নীল মুখ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০২/০৮/২০১৫ - ১২:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আসসালামুয়ালাইকুম, স্যার কেমন আছেন?
এই ছেলে তুমি কে? আমার বাসার ভিতরে কি?
স্যার আমার নাম রশিদ, আমি আপনার পাশের গ্রামের ছেলে।
তো কি হয়েছে? চেনা নেই, জানা নেই এই সরকারি কোয়ার্টারে তোমাকে ঢুকতে দিয়েছে কে?
না মানে স্যার, ইয়ে মানে স্যার, দারোয়ারকে বলেছি আমি আপনার ভাগ্নে হই। তারপরেই ঢুকতে দিলো।
ছুটির দিনে সাত-সকালে আমার বাসায় কি?
আমাদের আশেপাশের সব গ্রামে স্যার আপনাকে এক নামে চেনে। আপনার সুনাম চারদিকে। আদর্শ হিসেবে সবাই শুধু আপনাকেই দেখায়। আমি ছোট ব্যবসায়ী, ঢাকাতে মাঝে মধ্যে আসি। তাই ভাবলাম স্যার, আপনার সাথে একবার দেখা করে যাই। স্যার, বড় বড় মানুষের পায়ের ধূলোও অমূল্য।স্যার অসময়ে এসে আপনাকে বিরক্ত করায় আমি লজ্জিত।
নিজের এতো প্রশংসা শুনে মনে মনে গদগদ হয়ে এতোক্ষনে মান্নান মিয়া কিছুটা নরম হয়েছে। ছোট এই জীবনে রশিদ এই বাস্তবতা খুব ভালো বুঝতে পেরেছে, এসব মানুষদের একবার তেলের উপর ভাসাতে পারলেই কেল্লা ফতে।
আরে এতো স্যার স্যার করছো কেনো? তুমি আমার এলাকার মানুষ। বসো, বসো।
না মানে, স্যার বাড়িতে কেউ নেই?
আমার ছেলে মেয়ে দু’জনই কানাডায় পড়াশোনা করে। আসলে দেশের যা অবস্থা, কোনও আশা নেই এই দেশ নিয়ে।
চাচী কি বাড়িতে আছেন?
নাহ, ও গেছে এক বোনের বাড়িতে। আজ আবার তার এক ভাগ্নির গায়ে হলুদ।
গ্রামে মৌমাছি চাষ করি তাই অল্প খাঁটি মধু এনেছিলাম আপনার জন্য। চায়ের সাথে খেলে অমৃত। ব্যাগ থেকে ছোট বোতলটা বের করে টেবিলের উপর রাখলো।
এসবের আবার কি দরকার ছিলো!!! শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলে। তা এতো ছোট বোতলে নিয়ে আসলে যে!
রশিদ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। সত্যিই বিরাট ভুল হয়ে গেছে। আস্তে করেই বলল, আসলে ভেবেছিলাম খাঁটি মধু তো, যদি আপনার ভালো লাগে তবেই পরে থেকে বড় বোতলে প্রতি মাসে আপনার জন্য পাঠাবো।
আরে ভালো লাগবে মানে বল কি!! দুনিয়ার সব থেকে উৎকৃষ্ট টনিক এই মধু তাও আবার তোমার নিজের চাষ করা। ভালো তো লাগতেই হবে হা হা হা।
স্যার একটু রং চায়ের সাথে খেয়ে দেখেন, মনে হবে দুনিয়ার সব স্বাদ যেনো ঐ রঙ চায়েই। জীবনেও ভুলতে পারবেন না সেই স্বাদ।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলেই ভিতরে রহমতকে বললেন দুই কাপ রঙ চা তারাতারি পাঠিয়ে দিতে।
তা স্যার সরকার তো আপনাদের বেতন প্রায় দ্বিগুন করে দিলো।
আরে ধুর, কিসের দ্বিগুন? মাস শেষে লাখখানেক টাকা দিয়ে কিছু হয় আজকাল? তারমাঝে ছেলেমেয়ে দুটোই দেশের বাইরে পড়াশোনা করছে। দেশেও তো আর ফকিরের মতো থাকা যায় না। তাই না?
অবশ্যই অবশ্যই কিন্তু স্যার আমি তো শুনলাম সচিবদের বেতন নাকি প্রায় দেড় লাখে গিয়ে ঠেকবে।
ঐ একই কথা। লাখ টাকা আর দেড় লাখের তফাৎ তো মাত্র পঞ্চাশ হাজার।
কথাটা শুনেই রশিদের মাথা ভন ভন করতে লাগলো। ও পাঁচ মাসেও পঞ্চাশ হাজার টাকা সঞ্চয় করতে পারে কিনা সন্দেহ আর এখানে এটা কিছুইনা!!!
তা তুমি পড়াশোনা করেছো কত দূর? তোমার বাবার নাম কি? কোন বাড়ির ছেলে তুমি?
এর মাঝেই রহমত চা নিয়ে ঢুকল। টেবিলের উপর চা নামিয়ে রেখে চলে যাবার পর রশিদ নিজেই বোতল থেকে অল্প মধু মিশিয়ে দিলো চায়ের মাঝে। এই অল্প সময়ের মাঝেই রশিদের ভক্তি দেখে মুগ্ধ মান্নান মিয়া। খুব আয়েশ করে তিনি চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর রশিদের চোখে মুখে আশ্চর্য এক তৃপ্তির ঝিলিক খেলা করছে।
এতক্ষণ নিষ্প্রভ হয়ে বসে থাকা রশিদ নিজের পরিচয় বলার সময় এক গর্বিত সন্তানের জ্বলজ্বলে চোখের দীপ্ত কণ্ঠস্বরে স্বকীয়তায় ফিরে এলো...
বেশি দূর পড়তে পারিনি স্যার। তার আগেই আমাদের গ্রামের বাজারে বাবার দোকানে বসতে হলো। আমি সেই মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান যাকে আপনি গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার পর অপমান আর গ্লানি সহ্য করতে না পেরে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে হয়েছিলো। লাল সবুজের এই পতাকাটা নিজেদের জীবন বাজি রেখে ছিনিয়ে এনেছিলো কিছু নরপশুদের গলা ধাক্কা খাওয়ার জন্য নয়। ১৬ ডিসেম্বর,২৬ মার্চের কিংবা বিশেষ কোনও দিবসে টকশো-তে গলার রগ ছিড়ে ভাষণ দেয়ার জন্য আমার বাবা সাত দিনের নব-বিবাহিত স্ত্রী ছেড়ে দেশের জন্য ঝাপিয়ে পড়েনি। আমি সেই বাবার সন্তান, যিনি বাংলাদেশের পতাকাশোভিত রাজাকারের গাড়ি যে রাস্তা দিয়ে যায় সেই রাস্তায় জীবনে পা তো রাখেইনি, চলাফেরা করতেন অন্য রাস্তা দিয়ে।
শুনতে পায় না মান্নান মিয়া । মৃত মানুষ কিছু শুনতে পায় না। মুখটা গাঢ় নীল হয়ে আছে। রশিদের মুক্তিযোদ্ধা বাবার বোতলে রেখে যাওয়া অবশিষ্ট বিষটুকু রশিদ মিশিয়ে দিয়েছিলো মধুতে। কিন্তু বাবার নীল মুখ আর মান্নান মিয়ার নীল মুখ যেন সম্পূর্ণ আলাদা। বিষ এক হলেই কি মানুষ ও পশুর নীল মুখ এক হয়ে যায়?
যায় না।

হাসান রাশেদুজ্জামান


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ভাল লাগল। সচলে স্বাগতম। লিখতে থাকুন। হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সাক্ষী সত্যানন্দ। তবে এই রকম সত্যি ঘটনাগুলো খুব কষ্টদায়ক

হাসান রাশেদুজ্জামান

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটা প্রথমাংশে ভাল লেগেছে। গল্প বলার ভঙ্গি খুব সাবলীল মনে হয়েছে। চরিত্র চিত্রন বা সংলাপ সৃষ্টিতেও পাওয়া যায় সম্ভাবনার ছাপ। তবে শেষাংশ আরও নিখুঁত হতে পারত। আধুনিক গল্পে সবকিছু বলে দিতে হয় না, ভাই, পাঠকদের বোঝার জন্য কিছু ইঙ্গিত রেখে দিতে হয়।

লিখে চলুন, ভাই।
।।।।।।।।
অনিত্র

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার পরামর্শ খুব ভালো লেগেছে, বিশেষ করে কিভাবে শেষ করা যায় এটা সম্পর্কে। এভাবে বলে দিলে আশা করি আগামীতে ভালো হবে আরও।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো হাসি লিখুন আরও। আর একটা অন্য কথা বলি-শেষের দিকে এসে রশিদের কথাগুলো সব বক্তৃতার মতো শোনাচ্ছে না? কথাগুলো তো সাধারণ হওয়ার কথা ছিল, পরেরবার খেয়াল করবেন, তাইলেই হবে হাসি আর প্যারাগুলোও খেয়াল করবেন, কেমন? শুভ কামনা

দেবদ্যুতি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মরণযাত্রী রাজাকারের মুখের ওপর বক্তৃতা দেয়ার মতন আনন্দের আর কি আছে? একবারই তো মরবে। শান্তিতে মরবে ক্যান? হুয়াই??? সাকা মরার আগে কোনভাবে কান আর মস্তিষ্ক বাদে তার সারা দেহ অচল করে রেখে চৌদার এই উগ্র লেখাটা কিংবা, স্বপ্নাহত'র এই দুর্ধর্ষ ছড়াটা যদি ফরমান আলী পড়ে শোনায়, দারুণ হয়! শয়তানী হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ হয় তো বটেই কিন্তুক এই পরিস্থিতিতে রশিদের কি বক্তৃতা দেবার কথা? আমার তো মনে হয় এর চেয়ে ঠা ঠা করে হেসে চারপাশটা সচকিত করে দেয়া সহজ ইয়ে, মানে... তবে চৌদার লেখা আর স্বপ্নাহত’র ছড়া শোনানোর ব্যাপারে দ্বিমত নাই শয়তানী হাসি

দেবদ্যুতি

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব নরম নরম কথা বলা রশিদের আসল বলিষ্ঠ চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতেই এমনভাবে বলতে চেষ্টা করা। আপনার পরামর্শের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

সাক্ষী সত্যানন্দ, আপনার সাথে ১০০ ভাগ একমত। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে সেই লেখাগুলো আমি পড়তে চাই এই হারামিগুলার সামনে।

হাসান রাশেদুজ্জামান

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।