ইশকুল

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ৩০/০৩/২০১৬ - ১:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হয়ত আমিও চাইলে আজ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতাম!

কিংবা ইউনিভার্সিটির বড় প্রফেসর! বড় কোন উকিল! কিংবা দেশ-বিদেশে ঘোরা অনেক বড় বিজনেজম্যান!

কিন্তু সেগুলোর কিছুই আমি হতে পারি নি। হতে পারতাম কিভাবে? ইশকুলের অংকের মোতালেব স্যার বলতেন রাজনের পড়াশোনায় একদম মনোযোগ নেই। কয়েকটা মুহূর্তও স্থির থাকতে পারে না! জিজ্ঞেস করতেন, “উপপাদ্যগুলো পড়েছিস?”

আমি আমতা আমতা স্বরে হ্যাঁ বলতাম। পড়া ধরলেই কোণ এবিসি বিসিডি জট পাকিয়ে ফেলতাম। স্যারের সপাং সপাং বেতের মার আমার হাতেই বেশি পড়ত। মার খেয়ে যখন প্রাণপণ চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারতাম না, স্যার স্নেহমাখা কন্ঠে বলতেন, “রাজন রে, একটু পড়িস না কেন বাবা?”

স্যারের সেই মমতামাখা স্বরটাই বেশি খারাপ লাগত। চোখের পানি কোনভাবেই আটকানো যেত না। তখন খুব বেশি আমাদের ফার্স্ট বয় অভিজিতের মত হতে ইচ্ছা হত। ওর মত গটর গটর করে সব পড়া বলে দিয়ে স্যারদের খুশি করতে ইচ্ছে হত। কিন্তু পারতাম না। ক্লাস শেষ হলেই রাজ্যের যত কাজ মনে পড়ত। লিচু গাছটায় হলদে পাখির ছানা, পেছনের ঝোঁপে নাম না জানা টক ফল, কুড়িয়ে পাওয়া ময়লা টেনিস বল আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। সেসবে ডুবে গিয়ে পড়ার কথা মনেই থাকতো না আমার!

আমার বাবা ছিলেন সামান্য এক হোমিও ডাক্তার। সারাটা দিন চেম্বারে বসে রাত দশটার পর বাড়ি ফিরতেন। তিন ভাই বোনের মাঝে আমিই ছিলাম সবার বড়। আম্মা আমার পাঁচ বছরের ছোট বোন আর দশ মাসের ভাইটাকে নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন। আমি ইশকুল ছুটির দু তিন ঘন্টা পর বাড়ি আসলেও আম্মার তাই মাথাব্যথা হত না। আমি সারাদিনই বলতে গেলে তাই আমার ইশকুলে কাটাতাম। এই পৃথিবীতে আমার সবচে’ প্রিয় জায়গা ছিল ওই ইশকুলটাই।

ইশকুলের নাম ছিল “অরূপ রতন বিদ্যা নিকেতন।” এই অরূপ রতন কে ছিল তা নিয়ে আমাদের কারোই মাথা ব্যথা ছিল না। কিন্তু নামটা ভারী পছন্দ ছিল আমার। কীরকম ছড়া ছড়া একটা ভাব। আমি প্রতিদিন সবার আগে ইশকুলে যেতাম। গেটটা পার হয়ে ভেতরে যখন ঢুকতাম, কালিপদ মামা সবে কেবল ঘর ঝাড়ু দিচ্ছেন। আমাকে দেখে বলতেন, “কি ছোটবাবু ভালা?”

আমি উনার দিকে তাকিয়ে হাসতাম। ক্লাসে ঢুকে জানালাগুলো খুলে দিতাম। জানালা দিয়ে রোদটা যখন ক্লাসে ঢুকত, এক অন্যরকম ভালো লাগা দিয়ে আমার সকাল শুরু হত। আস্তে আস্তে ক্লাসরুমটা অনেকগুলো চিকন স্বরে গমগম করে উঠত। সবার আগে আসলেও আমি বসতাম সবার পেছনে। পেছন থেকে সবকিছুই দেখা যেত। অভিজিৎ আর ভূবনের ফার্স্ট বেঞ্চে বসার জন্য হুড়োহুড়ি, মামুনের স্যার আসার আগেই বাড়ির কাজগুলো অন্যের খাতা দেখে টুকে নেওয়া, সাগরের লুকিয়ে লুকিয়ে চকলেট খাওয়া... সব দেখতে পেতাম। টিফিনের সময়টায় সবাই যার যার টিফিন বের করত। প্রায় সবাই বাসা থেকে ভালো ভালো টিফিন নিয়ে আসত। এর টিফিন ওকে খাইতে দিত, ওর টিফিনের সামান্য আরেকজন খেত! আমার সাথে কেউ টিফিন শেয়ার করতে চাইতো না। কারণ আমি নিয়ে আসতাম চিনি মাখা রুটি কিংবা টোস্ট বিস্কুট। আমি একাই পেছনের বেঞ্চে বসে আমার টিফিন খেতাম। আমি খারাপ ছাত্র ছিলাম বলে আমার সাথে কেউ বসতেও চাইতো না, কেউ দেরী করে এসে আমার পাশে বসে মুখটা কালো করে ফেলতো। আমি এগুলো কখনই গায়ে মাখাতাম না। আমি শুধু অপেক্ষা করতাম কখন ঘন্টা পড়বে আর আমার খেলা শুরু হবে!

সত্যি বলতে আমার খেলা হত আমার নিজের সাথেই, একা একা। ওরা ক্রিকেট ফুটবল খেলত, কি একটা কারণে ওরা আমাকে নিত না। আমি একদমই খেলতে পারতাম না তা নয়, কিন্তু তবুও ওরা আমাকে নিতে চাইতো না। আমি একা একা আমার পুরো ইশকুল ঘুরে বেড়াতাম। আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল জঙ্গলের বেগুনী ফুলের সাথে, বিড়ালের বাচ্চাগুলোর সাথে, ইটের দেয়ালগুলোর সাথে।

ছুটির ঘন্টার পর আমার বাড়ি ফেরার চাপ থাকত না, তাই প্রায়ই দেখা যেত আমি মাঠের মধ্যে একা বসে আছি! মাঠের কোন এক ছায়ায় বসে ব্যাগটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়তাম! কত নিশ্চুপ দুপুর আমার এভাবে পার হয়েছে কে জানে! আমি উপরের বিশাল আকাশটা দেখতাম, দেখতাম ঘাসের ভেতর ছোট ছোট পিপড়ার দলকে। নরম কচি ঘাসের গন্ধ আমার পুরো শৈশবটা সোনায় ভরিয়ে দিয়েছিল। ওরকম একা একা বসে থাকতে থাকতে কেন যেন ভীষণ কান্না পেয়ে যেত আমার, কী এক অদ্ভুত ভালো লাগা, কী এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা আমার ছোট বুকটা ভারী করে দিত, আমি বুঝতাম না!
আমার সব থেকে বেশি আনন্দ হত বর্ষার দিনগুলোতে! ঝড় বৃষ্টি সবকিছু উপেক্ষা করে আমি ইশকুলে যেতাম। রাস্তাঘাট সব পানিতে ভেসে যেত, একটু দেরী করে হলেও একহাতে ছাতা আরেক হাতে জুতো নিয়ে কাকভেজা হয়ে যখন যেতাম, দেখতাম তবুও ক্লাসে আমি ছাড়া আর কেউই নেই। অনেক পরে হেডমাস্টার স্যার খোঁজ নিতে এসে একমাত্র আমাকে দেখে অবাক হয়ে যেতেন। তারপর বেশ রাগ হয়ে বলতেন, “ যা যা ব্যাটা বাসায় যা। গিয়ে পড়ালেখা কর। বৃষ্টির দিন মানুষজন কেউ নাই তবুও তার আসা চাই! যা ভাগ!”

আমি তবুও যেতাম না! একা একা পুরো ক্লাসে বসে থাকার আনন্দ থেকে নিজেকে কোনভাবেই বঞ্চিত হতে দিতাম না। সারাটা ক্ষণই বসে থাকতাম, মাঝে মাঝে বেঞ্চ পাল্টে পাল্টে বসে দেখতাম কেমন লাগে! জানালা দিয়ে দেখতাম প্রিয় মাঠটা পানিতে পানিতে ভেসে যাচ্ছে। টিনের চালায় ঝমঝম শব্দে এক অন্যরকম আনন্দ পেতাম। আমি ক্লাসরুমের প্রতিটা টেবিল, বেঞ্চের সাথেই যেন কথা বলতাম। প্রতিটা ইট যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম। ব্লাকবোর্ডে চক দিয়ে হিজিবিজি আঁকতাম, আবার মুছে দিতাম! সারাটা ক্ষণ আমার এই খেলা চলত!

এই ইশকুলটাকে আমি সবচে’ বেশি ভালোবাসতাম। এখনও বাসি। এবং সব থেকে অবাক লাগে এই ভালবাসায় কোন মানুষেরই স্থান নেই! তাদের জায়গায় আছে প্রতিটা বেঞ্চ, সারি সারি গাছপালা, ইটের দেয়াল, সবুজ মাঠটা। ভাবলে অবাক লাগে আমার শৈশব জুড়ে শুধু এগুলোর অবস্থান!

আমার প্রায়ই আমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় তাদেরও এরকম হয় কি না। কিন্তু আমি জানি তাদের কারোই এরকম লাগে না। আজকাল যখন তারা ইশকুলের জন্য মায়ামাখা কথা বলে আমার শুনতে বেশ লাগে। কারণ আমি জানি সবাই বলতে হয় জন্যেই বলে। এদের কারোই ইশকুলের টান আমার মত না। আমি যতটা সময় ইশকুলে দিয়েছি এদের কেউই তার সিকেভাগও দেয় নি। আগের রাতের ঝড়ে যখন আমের গাছটা ক্লাসরুমে এসে পড়েছিল তখন ক্লাসরুম আর গাছের ডালের ওই চড়ুইপাখিদের জন্য এরা কেউ হাউমাউ করে কাঁদে নি। রাতের ইশকুল কেমন লাগে এটা জানার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে রাতের বেলায় এরা কেউই আর পাঁচিল টপকে ইশকুলে আসে নি। তবুও আজ যখন তারা বলে, আমি শুনি। আমাকে শুনতে হয়। কেননা, আজ তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত। অভিজিৎ মস্ত বড় ডাক্তার, ভূবন শহরের সেরা উকিল, অন্যের খাতা দেখে লেখা সেই মামুন আজ বিশাল বিজনেজম্যান। গাড়িতে চড়ে সবখানে ঘুরে বেরায় এরা।

আর আমি? আমি এদের কারো মতই কিছু হতে পারি নি। পড়তে ভালো লাগত না, টেবিলে বসে স্যারদের কথা শুনতেও ইচ্ছে করত না। আমার মনে হয়, আমাকে ওগুলো মানাতোও না। আমায় মানাতো ক্লাসের পেছনে বসে খাতায় হিজিবিজি আঁকতে, মানাতো উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে। ইশকুলের প্রতিটা ইটে মমতার আদর মাখানোই শুধু আমায় মানাতো। প্রতিটা ঘাসে স্বপ্ন বুনে দেওয়াটাই শুধু আমায় মানাতো।

তাই আমি আমার বন্ধুদের মত অনেক বড় কিছু হতে পারি নি। আজকাল আমার সেই প্রতিষ্ঠিত বন্ধুরা যখন আমাদের এই ইশকুলের কথা বলে, আমি ওদের প্রতেকের দৃষ্টিতে একটা ঈর্ষা দেখতে পাই। ঈর্ষা ক্লাসে পেছনের বসা এই রাজন নামের ছেলেটার জন্য, যার সাথে তারা কেউই কখনও বসতে চাইতো না।

আমিই সেই রাজন, এই “অরূপ রতন বিদ্যা নিকেতনের”ই এক সামান্য হেড মাস্টার। আমি ওদের মত বড় কিছু হতে পারি নি, কিন্তু ওদের থেকেও অনেক বড় একটা সম্পদ আমি পেয়েছি। আমিও জানি, ওরাও জানে। যে সম্পদ কেউ কখনও মাপতে পারবে না।

আজকাল ছুটির পর কোন ছেলেকে যদি মাঠে একা একা বসে থাকতে দেখি, কিংবা দেখি ক্লাসে পেছনের সাড়িতে বসা একটা ছেলে তন্ময় হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে, অনেক আগের এই ছোট্ট আমাকেই যেন দেখতে পাই। কারো কাছে পাত্তা না পাওয়া নিঃসঙ্গ ছেলেটার বিষণ্ণতা আমায় গ্রাস করে ফেলে।

বেশিক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থাকতে পারি না। ছাত্ররা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে তাদের হেডমাস্টার স্যার চশমা খুলে চোখের পানি মুছছে। ওরা ভীষণ অবাক হয়, আর আমি প্রচন্ড বিব্রত হয়ে পড়ি।

হেডমাস্টারদের কাঁদতে নেই।

রাসিক রেজা নাহিয়েন


মন্তব্য

তারেক এর ছবি

ভালো লাগলো ,

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক এর ছবি

অদ্ভুত ভালো লাগলো। আরো অনেক লেখার দাবী তৈরী হয়ে গেল কিন্তু, কলম থামলে চলবেনা। চলুক

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। চেষ্টা চালিয়ে যাবো।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

অদ্ভুত। বিষণ্ণ। মন খারাপের পাঠ।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপের লেখা...

রাসিক রেজা নাহিয়েন

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রিয় কবিতা...

রাসিক রেজা নাহিয়েন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।