জীবন-টেম্পো

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৬/০৮/২০১৫ - ৯:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পুরান ঢাকায় কিছু টেম্পো চলে, লক্কড়-ঝক্কর মার্কা এই টেম্পোগুলো যখন তীরের বেগে ছুটতে থাকে, যাত্রীদের প্রায়ই মাথা ঠুকাঠুকি লেগে যায়! স্টপেজগুলিতে যাত্রী উঠানামা যেন আর এক বিভীষিকা! টেম্পোর সিট দখলের জন্য চর দখলের মতই যুদ্ধ চলে, চলন্ত রাস্তায় ছিটকেও পড়ে কেউ কেউ! আশ্চর্য হল, এই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায়ই রেফারির দায়িত্ব দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় নয়-দশ বছরের কিছু শিশুকে।

তো এমন শিশু হেল্পার পড়লে টেম্পো যাত্রীদের হয় পোয়াবারো, অনেকে দুচারটা ঝাড়ি দিয়ে কম পয়সা দিয়েই নেমে যেতে পারে, অনেকে আবার পেয়ে যায় চলতি পথে বিনুদুনের সুযোগ, বাচ্চাগুলিকে নিয়ে মেতে উঠে আদিম রসিকতায়।

শিশু হেল্পারকে প্রায়ই দেখা যায় বড়দের মত করে টাকা গুনতে। যাত্রীসংখ্যার সাথে ভাড়ার আনুপাতিক হিসেব না মিললে সে যাত্রী ভদ্রলোকদের কাতর মিনতি জানায় ভাড়াটা দিয়ে দেয়ার জন্য। আর যায় কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় ভদ্রলোকীয় সব গালাগাল! অক্ষর না চিনলেও টাকা পয়সা তো নাড়াচড়া বেশ ভালই শিখে গেছে এই বয়সেই! ইচড়েপাকা বা বে-আদব বা বখাটে শিশু হেল্পারের অবশ্য তখন যাত্রীদের গালাগাল নিয়ে ভাবার সময় নেই, ওস্তাদের ভয়ে বুক লক্কড় ঝক্কর টেম্পোর চেয়েও দ্রুতগতিতে কাঁপতে থাকে! ওস্তাদকে চলতি পথে মাঝে-মধ্যে সিগারেট ধরিয়ে দেয়ার পরও সে ভয় এতটুকু কমে না!

তবে শুধু যাত্রীদের ঠোকাঠুকিই নয়, টেম্পোগুলির মধ্যেও ঠোকাঠুকি লেগে যায়। পেছন থেকে কোন টেম্পো এসে হয়ত টপকে গেল, হয়ত কোন জওয়ান হেল্পারের ক্যারিশমায় অধিক সংখ্যক যাত্রী অন্য আরেক টেম্পোতে উঠে পড়ল, কোন যাত্রী অর্ধেক ভাড়া দিয়েই নেমে পড়তে চাইল, বা, কোন মোটা-সোটা মানুষের জন্য বরাদ্দ সিটসংখ্যা কমে গিয়ে ভাড়া- হৃাস ঘটাল, -- এ সবকিছুরই দায়িত্ব নিতে হয় শিশু হেল্পারকে।

শিশু হেল্পারকে আরও কত যে উত্তর দিতে হয়! গাড়ির সার্ভিস খারাপ কেন, গাড়ি আগে ছাড়ে না কেন, ভাঙতি টাকা চকচকে নয় কেন, ভাঙতি করতে দেরী কেন, ভাড়া এত বেশী কেন, পথের মধ্যিখানে যাত্রী উঠায় কেন, যাত্রী নামার আগেই যাত্রীরা হুড়মুড় করে উঠে কেন ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। এক পর্যায়ে আর উত্তর দিতে না পেরে সে ওস্তাদকে রেফার করতে যায় বটে, তবে তীরের গতিতে ছোটা ওস্তাদের কড়া ধমক খেয়ে মুহুর্তেই ম্রিয়মান হয়ে যায়!

যে বয়সটা ছিল স্কুলে যাওয়ার, সেই সময়েই এমন সংগ্রামী এক একটি দিন পার করতে হয়! এক সময়ে আর না পেরে ঘুমিয়ে পড়ে টেম্পোর দরজাতেই, কিন্তু তাতে কি? শিশু হেল্পারদের মাড়িয়েই যাত্রীদের উঠানামা অব্যাহত থাকে, আর টেম্পোও চলতে থাকে, রাজপথ কাঁপিয়ে-দাপিয়ে!

।।।।।।।।।।।
অনিত্র


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

টেম্পো হেল্পারদের সংখ্যা এই শহরে প্রায় অগণন। শুধু হেল্পারি নয়, মাঝেমাঝে ড্রাইভারের কাজও করতে দেখা যায় এদের। শৈশবটা তো হারিয়ে যায়ই, রাজপথের এ মাথা ও মাথা হাজার যানবাহনের ফোকড় গলিয়ে ডিউটি করতে করতে হারিয়ে যায় বোধহয় বেঁচে থাকার আনন্দ আর মরে যাবার ভয়টুকুও।

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

মূল্যবান মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

শুধু হেল্পারি নয়, মাঝেমাঝে ড্রাইভারের কাজও করতে দেখা যায় এদের।

একদম সত্যি! নারী শ্রমিকদের মত শিশু শ্রমিকদের দিয়েও কম মজুরীতে বেশী কাজ করিয়ে নিতে পারলে মুঠোভর্তি করে মুনাফা আসে! অধিক মুনাফার জন্য খানিক রিস্ক তাই নিয়েই থাকেন টেম্পো-মালিকগণ! সবচেয়ে অবাক হতে হয়, অনেক যাত্রীর এতেও অসুবিধে নেই, কোনমতে গাড়িতে উঠতে পারলেই হল! এই ব্যস্ত পৃথিবীতে কারো সময় নেই, সবাই ছুটছে নিজের কাজে, এই যাত্রাপথে একটি চারাগাছ বড় হয়ে উঠার আগেই আগেই চাপা পড়লে তাতে কারোই কিছু আসে যায় না, তাকে মাড়িয়েই চলতে থাকে জীবন-টেম্পো!

হারিয়ে যায় বোধহয় বেঁচে থাকার আনন্দ আর মরে যাবার ভয়টুকুও।

তখন কি হয় পরিনাম? এভাবেই নিজেদের ধ্বংসের বীজ বপন করে যাচ্ছি আমরা!
।।।।।।।।।
অনিত্র

চরম উদাস এর ছবি

ভালো লাগলো টেম্পো হেল্পার শিশুদের নিয়ে লেখাটা। কতদিন যে এরকম কত হেল্পারকে ধমক বা চড় খেতে দেখেছি।

আয়নামতি এর ছবি

মন খারাপ হবার মতো আরো অনেক কাহিনি পড়তে হবে শিশু সপ্তাহ ভর। আপনার লেখা দিয়েই শুরু করলাম।

এক লহমা এর ছবি

নির্মম চালচিত্র। চলুক
৫ তারায় ৫ তারা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কিশোর পত্রিকা 'টেম্পোর পিচ্চি' নামে নব্বই দশকে একবার একটা প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিল। কারো সংগ্রহে থাকলে সেটা স্ক্যান করে দিতে পারেন। ঐ প্রতিবেদনে প্রতিবেদক বলেছিলেন, তিনি যখন ঐ শিশুদেরকে ছুটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন তখন শিশুগুলো ঠিক উওর দিতে পারেনি। কারণ, ঐ শিশুরা কোনদিন ছুটি পায় না। কয়েকজন অসুস্থতাবশত কাজ কামাই করার কথা বলেছিল। সেটাকেই তারা ছুটি বলে ভেবেছিল। প্রতিদিন গুলিস্থান, মালিবাগ, ফার্মগেট মোড়ে টেম্পোর হেলপার বাচ্চাগুলোকে দেখলে আমার ঐ কথা মনে হয়। এই রাস্তাগুলো দিয়ে যেসব ক্ষমতাবান লোকজন যায় এই বাচ্চাগুলো কখনো তাদের চোখে পড়ে না। অথবা চোখে পড়লেও তাদের জন্য কিছু করার কথা তাদের বোধে আসে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

চরম উদাস ভাই, আয়নাদি, লহমাদা, এবং পান্ডবদাকে ধন্যবাদ পাঠ ও মূল্যবান মন্তব্যের জন্য।

অথবা চোখে পড়লেও তাদের জন্য কিছু করার কথা তাদের বোধে আসে না।

ক্ষমতাবানদের কাছে এরা শুধুই 'ফকিন্নির পুলা'; তাই এই 'ফকিন্নির পুলা'দের জন্য কোন দরদ তো থাকেই না, বরং, উল্টো 'এই হারামিগুলাই আর একটু বড় হইলে চোর-বদমাশদের দলে ভিড়ব' এমন ভাবনাতেই ব্যাকুল থাকে আমাদের তথাকথিত ক্ষমতাবানেরা!
।।।।।।।।।।।।
অনিত্র

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।