প্রশংসনীয়, লেখক/মানুষ হিসেবে তিনি সৎ আচরণ করেছেন এক্ষেত্রে। আরিফুল তার লেখায় হুমায়ুন আজাদের নারী ও সেকেন্ড সেক্স বইটি যে চুরি করে লেখা নয় তাও দেখিয়েছেন। তাকে এই কারণেও ধন্যবাদ।

আরিফুল তার মতামত প্রত্যাহার করলেও শিবলি আজাদ গংরা কিন্তু শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ বইটি সম্পর্কে তাদের মতামত প্রত্যাহার করেননি। এ থেকে শিবলিদের ভন্ডামির নমুনা পাওয়া যায়।

লেখক - আহমদ রনি।

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

হিমু এর ছবি

বিমানবিকরন > বিমানবিকীকরণ।

প্রচুর বানান ভুল আছে, একটু কষ্ট করে শুধরে নিন।

অতিথি লেখক এর ছবি

শব্দটা আসলেই “বিমানবিকীকরণ” হবে, এখানে ‘বিমানবিকরণ’ লেখা হয়েছে ভুল করে। শিবলি আর তুহিনের বক্তব্যগুলো কপি পেস্ট। তারা সেখানে ভুল করেছেন বারবার। তাই দেখাদেখি আমি নিজেও ভুল করেছি অন্তত তিন জায়গায়। ক্ষমা চাচ্ছি সেজন্য। :/ পোস্ট করার পরপরই চোখে পরেছে, কিন্তু গেস্ট আইডি হওয়ায় আমি এডিট কর দিতে পারিনি মন খারাপ

এডমিনদেরকে ঠিক করে দিতে অনুরোধ করে রেখেছিলাম সাথে সাথেই, কিন্তু তারা হয়ত সময় পাননি।

-আহমদ রনি।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটার টাইটেলে ও প্রথম বাক্যে একটা বানান ভুল এসেছে। এডমিনকে দয়া করে বানান ভুলটা ঠিক করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।[আইডি না থাকায় আমি এডিট করতে পারিনা যেহেতু]
শব্দটা “বিমানবিকীকরণ” হবে, এখানে ‘বিমানবিকরণ’ লেখা হয়েছে ভুল করে।

অতিথি লেখক এর ছবি

"কুম্ভলকবৃত্তি", "চোর্জবৃত্তি", "বিমানবিকরন" এই তিন ধরণের চরম দৃষ্টিকটু বানান ভুল করেছি দেখে, নিজেই নিজের উপর হতবাক ও বিরক্ত। গেস্ট একাউন্ট বলে এডিট করে ঠিকও করে দিতে পারছিনা। সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। মন খারাপ

সজল এর ছবি

হুমায়ুন আজাদ নিজেই ‘ শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ’কে ভাবানুবাদ বলে যাবার পরও এই বইটি চুরি করে লেখা বই বলাটা শিবলি, ইমতিয়াজ মির্জা গংদের স্রেফ ভন্ডামি।

শিবলি, মীর্জা যদি দাবী করে থাকে তারা আজাদের বইটা পড়েই তার সমালোচনা করেছে, তাহলে এটা ঠিক ভণ্ডামি না, বরং অসততা।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অতিথি লেখক এর ছবি

না পড়েই দাবী করা যায় নাকি?

যদি, তবে, কিন্তুর ব্যবহার করলেন!!
দাবী শিবলি করেছেন, মির্জা সেটা প্রমোট করেছেন। ফেসবুকের বইয়ের পোকা গ্রুপে এখনও তাদের মন্তব্যগুলো ঝুলছে।

মামুন এর ছবি

আপনি এমন ভাবে মির্জা করেছেন মির্জা গিয়েছেন বলতেছেন যেন মির্জাবাড়ির ছোট মির্জার কথা হইতেছে। ইতর নালায়েক ইমতিয়াজ মির্জা আবার বই পড়ে কবে? সারাদিন ফেসবুকে এই গ্রুপে ঐ গ্রুপে শুকরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করিয়াই তার দিন যায়। তার বই পড়ার দৌড় মকসুদুল মমেনিনের বেশী নহে। রাস্তায় তারে খাড়া করাইয়া অর্তেগা ই গাসেত বানান জিজ্ঞাসা করলে সে আটকাই যাবে। এই গান্ধা ছাগুটারে বেশী পাত্তা দিয়েন না।

অতিথি লেখক এর ছবি

হো হো হো

সজল এর ছবি

করা যায় নিশ্চয়ই, এই যে করল হাসি
যদি, তবে ব্যবহার করলাম যদি বলে অমুক বলছে, তমুক বলছে এই জন্য আর কি।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

মন মাঝি এর ছবি

"শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ" প্রবন্ধটা আমি যদ্দুর মনে পড়ে '৮০ দশকের শেষ বা '৯০-এর দশকের শুরুর দিকেই কোন এক সময় পড়েছিলাম। এটা যে অনুবাদ / ভাবানুবাদ - হুমায়ুন আজাদ একথা যে গোঁড়াতেই উল্লেখ করে দিয়েছিলেন - সেটা আমার স্পষ্টই মনে আছে। বিশেষ করেই মনে আছে - কারন এটা আমার খুব প্রিয় একটা প্রবন্ধ ছিল। সুতরাং কেউ যদি এখন বলে যে হুমায়ুন এই স্বীকৃতি বইটার প্রথম দিকের সংস্করণে দেননি, তাহলে সেই ডাহা মিথ্যা কথা বলছে। ধন্যবাদ।

****************************************

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হুমম...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।