মেট্রোরেল ইস্যুঃ যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যর্থ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৫/০১/২০১৬ - ৯:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর দিয়ে মেট্রোরেল যাবে কি না কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রোরেলের স্টেশন হবে কি না সেটার পক্ষে-বিপক্ষে নানা বিতর্ক চোখে পড়ল। যেহেতু আমি সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই, আমার পক্ষে ব্যক্তিগত মতামত জানানো ছাড়া আর কিছু বলার অধিকার নেই বলেই আমি মনে করি। আমি যেটা করতে পারি দুই পক্ষের অভিমত নিয়ে আমি একটা পক্ষ নিতে পারি শুধু। এছাড়া মেট্রোরেল ইস্যু নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের এইসব আলোচনায় একটি বড় পয়েন্ট মিসিং (missing) বলে মনে হয়েছে। সেটি নিয়ে আলোচনা করাটাই এ লেখার উদ্দেশ্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সে চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেট যতটুকু না বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের নীতির পরিবর্তনের কারণে হয়েছে তার চাইতে হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। সবসময় আবাসন সংকট তৈরী করে রাখলে সেটার সুফল ক্ষমতাসীন দলের ভাগে যায় যেটি সর্বজনবিদিত। সম্প্রতি বেশ কিছু হল খোলা হয়েছে যেটি বেশ ভাল উদ্যোগ। কিন্তু এর মাঝে আমরা যেটি ভুলে যাই সেটি হচ্ছে একটি নতুন হল তৈরী করা বেশ কয়েক বছরের উদ্যোগ। সেটি যখন হতে থাকে, তখন কিন্তু বর্তমান ছাত্রদের সমস্যা সমাধান হয়ে যায় না। তাদের ভোগান্তি রয়েই যায়। আমি যখন ক্লাস শুরু করি তখন আমার হলে ১০তলা একটি ভবনের কাজ শুরু হয়, ১৬ জনের রুমে থাকা অবস্থায় আশা ছিল খুব দ্রুত ভবনের কাজ শেষ হয়ে গেলে আবাসন পেয়ে যাব। সেই ভবনের কাজ যখন শেষ হয় তখন আমি ব্যাচেলরের রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছি। এমনটি হয় অনেক ছাত্রের ক্ষেত্রেই। প্রতিটি বিভাগেই প্রতিবছর মেধাবী কিছু ছাত্র পাওয়া যায়, মেরিট লিস্ট করলে তেমনটি পাওয়া স্বাভাবিকও। কিন্তু বাস্তবতা বলে প্রতি বিভাগের, প্রতি ব্যাচের ছাত্রদের বড় অংশ এই সমস্যার ভুক্তভোগী। এখন এসব আবাসন সংকটের ভুক্তভুগী যারা তারা সংখ্যায় অনেক হলেও তারা কিভাবে ভোগে সেটা কোন আলোচনায় আসে না, তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবাই এগুলো নিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি মেট্রোরেল হলে ছাত্ররা কিভাবে লাভবান হবে সেটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের উদ্যোগে একটি বিস্তারিত স্টাডি (study) হওয়া প্রয়োজন। সেটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শুধু নয়, ছাত্রদেরও বুঝতে সাহায্য করবে মেট্রোরেলের স্টেশন কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ।


ছবিঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন হল বিজয় ৭১ (সূত্রঃ বিজয় ৭১)

এখন প্রশ্ন হল মেট্রোরেলের আলোচনায় এসব কথা আসছে কেন? এখন চেষ্টা করব এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে। আমার দেখা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটু ব্যতিক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। ৩৩টি (জানুয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে দেশের রাজধানীর মাঝখানে থাকা একটি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একাডেমিক চরিত্রের চাইতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক চরিত্রটির ভূমিকা বরাবরই বেশী। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সব ক্ষেত্রেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে কোন আলোচনা, প্রশংসার শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ভূমিকা দিয়েই। সেটি গর্বেরও বিষয়, কিন্তু লক্ষ করুন পাঠক আজকে ২০১৬ সাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে, যোগ বিয়োগের হিসাব বলে সেটি ৪৪ বছরেরও বেশী। যদি গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শুরু সময় ১৯৯১ সাল থেকে হিসেব করি তাহলেও সেটি গুণে গুণে সেটি ২৫ বছর। এখন খেয়াল করুন পাঠক, দিন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়টুকু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হিসেব না করে যদি আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হবার সময় থেকেও হিসেব করি, এই ২৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক চরিত্রের কোন উন্নতি হয়েছে কি? দেশের সেরা ইন্টার ডিসিপ্লিনারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে আমরা যেমন সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানী প্রত্যাশা করি তা পেয়েছি কি? আমি বলব পাই নি। ওয়াকিবহাল যে কেউই বোধ করি আমার সাথে একমত হবেন। বুদ্ধিজীবি নিধনের ফল হিসেবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একটি শূণ্যস্থান তৈরী হয়েছিল, কিন্তু এই দীর্ঘ ৪৪ বছরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সেই শূণ্যস্থান পূরণ করার মত স্কলার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকায় দেখেছি অজপাড়াগাঁয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কি দূর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে, সেখান রাজধানীর মাঝখানে থেকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটাই নিস্প্রভ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে থেকে গর্বিত বোধ করা স্বাভাবিক, কিন্তু বিশ্বের আর দশটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতটুকু পিছিয়ে সেটা রীতিমত ভয়ের ব্যাপার।

এখন প্রশ্ন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন এই দীর্ঘ সময়েও বুদ্ধিজীবি নিধনের কারণে তৈরী হওয়া শূণ্যস্থান পূরণ করতে পারে নি? আমার ব্যক্তিগত মত হল সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক চরিত্রকে ব্যবহার করার কারণে। যেটি করেছে দেশের রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন হয়ে ছাত্ররা পর্যন্ত সবাই। দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলেরই শীর্ষ স্থানীয় নেতৃত্বের ধারণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখে মানে পুরো দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীলতা কিভাবে সারা দেশকে প্রভাবিত করে সেটি বুঝতে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠে সেনা সদস্যের করা দূর্ব্যবহারের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দেখলেই সেটির সত্যতা বোঝা যায়। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সঙ্কট তৈরী করে, শিক্ষকদের মাঝে দলাদলি সৃষ্টি করে একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘদিন ধরে পঙ্গু বানিয়ে রেখেছে। সবচাইতে দুঃখের কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এই দলগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে সেটি হতে দিয়েছেন। আমি বলব রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তাঁরাও সমান অপরাধী। একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে এভাবে পঙ্গু বানানোর দায় থেকে তারা কোনভাবেই মুক্ত নন। কিভাবে পঙ্গু বানিয়ে রাখা হয়েছে সেটি একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের বেশিরভাগ বিভাগের একাডেমিক কার্যক্রম চলে "ইয়ার" (বছরে একবার পরীক্ষা) সিস্টেমে। যতদূর জানি হাতে গোণা দুয়েকটি বিভাগ ছাড়া কোন বিভাগ এখনো সেমিস্টার পদ্ধতিতেই যেতে পারে নি। ২০১৬ সালে এসে এই ব্যর্থতার দায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নিতে রাজি আছেন কি?

দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় - এ দাবীর দাবীদার হয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত যেকোন আলোচনায় একাডমিক কোন সাফল্যের বর্ণনা আজও আমি শুনিনি (এখানে বলে রাখি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহনে করা কোন প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্রের প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়াকে আমি একাডমিক সাফল্য বলি না, বলি গবেষণা এবং পাবলিকেশনকে)। বরঞ্চ সব আলোচনায় আমরা শুনেছি দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অবদানের কথা। যদি ধরে নেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বুদ্ধিজীবি শূণ্যতার কারণে সম্ভব হয় নি, তাহলেও যেখানে ২৫ বছর ধরে দেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চলছে সেখানে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একাডেমিক সাফল্য নেই? সদিচ্ছা থাকলে স্বল্পতম সময়ে কিভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে নিয়ে আসা যায় সেটির উদাহরণ চাইলে এই লিংকটি দেখা যেতে পারে।

এর একটি বড় কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যতটুকু রাজনৈতিক সচেতনতা রয়েছে, ততটুকু একাডেমিক সচেতনতা নেই। রাজনৈতিক চরিত্রের ধুম্রজালের আড়ালে যে একাডেমিক চরিত্রটি হারিয়ে যাচ্ছে এই বোধটি কারোরই নেই এবং আসছেও না। আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতা দেশের অন্যান্য যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চাইতে বেশী এবং সেটি প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে বুঝতে হবে সেটি কিছুতেই একাডেমিক ব্যর্থতা ঢাকার জন্য কোন অযুহাত নয়। প্রশ্ন আসতে পারে এ ব্যর্থতা থেকে বের হয়ে আসার উদ্যোগ নেবার কথা সরকারের। সরকার সাহায্য না করতে চাইলে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেরই। সেটিও না হলে শেষে করতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিজেদেরকেই। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিতে পারে তারা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিবর্তনের ধারায় নিতে পারবে না? গণতন্ত্র একটি প্রক্রিয়া, আমাদের দেশ সে প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে তার নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছে। এই প্রক্রিয়ায় আগামী ২০ বছর চলার পরে যখন দেশের মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে রাজধানীর মাঝখানে থাকা একটি নিচু মানের বিশ্ববিদ্যালয় দেখবে তখন কি "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের স্বাধীন দেশ দিয়েছে"- এই বলে পার পাওয়া যাবে? মনে হয় না। এখনই সময় নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নতুন চোখে তাকানোর। কেননা সেই দিন বেশি দূরে নেই যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সেটা করতে চাইলে মেট্রোরেলকে নতুন চোখে দেখতে হবে।

এখন মেট্রোরেল নিয়ে ব্যক্তিগত মতামতটুকু জানিয়ে নাই। আমি চাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর দিয়ে মেট্রোরেল যাক। শুধু তাই না আমি চাই ক্যাম্পাসের খুবই সুবিধাজনক একটা জায়গায় স্টেশন হোক যেন একজন ছাত্র মেট্রোরেলের ভাড়া বাদে আর কোন খরচ ছাড়া নিজের ক্লাসরুমে যেতে পারে। শুধু তাই নয় যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মেট্রোরেলের সময়ের সাথে মিলিয়ে সার্কুলেটিং বাস শিডিউল করে যেন একজন ছাত্রের পক্ষে ভাড়া বাদে আর কোন খরচ না করে ক্যাম্পাসের যেখানেই তার বিভাগ বা ক্লাস হোক না কেন সে পৌছাতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমি কেন সেটা চাই? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তণ ছাত্র হিসেবে এর উত্তর দেব দুটি উদাহরণ দিয়ে।

প্রথম উদাহরণ দেব আমাদের ক্লাসের মাহমুদকে দিয়ে যার বাসা ঢাকার গাজীপুর। তাকে আমাদের ব্যাচেলর এবং মাস্টার্সের পুরোটা সময়েই তাকে গাজীপুর থেকে ক্লাস করতে হয়েছে। সকাল নয়টার ক্লাস করতে মাহমুদকে পুরোটা সময়েই ৭টার বাসে করে ক্যাম্পাসে করে আসতে হয়েছে। মেট্রোরেল চালু হলে এবং ক্যাম্পাসে একটি স্টেশন থাকলে ধারণা করি ৮:৩০ এর ট্রেনে করেই ক্লাসে আসতে পারত মাহমুদ। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ কিংবা মানিকগঞ্জ থেকে আসা এমন মাহমুদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয় এবং মেট্রোরেল তাদের জন্য ভাল খবর হবে সে ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী।

দ্বিতীয় উদাহরণটা হল আমি নিজে। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ব্যাচেলর শুরু করি তখন আবাসন সঙ্কট প্রকট। আবাসন সঙ্কটের কারণটি রাজনৈতিক। আবাসন সঙ্কটের কারণে আমার ব্যাচেলরের প্রথম দুই বছর কেটেছে একটি ছোট রুমে ১৬ জনের সাথে থেকে। ব্যাপারটা এমন নয় যে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকার মত আর্থিক সামর্থ্য আমার ছিল না, তারপরেও যেসব কারণে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা সম্ভব হয়নি তার মাঝে অন্যতম কারণ ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা। ক্যাম্পাস থেকে একটু দূরে থাকলেও ক্যাম্পাসে যাতায়াত করার ব্যাপারটি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যায়। একই কথা ক্যাম্পাসের অনেক ছাত্রের ক্ষেত্রেই থাকে। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে আর্থিক সামর্থ্য ছিল বলে আমি না হয় বাইরে থাকলাম, যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তাদের কি হবে? এক্ষেত্রে আমি মনে করি সামর্থ্যবান ছাত্ররা যদি গণপরিবহন ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ক্যাম্পাসে থাকতে বাধ্য না হয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে পারে, তাহলে হলে আবাসনপ্রত্যাশীদের ভীড় কমবে। এর ফলে যাদের সামর্থ্য নেই তাদের জন্য দিনশেষে এটি ভাল ছাড়া খারাপ হবে না। মোটকথা মেট্রোরেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটু নতুন এবং চমৎকার শুরু দিতে পারে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেটি ব্যবহার করতে পারে। মোটকথা মেট্রোরেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আবাসন সমস্যার মত অনেক বড় একটি ওভারহেড (overhead) সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর চাইতে একাডেমিক চরিত্রটিকে উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে। ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবার চাইতে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি সেন্টার অফ এক্সেলেন্স হিসেবে গড়ে তোলা অনেক, অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।


ছবির সূত্রঃ এই অবস্থা প্রায় সব হলেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মেট্রোরেল স্টেশনের বিপক্ষ নিয়ে যেসব যুক্তি চোখে পড়েছে তার বেশিরভাগই দূর্বল বলে মনে হয়েছে। যেমন ধরা যাক ক্যাম্পাসে ভীড়ের ব্যাপারটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাত্রই স্বীকার করবেন বিকালের পরে টিএসসিতে যে ভীড় হয় তার বড় অংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তণ ছাত্র। আইনত তাদের এই সময়ে ক্যাম্পাসে থাকার কোন অধিকার নেই। সেটি কি অবাঞ্চিত ভীড় নয়? শুধু টিএসসি নয় পুরো ক্যাম্পাসেই বহিরাগত মানুষের আনাগোনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক প্রান্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ। বহিরাগতদের আনাগোনা বন্ধ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কি ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসা রোগীদের আসা যাওয়া বন্ধ করতে চান? মেট্রোরেল নিয়ে আপত্তি তোলবার আগে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা জরুরী। দ্বিতীয়ত কম্পন (vibration) কিংবা শব্দ দূষণ নিয়ে যে আপত্তি সেটি মোটেই মেট্রো রেল বন্ধ করবার মত শক্ত কোন যুক্তি নয়। এগুলো একান্তই প্রকৌশলগত সমস্যা (engineering problem)। এ নিয়ে আপত্তি থাকলে ছাত্রদের উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করা যেন তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সেগুলো সমাধান করে। সোজা কথা প্রতিটা সমস্যা বা আপত্তিই সমাধানযোগ্য । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই কাজল আবদুল্লাহ'র লেখা একটি নোটে পড়লাম তিনি সংশয় প্রকাশ করেছেন মেট্রোরেল হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব হুমকির মাঝে পড়বে। মূলত আমার পুরো লেখাটিই তার এই সংশয়ের উত্তর, তারপরেও সংক্ষেপে বলতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব তার জায়গার উপর নির্ভর করে না। করলে আয়তন ৬৪০ একর থেকে কমে ২৫৪ একরে নেমে আসার পরে (সূত্র: আয়তন কমছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের) তার রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অস্তিত্বও সেভাবে কমে যেত, সেটি কমে নি। বরং সময়ের সাথে বেড়েছে। পহেলা বৈশাখে ক্যাম্পাসে মানুষের সমাগম তার বড় প্রমাণ। আরো স্পষ্ট করে বললে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন জাদুঘর নয়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানচর্চার জায়গা, আর জ্ঞান নিয়ত পরিবর্তনশীল। সেই জ্ঞানকে ধারণ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেকেও পরিবর্তনশীল হওয়া জরুরী। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি মেট্রোরেলের স্টেশন স্থাপনের পরিবর্তনকে ঔন (own) না করতে পারে তাহলে নিয়ত পরিবর্তনশীল জ্ঞানচর্চার স্থান হিসেবে টিকে থাকবে কিভাবে? নাকি এখন জ্ঞানচর্চা হয় না বলে সেটি ভবিষ্যৎ এও করতে চান না?

যে কোন ভুল বা ব্যর্থতা সংশোধনের প্রথম ধাপ সেটি স্বীকার করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক ক্ষেত্রে একটি ব্যর্থতা - সেটি স্বীকার করা এই ভুল বা ব্যর্থতা সংশোধনের প্রথম ধাপ। যেকোন নতুন উদ্যোগ সেটি মেট্রোরেল হোক কিংবা অন্যকিছু, সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক চরিত্রটিকে উন্নত করবে কি না সেই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। মেট্রোরেল কতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকারে আসবে সেটি বোঝা খুব কঠিন নয়। এজন্য রাজনৈতিক চরিত্রের দায়বদ্ধতা থেকে বেরিয়ে একাডমিক দায়বদ্ধতাটুকু বোঝাই যথেষ্ট। যেখানে মেট্রোরেল সবদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকারে আসছে সেখানে কম্পন, শব্দ দূষণ, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষা খুবই গৌণ এবং সমাধানযোগ্য সমস্যা। সেজন্য শুধুমাত্র সদিচ্ছাটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সেটি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি সে পরিবর্তনটিকে না করতে পারে তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সময়ের সাথে পিছিয়েই যাবে আর নিজের ব্যর্থতার তালিকাটিকে লম্বাই করবে শুধু, আর কিছু নয়।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ বেশ কিছু শব্দের যুতসই বাংলা শব্দ না পাওয়ায় ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করেছি। দৃষ্টিকটু এই মিশ্রণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

দূরের বাতিঘর
২৪ জানুয়ারি, ২০১৬


মন্তব্য

শেহাব এর ছবি

ভাল লেগেছে।

সোহেল ইমাম এর ছবি

ভালো বলেছেন। একাডেমিক দিকটার দিকে যে আরো বেশি করে নজর দেওয়াটা জরুরী এটা মনে হয় দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যতো বটেই দেশের সার্বিক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যও একান্ত জরুরী।

স্পর্শ এর ছবি

মেট্রোরেল প্রসঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরই অবতারণা করেছেন আপনি লেখাটিতে।
আপনার সবগুলো পয়েন্টেই সহমত।
মজার ব্যাপার হলো মেট্রো রেলের পক্ষে যেসব শিক্ষার্থিকে ডেমন্সট্রেশন করতে দেখলাম তারাও সম্ভবত ওয়াকিবহাল না যে এটা হলে কতটা উপকার হবে। তাদের লিফলেট-ব্যানার এর বক্তব্য আরও সিলি। এ সময় আপনার এই লেখাটি পথ প্রদর্শক হিসাবে কাজ করবে।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অনুসন্ধিৎসু এর ছবি

ঢাবি এর একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আপনার লেখার সাথে পূর্ণ সহমত জ্ঞাপন করছি ।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখার জন্য ধন্যবাদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আকারে খুবই বড়। এ কথা কোন গবেষণা না করেই বলা যায় এত বড় পরিবারের সবাই কোন বিষয়েই শতভাগ এক মত হতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে যত অনুকুল সিদ্ধান্তই নেয়া হোক না কেন, কেউ না কেউ তার বিরোধিতা করবেই। তবে মেট্রোরেলে বিরোধিতাটিকে আমার কাছে একটি পলিটিকালি মটিভেটেড বিরোধিতা মনে হয়েছে। বিশেষত এর সপক্ষে দেখানো যুক্তিগুলো দেখে যে কারোই তাই মনে হতে পারে।
আজকে যদি মেট্রোরেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে নেবার প্ল্যান না করে অন্য কোথাও দিয়ে নেবার প্ল্যান করা হ’ত, আমি নিশ্চিত যে তার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব বড় মাত্রার আন্দোলন হত। প্রমান স্বরূপ, আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম সে সময়ের একটি ঘটনার কথা বলতে পারি। তখন ৬ নম্বর বাস সহ সকল বাস মিনিবাস শাহবাগ থেকে টিএসসি আর দোয়েল চত্বর হয়ে মতিঝিল ও অন্যান্য গন্তব্যে যেত। টিএসসি-তে বাসগুলোর একটি স্পপেজ ছিল। টিএসসি স্টপেজে ছাত্রদের সাথে বাস হেল্পার ও ড্রাইভারের কি এক গন্ডগোলের রেশ ধরে বাসগুলো টিএসসিতে থামা বন্ধ করে দেয়। সে নিয়ে সেই সময় ছাত্রদের টিএসসিতে বাস থামানোর দাবীতে আন্দোলন করতে দেখেছি। আমি নিজেও সে আন্দোলনে শরীক হয়েছি।
তাই বলবো, মাথাব্যাথা সাড়ানোর পন্থা হিসেবে মাথা কেটে ফেলার মত হঠকারী দাবী না তুলে মাথা টিকিয়ে রাখার (বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে মেট্রোরেল নেবার) ব্যবস্থা নিন আর মাথা ব্যাথা (মেট্রোরেল যাবার ফলে উদিতব্য অসুবিধাগুলো) সাড়ানোর জন্য কার্যকরী প্রতিরোধক ও প্রতিশেধকের ব্যবস্থা করার দাবী তুলুন। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিক করতে হলে একে মেট্রোরেলের মত আধুনিক প্রযুক্তির নেটওয়ার্কের বাইরে রেখে তা করা সম্ভব নয়।

- পামাআলে

মুকুল রানা  এর ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি কত সালে পড়েছেন? মানে আমি জানতে চাচ্ছি কত সালে টিএসসি হয়ে বাস চলাচল করত? আরেকটা প্রশ্ন, কত সালে এটা বন্ধ হয়েছে?
শুধুই জিজ্ঞাসা।

মোখলেছুর রহমান সজল  এর ছবি

অনেক ভালো লেগেছে। ব্লগে জুড়ে দেয়া লিঙ্ক-এ গিয়েও পুরোটা পড়লাম। আশা জাগানিয়া দৃষ্টান্ত।
মেট্রোরেল প্রসঙ্গে আপনার মতামত আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও সৌন্দর্য্য যেন নষ্ট না হয় সেই বিষয়েও কর্তৃপক্ষের সুনজর থাকা প্রয়োজন।

হিমু এর ছবি

সচলায়তনে আরো লিখুন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।