এর পর আপনি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৩/০৭/২০১৬ - ৩:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাত দুটো পেছনে মুড়িয়ে বেধে রাখা। মুচড়ে খোলার চেষ্টা করে খুব একটা লাভ হচ্ছে না বরং শক্ত নাইলনের দড়ি হাত কেটে বসে যাচ্ছে । হাটু ভাজ করে ফ্লোরে বসিয়ে রাখা হয়েছে ওকে। ধবধবে সাদা রঙের টাইলসের ফ্লোরটার সাদা রঙটা অবশ্য এখন আর দেখা যাচ্ছে না। লালচে কালো রঙ এর তরল পদার্থটা আর টেবিল উলটে ফ্লোরে পড়া আধখাওয়া খাবার বিভিন্ন জুতার চাপে লেপ্টে গিয়ে কেমন যেন অদ্ভুত একটা আকার ধারন করেছে । ছোটবেলায় ছাদে শুয়ে আকাশের মেঘের মাঝে যেমন বিভিন্ন নকশা খুজতো, তেমনি করে এই নোংরা ফ্লোরেও কোন একটা নকশা খোজার চেষ্টা করছিল ও । হঠাত করেই গলায় ঠান্ডা কিছুর অনুভুতিতে চিন্তার খেইটা কেটে গেলো । চোখ দুটো আপনাআপ্নি বন্ধ হয়ে এলো । তারপর ......

ইশরাতের জীবনের শেষ মুহূর্তটা এমন ছিল না। আমরা সবাই একটা সম্মানজনক প্রস্থান (ডিগ্নিফাইড ডেথ) কামনা করি। ইশরাতের জীবনের শেষ কয়েকটা ঘন্টা ছিল আতংকের, ভয়ের । যার শেষটা ছিল অত্যন্ত বিভৎস । নোংরা । রেস্টুরেন্টের ফ্লোরে হাঁটু ভাজ করা অবস্থায় মৌলবাদীর ধারালো ছুরির আঘাতে প্রান হারাতে হয়েছে ইশরাতকে । সোজা বাংলায় যাকে বলে জবাই করে খুন করা হয়েছে তাকে । রক্তমাখা ফ্লোরে কিছুক্ষন ছটফট করে নিথর হয়ে গেছে । সকালে কমান্ডোডের অপারেশনের আগ পর্যন্ত বাকী ১৯ জনের লাশের স্তুপের মাঝে পড়ে ছিল । ( ** অশ্লীল বলে জবাই শব্দটা এড়িয়ে যাই আমরা অনেকেই । আর এড়াবো বা না । দেশটাই একটা অশ্লীল ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে । শাব্দিক শ্লীলতার ঘোমটা টানার কোন মানে দেখি না আর ) ।

ইশরাত আপুর সাথে আমার পরিচয়টা কয়েক মুহুর্তের । ইউকে চলে আসার আগে ব্র্যাকনেটে কয়েক মাস কাজ করেছিলাম । আমি চলে আসার কিছুদিন আগে উনি ব্র্যাকনেটে হিউম্যান রিসোর্সের হেড হিসেবে জয়েন করেছিলেন । মাত্র ৭ দিনের নোটিসে বের হয়ে আসছি । আগে হিউম্যান রিসোর্সের দায়িত্ব ছিলেন সাথিল আপু । তিনি বলেছিলেন, “তাড়াতাড়ি তোমার হলিডে পেমেন্ট আর রেফারেন্স লেটার নিয়ে যেও । নতুন যিনি আসছেন বেশ কড়া । মাত্র ৭ দিনের নোটিস দিয়েছো শুনলে কিচ্ছু দিবে না ” । আমিও তাড়াতাড়ি সব বুঝেসুঝে নিয়ে আসি । চলে আসার ২/৩ আগে কোন একটা কারনে অফিসে বিশাল লাঞ্চের আয়োজন ছিল । সবাই লাইনে দাড়িয়ে খাবার নিচ্ছে । আমার ঠিক সামনেই দাড়ানো ছিলেন ইশরাত আপু । কথা বলা ঠিক হবে কিনা ঠিক করতে করতেই উনি নিজেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি চলে যাচ্ছেন ইউকে ? পড়াশোনা করতে ? ” । আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিয়েছিলাম , “হ্যা” । ঐটুকুই । এর পর আর কথা আগায় নি ।

আজ ইশরাত আকন্দের অরবিচুয়ারি লিখতে বসি নাই । লেখার মত জানাশোনাও আমার ছিল না । আর বাইশজন নিহতের মাঝে তিনিও একজন । ক্ষনিকের পরিচয়টা বিভৎস ঐ কয়েক ঘন্টার ঘটনা কল্পনা করতে গিয়ে নাম না জানা মানুষগুলোর ভিড়ে একটা আবছা পরিচিত অবয়ব দিতে পেরেছে কেবল । কল্পনার চোখ দিয়ে ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠেছি বার বার । তবে এই পাশবিক ঘটনাকে ছাপিয়ে যে নোংরা অনুভুতিটা গতকাল থেকে তাড়া করছে সেটা হলো এই ঘটনায় বাংলাদেশের লাখো লাখো মানুষের অবাক হয়ে যাওয়া । সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেদিকেই তাকাই বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন সবাই নাকি হতভম্ব, শেল শকড, বিস্মিত । এ ঘটনা কল্পনাতীত ।

আমার মৌলিক প্রশ্ন ঃ আপনারা কি এতটাই নির্বোধ নাকি এটা আপনাদের ভন্ডামি ?

গত ২/৩ বছর ধরে দেশের ছেলেমেয়েদের কখনো নাস্তিক, কখনো ব্লগার, কখনো হিন্দু, কখনো খ্রিস্টান হবার অপরাধে দিনে দুপুরে রাস্তায় কুপিয়ে মারা হয়েছে । তখন আপনি নিশ্চুপ ছিলেন । তাদের রক্তমাখা নিথর দেহ, সহধর্মিনীর সাহায্যের আকুতি কিছুই আপনাদের নীরবতার দেয়াল ভাঙ্গতে পারেনি । অনলাইনে মৃত ব্যক্তির চরিত্র সনদ খুজেছেন । বিভিন্ন নোংরা আস্তাকুড় ঘেটে বের করেছিলেন একেকবার একেক রকম অজুহাত । সেই সস্তা অজুহাতের কাছে নিজের বিবেক বিক্রী করে শান্তিতে ঘুমিয়েছেন । বাড়তে দিয়েছেন ধর্মান্ধতা ।

- ও, ছেলেটা নাস্তিক ছিল । এ দেশে বসে সংখ্যা গরিষ্ঠদের ধর্মানুভুতিতে আঘাত দিলে তো কোপ খেতেই হবে ।
- ও, সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতো। এই দেশে এই রকম বেশরীয়তী কাজ করলে লোকজন খ্যাপাটাই স্বাভাবিক ।
- ও, শিক্ষক হয়ে গান বাজনা করার কি দরকার ছিল । সেতার বাজাতো !! এমন হিন্দুয়ানী যন্ত্র বাজানোর কি দরকার ছিল ?

দিনে দিনে আপনাদের অজুহাত সস্তা থেকে সস্তাতর হয়েছে । বিবেকের দর কমাতে কমাতে রীতিমত দেউলিয়া হয়েছেন । মানবিকতা হারিয়েছেন ।

এসবের পর যারা দাবী করছেন তারা হতভম্ভ, অবাক, শকড তারা আসলে ভন্ডামী করছেন। এই বাংলাদেশই আপনারা চেয়েছিলেন। কয়েক বছর ধরে নীরব থেকে এই বাংলাদেশের সম্মতি দিয়েছেন আপনারা ।
ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে লেখক, ব্লগার, প্রকাশক কোপ খেয়ে নিথর হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকবে আর আপনারা নামী দামী রেস্টুরেন্টে বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে মৌলবাদী এবং সেকুলার দুই পক্ষ সমান উগ্রবাদী এই বিষয়ে একমত হবেন । সেটা আসলে আপনাদের সুখস্বপ্ন ছিল । বাস্তবতা হলো এখন শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হল সব জায়গায় হামলা হবে ।

বাস্তবতায় স্বাগতম । তৈরী হন । এর পর আপনি ।

মামুনুর রশীদ [ ভবঘুরে শুয়োপোকা ]
========================
mamun babu ২০০১ at gmail.com
হাজার মানুষের ভিড়ে আমি মানুষেরেই খুজে ফিরি


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারা কি এতটাই নির্বোধ নাকি এটা আপনাদের ভন্ডামি ?

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যারা আজ হতভম্ব, শেল শকড, বিস্মিত হয় তারা নিপাট ভন্ড আর না হলে এতদিন যা ঘটে গেছে তাতে তাদের কিছু আসত যেত না। রক্ত ধোয়া মোছা শেষ হতে দেন, এতদিন যারা বলেছে লেখক/প্রকাশকদেরকে কে খুন করা উচিত নয় কিন্ত ……………………….. তারা এখন কিন্তু যুক্ত বিবৃতি তৈরি করতেছে। যারা হতভম্ব, শেল শকড, বিস্মিত তারা কিন্তুওয়ালাদের পাচ্ছে না বলে একটু দিকভ্রান্ত। সময়মত লাইনে চলে আসবে। আর একেবারেই কিছু তৈরি করতে না পারলে সহীহ মুসলমানের লজিক্যাল ফ্যালাসিটা তো আছেই, কেয়ামত পর্যন্ত সবকিছু এই সহীহ মুসলমানের তত্ত্ব দিয়ে খারিজ করে দেয়া সম্ভব।

বাস্তবতায় স্বাগতম । তৈরী হন । এর পর আপনি ।

আপনার বটমলাইনাটা একটা ধাক্কা দিলো, অবশ্য যাদের এই ধাক্কাটা দরকার তাদের মনে হয় ধবধবে সাদা রঙের টাইলসের ফ্লোরে শুয়ে সূরা/কলেমা মনে করার চেষ্টা করার আগ পর্যন্ত কিছুই হবেনা।

- আতোকেন

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ।

গতকাল থেকে দেখলাম "যারা আরবী সুরা বলতে পেরেছে তাদের ছেড়ে দিয়েছে" এই টাইটেলে বিভিন্ন নিউজ, অনলাইন পত্রিকা নিউজ ছড়াচ্ছে । এই টাইপের খবর ছড়ানোর উদ্দেশ্য পরিষ্কার হলো না ।
এক হতে পারে সন্ত্রাসীরা প্র্যাকটিসিং মুসলিমদের ছেড়ে দিচ্ছে কিন্তু যারা সন্ত্রাসীদের মুসলিম ফিল্টার পাশ করতে পারেনি তাদের হত্যা করেছে । দেশের সবাই এখন পুরানো সুরা ঝালাই করতে লেগে যাবে ।

মামুনুর রশীদ [ ভবঘুরে শুয়োপোকা ]
========================
mamun babu ২০০১ at gmail.com
হাজার মানুষের ভিড়ে আমি মানুষেরেই খুজে ফিরি

অতিথি লেখক এর ছবি

ইতিহাসে সবকিছু ঘুরে ঘুরে ফেরত আসে। এই মুসলিম ফিল্টারও নতুন কিছু না। একাত্তরে ধর্মের নামে পাকিস্তান রক্ষার সৈনিকরা ৫ কলেমা জিজ্ঞাস করত, না পারলেই গুলি। সন্ত্রাসীরাও অনেকদিন পর এই পুরাতন ফিল্টার আবার ব্যবহার করল, এই আরকি।

- আতোকেন

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধর্মবিশ্বাস এখন রাজনীতির পুঁজি। জানিনা তারা কিভাবে লাভের কড়ি ঘরে তোলেন। ধর্মবিশ্বাসের গোড়ায় যারা লাগাম ছাড়া পানি ঢেলেছেন এখনও ঢেলে চলেছেন এই জঙ্গীবাদের হামলায় তাদেরও দায় রয়েছে। অযথা যারা শকড্ হচ্ছেন তাদের দেখেই আমি হতবাক। মামুনুর রশীদ ভাইয়ের সাথে সহমত, আরো কড়া কথা বললেও অপ্রয়োজনীয় মনে হতোনা।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধর্মবিশ্বাস এখন রাজনীতির পুঁজি। জানিনা তারা কিভাবে লাভের কড়ি ঘরে তোলেন।

আওয়ামিলীগ আপাতত মৌলবাদ কে প্রশ্রয় গদি নিরাপদ রাখছে । আপাতত । লং রানে দেশের একটা ভয়ানক ক্ষতি করে দিয়ে যাচ্ছে । সেইটার একটা ছোটখাটো প্রিভিউ দেখলাম আমরা ।
আগামীতে আরো দেখবো ।

মামুনুর রশীদ [ ভবঘুরে শুয়োপোকা ]
========================
mamun babu ২০০১ at gmail.com
হাজার মানুষের ভিড়ে আমি মানুষেরেই খুজে ফিরি

সোহেল ইমাম এর ছবি

যথার্থ বলেছেন, আপনার সাথে পুরোপুরি সহমত।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

শ্রদ্ধা

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।