ফসল বিলাসী হাওয়া (১.১)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৪/১২/২০১৭ - ৯:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

*****শীতনিদ্রা কাটিয়ে আবার লিখতে শুরু করেছি। লেখার শেষে প্রথম কিস্তির লিংক।

সাত।।
সেই রাত্রেই পালিয়ে এসেছি। পেওলার মুখোমুখি হাবার সাহস হয়নি আমার।

প্রথম বিশ্বের কোন দেশে থাকার অনেক সুবিধা। না খেয়ে মরতে হয় না, নিতান্ত অপদার্থ না হলে ঘুমুতে হয়না খোলা আকাশের নিচে, একটা না একটা কাজ জুটেই যায়। ওয়ান টু পিৎজা ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় তবুও খুব চিন্তা হচ্ছিলো। কোথায় যাবো, করব কী, জমানো টাকা ফুরিয়ে গেলে কেমন করে চলবে, এই সব। শেষমেশ বুদ্ধি করে একটা ট্রেনে উঠে পড়েছি। টরোন্টো থেকে ভ্যানকুভার, প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটারের পাড়ি। টিকিটের দাম পড়েছে চার’শ ডলার, প্লেনে গেলে দু’শ ডলারেই হয়ে যেতো। কিন্তু আমিতো আর বেড়াতে যাচ্ছি না। আমার দরকার কিছুটা সময়, ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নেবার জন্য। প্লেনে সেই সময় কোথায়! মাত্র তো পাঁচ ঘণ্টার পথ। রেলগাড়ি চলবে চার রাত তিনদিন। থাকা খাওয়ার খরচ ধরলে চার’শ ডলারে চার দিনের জন্য একটা হোটেলও মেলেনা আজকাল।

ভিয়া রেলের কর্তারা রসিক বটে। ইকোনমি ক্লাসের টিকিটে ভাড়ার জায়গায় লিখে রেখেছেন ‘এস্কেপ ফেয়ার’। আমি নাকের উপর একটা বই রেখে আড়ে আড়ে সহযাত্রীদের দিকে তাকাই। পাশের চেয়ারটা খালি। পরের সারিতে প্রথম সিটে যে বসে আছে তার গায়ে হাওয়াই জামা, মাথায় উল্টো করে ঝোলানো বেসবল টুপি, আসার পর থেকেই সে ফোনে বকবক করে চলেছে সদ্য গোঁফ গজানো কিশোরের মতো। সুখী সুখী চেহারার ওই আধবুড়োটা পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নয়।

আমার খুব কৌতূহল হলো। এই কামরায় আর কে কে আছে আমার মতো! অল্পবয়স্ক দুটো মেয়েকে চোখে পড়ছে, হয় বান্ধবী নয়তো বোন। একজনের হাতে ছবির অ্যালবাম, একটা করে পাতা উল্টে যাচ্ছে আর খিল খিল হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে পাশের জনের গায়ে। জীবনপাত্র উল্টে চলার বয়েস এদের।
বছর তিনেকের দস্যি একটা বাচ্চাকে নিয়ে চলেছে ওর বাবা মা। বাবাটি গোবেচারা ধরনের, কিছুতেই পেরে উঠছেনা বাচ্চার সাথে। বাচ্চাটি এই হয়তো সিটের হাতলে, এই আবার মেঝেতে, কখনও তারস্বরে চিৎকার করছে, পরক্ষনেই রিনরিনে গলায় গেয়ে উঠছে টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার। ওর মা পৃথিবীর সকল চিন্তা ভাবনা একপাশে সরিয়ে রেখে মন দিয়ে ঘুরিয়ে চলেছে উলের কাঁটা। এরা ঘোরতর সংসারী। এদেরকে দেখে মনটা দমে গিয়েছে আমার। বইয়ের পাতায় নাক ডুবিয়ে পড়তে শুরু করলাম আবার।

এ দেশের ট্রেনযাত্রা বড় একঘেয়ে। টানা কাঁচের জানালায় ঘেরা ঝকঝকে তকতকে কামরা, সেখানে সারি সারি চেয়ার, জানালার বাইরে ক্রমশ পাল্টে যাওয়া পৃথিবী, কিন্তু সে পৃথিবীর কোন উত্তাপ আমাকে ছুঁতে পারছেনা। এমনকি মাইলের পর মাইল সমান্তরাল বয়ে চলা লোহার পাতের সাথে রেলের চাকার ঘটাং ঘটাং শব্দটাও খুব করে কান না পাতলে শোনার উপায় নেই। একটুখানি খোলা হাওয়ার জন্য ভেতরটা আকুলি বিকুলি করছে আমার। সেই অন্য জীবনে, দ্রুতযান কি ঝটিকায়, পদ্মায় অথবা তুর্না নিশিথায় হাত দিয়ে টেনে খোলার মতো জানালা ছিলো অনেক। শিকের ফাঁক দিয়ে পিছলে আসা ফুরফুরে বাতাস, বৃষ্টির ছাঁট, সর্ষে ফুলের ঘ্রাণ আর গমগমে জনপদের অপস্রিয়মাণ কোলাহল এখন রূপকথার মতো লাগে। সে রূপকথায় মাথার উপরে তাতানো বালিতে আধো ডোবানো বাদামের পসরা নিয়ে হেঁটে বেড়াতো একজন হকার। সেখানে জীবন ছিল শব্দময়, বর্ণালি। সেই জীবন, সেই ‘বাদাম, বাদাম’ ডাক, ঠোঙায় মোড়ানো বড়ই-চালতা, মেঝ জ্যাঠাজির প্রশ্রয়ের হাসি, ঝিকঝিক ঝিকঝিক ঝিকঝিক দুলতে থাকা ট্রেনের মেঝে, মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকা বুড়ো ফকিরের বুক ভাঙা গান- গলায় আটকে থাকা শোল মাছের কাঁটার মতো বিঁধছে আমাকে।

ট্রেনে এখন মধ্য রাত। দুরন্ত বাচ্চাটি ঘুমিয়ে পড়েছে মা’র কোলে মাথা রেখে। ঘুমিয়ে আছে বাবা, ঘুমিয়ে আছে মা। আধবুড়োটার মাথা ঝুঁকে ঝুঁকে দুলছে এপাশ ওপাশ, টুপিটা খসে পড়েছে মাথা থেকে, টুপির তলায় লুকিয়ে থাকা ডিমের খোসার মত নিটোল তার টাকে লেপ্টে রয়েছে ট্রেনের ঘুমবাতির নীলাভ আলো। হা করে ঘুমুচ্ছে দুই বোনের একজন, আরেক জন একটা গোলাপি চাঁদরে জুবুথুবু হয়ে পড়ে আছে, যেন ঠাণ্ডা শীতের রাতে চুল্লির পাশে গুটিয়ে থাকা আলসে বেড়াল।

“এক্সকিউজ মি, তুমি কি দাবা খেলতে জানো?”

ঘাড়ের কাছে আচমকা এসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে মাঝবয়সী একজন মানুষ। অন্য কোন সময় হলে চমকে উঠতাম, কিন্তু কেন জানি না, ভিয়া রেলের বন্ধ কামরায় খুব স্বাভাবিক মনে হলো এই জিজ্ঞাসা। মাথা নেড়ে বললাম,

“জানি, কেন খেলবে নাকি এক হাত?”

“যদি তোমার আপত্তি না থাকে। কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলাম না। একা একা আর কতো খেলা যায় বলো? ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম কেউ জেগে আছে কিনা। ভাগ্যিস তুমি ঘুমাও নি!”

“আমার নাম আহমেদ। কী নেবে তুমি, সাদা না কালো?”

“পরিচিত হয়ে খুশি হলাম আহমেদ, আমি অ্যালেক্স। সাদা নিলে তোমার আপত্তি নেই তো?”

অ্যালেক্স ওর প্রথম চালটা দিয়েছে, ডি ফোর। সাদা মন্ত্রীর সামনের বোড়েটা দুই ঘর এগিয়ে এসে আমার চালের অপেক্ষায়। অনেকদিন দাবা খেলিনি তাই ভাবনা চিন্তা না করে ওর চালটাকেই অনুসরণ করলাম, ডি ফাইভ। চৌষট্টি খোপের ছকে বাঁধা রণক্ষেত্রে সাদা আর কালো পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
অ্যালেক্স খেলেছে সি ফোর। মুফতে একটা বোড়ে পাওয়াতে খুব আনন্দ হলো আমার।

“আমি ভাবিনি বোড়েটা তুমি খাবে আহমেদ।”

“কেন, কেউ তো ওটাকে রক্ষা করছে না!”

“দাবা কি আর একচালের খেলা? ও আমি সমান সমান করে নেব। এই নাও ই থ্রি।”

আমার বোড়েকে শুঁড় উঁচিয়ে হুমকি দিচ্ছে অ্যালেক্সের হাতি। বি ফাইভ খেলা ছাড়া উপায় দেখছি না কোনো। খেলেই বুঝলাম ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি। সাদা নৌকার সামনের বোড়েটা দুই ঘর এগিয়ে উঠে এসেছে এ ফোরে। না খেলে ও আমাকে খাবে, যদিনা আমি সি সিক্স চালি। দাবা যে একচালের খেলা নয় সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

পরবর্তী এক মিনিটে যেন ঝড় বয়ে গেলো দাবার বোর্ডে। সাত নাম্বার চালে উধাও আমার একটা ঘোড়া। সাদা মন্ত্রী ত্রিশূলে বিঁধেছে আমার নৌকা এবং রাজাকে- চেক।

আর খেলার কোন মানে হয় না। অ্যালেক্স রীতিমতো ওস্তাদ, আর আমি স্রেফ গাইতে গাইতে গায়েন, তাল লয় সুরের কোন ঠিক নেই। হাতিটা দিয়ে চেক রুখতে রুখতে বললাম,

“আমার সাথে খেলে আনন্দ পাবে না তুমি। সাথে ল্যাপটপ নেই? তোমার উচিৎ কম্পিউটারের সাথে খেলা।”

অ্যালেক্সের মুখে একটা মৃদু হাসি। বলল,

“আমি তো জেতার জন্য খেলিনা আহমেদ।”

“তাহলে কী জন্য খেলো, সময় কাটাতে?”

“ঠিক তা নয়। খেলার ভেতর ঢুকে যাবার একটা আনন্দ আছে। ছুঁয়ে না দেখলে সেই আনন্দকে উপভোগ করা যায় না। এই যে তুমি তোমার হাতিটা হাতে ধরে রেখে চিন্তা করছিলে, তার ওজন অনুভব করছিলে তোমার আঙুলে, প্রতি মুহূর্তেই হারিয়ে ফেলবার একটা ভয়, এটা কম্পিউটারের সাথে খেললে পাবে না।”

হাতিটা খোয়া যায় নি। অ্যালেক্স আলগোছে ওর মন্ত্রীটাকে এ সিক্সে সরিয়ে নিয়ে বলল,

“কোথায় যাচ্ছ আহমেদ?”

“আপাতত ভ্যানকুভারে। আর কিছু ঠিক করিনি।”

“আমি যাচ্ছি স্যু লুক আউটে। থান্ডার বে আর উইনিপেগের মাঝামাঝি ছোট্ট একটা শহর। কাল বিকেলেই পৌঁছে যাবো। ভ্যানকুভার পর্যন্ত গেলে খেলাটা তোমাকে শিখিয়ে দিতে পারতাম।”

“কোন টুর্নামেন্ট খেলতে যাচ্ছ নাকি?”

“আরে নাহ, কী যে বলো! পেশাদার খেলোয়াড় এক কালে ছিলাম বটে, সে অনেক আগের কথা। আমি যাচ্ছি গম কিনতে।”

“তোমার গমের ব্যাবসা?”

“ব্যাবসা না, চাকরি। ক্যানেডিয়ান গ্রেইন কর্পের মাঝারি একজন এক্সিকিউটিভ আমি, দেশ জুড়ে ঘুরে ঘুরে গম কেনা আমার কাজ।”

“বাহ, দারুণ চাকরি তো! এই রকম একটা কাজ পেলে মন্দ হতো না। জীবন কেটে যেতো ঘুরে ঘুরে।”

“তুমি এখন কী করছ?”

“এই মুহূর্তে কিছুই না। কী করব তাও জানিনা।”

“কিছু না মনে করলে একটা প্রশ্ন করি?”

“মনে করার কী আছে!”

“লেখা পড়া কদ্দুর করেছ তুমি?”

“মেলা দুর, মানে প্রায় যত দুর করা যায় আর কি। ছ’মাস সময় পেলে পি এইচ ডি টা শেষ করে ফেলতে পারতাম।”

“বল কি! কোন বিষয়ে?”

“অর্থনীতি।”

“শেষ করোনি কেন?”

“সে অনেক কাহিনী, বাদ দাও। গম কিনে কী করবে?”

“হা হা হা, কী আর? বিক্রি করবো। অবশ্য ক্যানাডায় না, আমাদের রপ্তানির ব্যাবসা।”

“কোথায় কোথায় যায় তোমাদের গম?”

“সারা দুনিয়ায়। গমের সাথে দাবার একটা খুব মজার সম্পর্ক আছে, জানো?”
“জানি না তো! কী সম্পর্ক?”

“সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। ইন্ডিয়াতে খুব জ্ঞানী একজন মানুষ ছিলেন, রাজার উপদেষ্টা তিনি। একবার কোন এক কারণে রাজা খুশি হয়ে তাঁকে বললেন, ‘তুমি যা চাইবে তাই পাবে। বল কী চাও?’ জ্ঞানী মানুষটা খুব সামান্য একটা ইচ্ছার কথা বললেন।”

“কী ইচ্ছা?”

“বললেন, ‘খুব বেশি কিছু চাইনা সম্রাট। আপনি কেবল আমার দাবার বোর্ডটা গম দিয়ে ভরে দেবেন।’ রাজা হেসে দিয়ে বললেন, ‘যত বুদ্ধিমান তোমাকে ভাবি, ততটা নও দেখছি। যাও নিয়ে এসো তোমার দাবা’। মানুষটা বিনয়ী গলায় বললেন, ‘দাবার বোর্ডটা ভরার একটা নিয়ম রয়েছে’। রাজা জানতে চাইলেন কী নিয়ম। মানুষটা বললেন, ‘প্রথম ছকে দেবেন একটা গমের দানা। পরেরটায় তার দ্বিগুণ, তার পরেরটাতে তারও দ্বিগুণ, এইভাবে প্রতিবার আগেরবারের চেয়ে দ্বিগুণ করে পুরো বোর্ডটা ভরে দিতে হবে।’ সম্রাট অবাক হলেন। লোক পাঠালেন গম নিয়ে আসতে।”

“তার পর?”

“তুমি না অর্থনীতির ছাত্র! ওই বোর্ড ভরে দেওয়ার মতো এতো গম কি আছে পৃথিবীতে?”

“নেই!”

“না নেই। গম তো নেইই, এমনকি অত গম রাখার জায়গাও নেই। একটার পর একটা গম সাজিয়ে লাইন তৈরি করলে সে লাইন আলফা সেঞ্চুরি পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তাও ফুরোবে না।”

“বল কি!”

“দাবা জিনসটা খুব মজার। মাত্র চৌষট্টিটা ঘর অথচ সীমাহীন চাল, অনেকটা আমাদের জীবনের মতো। সীমিত জীবনে কী অসীম সম্ভাবনা নিয়েই না দিন কাটাই আমরা!”

“সে তোমার খেলায়। আমি তো কোন সম্ভাবনাই দেখতে পাই না অ্যালেক্স।”

“কারণ সঠিক চালটা চালছো না তুমি। এই খেলাটার কথাই ধর না। আমি যা খেলেছি তার নাম ‘কুইন্স পণ গ্যাম্বিট’। দাবাড়ুদের খুব পছন্দের ওপেনিং এটা। তোমার পাল্টা চালগুলো ভুল ছিল, তাই দ্রুতই ফুরিয়ে গিয়েছে তোমার সম্ভাবনা।”

“তোমার বিশ্লেষণের সাথে আমি একমত নই অ্যালেক্স।”

“তাই নাকি?”

“তাই। দাবা খেলার নিয়ম আমি জানি না। নিয়ম না জেনে খেলতে শুরু করাটা ভুল হতে পারে। কিন্তু খেলা শুরুর পর চালগুলো আমি ভেবে চিন্তেই দিয়েছি। ওগুলো ভুল নয়, সিদ্ধান্ত মাত্র। ফলাফল আমার পক্ষে আসেনি, এইই যা। ওপাশে আমার চেয়ে দুর্বল কেউ থাকলে হয়তো জিতেই যেতাম। জীবন তোমার দাবার ছক নয়, এই জীবনটা আমি নিজের ইচ্ছেয় বেছে নিইনি। নিয়মগুলোও আমার অজানা। সম্ভাবনার হিসেব করি কী করে বলো?”

অ্যালেক্সের ভিজিটিং কার্ডটা তিনপাতার, ভাঁজে ভাঁজে গুটিয়ে রাখা। এ জিনিস আগে কখনও দেখিনি আমি। ভাঁজ খুলে কার্ডটা উল্টাতেই চোখে পড়লো একটা বন্দরের ছবি, ভ্যানকুভারের আ'ড্যু হারবার। সেখানে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরনো দিনের একটি পালতোলা জাহাজ। তারপর সমুদ্র, সমুদ্রের ওপারে পুরো পৃথিবী। জাহাজ থেকে লাল রঙের অজস্র রেখা চলে গিয়েছে পৃথিবীর নানান প্রান্তে। একটা গিয়ে মিশেছে মোম্বাসা বন্দরে। পাঁচ সমুদ্র আর দুই মহাসমুদ্রের ওপারে দাঁড়িয়ে মোম্বাসা, কেনিয়ার মোম্বাসা। ক্যানাডা থেকে সাড়ে আট হাজার নটিকাল মাইল দূরে। আমার বুকের রক্ত ছলকে উঠলো। হাত থেকে কার্ডটা নামিয়ে রেখে বললাম,

“অ্যালেক্স, তুমি কি কখনও কেনিয়ায় গিয়েছো?”

“গিয়েছি কয়েকবার, কেন?”

“কতদিন লাগে যেতে?”

“দিন বলছ কেন! ডিরেক্ট ফ্লাইট নিলে বড়জোর ষোল ঘণ্টার পথ।”

“আমি জানতে চাইছিলাম তোমাদের জাহাজে কতদিন লাগে।”

“আমাদের তো মালটানা জাহাজ, এ বন্দর সে বন্দর ঘুরে মোম্বাসা পৌছুতে অনেকদিন লেগে যায়, এই ধর মাস দেড়েক।”

“সমুদ্রে থাকতে হয় কতদিন?”

“পঁয়ত্রিশ দিনের মতো, যেতে চাও নাকি? ক্রুজ শিপে অল্প সময় লাগে। অবশ্য ভাড়া অনেক বেশি।”

“ভাবছিলাম তোমাদের জাহাজে একটা কাজ জুটে গেলে মন্দ হয় না, আফ্রিকাটা দেখা হয়নি।”

“এর আগে সমুদ্রে গিয়েছো কখনও?”

“না যাইনি। খুব কি মুশকিলের?”

“প্রথম প্রথম কয়েকদিন খারাপ লাগে, তারপর সয়ে যায়। কিন্তু সে কথা বলছি না। তোমার যা বিদ্যা এবং অভিজ্ঞতা তার কোনটাই জাহাজে চাকরির জন্য উপযোগী নয়। কী চাকরি দেবো তোমাকে!”

“জাহাজের কিছু জানিনা সত্যি, কিন্তু ধোয়াপাল্লা, মালামাল টানা, ফুটফরমাস খাটা, এইধরনের কাজ তো পারবো।”

অ্যালেক্স অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়, বোঝার চেষ্টা করে আমি রসিকতা করছি কিনা।

“আমি কিন্তু সিরিয়াস অ্যালেক্স, ঠাট্টা করছি না।”

“তাই তো মনে হচ্ছে। দেখি কী করতে পারি। ক’টা দিন সময় দাও। ভ্যানকুভার পৌঁছে আমাকে একটা ফোন দিও।”

“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার কোন ধারণাই নেই কতোটা কৃতজ্ঞ বোধ করছি আমি।”

“চাকরি পেলে তবে না কৃতজ্ঞ হবে! ওসব পরে ভেবো, এখন ঘুমাও। আমিও চলি, না ঘুমালে কালকে আর দাঁড়াতে পারবো না।”

কিসের ঘুম! বিদায় নিয়ে অ্যালেক্স চলে যাবার পর আমার মাথায় জাঁকিয়ে বসেছে আফ্রিকা। অনেকদিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম, বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়। গল্পের নায়ক এক তুখোড় যুবক। তার নাম শঙ্কর। আর দশটা বাঙালির মতো নয়, সে দক্ষ সাঁতারু, দুরন্ত খেলোয়াড়, তার বুক ভরা সাহস। আমি এর কোনটিই নই। তবু কেন যেন নিজেকে শঙ্কর ভাবতে ইচ্ছে করছে খুব।

জানালার বাইরে আকাশ ভরা অন্ধকার। আমি যেন অন্ধকারের আড়াল ভেদ করে দেখতে পাচ্ছি ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে হাতির দল, কাছেই দাঁড়িয়ে একটি সিংহ, টেনে ধরা ধনুকের ছিলার মতো টান টান তার পেশল দেহ, কিছুটা দূরে জলায় পানি খেতে নেমেছে ল্যাকপ্যাকে ঠ্যাঙের একটি জিরাফ ছানা। বনের ভেতরে দিরিম দিরিম ঢাকের শব্দ, আমি জানি ওটা ঢাক নয়, ওখানে গরিলারা থাকে। হাতের মুঠো দিয়ে বুকে আঘাত করে শত্রুকে হুশিয়ার করে দিচ্ছে তারা।

আমি আফ্রিকায় যাচ্ছি। আমি সেই দেশে যাচ্ছি, যেখানে কিলিমাঞ্জারোর ঢালে গভীর জঙ্গলে হীরের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে হলুদ একটা নদীর বাঁকে শঙ্কর একদিন মুখোমুখি হয়েছিলো ভয়ংকর এক প্রাণীর। সিংহের চেয়ে হিংস্র, হাতির চেয়ে শক্তিশালী আর ব্ল্যাক মাম্বার চেয়েও ক্ষিপ্র সে প্রাণীর নাম বুনিপ।

“বুনিপ বলে কিছু নেই আহমেদ। ওসব মানুষের বানিয়ে বানিয়ে বলা।”

হামফ্রে এসেছে। নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি!

প্রথম কিস্তির লিংকঃ
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56101


মন্তব্য

বড়বাঘা এর ছবি

অনেক দিন পর ভালো একটা পোস্ট পড়লাম। বেশী অপেক্ষায় রাখবেন না, প্লিজ। আগেরটা পড়া হইনি। এক্ষনি পড়ে ফেলবো। ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ বড়বাঘা। আশা করছি লিখতে লিখতে আটকে যাবো না।

---মোখলেস হোসেন

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আপনার এই লেখাটা ভালো লাগা শুরু করেছে। একসময় দাবা খেলার এই ঘরগুলো পড়া শিখেছিলাম। তখন, আগি আর আমার এক স‌হপাঠী পেপারে পড়া চাল রিকনস্ট্রাক্ট করার চেষ্টা করতাম। (এক সময় খেলার পাতায় গ্যারি ক‌্যাসপারভ/আনান্দ -এঁদের খেলার চাল ছাপা হতো!)

পরের কিস্তি শীগগীর আসুক।

আর মোখলেস ভাইকে হাচল করা দাবী পুনর্ব্যাক্ত করে গেলাম।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ। আপনার দাবীর প্রতি আমার সমর্থন রইলো।

---মোখলেস হোসেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

দুরদুরু বুকে পড়তে বসলাম, পড়েই ফেললাম। পৃথিবীর সব কিছুই যে অনিশ্চিত এটাতো আপনার ভুক্তভোগী পাঠক ছাড়া আর কেউই ভালো জানেনা। পাগলকে সাঁকো নাড়ানোর কথা মনেও করিয়ে দেবোনা। দেখি কয় কিস্তি লেখা এবার পাওয়া যায়। অনুভবের প্রকাশ একেবারে শেষ কিস্তির আগে ঘটবেনা, মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলাম। হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

সদ্য কলেজে পা দেয়া ছাত্রের মতো অবস্থা আমার। এক সাথে অনেক প্রেম, অনেক গল্প। একদিন এই গল্পটা ভাবাচ্ছে তো আরেকদিন মেতে আছি অন্যটা নিয়ে। কোনটিই পূর্ণতা পাচ্ছে না।

---মোখলেস হোসেন।

হাতুড়ি এর ছবি

অসাধারন মোখলেস ভাই-- পরের কিস্তির অপেক্ষায় থাকলাম। তবে কেন জানি প্রথম পর্বটার গন্ধ এটাতে পেলাম না। কী জানি, সেটা হয়তো আমার ব্যর্থতা।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাতুড়ি। দ্বিতীয় পর্বের খণ্ডিত অংশ এটি। ঠিক করেছি কিস্তি গুলো ছোটো রাখবো। মাকেটিং স্ট্রাটেজি বলতে পারেন, হা হা হা। লেখা বেশি বড় হয়ে গেলে লোকে পড়তে চায় না।

---মোখলেস হোসেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।