আমার বিষন্নতার পঙক্তিমালা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৪/০৩/২০১৬ - ৫:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি রান্না ভালোবাসি। দুধরনের মানুষের মাঝে আমি সে ধরনের যারা শুধুই বেচে থাকার জন্য রান্না করে না। ক্লান্তিকর দিনের শেষে গান চালিয়ে জৈবিক তাড়না নিবৃত্তির লক্ষ্যে যে শুধু চুলোয় কিছু চাপিয়ে দেয়া সেরকম নয়। রান্না একটি শিল্পচর্চা, নৈপুণ্য আর বিজ্ঞানের এক সমন্বয় হিসেবেই বেছে নিয়েছি একে। ক্রোধ আর হতাশা গুলোকে ধারালো ছুরি দিয়ে ফালি ফালি করে কেটে সেখানে কষ্টগুলোকে মিশিয়ে হৃদয়ের উষ্ণতায় তৈরী করি আমার কাঙ্খিত রসনা। আমি রান্না ভালোবাসি, কারন এটা আমার অশান্ত মনকে নিস্তব্ধ করে দেয় কোন অহমিকা ছাড়াই। কিন্তু আজ কোন গান শোনার নেই, জৈবিক তাড়না নিবৃত্তির অভিযোগ নেই দেহের ভেতর থেকে। বহুদুরের চাঁদকে খুব ঘোলাটে আর কাছের মনে হচ্ছে, যেন ডুবে আছে সে অতলান্তিকের গভীর জলে। হয়তোবা শুধুই দৃষ্টি বিভ্রম, জলের উৎস অতলান্তিক নয়।

তার সাথে কোথায় কিভাবে কখন দেখা হল সেগুলো না হয় স্মৃতির পাতাতেই আটকে থাক। পূর্বের সব জাগতিক কাজ গুলো রুপান্তর হয়ে ওঠে শুধুই স্মৃতিতে। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে যখন তাকে আবিষ্কারের নেশায় মত্ত হয়ে উঠি তখন আমার হাতে ধরে রাখা বই গুলো খসে খসে পড়ছে, ইউভাল, সক্রেটিস, আর্মস্ট্রং, ফ্রয়েড আর কাছে টানে না। তার মাঝে এক আমাকে আবিষ্কার করে বসি, যেখানে প্রবেশাধিকার শুধু আমার জন্যই সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়। ভূলে যাই আমার রাশ টেনে ধরা স্বর্ণ শেকলের কথা, ওগুলোর অস্তিত্ত্ব আমাকে ব্যাথিত করে তোলে। ভালোই তো ছিলাম আমি তার আগে, আমার বহুরাঙা জীবন নিয়ে। যে জীবনের প্রতিটি মূহুর্তকে আমি একটি পরিতৃপ্তির খাঁজে আটকে রাখতে চেয়েছি; আমার গবেষণা, বিজ্ঞানচর্চা, দর্শনপাঠ আর সেই ইতালিয়ান তরুনীটির কাছ থেকে পাওয়া গুঢ় অধ্যাত্মরহস্যের অবধারনা নিয়ে। কখনও মনে হয়নি একটি মানবী আমাকে আর দুর্বল করে ফেলতে পারবে যখন আমি এই মহাবিশ্বের শাশ্বত জ্ঞানচর্চায় বুঁদ হয়ে আছি। সেটি আমি আরেক জীবনে পার করে এসেছি। আমাদের জীবন আরেকটি রহস্যপূর্ণ আধাঁর। আমাদের জীবনের কতটুকু অংশ আমাদের নিজেদের জন্য? অপরের জন্য জীবন আমাদের, এখানে আমাদের ইচ্ছে নির্ধারণ করে দেয় অন্য কেউ। কিন্তু জীবন নিয়ে ভেবে কি হবে, আর এই ভাবনার কি শেষ আছে কোথাও? সহস্রাধিক বছর এই সামাজিক বিবর্তন আমাদের সভ্য করেছে, সংস্কৃতি দিয়েছে, দিয়েছে ধর্ম, আর কিছু নীতিমালা। আমি এগুলোর কদর বুঝি। সমাজ ও সংস্কৃতি না থাকলে আজ সেই অপেরা গানটি শুনতে শুনতে মোহাবিষ্ট হয়ে কি-বোর্ডে হাত চালিয়ে লিখতে পারতাম না আজ রাতের সবথেকে বিষাদগ্রস্থ পংক্তি। মানবজাতী যেদিন থেকে অজ্ঞানতার মুক্তি পেল বোধকরি সেদিন থেকেই তাদের জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন তাদের জর্জরিত করেছে, আমি কোথা থেকে এলাম আর আমার করনীয়ই বা কি এখানে? কিন্তু এই প্রশ্নগুলো নিয়ে শুধু বসে থাকলে মানবজাতীর সভ্যতার বিকাশ ঘটতো না। হতোনা সমাজের সৃষ্টি, যা আমাদের এখন নির্ধারণ করে দেয় ভালো ও মন্দের ভেদরেখা। মানুষের প্রধানতম সংগ্রাম ছিলো বেঁচে থাকার লড়াই, বংশগতি রক্ষা করা। আদিম কালে পুরুষের দায়িত্ব ছিলো তাদের ভালোবাসার মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া, শিকারের মাধ্যমে খাদ্যের আর ভাল্লুকের হাত থেকে বাসস্থানের নিরাপত্তা। বিনিময়ে মেয়েটির দায়িত্ব ছিলো বংশরক্ষার প্রতিশ্রুতি। প্রতিষ্ঠিত হলো সমাজ, অলীক অনুশাসন। সমাজ কি খুব বেশী পরিবর্তিত হয়েছে এই শত-হাজার বছর আগের পটভূমির তুলনায়? কিন্তু কি লাভ হবে এসব ভেবে, কার জন্যই বা ভাববো এসব, নিজের জন্য? যেখানে নিজের জীবনকেই পরিচালিত করে চলেছি অন্ধের মত কতিপয় মানবসৃষ্ট কাল্পনিক সমাজদর্শনের শাসন মেনে চলে, সেখানে আমার এই বিচ্ছিন্ন ভাবনা কতটুকুই বা প্রভাব ফেলবে এই মহাবিশ্বে? আমি, আমার আত্মবাদী আমিকে নিঃশেষ করে দেব, যেমনটি তেজষ্ক্রিয় মৌলটি উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে প্রতিটি কণা বিলীন হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।

বলছিলাম তার কথা, তার প্রতি এই দুর্ণিবার আকর্ষনের উৎস যেন এই পরিচিত জগতে নয়। একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত অন্ধকার অতিভর তারকার অভ্যন্তরে এর জন্ম, যেখানে সময় থেমে থাকে। নর-নারীর এই আকর্ষণ দৈহিক আর মনঃস্তত্ত্বিক কামনার সুতোর পরতে পরতে বুনানো একটি চাদর, ঠিক যেমনটি আমাদের এই মহাবিশ্ব স্থান ও কালের। তার প্রতি এই বিমোহিতার কারন শুধুই দৈহিক কামনা নয়, জাগতিক সকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঝঞ্ঝাট থেকে মনঃস্তত্ত্বিক মুক্তি। এই আকর্ষন ধারণাতীত, এই আকর্ষন শুধু শারীরিক পরিসরেই আবদ্ধ নয়, এই আকর্ষন আধ্যাতিকতার মোড়কে পূর্ণ একটি অভিলাষ। নিজেকে আবিষ্কার করার পথ চলায় টের পেয়েছি আমার চারপাশের জগতটিকে উপলব্ধি করা সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ। আত্মপ্রসাদের জন্য খুব বেশী কিছুর প্রয়োজন নেই। পেঁজা তুলোর মতন আকাশ থেকে ভেসে আশা তুষার কণা, কফিশপের কাঁচের জানালায় লেগে থাকা বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় গড়িয়ে পড়া দুফোটা জল, ফাল্গুনের বিষন্ন রবিবারে মৃদু সমীরনে খসে যাওয়া সেই চেরীফুল অথবা তার কথা ভেবে রাতের আকাশের নিহারীকার দিকে তাকিয়ে থাকা। এর চেয়ে বেশী কি-ই বা আর প্রয়োজন সুখি থাকার জন্য?

আমার অধীনতার এই জীবনে আমি তাকে কি করে প্রবেশ করাই? সে কি জানে আমি একজন শুধুই কল্পনাবিলাসী মাত্র, আশাহীনতা আর শূন্যবাদ আমার সবথেকে বড় বন্ধু। আমি আবেগগ্রস্থ, কিন্তু আমার সেই আবেগকে জোড় করে ধরে খাঁচায় বন্দি করে রাখতে হয় আমাকে, আমার জীবনটি যে আমার নয়। তাকে কি আমি ভালোবাসি সেটা অহেতুক প্রশ্ন। তাকে আমি ভালোবাসি আমার প্রিয় কবির সেই কবিতাটির মতন। তাকে তারকারাজি বা রক্তরাঙা গোলাপের সাথে তুলনা করা বাতুলতা, তাকে ভালোবাসি আমার জীবনের গোপন অধ্যায় গুলোর মতন। তাকে ভালোবাসি সেই না দেখা কৃষ্ণ গহবরের মত, সেই অকালসুর্য্যস্পর্শা কিশোরীর দেখা সুর্যালোকের মতন। তাকে ভালোবাসি আমার স্বপ্নগুলোর মতন যার বাস্তবতা আমাকে গ্রাস করতে পারেনা। তাকে আমি ভালোবাসি আকাশ দেখা আর দুরের সেই বাড়ির চিমনি থেকে ওঠা ধোঁয়া কুন্ডুলীর মতন, যা মিলিয়ে যায় ধীরে। তাকে আমি ভালোবাসি আমার একান্ত আপন অনুভূতি, আমার বিষন্নতার মতন। এই বিষন্নতা আমার বহুদিনের সঙ্গি। বিষন্নতার জড়বাদী রূপ আমাকে একটি নতুন জগৎ খুলে দেয়, আমার একান্ত আপন সেই জগৎ, আমার সৃজনশীলতায়, আমার সৃষ্টিশীলতায় যার বহিঃপ্রকাশ। আমার ক্রোধ, আমার মানসিক অশান্তি, ক্লান্তি, বিষন্নতা এগুলোতো মস্তিষ্কের সেই জটিল জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া, সিনাপসিসের ইলেক্ট্রনের সেই মিথষ্ক্রিয়া যা আমাকে আলাদা করে ফেলে তোমাদের এই পরিচিত জগৎ থেকে। আমার এই বিষাদময় জগতকে আমি ভালোবাসি।

ভালোবাসা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ভূলে যাওয়া? যদি তুমি আমাকে ধীরে ধীরে ভূলে যাও, আমি তোমাকে রেখে দেব ছেলেবেলার সেই ঢেউ তোলা পুকুরের মাঝে, যার ঢেউ শাশ্বতকাল ধরে আমার আমি অনুভব করছি। আমি তোমাকে রেখে দেব সেই প্রথম প্রেমটির মত, আমার সেই নিষ্কাম ভালোবাসার মতন, যা অনন্ত। যদি তুমি আমাকে চট করে ভূলে যাও, মনে রেখো, তুমি হবে আমার সেই মেরুপ্রভা, যার দীপ্তিমান ঝলসানি বিমোহিত করেছিলো আমায়, ক্ষণিকের জন্য। আমি বিষন্ন, আমার স্বার্থপরতার জন্য নয়, আমি বিষন্ন ভূল সময়ে তোমাকে পাবার জন্য। আমার এই পুঞ্জিভূত একান্ত বিষন্নতাকে উৎসর্গ করলাম তোমায়। আমার তিলে তিলে গড়ে ওঠা সৃষ্টিশীলতা অর্পণ করলাম তোমাকে। আমার বস্তুগত জগতের বাইরের সকল উন্মাদিত কল্পনা তোমার জন্য।

[আমার প্রিয় কবি পাবলো নেরুদার কবিতায় অনুপ্রানিত হয়ে লেখা। ছবি স্বত্বঃ লেখকের নিজের।]

- নুভান
মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি অফ নিউফাউন্ডল্যান্ড, কানাডা।

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বাহ, আরো লিখুন!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সত্যানন্দ দা।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অনেক যত্ন করে লেখা। আরো লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মাহবুব দা।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এত চমৎকার একটা লেখায় বানান ভুলের কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ওটা ছাড়া এই লেখাটা পড়ে মুগ্ধতাই ছড়ায় শুধু।
প্রগাঢ় অনুভুতি প্রকাশের সুত্রে মহাকাল ও মহাকাশের অচেনা জগতের কাব্য পড়লাম যেন। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। বানান ভুলের ব্যাপারটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য ধন্যবাদ আবারও। বহুকাল পর বাংলায় লেখালেখি শুরু করেছি আবার, অনাভ্যাসে বিদ্যা নষ্ট আর কি! পরের বার থেকে অবশ্যই বানানের দিকে নজর রাখবো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।