রেনুর পুতুল: পর্ব ৩

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৪/০৯/২০১৮ - ৫:৩২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রেনুর পুতুল

[ধারাবাহিক উপন্যাস]
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর

[পর্ব ১]
[পর্ব ২]

৩.
প্রথমে তারা ভেবেছিলো নরসিংদী যেহেতু ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়, দিনে গিয়ে খুঁজে টুজে দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। কিন্তু অজানা অচেনা একটা জায়গায়, কতক্ষণ লাগে না লাগে কে জানে? তাই সাদিয়া একেবারে তাবু ইত্যাদিসহ কয়েকদিনের প্রস্তুতিই নিয়ে ফেললো। জয়া যদিও একটু দোনোমোনো করছিলো, রাতে কোথায় থাকবে বা শৌচাগার ভালো হবে কি না এসব নিয়ে। কিন্তু সাদিয়া এগুলোকে থোড়াই পরোয়া করলে তো!

এই নগর সভ্যতায় দু’জন কিশোরী মেয়ের একা একা কোথাও যাওয়ার কথা শুনলে বাবা মায়েরা আঁতকে উঠবেন স্বাভাবিক। জয়ার ব্যাপারটাও সহজ ছিলো না তেমন। কিন্তু সাদিয়া এই বয়সেই নিজেকে এমন একটা ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে যে সবাই এমনকি বড়দের চেয়েও সাদিয়ার ওপর বেশি ভরসা করতে পারে। তাই সাদিয়া যখন আদনানকে বললো নানান কারনে জয়ার একটু মন খারাপ, সে জয়াকে একটা ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চায়। ক্যাম্পে গেলে মজা পাবে। শুনে আদনান তো সঙ্গে সঙ্গেই রাজি। কিন্তু বাদ সাধলো সোমা। কিসের ক্যাম্প, কোথাকার ক্যাম্প, আর কে কে যাবে ইত্যাদি হাজার প্রশ্ন শুরু হলো। যেই সাদিয়া বললো স্বাধীন ক্যাম্প, মানে তারা একটা তাবু নিয়ে যাবে একটা গ্রামে, তারপর সেখানে ক্যাম্প করবে, শুনে তো সোমা কিছুতেই রাজী হয় না। আদনানও এবার গড়রাজি।

সাদিয়ার তখন বাধ্য হয়ে মিথ্যে বলতে হলো যে তারা যাবে নরসিংদির একটা গ্রামে। সেখানে একটা স্কুল আছে, সেই স্কুলের এখন যে স্কাউট লিডার তিনি আগে সাদিয়াদের স্কুলে ছিলেন। সেই স্কুলে একটা ক্যাম্প হচ্ছে, সাদিয়া যাবে সেই ক্যাম্পে। সঙ্গে জয়াকে নিয়ে যেতে চায়। কোনো ভয় নেই, স্কুলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।

এবার আদনান রাজী হলো, সোমাকেও রাজী করালো। পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে সাদিয়া দেখেছে গুরুজনেরা সত্যটাকে খুব ভয় পায়, একটু আধটু মিথ্যে মিশিয়ে দিলেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। যদিও সে জানে মিথ্যে বলা মহাপাপ, কিন্তু সাদিয়া জানে সে কখনো অন্যায় মিথ্যে বলে না। কিছু মিথ্যে আছে যা কারো কোনো ক্ষতি করে না, উল্টো অনেক ভালো কিছু হয়। যেমন একবার সাদিয়ার মা আর বাবার মধ্যে তুমুল ঝগড়া। তিনদিন ধরে কথাকথি বন্ধ। মুখ দেখাদেখিও। সাদিয়ার বাবা বাইরে হোটেল থেকে খেয়ে আসে, খাবার কিনে নিয়ে এসে খায়। ঘুমায় বসার ঘরের আরাম কেদারায়। মহা মুশকিল রে বাবা। সাদিয়া তখন করলো কী? রাস্তা থেকে একটা গোলাপ আর দোকান থেকে একটা ’স্যরি’ লেখা কার্ড কিনে চুপ করে মায়ের বালিশের তলায় রেখে দিলো। সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে বাবা তো অবাক, দেখে বাড়িতে তার জন্য হুলুস্থুল আয়োজন। মা সেজেগুজে বসে আছে, ঘরে মোম জ্বলছে, ফুল ফুটে আছে, বিশেষ রান্না হয়েছে... বিশাল ব্যাপার স্যাপার। সাদিয়া বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিলো, বাবাও আর উচ্চবাচ্য করলো না। অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো। এরকম নির্দোষ মিথ্যে বা ছলনায় সাদিয়া বরঞ্চ আনন্দই পায়।

তো মোটকথা হলো জয়ার যাওয়ার অনুমতি মিলেছে। সাদিয়ার অনুমতির জন্য কোনো কষ্টই করতে হয়নি। এমনিতেই ডিসেম্বর মাসে এখানে ওখানে তার এতো ক্যাম্প থাকে যে এখন আর বাবা মা জিজ্ঞেসও করে না কোথায় যাচ্ছে। পিঠব্যাগ আর অস্থায়ী তাবুটা নিয়ে বের হয়ে গেলেই হলো।

সকালে যখন আদনান জয়াকে সাদিয়ার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেলো জয়ার লটবহর দেখে সাদিয়া হেসে খুন। পারলে পুরো বাড়ি ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছে। শীতের জামা কাপড় থেকে শুরু করে কম্বল চাদর বালিশ। আর শুকনো খাবার যা এনেছে তা দিয়ে এক মাঠ ভর্তি দর্শক একবেলা খেয়ে উঠতে পারবে। সাদিয়ার হাসি দেখে জয়া কাঁদো কাঁদো বললো ’ধুরো, আমি কি এতোকিছু আনতে চেয়েছি নাকি? মা-ই তো...’

অবশেষে ব্যাগ থেকে সব বের করে তিনভাগের দুইভাগ জিনিস সাদিয়ার ঘরে স্তুপ করে রেখে তারা যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। আর অমনি তারা দেখে নৈঋতবাবু তার ছোট্ট ব্যাগ গুছিয়ে রেডি! অবাক কান্ড! জিজ্ঞেস করতেই নৈঋত গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো ’আমি যদি না যাই তাহলে তোমাদের যখন ভূতে ধরবে তখন সেই ভূতের ঘাড়টা কে মটকে দেবে?’ তখন সাদিয়া আর জয়া অবাক হয়ে বললো ’হুমম... তাই তো!’ তখন নৈঋত ততোধিক গম্ভীর কণ্ঠে বললো ’তোমরা যে আমাকে ছাড়াই রওনা হলে, তাহলে তোমাদেরকে যখন সাপে কামড়াতে আসবে, তাকে উল্টো কামড়টা কে দেবে?’
এরকম মোক্ষম যুক্তির পরে আর কোনো কথা চলে না। নৈঋতকে নিয়ে যাওয়ারই সাব্যস্ত হলো। বাবা মা-ও সমস্যা হলো না। সাদিয়ার ডাকুপনায় বাবা মা এতোই অভ্যস্ত যে ন্যাকাবোকা পোলাপান দেখলে বরঞ্চ তারা বিরক্ত হয়। নৈঋতটা এরকম গোবেচারার মতো বড় হচ্ছে দেখে তারা একটু অস্বস্তিতেই ছিলো। তাই যখন শুনলো সাদিয়া ক্যাম্পে নৈঋতকেও নিয়ে যেতে চাইছে তখন তারা সানন্দেই রাজী হয়ে গেলো।

তারা তিনজনে যখন বাড়ি থেকে বের হলো, জয়ার পিঠে ব্যাগ, বুকে ধরে আছে সেই বইটি। যেন রেনুকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আর চোখে স্বপ্ন। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে জয়া একবার বিড়বিড় করে বললো ’রেনু, তোমাকে পুতুলটা আমরা খুঁজে দেবোই দেবো, দেখে নিয়ো’। সাদিয়া মাথায় চাটি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ’কী ভাবিস? ভয় করছে?’ জয়া বললো ’না আপু, ভীষণ ভালো লাগছে, ভীষণ!’

রাস্তার মোড়ে আসতেই সাদিয়া খেয়াল করলো কেউ একজন তাদেরকে ফলো করছে। কিন্তু কে তা বুঝতে পারলো না। সে পেছনে তাকাতেই কেউ একজন চট করে আড়ালে সটকে পড়ছে। ব্যাপারটা সাদিয়াকে কিছুটা টেনশনে ফেলে দিলো। কারন রাস্তাঘাটে একে ঠেঙ্গিয়ে ওকে মেরে সাদিয়ার কম শত্রু জোটেনি। এমনিতে সে এগুলোকে ভয় পায় না তেমন, কিন্তু আজ সঙ্গে জয়া আর নৈঋত আছে। তাই একটু ভয় হচ্ছে। আর তখন অবাক বিস্ময়ে সে আবিষ্কার করলো, নিজেকে এখন তার কেমন অভিভাবক অভিভাবক মনে হচ্ছে। মা গো... সে যে কখনো অভিভাবকদের মতো পানসে হতে চায় না! যদিও জয়া আর নৈঋতকে কিছু বললো না। বললে যদি ভয় পেয়ে যায়? তাই সে তক্কে তক্কে থাকলো অনুসরণকারীকে হাতে নাতে ধরতে। আর দু’হাতে জয়া এবং নৈঋতকে ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো দারুণ এক অ্যাডভেঞ্চারের দিকে।

[চলবে]


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

পর্ব ৩, এক ও দুই এর থেকে অনেক সাবলীল, স্বচ্ছন্ন গতি পেয়েছে। বাক্যের পর গোছানো বাক্য গুলো যখন আর মুখের মনে আটকে থাকেনা, মনের চোখে এসেও জায়গা করে নেয়, তখন আর চিন্তা কি। দেখা যাক কি হয়। মনে হচ্ছে বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে।

--- জে এফ নুশান

এক লহমা এর ছবি

উপরে "জে এফ নুশান"- এর মন্তব্যের সাথে সহমত। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আয়নামতি এর ছবি

ও নিধি গল্প তো বেশ জমে ওঠেছে! পরের পর্ব আসুক জলদি। অনেক শুভকামনা হাসি

সোহেল ইমাম এর ছবি

ভাবছিলাম, রেনুর পুতুলের পরবর্তী পর্বটা কবে আসবে। এসে গেলো তাহলে। চলুক লেখা।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।