ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ঠেকাতে চেয়ে পাল্টা ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি করা আওয়ামী লীগের একটি ঐতিহাসিক ভুল

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০১/১১/২০১৫ - ২:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রগতিশীলদের মধ্যে আমরা যারা সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত নই, বা কখনও মাঠ পর্যায়ের রাজনীতি করিনি তাদেরও কিন্তু একটা রাজনৈতিক চেতনা আছে। এই চেতনা কখনও আওয়ামী লীগের অনেক উদ্যোগকে সমর্থন করে, কখনও বাম উদ্যোগকে সমর্থন করে। আবার এই দুই পক্ষেরই নানা কাজের সমালোচনাও করে। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমাদের সবার মিল এখানে যে, আমরা ধর্মান্ধতা, অন্ধকারের বিরুদ্ধে কথা বলি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও চাই। পার্টিজান অবস্থান না থাকলেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক এই ব্যাপারটা স্পষ্ট।

এই আপাত নিরপেক্ষ অবস্থান থাকার পরও আমরা ২০১৩ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিলাম। কারণ আমরা দেখেছি, জিয়াউর রহমানের অধীনে, গোলাম আজম সহ বিদেশে পলাতক জঙ্গিরা ক্ষমতায় এসে বসেছে। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে আমরা দেখেছি, গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব ফিরে পেতে। তসলিমা নাসরিনকে কেন্দ্র করে মুসলিম জঙ্গিদের সংগঠিত আন্দোলন আমরা দেখেছি। আমরা আরও দেখেছি, যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে দেশদ্রোহী খেতাব দিয়েছিল তৎকালীন বিএনপি। এরপর আমরা ২০০১-০৬ এ মুসলিম জঙ্গিদের উত্থান আরও বড় পরিসরে দেখেছি। জামাতের গর্ভে চলে যাওয়া বিএনপির মদদপুষ্ট হয়েই জঙ্গিদের আস্থাফালন, বোমা হামলা, হত্যাকাণ্ড অনেক কিছুই হয়েছে তখন। সব মিলিয়ে ঝিলিয়ে ২০১৩ সনে আমরা ভেবেছিলাম, শেখ হাসিনা যেহেতু নিজে জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, জাতির পিতা নিজেও যেহেতু ডানপন্থীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন সেহেতু তিনি ও তাঁর দল জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাবেন। অর্থাৎ আমরা ভেবেছিলাম, আওয়ামী লীগ বিএনপির চাইতে অন্তত মন্দের ভালো। আরও ভেবেছিলাম, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা এসব আদর্শ বাদ দিয়ে শুধু গণতন্ত্রের কোনও কার্যকর ভ্যালু নেই। খোদ আওয়ামী লীগেরই অনেক নেতাকর্মীই সন্দিহান ছিলেন ২০১৩ সালের নির্বাচন পার করতে পারবে কিনা, কিন্তু আমরা প্রগতিশীলরা তখন সমর্থন দিয়েছিলাম। অন্যদের কথা জানি না, আমি নিজে এই সাপোর্টের কারণে তখন বামপন্থী বন্ধুদের গালি শুনেছি। আমার কথাবার্তায় নাকি বড্ড আওয়ামী সুর এসে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম, আওয়ামী লীগ একে একে বিএনপির পথই যেন অনুসরণ করল। বিএনপি আমলের মতই আওয়ামী লীগ আমলেও জঙ্গি গ্রেফতারের কিছুদিন পরেই তাদের জামিনে ছেড়ে দেয়া হল, জঙ্গি কৃত হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রচার করা শুরু হল। স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগে ঢোকা শুরু করল জামাতের অসংখ্য লোকজন। ফুলের মালা দিয়ে রীতিমত বরণ করে নেয়া হল জামাতীদের। যে পতন চলছিল গত চল্লিশ বছর ধরে তা যেন আরও ত্বরান্বিত হল।

বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ সোনার বাংলা চেয়েছিলেন, মুসলিম বাংলাস্তান নয়। জাতির পিতা 'আওয়ামী মুসলিম লীগকে' পরিণত করেছিলেন 'আওয়ামী লীগে' আর বর্তমান আওয়ামী লীগ যেন উল্টো দিকে যাবার চেষ্টা করছে। বিএনপির ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্তর আওয়ামী লীগ দেয়ার চেষ্টা করছে ধর্মের সুরেই! আয় দেখি কে কত ধার্মিক হয়ে দেখাতে পারি - কি এক অস্থির প্রতিযোগিতা। শেখ হাসিনা নিজে বললেন, মদীনা সনদ অনুযায়ী দেশ চালানোর কথা ! অথচ আমাদের জাতির পিতা খুব স্পষ্ট করে বলে গিয়েছিলেন, রাজনীতিতে যেন ধর্ম ঢুকতে না পারে। রাজনীতির মাঠে ধর্ম ব্যবহার করে ফায়দা হাসিল করা যাবে না, এইটা স্বাধীনতার মূলমন্ত্রগুলোর একটি। অথচ আওয়ামী লিগাররা উল্টা প্রচার করা শুরু করল, জাতির পিতার পূর্বপুরুষরা নাকি ধর্ম প্রচার করতে আরব থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তা তাঁরা এসে থাকতেই পারেন, কিন্তু এ কথা গর্ব করে প্রচার করা মানে, জাতির পিতাকে নিয়েও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করা। আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে এমন ধর্মীয় উপাদান চাইলে আরও অনেক দেখানো যাবে। ধ্বংসাত্বক কার্যক্রম করার পরেও হেফাজতের বিরুদ্ধে কোনও উদ্যোগ নেয়া হল না, উল্টো আরও বেশি করে মসজিদ-মাদ্রাসা তৈরি শুরু হল সরকারি উদ্যোগে। হেফাজতকে মাদ্রাসার জন্য দেয়া হল বিঘার পর বিঘা সরকারি জমি। এই ভুলগুলো ঐতিহাসিক ভুল। যুদ্ধাপরাধের বিচার করায় আওয়ামী লীগ যেমন প্রশংসার দাবী রাখে তেমনি এই ভুলগুলোর কারণে তীব্র সমালোচনাও শুনতে হবে, অনেক মূল্যও দিতে হবে ভবিষ্যতে।

আমরা চেয়েছিলাম, কয়েক যুগ ধরে বাংলাদেশকে যেভাবে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আবার ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে যাবে। আমাদের আশা পূরণ হয়নি, উল্টো বিএনপি আমলে প্রণীত ৫৭ ধারাকে আরও শক্তিশালী করে আমাদের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। অনুভূতি তো অনেক ক্ষুদ্র ব্যাপার, বাংলাদেশে অন্য ধর্মের লোকদের মেরে ফেললেও বিচার হয়না, মূর্তি ভাঙ্গা আর মন্দির-গীর্জা পোড়ালেও বিচার হয়না। শুধু মুসলমানদের তথাকথিত অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই বিচার করা শুরু হয়। এসব দেখে জঙ্গিরা কিন্তু আস্কারা পেয়েছে। কোথায় হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, তা না। উল্টো আইজিপি মহোদয় আমাদের উপদেশ দিয়েছেন, সীমা লংঘন না করতে। তাই আমরা চুপ করেই ছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাতে তো সমাধান আসেনি। জঙ্গিরা ঠিকই আমাদের ঘরের ভিতর ঢুকে খুন করে যাচ্ছে। জঙ্গিরা এখন আর শুধু নিধার্মিকদের মারে না, তারা বিদেশীদের খুন করে, ভিন্নমতের মুসলমানদেরও খুন করে। আইজিপি মহোদয়ের সাথে কখনো দেখে হলে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা আছে, সীমা লংঘন করার কারণেই কি বিদেশী নাগরিকেরা খুন হয়েছে?

মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কদের একজন ইন্দিরা গান্ধীর প্রয়াণ দিবসকে লেখক-প্রকাশকদের উপরে আঘাত হানার দিনে হিসেবে বেছে নেয়াতে বোঝা যায় এ আঘাত প্রগতিশীলদের উপর আঘাত, এ আঘাত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের উপর আঘাত, এ আঘাত বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের উপর মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের আঘাত। উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর আমরা, অথচ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আজ নাই। "নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যে খেলাটি আমরা খেলে যাই, তার নামই জীবন"- শেষ বেলায় বলে গেলেন নিহত দীপন। দেশটাকে ভালোবেসে এমন অনেকেই তো দিয়ে গেল প্রাণ, মুক্তির মন্দিরের সোপানতলে একে একে আরও অনেক মেধাবী লেখক-ব্লগারের প্রাণই তো হল বলিদান, তবু বিজয়ের গান আমরা আজও গাইতে পারলাম না, সোনার বাংলা আজও গড়ে উঠল না। কবে গড়ে উঠবে তাও জানি না, তবে আপনারা নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু রেখে সোনার বাংলার মুক্তি কোনও দিন আসবে না।

মহাভারতের ঋষি দধীচির কথা মনে আছে আপনাদের? ওই যে, অসুররা স্বর্গ দখল করে ফেলার পর যার দেহের হাড় দিয়ে অস্ত্র বানিয়েছিলেন দেবতারা এবং পুণরায় উদ্ধার করেছিলেন স্বর্গ? আমরা প্রগতিশীলরাও দধীচির মত জীবন দিচ্ছি স্বর্গোদ্ধারের আশায়। আশা করি, এই আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না। অন্ধকারের সাথে, ধর্মান্ধতার সাথে এই লড়াইটা চিরন্তন, আপনারা কেউ হতাশ হবেন না। আমরা মরলে মরব। তবু এই প্রাণের দেশকে বাংলাস্তান হতে দিতে পারিনা আমরা।

বিনীত - আহমদ রনি


মন্তব্য

নিঘাত তিথি এর ছবি

ঠিক এই কথাগুলোই মাথায় ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে বারববার। এই রকম অদ্ভুত স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আওয়ামী লীগ যাদের মনরক্ষা করার কথা ভাবছে তারা তো কোন দিন এমনিতেও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিবে না, কেন তারা তাহলে নিজস্ব সমর্থনটুকুও হারাবে? মানবিক বোধ না হোক, রাজনৈতিক লাভের আশায়ও কি তাদের চোখ খুলতে পারে না? এই ভাবে তো হয় না, এইভাবে আর কত দিন? এনাফ!

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

আলবাব ইয়াফেজ ফাতমী এর ছবি

আমরা যারা মাঠের রাজনীতিতে জড়িত নই কিন্তু আদতে রাজনীতি নিয়ে সোচ্চার এবং চিন্তিত, তাদের সবার বিশ্লেষণই একই দিকে ধাবিত, আর তা হল আওয়ামী লীগ নিজেই নিজের কবর খুড়ছে। কিন্তু মাঠ-ঘাট দাপিয়ে আসা মূলধারার আওয়ামী নেতাদের ভাবনাটা কেন যেন বিপরীত। আর এ প্রসঙ্গ তুললেই তারা বলে, ঘরে বসে রাজনীতি বোঝা যায় না, আমরা মাঠে থাকি, আমরা জানি কখন কোথায় কি করতে হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

কেবলই হতাশ হয়ে পড়ছি।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

আওয়ামী লীগ অনেকগুলো দোকান খুলে রাখছে। প্রতিক্রিয়ার জয়গান পূর্ণভাবে ঘোষিত হলে, পুরো দল সেই রাজনীতিতে মিশে যেতে পারবে- ওলামা লীগের হাত ধরে বা হেফাজতকে দেয়া দান বা সুবিধার পথ ধরে। উদারনৈতিক কাঠামোতে সে নিজে তার ইতিহাস তুলে ধরে টিকে যাবে। আর বামধারা জেগে উঠলে (যদিও এ এক দূর কল্পনা) আত্মীকৃত বামদের নিয়েই সে ভেলায় ভাসতে পারবে। তাই তার আর চিন্তা কী। বরং ক্ষমতা উপভোগ করা যাক.....

আওয়ামী বা আর কারো দিকে তাকিয়ে থেকেই প্রগতিশীলরা বাঁচবে না....নিজেদের নিরাপত্তার দায় নিজেদের নিতে হবে...এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেই কেবল বেঁচে থাকা বা চিন্তার বিস্তার ঘটানো সম্ভব।

স্বয়ম

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এই লেখাটার শিরোনামের বাক্যটা মনের মধ্যে ঘুরছে অনেক দিন ধরে।

আহা রুবন এর ছবি

আওয়ামীলীগের এসব কর্মকাণ্ডে আমরা হতাশ হই,ক্ষুব্ধ হই,পুরো সময় সমালোচনা করি।মুখে দু-একবার বলিও সময় আসুক বুঝিয়ে দেব। কিন্তু আমরা যারা প্রগতীর কথা,মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি,তাদের এমনই দূর্ভাগ্য, শেষ পর‌্যন্ত আওয়ামীলীগকে-ই বেছে নেয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।