দার্জিলিং এর গপ্পো # ৩য় পর্ব # শুভ সকাল, দার্জিলিং

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৯/০৭/২০১৬ - ৯:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নতুন কোন জায়গায় ঘুরতে গেলে প্রথম রাতে আমার ভালো ঘুম হয় না। দার্জিলিঙেও তেমনটিই ঘটবে ভেবেছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে শোয়ার পরপরই এমন ঘুম আসল যে চোখ খোলা রাখাই রীতিমত কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। সম্ভবত ভ্রমণক্লান্তিই এর জন্য দায়ী। শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। রেডিয়ামের প্রলেপ মাখানো ঘড়ির কাঁটা নির্দেশ করছিল পৌনে ৬ টা বেজে গেছে। প্রথমে ঠাহর করতে পারি নি কোথায় আছি। দার্জিলিং এ এসেছি মনে পড়ার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম দেশের বাইরে প্রথম রাত কাটানো হয়েছে। কম্বলের নিচের আরামদায়ক উষ্ণতা এত দ্রুত বিসর্জন দিতে ইচ্ছে করছিল না বিধায় মিনিট দশেক এপাশ ওপাশ করলাম। কিন্তু ভোরের আলোয় দার্জিলিং দেখার লোভ এতটাই পেয়ে বসেছিল যে কম্বল ছুঁড়ে ফেলতে সময় নিলাম না। জানালা খুলে দিতেই মুগ্ধতার পরশে মন জুড়িয়ে গেল। সাতসকালের হিমেল হাওয়ার আলিঙ্গনে আপ্লুত হয়ে ভোরের শান্ত দার্জিলিংকে প্রথমবারের মত দেখলাম।

আকাশ এখনও তার ঘোমটা পুরোটা খুলে নি বলেই হয়ত দিগন্তের পাহাড়গুলোকে ঝাপসা দেখাচ্ছে। ঘুম ভাঙা পাখির কূজনে চারপাশ মুখরিত। রাতের বেলায় বুঝিনি যে আমরা এতটা উপরে আছি। সে জন্যেই কুয়াশায় ঢাকা নিচের শহরটাকে ভীষণ মায়াবী লাগছিল। পাহাড়গুলো সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে নিচের দিকে নেমেছে। আবার অনেক দূরে ধাপে ধাপে উঠতে উঠতে দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। ঘরবাড়িগুলো এমনভাবেই পাহাড়গুলোকে আলিঙ্গন করে গড়ে উঠেছে যেন মনে হচ্ছে কত জন্মের আত্মীয়তা তাদের সাথে পাহাড়গুলোর। চারপাশের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করার নিমিত্তেই কিনা দূরের কোন গির্জা থেকে ঢং ঢং শব্দে বেজে উঠল ঘণ্টা। পরপর ৬ বার বেজে জানান দিল ভোর ছয়টা বেজে গেছে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখে সাধ মিটে? সূর্যোদয় ভালোভাবে উপভোগের জন্য হোটেলের ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ছাদে আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য একপাল কবুতরের দেখা পেলাম। বাড়ির মালিক যে কবুতর পোষেন সেটা বোঝা যায় ছাদের রেলিঙের দিকে তাকালে। রেলিঙের উপরদিকটা সমতল নয় বরং ড্রেইনের মত খাঁজ কাটা। সেই খাঁজের ভিতর খাবার দেওয়া আছে। কবুতরগুলো মনের আনন্দে খাবার খাচ্ছে। আমাকে দেখে তাঁদের মাঝে বিরক্তি কিংবা ভয়ের কোন প্রকাশ দেখা গেল না। মানুষের সান্নিধ্যে থেকে অভ্যস্ত বোঝাই যায়।

দরোজা খোলার শব্দে পিছনে তাকিয়ে দেখি অশীতিপর এক বৃদ্ধ বের হয়ে এসেছেন। বয়স সত্তরের ঘরে হলেও গায়ে গতরে তিনি যে এখনও যথেষ্ট শক্ত আছেন বোঝাই যায়। হাসিমুখেই পরিচিত হলেন। তিনিই এই হোটেলের মালিক। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গুর্খা ডিভিশনের সৈনিক ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর পেনশনের টাকায় এই হোটেল তৈরি করেছেন। এটাকে অবশ্য হোটেল না বলে অতিথিশালা বলাই মনে হয় উত্তম হবে। ৪ তলা এই অতিথিশালার চতুর্থ তলায় তিনি সপরিবারে থাকেন। বাকি ৩ তলা অতিথিবৃন্দের জন্য বরাদ্দ। স্ত্রী, ছেলে এবং পুত্রবধূকে নিয়ে শান্তিতেই আছেন শেষ বয়সে। জানালেন, আকাশ পরিষ্কার থাকলে এই ছাদ থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না বলেই হয়ত সেদিন আর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হয় নি। কিছুক্ষণের মাঝেই অনিন্দ্য ছাদে উঠে আসল। প্রশান্তচিত্তে সূর্যোদয় উপভোগ করতে মন্দ লাগছিল না। ছাদ থেকে পুরো শহরটাকেই চমৎকারভাবে দেখা যায়। দেখতে দেখতেই কুয়াশার আড়াল ছেড়ে দার্জিলিং শহরের আত্মপ্রকাশ ঘটল এবং কর্মব্যস্ত রূপে ফিরে যাওয়ার সে জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

হোটেল পরিচালনার জন্য যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাঁর নাম রবি। ভদ্রলোককে যদিও আমাদের বাঙালী বলেই মনে হয়েছে কিন্তু যে কয়দিন ছিলাম একবারের জন্যও তিনি আমাদের সাথে বাংলায় কথা বলেন নি। রবি বাবু স্ত্রী’কে নিয়ে এখানেই থাকেন। দুজন মিলেই এই অতিথিশালা পরিচালনা করেন। রন্ধনশালার দায়িত্বটি ভদ্রমহিলা পালন করেন বলেই মনে হল। কারণ আমাদের খাবারের দেখভাল তিনিই করেছিলেন। স্বীকার করতেই হবে রবি বাবু’র ব্যবহার ছিল অত্যন্ত মার্জিত এবং বন্ধুত্বপূর্ন। যথেষ্ট সহযোগিতাও পেয়েছিলাম আমরা তাঁর কাছে। এই যেমন আজ থেকে শুরু করে মোট ৩ দিন আমরা কোথায় কোথায় ঘুরব সেটা ঠিক করা থাকলেও কাকে নিয়ে ঘুরব সেটার বন্দোবস্ত তিনিই করে দিয়েছিলেন। আমরা হোটেলে ঢুঁকে প্রথমেই তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এমন কাউকে ম্যানেজ করে দিতে পারবেন কি না যিনি আগামী ৩ দিন আমাদের সাথে গাইড এবং ড্রাইভার হিসাবে সময় দিবেন। কারণ আমরা যদি সকালের জন্য অপেক্ষা করি তাহলে গাইডের যোগাড় করতে করতেই অনেক সময় চলে যাবে। রবি বাবু এমন একজন গাইডকে ফোন দিয়ে আনিয়েছিলেন। যদিও আমার সাথে দেখা হয় নি কিন্তু অনিন্দ্য রাতেই গাইডের সাথে কথা বলে ঠিক করে নিয়েছে আগামী ৩ দিন আমরা কোথায় কোথায় যাব। দার্জিলিং এবং কালিম্পং এর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখার বিনিময়ে আমাদের ৮ হাজার রুপি খরচ করতে হবে। একেকজনের ভাগে তাহলে আড়াই হাজার রূপির কিছু বেশি পড়বে। মানতেই হবে, অনেক সস্তা। ঢাকা থেকে যদি আপনি রাঙ্গামাটির সাজেকে ঘুরতে চান তাহলেই ট্র্যাভেল এজেন্টগণ দুইদিনের জন্য ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা চেয়ে বসেন। সেই তুলনা করলে আমরা অনেক সস্তায়ই গাড়ি ভাড়া করেছি।

সাইমুমকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নাস্তা করার মানসে ক্যান্টিনে প্রবেশ করলাম। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই অতিথিশালার ক্যান্টিনটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। ক্যান্টিনের একপাশে চমৎকার একটা লাইব্রেরী। যারা হোটেলে থাকেন তারা চাইলেই বই নিয়ে পড়তে পারেন। অন্যপাশে গ্লাসের ভিতরে রাখা বিভিন্ন দেশের টাকা এবং মুদ্রা। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও বাংলাদেশের কোন টাকা-পয়সা না দেখে কিছুটা খারাপ লেগেছিল। চেয়ার টেবিলগুলো এমনভাবে বসানো আছে যে আপনি চেয়ারে বসে নাস্তা করতে করতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবেন। এত সকালে নাস্তা করতে আর কাউকে পাব না ভেবেছিলাম। আমার ধারণাকে ভ্রান্ত করার জন্যই হয়ত বেশ কয়েকজন বিদেশিকে দেখলাম রিলাক্স মুডে বই পড়তে পড়তে নাস্তা করছেন। একজন ব্যস্ত ছিলেন মোবাইল আর ল্যাপটপ নিয়ে। নাস্তার অর্ডার দিয়ে আমরাও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কেউই এখানকার সীমকার্ড কিনি নি। তাই বাসায় খবর পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল ফেসবুক। ওয়াইফাই থাকায় খুব সুবিধা হয়েছিল। ঝটপট ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে ছোটবোনকে জানিয়ে দিলাম সুস্থভাবেই পৌঁছেছি দার্জিলিং। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়লাম জানাল দিয়ে পাহাড় দেখতে। প্রকৃতি দর্শনে মনে হয় অনেকখানিই আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। সম্বিত ফিরল অনিন্দ্যর ডাকে। নাস্তা চলে এসেছে। মেন্যুতে আছে তিব্বতিয়ান নান রুটি এবং পনির মাখানো ডিম। সাথে আছে হরেক রকমের আচার এবং সস। সবশেষে দার্জিলিং এর বিখ্যাত লিকার চা। সেইরকম সুস্বাদু।

সকাল ৮ টায় আমাদের গাইড এবং ড্রাইভার পুষ্করের আসার কথা। ঠিক ৮ টা’র সময়ই হোটেলের নিচে গাড়ির হর্ণ। নিচে নেমে দেখি পুরো মাথা কামানো এক ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে বসে আছেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনিন্দ্যর দিকে তাকাতেই বলল ইনি পুষ্কর নন। পুষ্কর আজ আসতে পারবে না বলে এক বন্ধুকে পাঠিয়েছে। আগামী দিন সে থাকবে। অনেকটা আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পগুলোর মত সাব-কন্ট্রাক্ট এর ব্যবস্থা আর কি। ড্রাইভার কে হবে সেই নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। যেসব জায়গা ঘুরার পরিকল্পনা করেছি সেসব ঘুরতে পারলেই হল। গাড়িতে উঠে বসলাম সবাই।

আজ আমরা শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখব বলে বের হয়েছি। এইবেলা দার্জিলিং শহরের ইতিহাস একটু বলে নেওয়া যাক। দার্জিলিংয়ের ইতিহাসের সাথে সিকিম, নেপাল, ভূটান ও ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত। নিজেরা নিজেরা মারামারি করলে তৃতীয় পক্ষ কিভাবে সুবিধা নেয় সেটার চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে দার্জিলিং। এখানে যদি সিকিমকে প্রথম পক্ষ এবং নেপালকে দ্বিতীয় পক্ষ হিসেবে বিবেচনা করেন, তাহলে তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে ব্রিটিশরা। একটু খুলেই বলা যাক।

Darjeeling নামকরণের উৎপত্তি Dorje Ling থেকে। Dorje Ling ছিল দার্জিলিঙের স্থানীয় এক জাতির উপাসনালয় যা কি না সিকিমের রাজা (যাদেরকে চোগিয়াল বলা হত) ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন। Dorje মানে হচ্ছে বজ্র কিংবা বিদ্যুৎচমক এবং Ling মানে হচ্ছে স্থান। তাহলে দার্জিলিং এর অর্থ দাঁড়ায় এটি এমন এক স্থান যেখানে বজ্রসহ বিদ্যুৎ চমকায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৭০০০ ফুট উপরে বর্ষাকালে বেশি বেশি বিদ্যুৎ চমকাবে সেটাই স্বাভাবিক। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে উপাসনালয়টি ১৮১৫ সালে নেপালের গোর্খা বাহিনীর দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

দার্জিলিং একসময় সিকিমের অংশ ছিল। আর সিকিম ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল যা কি না ভারত পরবর্তীতে জবরদখল করে। সিকিমের সাথে নেপালের সবসময় দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। সিকিমের দার্জিলিং অংশ দিয়ে নেপাল এবং ভুটানের সীমান্ত আলাদা করা ছিল। ফলে দার্জিলিং তথা সিকিম একটা বাফার রাষ্ট্র হিসাবে বেশ শান্তিতেই ছিল। কিন্তু সেই শান্তি সহ্য হল না নেপালী গুর্খাদের। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সিকিম রাজ্য দ্বারা দার্জিলিং সংলগ্ন পাহাড়ী অঞ্চল এবং নেপাল রাজ্য দ্বারা শিলিগুড়ি সংলগ্ন তরাই সমতল অঞ্চল শাসিত হত। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে নেপালের গুর্খারা সমগ্র পাহাড়ী অঞ্চল অধিকারের চেষ্টা শুরু করলে সিকিমের রাজা তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। গোর্খারা যোদ্ধা জাত, তাঁদের সাথে যুদ্ধ করে সুবিধা করা এত সহজ নয়। ক্রমাগত পরাজয়ের ফলশ্রুতিতে সিকিম সেনাবাহিনী একটা পর্যায়ে তিস্তা নদীর তীর পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সিকিমের রাজা ব্রিটিশদের সহায়তা কামনা করেন। ভারত তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশ রাজের দখলে। ব্রিটিশরা দেখল নেপালিদের এই অগ্রযাত্রা রুখতে না পারলে তো বিপদ। তাই সমগ্র উত্তর সীমান্তে নেপালীদের বিজয়যাত্রা রুখতে ব্রিটিশরা তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত ইঙ্গ-গুর্খা যুদ্ধের ফলে গুর্খারা পরাজিত হয়ে পরের বছর সগৌলি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির ফলে নেপাল তার ভূমির এক তৃতীয়াংশ মালিকানা হারায় এবং সিকিম রাজ্য থেকে অধিকৃত মেচী নদী থেকে তিস্তা নদী পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৮১৭ সালের তিতালিয়া চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চল সিকিমের রাজাকে ফেরত দানের মাধ্যমে সিকিমের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে। যারা ভাবছেন, আহা ব্রিটিশরা কতই না মহান তারা একটু অপেক্ষা করে বাকি কাহিনী পড়ুন।

১৮২৯ সালের ঘটনা। নেপাল এবং সিকিমের মাঝে আবারও গ্যাঞ্জাম শুরু হয় “অন্তুদারা” সীমান্ত নিয়ে। এই গ্যাঞ্জাম মিটানোর খায়েশে তৎকালীন ব্রিটিশ বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিংক তাঁর দুজন অফিসার Captain George Alymer Lloyd এবং J. W. Grant কে পাঠালেন অন্তুদারা’তে। দুই অফিসার পথিমধ্যে যাত্রাবিরতি করেন দার্জিলিঙে। এবং দার্জিলিং এর সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েন যে ব্রিটিশ গভর্নরকে প্রস্তাব দিয়ে বসেন যেন এই স্থানে একটা স্বাস্থ্যনিবাস তৈরি করা হয়। ব্রিটিশ হর্তাকর্তারা নিজেদের দেশের ঠাণ্ডা পরিবেশ থেকে উত্তপ্ত ভারতে এসে হাঁসফাঁস করছিলেন। এমন সময় দার্জিলিং তাঁদের শুষ্ক জীবনে দু’ফোটা শান্তির পরশ নিয়ে হাজির হয়েছিল। ছুটিছাটায় বিবি-বাচ্চা নিয়ে এখানে বেড়াতে আসবেন এমন দিবাস্বপ্নে বিভোর হতে তাঁদের মোটেই সময় লাগে নি।

বেন্টিংক সাহেব সানন্দে তাঁদের প্রস্তাব মঞ্জুর করলেন এবং সিকিমের রাজার কাছে দার্জিলিং লিজ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সেসময় দার্জিলিঙে খুব বেশি বসতি ছিল না। রাজার ছিল দয়ার শরীর তার উপর নেপালের সাথে যুদ্ধে ব্রিটিশদের সহায়তার কথাও (যদিও এই যুদ্ধ ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থেই করেছিল) তিনি ভুলেন নি। ১৮৩৫ সালের ১ লা ফেব্রুয়ারি তিনি দার্জিলিংকে ব্রিটিশদের কাছে বিনামূল্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য লিজ দিয়ে দিলেন। ব্রিটিশরা চালাক জাতি। ১৮৪১ সাল থেকে তারা রাজাকে খুশি করার জন্য বার্ষিক ১ হাজার রুপি দেওয়া শুরু করে যার পরিমাণ ১৮৪৬ সালে ৬০০০ রুপি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। অনেকটা বাংলাদেশ থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এশিয়া এনার্জির ৬% রয়্যালটিতে কয়লা উৎপাদনের প্রস্তাবনার মত আর কি ব্যাপারটা।

দার্জিলিং লিজ পাওয়ার পর থেকে ব্রিটিশরা জায়গাটির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটায়। রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, চার্চ, চা-বাগান, রেললাইন ইত্যাদি তৈরি হতে থাকে। এসব দেখে সিকিমের রাজা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। পানির দামে হীরা বিক্রি করার বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেন। আরও একটা ব্যাপার ছিল। দার্জিলিঙয়ে চায়ের আবাদ বাড়ার সাথে সাথেই সিকিম থেকে প্রচুর পরিমাণ শ্রমিক দার্জিলিঙয়ে পাড়ি জমায় যা কি না সিকিমের অভিজাত সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সিকিমের রাজার আদেশে সেইসব শ্রমিকদের জোর করে সিকিমে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে ব্রিটিশরা ভালোভাবে গ্রহণ করে নি। এভাবেই একদা মধুর সম্পর্কের আবরণে চিড় ধরে। সেই চিড় বিশাল খাদে পরিণত হয় ১৮৪৯ সালে যখন সিকিম রাজের নির্দেশে দুজন ব্রিটিশ অভিযাত্রীকে সিকিম ভ্রমণরত অবস্থায় বন্দী করা হয়। ব্রিটিশরা ঠিক এমন একটা মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁদেরকে মুক্ত করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠায় এবং ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোম্পানি ৬৪০ বর্গমাইল (১,৭০০ বর্গকিলোমিটার) এলাকা অধিকার করে নেয়। ব্যস, দার্জিলিং চিরতরে সিকিমের হাতছাড়া হয়ে গেল।

ব্রিটিশরা এখানেই থেমে থাকে নি। ১৮৬৪ সালে তারা কালিম্পং (যা কি না ছিল ভুটানের অংশ) দখল করে নেয়। কালিম্পং এর অবস্থানগত গুরুত্ব অপরিসীম। এটি দখল করার মাধ্যমে পাহাড়ের গিরিপথগুলোর উপর নজর রাখা সুবিধা হয়। দার্জিলিং হারিয়ে সিকিমের রাজার মাথা পাগল হওয়ার দশা। আবারও সিকিমিজ এবং ব্রিটিশ বাহিনীর মাঝে ১৮৬৫ সালে ছোটখাটো যুদ্ধ হয়। ফলশ্রুতিতে তিস্তা নদীর পূর্ব তীরের অঞ্চলগুলি ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কালিম্পংসহ ১,২৩৪ বর্গমাইল (৩,২০০ বর্গকিলোমিটার) ক্ষেত্রফল এলাকা নিয়ে দার্জিলিং জেলা গঠিত হয়, যা বর্তমানে একই আকারের রয়ে গেছে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতার পর দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং ও তরাই অঞ্চলের কিয়দংশ নিয়ে নির্মিত দার্জিলিং জেলাকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

অনেক তো গল্প হল, এইবার অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসা যাক। ব্রিটিশরা যখন প্রথম দার্জিলিঙয়ে আসে তখন স্থানীয় লেপচা গোত্রের মাত্র ১০০ লোক এখানে থাকত। বর্তমানে এই শহরে প্রায় ২০ লাখ লোকের নিবাস। আমার কাছে অবশ্য মনে হয়েছে দার্জিলিঙয়ে মানুষের চেয়ে হোটেলের সংখ্যাই বেশি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা শহরটির সৌন্দর্যের বারোটা বাজাচ্ছে এমন অভিযোগ অনেকেই করে থাকেন। আমি যেহেতু প্রথমবার এসেছি তাই আমার কাছে তেমন কিছুই মনে হয় নি। আমি বরং দার্জিলিং এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ।

নাস্তা করে বের হতে কিছুটা দেরী হয়েছিল। সূর্য উঠেছে সেও তো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। পরদিন সাপ্তাহিক ছুটি। ব্যস্ত লোকজনের পদভারে রাস্তাঘাট সরগরম। ট্রাফিক জ্যামের মাত্রাও খারাপ নয়। যে কোন জায়গায় গেলে আমার সেখানকার মানুষ দেখতে খুব ভালো লাগে। তাঁদের চলাফেরা, হকারদের সাথে তর্কাতর্কি, বাচ্চাদের সারিবদ্ধভাবে স্কুলের দিকে যাত্রা, ট্রাফিক পুলিশের ব্যস্ততা, শহর থেকে বাইরের গন্তব্যের গাড়িগুলোর যাত্রী পাওয়ার জন্য হাঁকডাক, নিঃসঙ্গ ট্রেনলাইন ধরে হেঁটে চলা কিশোর, নাম না জানা ফুলের সৌন্দর্য সবই ভাল লাগে। সেই সাথে শহর ঘিরে থাকা সুউচ্চ পাহাড়, পাহাড়ের উপর গড়ে উঠা উঁচু উঁচু দালানকোঠা আর ৬৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত দার্জিলিং রেলস্টেশনের টয় ট্রেন তো ছিলই। শহর দার্জিলিং যেন আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে তার অবগুণ্ঠন প্রকাশ করছিল।

প্রিয় পাঠক, একদম শেষের ছবিটা ভাল করে লক্ষ্য করুন। দার্জিলিং থেকে গ্যাংটক (সিকিমের রাজধানী) যাওয়ার টিকিট কাউন্টার এটি। কাউন্টারের পাশেই একটা বিদ্যুতের খুঁটিতে Darjeeling to Gangtok লেখা আছে। সেই খুঁটিতেই একটা পতাকা টানানো। পতাকাটি ভারতের অতি পরিচিত লাল-সাদা-সবুজ তেরঙ্গা থেকে একটু আলাদা। পতাকাটি প্রস্তাবিত গোর্খাল্যান্ডের। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন নিয়ে অন্য একটা পর্বে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে আছে। আপাতত আমার সাথে দার্জিলিং দর্শন করতে থাকুন। আমাদের প্রথম গন্তব্য Japanese Temple এবং Peace Pagoda. দার্জিলিং এর দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ আমরা এখান থেকেই শুরু করলাম।

দার্জিলিং, সকাল ৯ টা।
১৪ নভেম্বর ২০১৫, শনিবার।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

১ম পর্ব # পশ্চিমবঙ্গে স্বাগতম

২য় পর্ব # রোড টু দার্জিলিং


মন্তব্য

শুভায়ন এর ছবি

আমার জেলায় বেড়িয়ে ভালো পাচ্ছেন জেনে আনন্দিত হলুম। যদিও আমি নিজে জেলাসদরে একবার-ই গেছি। তাই ভালো গাইডের কাজ করতে পারব না।

তবে দার্জিলিং শহরের জনসংখ্যা মনে হয় সার্ধ-লক্ষ মতো - https://en.wikipedia.org/wiki/Darjeeling#Demographics

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। দার্জিলিং ঘুরে সত্যিই আনন্দ পেয়েছি। আপনার বাড়ি দার্জিলিং জেলার কোথায়?

জনসংখ্যার হিসেবটি আপনি উইকিপিডিয়া থেকে দিয়েছেন। সেখানে কিছুটা ভুল আছে। আমি রেফারেন্স হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের District Census Handbook, Darjiling ব্যবহার করেছি। সেখানে ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দার্জিলিং এর জনসংখ্যা উল্লেখ করা আছে ১৮৪৬৮২৩। ২০১৬ তে এসে জনসংখ্যা বেড়ে ২০ লাখে দাঁড়িয়েছে সেটা অনুমান করে নিয়েছি।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

শুভায়ন এর ছবি

উপস - তাই নাকি!! এটা একদম-ই জানা ছিল না। কাল্টিভেট করতে হবে।। তবে এটা মনে হয় জেলার হিসেব - শহরের নয়।

আমার বাড়ি শিলিগুড়িতে - জেলার প্রধান মহকুমাসদর ও উত্তর পুর্বাঞ্চলের দুয়ারপ্রান্ত। যতদিন না ট্রানজিট ব্যবস্থা গতি পাচ্ছে - ততদিন আমার শহরের বোল-বালাও বাড়তেই থাকবে। বর্তমানে এখানে পুরসভা অঞ্চলে ৭ লক্ষ লোকের বাস - কাওয়াখালি প্রভৃতি সংযোজিত অঞ্চল ধরলে ১০ ছাড়িয়ে যাবে।

কচি বেলায় - এ তল্লাটে এসেছিলুম - তার পর এখানেই থেকে গেছি। আর এই শহরও যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের দ্বারে উপনীত।

অতিথি লেখক এর ছবি

তবে এটা মনে হয় জেলার হিসেব - শহরের নয়।

হতে পারে। শিলিগুড়ি ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সময় করে উঠতে পারি নি। আফসোসটা রয়ে গেছে। মন খারাপ

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সোহেল ইমাম এর ছবি

Japanese Temple এবং Peace Pagoda

র জন্য প্রস্তুত থাকলাম। হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

অপেক্ষায় থাকুন। হাসি

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ঘোরাঘুরির সাথে সাথে ইতিহাসের ব্যাপারটা তুলে আনার জন্য ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো আপনার দার্জিলিঙের গল্প। প্রথম আর দ্বিতীয় ভ্রমণ পর্ব দুটি পরে পড়ে নেবো। পরবর্তী ভ্রমণ পোস্টের অপেক্ষায়।

মন্তব্যকারীঃ জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো জেনে ভাল খুশি হলাম। পরীক্ষা এবং চাকরির যুগল ব্যস্ততায় আর লেখা হয়ে উঠে নি। এইবার একটানে সবগুলো পর্ব শেষ করে ফেলার আশা রাখছি।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

shahanur Rocky এর ছবি

তাড়াতাড়ি লেখাটা শেষ করুন। খুব ভালো লাগছে আপনার লেখা।
পারলে সিকিম যাওয়ার ব্যাপারে কিছু জানলে লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

আবারও লেখা শুরু করলাম। এইবার ইনশাল্লাহ একটানে শেষ করে ফেলব। সিকিম যাওয়ার ইচ্ছে তো আছে কিন্তু বাংলাদেশীদের জন্য সেখানে যাওয়া নিষেধ। স্পেশাল পারমিট নিয়ে অবশ্য যাওয়া যায়। আবার কলকাতার বাঙালি পরিচয় দিয়েও যাওয়া যায়। তবে সেক্ষেত্রে ঝুকি আছে। ধরা পড়লেই কমপক্ষে তিনমাসের জেল।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।