রাজশাহীর রিকশার ছবিতে ধর্মীয় মোটিফ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১৯/০৩/২০১৬ - ৩:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


রিকশার ছবিতে ধর্মীয় মোটিফ এসেছে মূলতঃ ধর্মীয় স্থাপত্যের ছবি আঁকানোর মধ্যে দিয়ে। বিশেষ করে মক্কার কাবা শরীফ ও মদীনার মসজিদে নববীর ছবিই রিকশায় বেশি দেখা যায়। প্রায় ক্ষেত্রেই লাল বা গোলাপী রঙের পদ্ম ফুলের মধ্যে একই সাথে দুই ধর্মীয় স্থাপনাকেই পাশাপাশি রেখে আঁকা হয়েছে। কখনও কখনও কেবল কাবা শরীফের ছবিটিই একক ভাবে রিকশার টিনের ক্যানভাস জুড়ে থাকতে দেখা যায়। মোনাজাতের ভঙ্গীতে দু’হাত তুলে প্রার্থনারত শিশুর ছবিও সেই একই ধর্মীয় ব্যঞ্জনার বিষয়বস্তু। ধর্মীয় মোটিফের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়েছে অবশ্য হুডের অলঙ্করনে। হুডের প্লাষ্টিক বা রেক্সিনের ওপর চকচকে ও উজ্জ্বল রঙের প্লাষ্টিকের টুকরো এ্যপ্লিক সেলাইয়ের মাধ্যমে এই ধর্মীয় মোটিফ গুলোকে রূপ দেওয়া হয়েছে। প্রায় ক্ষেত্রেই সেই কাবা শরীফ তার দু’পাশে মিনার অথবা আরবী হরফে আল্লাহু লেখা হুডের দু’পাশে এবং পেছনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

রিকশার পেছনের টিনের ক্যানভাসের এই ধর্মীয় ছবির পরিমান খুবই কম। রিকশায় যে হারে পশু-পাখি, বিভিন্ন স্থাপত্য যেমন দালানকোঠা, বড় বড় সেতুর ছবি বিষয় হয়ে এসেছে সে তুলনায় ধর্মীয় মোটিফের ব্যবহার হয়েছে অনেক কম সংখ্যক রিকশায়। সে তুলনায় বরং হুডের কারুকাজেই ধর্মীয় মোটিফ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। রিকাশার পেছনের প্রধান টিনের ক্যানভাসে একটা বাঘ, উড়ন্ত ঈগল বা মানুষের ছবি থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে হুডের কারুকাজে কাবা শীরফের ছবি বা আরবী হরফে আল্লাহু লেখা হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবেও হুডের অলঙ্করনের ক্ষেত্রেও কাবা শরীফ বা অন্যান্য ধর্মীয় মোটিফের চেয়ে বিচিত্র ভঙ্গীর ময়ুরের ও অলঙ্কারবহুল ফুলের মোটিফ আরো বেশি এসেছে।

ছবির চেয়ে বরং ধর্মীয় মোটিফকে সক্রিয় দেখি রিকশার পেছনে বিভিন্ন ধর্মীয় বাণী বা উপদেশ জুড়ে দেওয়াতেই। এই সব বাণীও আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তা ও নামাজের উপকারিতা ও আহ্বান সংক্রান্ত। কখনও বাংলা হরফেই ফি-আমানিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, বিসমিল্লাহির রাহিমানির রাহিম রিকশার পেছনে ছবির বদলে স্থান জুড়ে থাকতে দেখা যায়। বেশিরভাগ বাণীই এসেছে নামাজ সংক্রান্ত বিষয়ে, এবং হাতে গোনা কয়েকটা ছাড়া প্রায় সবই দায়সারা গোছের।

রিকশার ছবিতে আমরা দেখেছি সাধারন মানুষের রুচি আর আকাঙ্খাকেই প্রতিফলিত হতে। সাধারন মানুষের মনের পরিবর্তনের সাথে সাথে রিকশার ছবিও আমরা পাল্টাতে দেখেছি। এক সময় সিনেমাই যখন সাধারন মানুষের প্রধান চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্র ছিল তখন দেখেছি চলচিত্র তারকারাই রিকশার ছবির বিষয় হয়ে এসেছিলেন। স্বাধীনতার পর পরই দেখেছি রিকশার ছবিতে যুদ্ধের ভয়াবহতা আর পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচারের দৃশ্য আঁকা হতে। জোয়ানা কার্কপ্যাট্রিকের লেখায় এ সময়কার রিকশার ছবির বর্ণনায় আমরা দেখি মানুষ জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানাচ্ছে, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে অত্যাচারিত হচ্ছে, পাকিবাহিনীর উপর স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন চালাচ্ছে প্রভৃতি ছবির কথা। আবার এই লেখিকার বর্ণনাতেই পাচ্ছি ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে চিত্রতারকাদের ছবি বা মানুষের প্রতিকৃতি আঁকানোয় এক ধরনের প্রচ্ছন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে যাওয়ায় শিল্পীরা ফুলের নক্সা আর পশুপাখি আঁকানোর দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন।

এখনকার এই সময়ের রিকশার ছবিতে যখন ফ্যাশনেবল স্পোর্টস কারের ছবি চলে আসে তখন তা মনে করিয়ে দেয় এখনকার তরুনদের ঘরে এই ছবির পোষ্টার অনেক অনেক বছর ধরে জনপ্রিয় একটা বিষয় ছিল। নগরজীবনের যান্ত্রিকতায় অবসাদগ্রস্ত মন যখন প্রকৃতির মধ্যে মুক্তি খোঁজে, ফেলে আসা গ্রাম বাংলার শান্তির শ্যামলিমায় অবগাহনের স্বপ্ন দেখে তখন রিকশার টিনের ক্যানভাসে উপচে পড়ে গ্রামদৃশ্যের ছবি। নিজের বাড়ি করবার মধ্যবিত্তের চিরন্তন স্বপ্নই বিদেশী কটেজের মনোরম দৃশ্যের পোষ্টারের ছবি কেনা আর তাদিয়ে ঘর সাজাবার মধ্যে ফুটে ওঠে। এই সময়ের রিকশায় সে ধরনের রঙ্গীন কটেজের ছবিও যখন আঁকা হতে থাকে তখন বোঝা যায় রিকশার ছবির সাথে সাধারন মানুষের মনের যোগটা এখনও কেটে যায়নি। জাতীয় স্মৃতিসৌধের ছবি, যমুনাসেতুর ছবি জাতীয় গর্ববোধ ছুঁয়েই এসে পড়েছে রিকশার ছবিতে।

রিকশার ছবি সে ধরনের কুলীন গোত্রের হয়তো শিল্প নয়। এ হয়তো নেহাতই অলঙ্করন প্রধান শিল্প কিন্তু শিল্প বলেই সাধারন মানুষের মনের সাথে তার যোগটা রক্ষা করে চলাটা জরুরী। রিকশা শিল্পীরা সাধারন মানুষের কাতারে থেকেই তাই এই হৃৎস্পন্দনকে অনুভব করার চেষ্টা করেন আর তাকে যুক্ত করে দিতে চান তাদের এই শিল্পের সঙ্গে। উচ্চস্তরের শিল্পদক্ষতা বা সে সংক্রান্ত প্রশিক্ষনের উপায় নেই। কেউই এই ছবি গুলো গ্যালারীতে সময় নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তন্ময় হয়ে দেখবেনা। রাস্তায় চলতে ক্ষণিকের চমক দিয়েই হয়তো দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে। এসমস্ত ভেবেই উজ্জ্বল বাহারী রঙের ব্যবহার আসে আর সেই সাথেই জনমনের খেয়ালটার সাথেও সেই ছবিকে যুক্ত করে রাখার একটা তাগিদ রিকশার ছবির শিল্পীদের মধ্যে সব সময়ই কাজ করে। অন্য শিল্পের শিল্পীরা যেখানে নিজের স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রাখতে চান, রিকশার শিল্পীরা সেখানে সমাজের সম্মিলিত মনের আকাঙ্খাটাকেই প্রকাশ করতে চান তাদের শিল্পে।

ছবি, বাণী বা হুডের কারুকাজ সব ক্ষেত্রেই রিকশার অলঙ্করনে ধর্মীয় মোটিফের ব্যবহার অন্যান্য মোটিফের চেয়ে এত কম হারে হয়েছে যে তা যে কারোই চোখে পড়বে। আর এখানেই ভাবনার অবকাশ তৈরী হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রায় নব্বইভাগ মানুষকেই দেখানো হয় ধর্মপ্রাণ হিসেবে। আর তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে চারিদিকে ধর্মেরই জয়জয়কার। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাদানের জনপ্রিয়তা ও সে সংক্রান্ত উচ্ছাসেরও কমতি নেই কোন দিকে। আধুনিক তরুনদের অনেককেই নামাজের দিকে ঝুঁকতে ও দাড়ি রাখতে যেমন দেখা যাচ্ছে তেমনি হিজাব-বোরখার প্রচলন সব বয়সী নারীদের মধ্যেই সার্বজনীন জনপ্রিয় ফ্যাশনে পরিনত হতেও দেখা যাচ্ছে। ফেসবুকের মত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও একটা ধর্মীয় বাণী সম্বলিত ছবি বা মক্কা-মদীনার দৃশ্য মুহূর্তের মধ্যেই হাজার হাজার লাইক পেয়ে যাচ্ছে। প্রচুর মানুষ এই সব ছবির কমেন্টে একটা আলহামদুলিল্লাহ বা সুবহানআল্লাহ না লিখে পারছেননা। ফেসবুকের ধর্ম বিষয়ক পেজ গুলোও অত্যন্ত কম সময়ে এত বেশি হারে লাইক ও মানুষের আগ্রহ আকর্ষন করছে যে অন্য বিষয় ভিত্তিক পেজ গুলোর কপালেও তা জোটেনা। লেখালেখি ও প্রকাশনার ক্ষেত্রেও ধর্মীয় মতের বিপরীতে যায় এমন লেখার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কম সময়েই একজোট হয়ে উঠছেন প্রায় সকলেই। ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি ব্যঙ্গ বা যেকোন ধরনের প্রশ্ন উচ্চারিত হলেই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের প্রশাসনও তার প্রতিবিধানের জন্য মুহূর্তেই সক্রিয় হয়ে উঠছেন। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের জামাতেও এখন আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি লোক জড়ো হয়। দেশের আনাচে কানাচে সর্বত্র সব সময়ই একটা না একটা ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছেই। সেখানে লোক সমাগমেও কমতি নেই, প্রচুর মানুষ আসে ধর্মীয় কথা শুনতে।

ধর্ম সম্পর্কে যে সমাজের মানুষ এতখানি উৎসাহী সেই সমাজের মনটা রিকশার ছবিতে সে হারে প্রতিফলিত হচ্ছেনা কেন? কেন এত কম হারে এসেছে ধর্মীয় মোটিফ? ছবি আঁকার প্রতি যে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা আছে সে জন্যই কি ধর্মীয় মোটিফকে রিকশার ছবিতে আনা সম্ভব হয়নি? সে ক্ষেত্রে বলতে হয় প্রাণীর বা মানুষের ছবি আঁকানোর উপর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা যেমন মুসলিম প্রধান আরব রাষ্ট্র গুলোয় দেখেছি জ্যামিতিক নক্সা বা আরবী হরফের ক্যালিগ্রাফীকে শিল্পে প্রধান্য বিস্তার করতে, রিকশার ছবিতেও সেরকম কিছু আসতে পারতো। কিন্তু তা আসেনি বরং ধর্মীয় মোটিফের ছবির চেয়ে দেখি অনেক অনেক বেশি হারে আঁকা হচ্ছে বাঘ, ময়ুর, পেঙ্গুইন, জিরাফ, ঈগল, টিয়া, কাকাতুয়া, দোয়েল, গরুগাড়ি চালনারত গাড়োয়ান, লাঙ্গল দেওয়া কৃষক, পালকি বেহারা, বাউলের সামনে সঙ্গীত মুগ্ধ ভক্ত। আবার বিভিন্ন জাতীয় সৌধ ও স্থাপনার সঙ্গে সঙ্গেই রিকশার টিনের ক্যনভাসে চলে আসছে মানুষের ছবিও। সংখ্যায় এই বিষয় গুলো ধর্মীয় মোটিফকে ঠেলে দিয়েছে সংখ্যালঘুর সীমানায়। কিন্তু কেন এমন হলো? কেন সমাজে ধর্মচর্চার, ধর্ম নিয়ে উচ্ছাসের ঢেউটা রিকশার ছবির মত লোকজ শিল্পধারায় এসে নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল। এখানেই প্রশ্ন জাগে এই ধর্মীয় আবেগের আন্তরিকতা নিয়ে। তবে কি বিপুল সংখ্যক মানুষের মনের অন্তস্তলে ধর্মীয় বোধ এখনও পৌঁছাতে পারেনি? আচার আর প্রথার বাহুল্যে যা চোখ ভোলায় তা কি হৃদয়ের গহীন কন্দরে প্রসারিত হতে পায়নি?

২০০৯-১০ সালের দিকেই রিকশার ব্যবসা ঝিমিয়ে পড়ে। রিচার্জেবল ব্যাটারী চালিত অটো (ইজিবাইক) আসার পর থেকেই পায়ে ঠেলা রিকশার কদর কমে যায়। এই ইজিবাইক গুলোই অল্প খরচে দ্রুততার সাথে সাওয়ারীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে থাকলে রিকশার ব্যবসায় বড় আকারে মন্দা দেখা দেয়। নতুন রিকশা তৈরীও প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এসময়। রিকশা অলঙ্করন বা রিকশায় ছবি আঁকানোর প্রশ্নই তাই ওঠেনি। রাজশাহী শহরে যারা রিকশার ছবি আঁকাতেন তারাও আর কাজ পাচ্ছিলেননা। এ সময় কোন নতুন রিকশা দেখা গেলেও তাতে কোন ছবি থাকতোনা। রিকশার ছবি আঁকানো একরকম উঠেই গেল এরকমটাই ভেবেছিল সবাই। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ২০১৩-১৪র দিকে। রিচার্জেবল ব্যাটারী আর মোটর সংযোজন করা হতে থাকে পুরনো রিকশার কাঠামোতেই। তারপর পুরনো কাঠামোর জায়গায় নতুনভাবে ধাতব কাঠামোর রিকশা তৈরী শুরু হয়, ব্যাটারী চালিত মোটরতো ছিলই। রিকশার এই নতুন রূপ পরিগ্রহনের সঙ্গে সঙ্গেই রিকশার ব্যবসার মন্দাটা কাটতে শুরু করে। আবার নতুনভাবে রিকশা তৈরী শুরু হয়ে যায়। আর সেই সাথে ফিরে আসে রিকশা অলঙ্করনও।

প্রথম দিকের এই মোটর সংযোজিত রিকশার অলঙ্করনে যারা জড়িত ছিলেন তারা আর চিত্র তারকাদের ছবি রিকশায় আঁকতে চাইলেননা। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞাকে সম্মান দেখানোই ছিল তাদের অভিপ্রায়। সেই সময়ের হেফাজতে ইসলামের প্রভাব ও সমাজে হিজাবি সংস্কৃতির ফ্যাশনের দৌরাত্ম্যেই তারা ভেবেছিলেন সিনেমার ছবি বা মানুষের ছবি আঁকানো আর ঠিক হবেনা। এই সচেতন প্রয়াসের ফলেই রিকশার ছবিতে আর সিনেমা তারকাদের ছবি ফিরে এলোনা। আসলো গ্রাম বাংলার প্রকৃতিক দৃশ্যের ছবি। অন্য শিল্পীরাও এই ধারাটাই অনুসরন করলেন। কেউই আর চিত্র তারকাদের ছবি রিকশায় আঁকলেননা। রিকশার ছবিতে সিনেমা তারকাদের উপস্থিতি একটা ঐতিহ্য রচনা করেছিল। রিকশার শিল্পীরাও সেই ধারাটাই অনুসরন করে এসেছেন এতদিন। এখন রিকশার ছবির ঐতিহ্যে এই মোড় ফেরাতে তাদের সেই পরিচিত ধারা ত্যাগ করে তারা নতুন ধারায় অভ্যস্ত হতে চাইলেন সময়ের দাবী মনে করেই। আঁকা হতে থাকলো জন মনুষ্যবিহীন প্রাকৃতিক গ্রামদৃশ্যের ছবি। ক্রমেই সেই সব দৃশ্য গুলোয় ক্ষুদে ক্ষুদে মানুষের আকৃতিও দেখা দিতে শুরু করলো। সময়ের সাথে সাথে এই আকৃতি গুলো ক্রমান্বয়ে আরো স্পষ্ট হতে শুরু করে। দৃশ্য আঁকানোর একঘেয়েমি কাটাতেই হয়তো রিকশায় আসতে শুরু করলো জাতীয় স্মৃতি সৌধ বা যমুনা সেতুর ছবি। পাখির ছবি প্রকৃতির অনুষঙ্গেই মনে হয় রিকশার শিল্পীদের ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার বেড়া ডিঙিয়ে উড়ে এসে ছিল। আসতে শুরু করলো বাঘের ছবি। রাজকীয় ভঙ্গীতে হুঙ্কার দেওয়া বাঘের ছবির সাথেই চলে এলো হরিনের উপর ঝাপিয়ে পড়া হিংস্র বাঘের শিকার দৃশ্য। পেখমে রঙের বাহার নিয়ে ময়ুরও উঠে এলো কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। এলো জিরাফ, পেঙ্গুইন, সিংহ। এসব ছবি আঁকানোর সময় শিল্পীদের কারোই আর মনে ছিলনা প্রাণী আঁকানোর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কথা। ধর্মীয় গোঁড়ামিটা ঠিক গভীর ভাবে প্রোথিত থাকলে হয়তো এটা সম্ভব হতোনা। কিন্তু তা ছিলনা, এবং বাংলাদেশের মানুষের অন্তকরনে তার শিকড় নেই বলেই শিল্প আপন ধারায় চলেছে। আর সেই চলার ছন্দেই এক শিল্পী আঁকিয়ে ফেললেন পেছনে দোতলা বাড়ি রেখে সামনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা সানগ্লাস চোখে এক যুবকের ছবি। যুবকের ছবিটাই রিকশার টিনের ক্যানভাস ভরিয়ে বিরাজ করছে। মানুষের ছবি, জল-জ্যান্ত মানুষেরই ছবি। ধর্মে বাধা আছে বলে যে মানুষের ছবি আঁকতে চাননি শিল্পীরা তাই আঁকিয়ে ফেললেন, হয়তো প্রাণেরই টানে। সেই প্রাণের টানেই আঁকা হয়ে গেল শিশু কোলে মায়ের ছবি। লাঙ্গল ঠেলছে দাড়িওয়ালা কৃষক, পাশে হরিনের গায়ে এক হাত আর কলসির উপর এক হাত রাখা নারীমুর্তি, একতারা হাতে গানে বিভোর বাউলের সামনে জড়ো হওয়া ভক্তের দল, মোষের গাড়িতে ছাতা মাথায় গাড়োয়ান, এভাবেই একের পর এক ছবিতে মানুষ চলে এলো। মানুষের অন্তকরন যে নিষেধাজ্ঞার বেড়া ডিঙিয়েই যায় রাজশাহীর রিকশার ছবিতে সেই গল্পটাই চলছে।

ধর্মীয় মোটিফের নতুন ছবি এখনও বিশেষ চোখে পড়েনি। পুরনো সিংহের ছবির ওপর চলছে ফের রং বুলানো। রিকশার মালিক চান সিংহটাকে আবার নতুন চেহারায় ফিরে পেতে। ধর্মীয় উপদেশ গুলো আবার রং করে উজ্জ্বল করার কথা এখনও বিশেষ কেউ ভাবেননি। রিকশার লাইসেন্স সংক্রান্ত একটা সমস্যার জন্য রাজশাহীতে নতুন রিকশার লাইসেন্স দেওয়া আপাতত বন্ধ আছে। সিটি কর্পোরেশন থেকে শহরের চৌহদ্দির মধ্যে রিকশার বিচরন বন্ধ করবার একটা কথাও শোনা যাচ্ছে। আর এসবের কারনেই বন্ধ আছে নতুন রিকশা তৈরী আর সেই সাথে বন্ধ হয়ে আছে রিকশার ছবি আঁকানোও। এ সমস্যাটা কাটিয়ে ‍উঠে আবারও রাজশাহীর শিল্পীরা ছবি আঁকানো শুরু করতে পারবেন কিনা বলা যাচ্ছেনা। বলা যাচ্ছেনা আবারও আঁকানো শুরু হলে নতুন করে ধর্মীয় মোটিফ রিকশার ছবিতে সংখ্যায় বাড়তে শুরু করবে কিনা। হয়তো শুধু এটুকুই বলা যায় একটা স্বাধীন মন বেড়া ডিঙিয়ে যাবেই। খাঁচার মধ্যে পুরে রাখার জিনিস নয় অচিন পাখি।
















সোহেল ইমাম


মন্তব্য

Maisha এর ছবি

এইগুলাতো আমাদের এলাকায় ছোটবেলা থেকে দেখে আসতেছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

সোহেল ইমাম

পরিবেশবাদী ঈগল এর ছবি

ঢাকার রিকশায় পিচ্চিকালে দেখতাম মোনাজাতের ছবিটার কয়েকটা ভার্শন ছিল, ফিল্মি টাইপ নায়ন নায়িকাদের হাতে মোনাজাত ।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার বর্ণনা শুনে আফসোস হচ্ছে, ভাবছি কেউ সেসব ছবিকি ক্যামেরাবন্দি করেছে? ফিল্মি টাইপ নায়ক নায়িাকাদের মোনাজাতের ভঙ্গীর ছবির কথা শুনেই দেখতে আগ্রহ হচ্ছে।

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক দিন আগের কথা। স্রেফ বলার খাতিরে বলছিনা, আসলেই অনেকদিন। শাহাদাৎ চৌধুরীর বিচিত্রা তক্ষণ জনপ্রিয়তার মধ্যগগনে। বিচিত্রার দুজন তরুণ সাংবাদিক বেরিয়েছেন রাতের ঢাকায়, উদ্দেশ্য "রাতের ঢাকা" নিয়ে একটি ফিচার তৈরি করা। তার পর কী থেকে কী হল কে জানে! রাত তখন আড়াইটা কি তিনটা। কোনমতে লুঙ্গির গিট ঠিক করতে করতে বিরক্ত চোখে দরজা খুলে দিলেন অধ্যাপক মামুন।
ঃ এত রাতে কী চাও তোমরা?
ঃ স্যার শাহাদাৎ ভাই বললেন রাতের ঢাকা নিয়ে একটা ফিচার লিখতে।
ঃ আমাকে এতো রাতে জ্বালাতে আসলে কেন?
ঃ না মানে স্যার, আপনি তো বলতে গেলে প্রায় ঢাকার মালিক। আপনার পারমিশন নিতে আসছিলাম আর কি......

ঢাকা নিয়ে অধ্যাপক মামুন যে হারে লিখেছেন আপনিও দেখছি সেই দিকেই এগুচ্ছেন সোহেল ইমাম। রাজশাহীর রিকশাচিত্র নিয়ে কথা বলতে হলে একদিন আপনার পারমিশন লাগবে। সাধু সাধু, প্যাডেল ঘুরতে থাকুক।

------মোখলেস হোসেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি ভাই খুবই মজার ঘটনা, আগে শুনিনি হাসতে হাসতে শেষ। মোখলেস ভাই আপনাদের মত লিখতে পারিনা, আপনারা যখন লেখেন গদ্যের মধ্যেও যাদু চলে আসে। আমি পড়ি আর ভাবি এই গুলাকি যাদুকর নাকি। যারা ভালো লেখেন তারাও যদি রিকশা নিয়ে, ফোকলোরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে উৎসাহিত হন এই জন্যই বেসুরো হাতে বীনা বাজাচ্ছি, অপেক্ষা করছি কেউ এসে বীনাটা কেড়ে নিয়ে সুমধুর সুর তুলুক আর বলুক দেখ বোকা এইভাবে বাজাতে হয়।
আপনার শুশুকের জন্য আমার একটা অপেক্ষা তৈরী হয়ে গেছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি পরবর্তী পর্বের জন্য।

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক এর ছবি

বাসের হ্যান্ডেলটা ধরার জন্য ছুটছি, এই তো!
----মোখলেস হোসেন।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হো হো হো

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার লেখা!
দুঃখী নারীর সাথে বাজপাখি---এই ছবিটা অনেকদিন পর দেখলাম, বেশ বিখ্যাত ছবি এককালের, এটা সম্ভবত পোস্টার ফর্মেও দেখেছি, যখন লোকে পোস্টার কিনে ঘরে টাঙিয়ে রাখত।

------দিফিও

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ একটা পোস্টার থেকেই এই ছবিটা আঁকা। এক রিকশা শিল্পীর কাছে এই পোস্টারটার একটা ছেঁড়া খোঁড়া নিদর্শনও দেখেছি।

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার, চমৎকার। ফেলে আসা রাজশাহী শহরটার স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন। মন খারাপ

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

সোহেল ইমাম

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

চলুক

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

সোহেল ইমাম

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বাহ, সবগুলোই দেখেছি। কখনো একসাথে দেখিনি যদিও। দারুণ সিরিজ। চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সাক্ষী সত্যনন্দ, আমি জানিনা কিভাবে লেখা গুলো এক সাথে করা যায়।

সোহেল ইমাম

হাসিব এর ছবি

ধর্মীয় বিষয়াদির বাইরে বিভিন্ন শহরের (কাল্পনিক) ছবি দেখা যায়। মানুষ কীরকম শহর চায় ওগুলো দেখে সেটা বোঝা সম্ভব।

অতিথি লেখক এর ছবি

শহরের চেয়ে এখানে গ্রাম বাংলার দৃশ্য গুলোই বেশি আসছে। আমার সংগ্রহের রিকশার ছবির মধ্যে এই গ্রামদৃশ্যই বেশি, রাস্তাতেও এধরনের দৃশ্যই দেখছি বেশিরভাগ রিকশায়। অনেক ধন্যবাদ কাল্পনিক শহরের ধারনাটার উল্লেখের জন্য, এরকম কিছু রিকশার ছবিতে আসছে কিনা খেয়াল রাখবো।

সোহেল ইমাম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।