প্রজেক্ট আইবেক (দুই)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৬/০৫/২০১৮ - ৫:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের কথা

(.........................আমাদের শেখানো হচ্ছে কী করে বেঁচে থাকতে হয়। আপাতত শিখছি সংগ্রহ এবং বিনিময়, তারপর শিখবো উৎপাদন।

দু ধরনের নারকেল গাছ রয়েছে সমুদ্র তীরে, সবুজ আর লাল। যেকোনো নারকেল গাছে চড়তে পারি আমি, কেবল একটাই শর্ত। নিজে যে রঙেরটা সংগ্রহ করবো সে রঙেরটা রাখতে পারবো না। অন্য কারও নারকেলের সাথে বদলে নিতে হবে। নারকেল বিনিময়ের জন্য আলটপকায় একটা নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে, পূবের পাহাড় থেকে অনেকটা পথ দৌড়ে যেতে হয় সেখানে। আমরা সারাদিন দৌড়াই। ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে যাই নারকেল বনে, নারকেল হাতে দৌড়ে যাই বিনিময়ের জায়গায়, সেই নারকেল কুঁড়েতে রেখে আবার নারকেল বনে, আবার বিনিময়, আবার কুঁড়ে……এই চলে দুপুর অবধি। ব্যাপারটা সহজ নয় মোটেই। হয়তো আমি পেড়েছি সবুজ নারকেল, আমার তাই প্রয়োজন লাল। কিন্তু বিনিময় কেন্দ্রে পৌছুতে পৌছুতে সব লাল শেষ। হাতের সবুজ নারকেল তখন জমা হয়ে যায় আলটপকায়। আমার মাথায় একদিন একটা বুদ্ধি এলো।)

নারকেল হাতে এতোটা পথ দৌড়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়, বিশেষ করে বেলা যখন বাড়তে থাকে। পূবের পাহাড় থেকে আরও খানিকটা পূবে একটা ছোট্ট ঝর্ণামতো রয়েছে, তারই ধারে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেই আমরা। সেদিন দুহাতে দুটি দুটি চারটি লাল নারকেল নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঝর্ণার ধারে পৌঁছুতেই দেখি ভীষণ শোরগোল। একজনকে জিগ্যেস করে জানতে পারলাম নারকেল নামিয়ে রেখে ঝর্ণায় নেমেছিলো শান্তনু। ফিরে এসে দেখে সব উধাও। বেশিক্ষণ খুঁজতে হয়নি, মাথার উপরে কিচকিচ শব্দ শুনে তাকাতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। কোত্থেকে একদল বানর এসে জুটেছে এখানে, নারকেলগুলো ওদেরই কব্জায়।

কিছুক্ষণ খিস্তি টিস্তি করে শান্তনু আবার ফিরে গেলো নারকেল বনে। আমিও হাঁটছিলাম আলটপকার পথে। মাথার উপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সূর্য, যেতে হবে আরও অনেকদূর। পেছন ফিরে তাকালাম একবার। চারজনের একটা দল নেমেছে ঝর্ণার জলে। নারকেলগুলো সার বেঁধে তীরে রাখা। কী হয় দুটো তুলে নিলে! বানরগুলো আমার চোখ খুলে দিয়েছে।

সেই আমার প্রথম। পুবের পাহাড়ের একটা কোনে গর্ত খুঁড়ে পাথর চাপা দিয়ে ফিরে গেলাম আলটপকায়। সেদিন থেকে আমার দুটো জীবন। দিনের বেলায় আর দশজনের মতো ছুটে ছুটে সংগ্রহ আর বিনিময়, রাতের আঁধারে সবাই ঘুমিয়ে গেলে পা টিপে টিপে ফিরে আসা পুবের পাহাড়ে। এখন কেবল নারকেলই নয়, যখন যেটা মনে ধরে, এনে রেখে দেই আমার তমসায়। গর্তটার নাম দিয়েছি তমসা, এখন আর ছোট্ট গর্তটি নেই সে, একটা মানুষ এঁটে যায় এমনই বড়। অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে চোখের জ্যোতিও যেন বেড়েছে আমার।

তমসায় বসে থাকতে বেশ লাগতো। কত কিছু সংগ্রহে আমার! একুশটা টুপি, তেরোটা জামা…………একশ তিরিশটা ঝিনুকের খোলা, আর নারকেল তো আছেই। কেউ টের পায়নি, কোনকিছু খোয়া গেলে সবাই ভাবতো বানরদের কাজ। খানিকক্ষণ শাপ শাপান্ত করে ক্ষান্ত দিতো।

বিপদে পড়লাম প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে যাবার পর। নারকেল পর্ব শেষ করে আমরা তখন রাই নিয়ে পড়েছি। কিন্তু শস্যক্ষেতে এতো মানুষ যে কোনকিছু সরাবার উপায় নেই।

কুঁড়েঘরগুলোতে যাওয়া বোকামি। একেতো সেখানে ঠাসাঠাসি মানুষ, তাছাড়া নেবার মতো কিছু থাকলে তো! যেতে হলে যাবো আলটপকায়। সেখানে রাত্তিরে লোকজন তেমন নেই, শুনেছি জনাদশেক বুড়োবুড়ি থাকে কেবল।

এক রাতে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লাম আমার কুঁড়ে থেকে। হেঁটে যেতে যেতে চোখে পড়লো শান্তনুর ঘরটা। পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাবার সময় কানে এলো শিস কাটা একটা শব্দ, সমুদ্রের বাতাস যখন নারকেল বন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় তেমনি আওয়াজ। আমার খুব চেনা, তবে শুনিনি অনেক দিন। তামারা নাক ডাকছে। শালা শান্তনু!

আলটপকার দেয়ালটা খাড়া উঠে গেলেও ফাঁকে ফোঁকরে একটা দুটা পাথরের চাঁই বেরিয়ে রয়েছে কাদার প্রলেপ ভেদ করে। বালিতে হাত ঘষে নিয়ে উঠে পড়লাম, তরতর করে চলেছি গিরগিটির মতো। নারকেল পেড়ে পেড়ে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে আমার।

দেয়ালের উপরে পৌঁছে খুব ভয় ভয় লাগছিলো। এতোদিন অন্ধকারকে অনুভব করেছি ডানে-বামে-সামনে-পেছনে। মেঘলা রাতে আকাশেও। কিন্তু পায়ের তলায় এমন ছোপ ছোপ আঁধার জমে থাকতে দেখিনি কোনোদিন। চোখের সামনে আকাশ ঢেকে দাঁড়িয়ে আলটপকা, প্রথম তলায় যা রয়েছে তার কণামাত্র নেই আমার তমসায়। ভাবতে ভাবতে শরীর গরম হয়ে গেলো। যেমন উঠেছিলাম দেয়াল বেয়ে তেমনি নিঃশব্দে নেমে গেলাম নিচের দিকে।

প্রদর্শন কক্ষ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে পুরনো পৃথিবীর ঐশ্বর্য। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও আমার চোখ ঠিক ঠিক অনুভব করছে সেইসব অবয়ব। এখানে বারবার ফিরে আসতে রাজি আমি। তবে এই মুহূর্তে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে যেতে হবে। কোন ভাবনা চিন্তা না করেই সহজে বইতে পারবো এমন একটা জিনিস তুলে নিলাম।

তমসা অবধি আর পেছন ফিরে তাকাইনি, উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটেছি কেবল। জিনিসটা রেখে ভালোয় ভালোয় আমার কুঁড়েতে ফিরতে পারলে বাঁচি। কী এনেছি সে কাল দেখা যাবে।

কাল কি আর অতো সহজে আসে! সারা দিন কেটে গেলো রাই শস্যের ক্ষেতে। ঘরে ফিরে রাইয়ের রুটি খেলাম মধু ভিজিয়ে। আমরা এখন মৌমাছি পুষতে শিখে গিয়েছি।

অন্ধকার নামতে এখনো অনেক দেরি। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। ঘুম ভাঙলো একটা বিকট শব্দে। হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়েই দেখি একদিকের আকাশ রাঙা হয়ে আছে তীব্র আলোর ছটায়, আরেকদিকে অন্ধকার। আগুন লেগেছে!

কিন্তু কেমন করে লাগলো? আগুন জ্বালানোর রসদ তো সব জমা থাকে আলটপকায়। আমরা গুনে গুনে আনি, কাজ সেরে গুনে গুনে ফেরত দিয়ে আসি। তবে কি…

এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়। ক্ষিপ্র গতিতে দৌড়ে চলে এলাম পুবের পাহাড়ে। দূর থেকেই চোখে পড়লো তমসা যেন জ্বলছে। তবে গনগনে নয়, খুব নরম আর নীলাভ-সাদা একটা আলো। ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখি সেই জিনিসটা। কাল রাতে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারিনি, স্বচ্ছ একটা ঘনক। তার উপরটায় কালো একটা আবরণ, সেখানে সোনালি সোনালি দাগ টানা। কিন্তু এ আলো নেভাই কেমন করে? তমসার খোঁজ কেউ পেলে আর রক্ষে নেই। শেষটায় টুপিগুলোর তলায় চাপা দিলাম ওটাকে। বাইরে এখনো শোরগোল চলছে বুঝতে পারছি। আজ আর ফিরে গিয়ে কাজ নেই।

মনটা আঁকুপাঁকু করছে টুপিগুলো সরিয়ে আরেকবার আলোটা দেখি। একটা সময় ধৈর্যহারা হয়ে হাত বাড়াতেই পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,

“তোমার জায়গায় আমি হলে এই ভুল করতাম না।”

চমকে উঠে তমসার এক কোনে গড়িয়ে গেলাম। দুই হাতে দুটো ঝিনুকের খোলা নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,

“খবরদার! কাছে আসলেই নারকেলের শাঁসের মতো ফালাফালা করে চিরে ফেলবো।”

লোকটা এক পা এগিয়ে এসে অবলীলায় আমার হাত থেকে ঝিনুক দুটো নিয়ে বললো,

“নারকেল আর মানুষ কি একজিনিস হে? শান্ত হয়ে একটু বসো। আমি তোমার ক্ষতি করতে আসিনি। আমার নাম মংপু।”

মংপু! ইনিই সেই মহামতি মংপু! আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কী বলবো। বোকার মতো জিগ্যেস করলাম,

“টুপির নিচে ওই যে জ্বলছে, ওটা কিসের আলো?”

বৃদ্ধ হাসলেন একটুখানি, প্রশ্রয়ের হাসি। তারপর বললেন,

“ওটাকে বলে সৌরবাতি। তুমি ঠিক বুঝবেনা তবুও বলি। এই গুহার ছাঁদের দিকে একটা ছোট্ট খোলা জায়গা আছে, তাইনা? সেখান দিয়ে ভোরের আলো এসে ওটাকে জাগিয়ে তুলেছে। এখন সেকথা থাক। তুমি এটা কোথায় পেলে?”

ভাবলাম মিথ্যে করে বলি, কুড়িয়ে পেয়েছি। কিন্তু কেন যেন পারলাম না। বললাম,

“কাল রাতে আলটপকা থেকে তুলে এনেছি।”

শুনেই বৃদ্ধ বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন। মাথাটা তাঁর ঠুকরে গেলো তমসার ছাঁদে। হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বললেন,

“তু-তু-তুমি চোর!”

আমি প্রশ্নটা ঠিক বুঝিনি। বললাম,

“চোর কী?”

মহামতি মংপু মৃদু হেঁসে বললেন,

“বলবো, সব বলবো তোমাকে। আগে এখান থেকে বের হবার একটা পথ করা দরকার। কেবল জেনে রাখো, অনেকদিন ধরেই একজন চোর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম আমরা। আর কী আশ্চর্য! ঠিক সেদিনই তোমাকে পেলাম, যেদিন মুজতবার লোকেরা আমাদের তল্লাটে হামলে পড়েছে।”

---চলবেই

প্রথম পর্বের লিংক

http://www.sachalayatan.com/guest_writer/57088


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

তারপর !!!! পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

তারপর অনেক কিছু। সময় পেলেই আবার...

---মোখলেস হোসেন

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনার প্রথম পর্বটা পরে পড়বো বলে রেখে দিয়েছিলাম। এই পর্ব দেখে মনে পড়লো। ওটা পড়ে এসে এটা ধরবো

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

সকালটাই ভালো করে দিলেন। অনেক ধন্যবাদ।

---মোখলেস হোসেন

মেঘলা মানুষ এর ছবি

পড়তে মজা লাগলো, পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ। আশা করি প্রথম পর্বটিও পড়েছেন।

---মোখলেস হোসেন

এক লহমা এর ছবি

মনের সুখে লিখতে থাকুন। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

এক লহমা এর ছবি

আচ্ছা, আপনের এখন কয়টা ধারাবাহিক চালু আছে? একদম নির্দোষ প্রশ্ন কিন্তু! দেঁতো হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

গুনে দেখলাম সচলে আছে চারটা, আর আমার কম্পিউটারে আছে তিনটা। এর বাইরে এগারোটা প্লট এক দুই প্যারা করে স্কেচ করে রেখেছি। ওই যে আপনি বললেন না, 'মনের সুখে লিখুন, যখন যা মনে আসে লিখে ফেলি। কোন তাড়া তো নেই! একটা অপরাধবোধ অবশ্য কাজ করে। মাফসাফ করে দিয়েন।

---মোখলেস হোসেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

প্রজেক্ট আইবেক এর তিন নম্বর কিস্তির সময় হয়ে গেলো কিন্তু- হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

অর্ধেকটা লিখতে লিখতেই মাথার ভেতর একটা গল্প ঢুকে গেলো। কাল জমা দিয়েছি সচলে। প্রকাশিত হলে যে কয়দিন নীড়পাতায় থাকবে সে কয়দিন প্রজেক্ট আইবেক নিয়ে থাকবো।

---মোখলেস হোসেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।