হার্ড ইমিউনিটি – আশঙ্কার নীতি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৬/০৫/২০২০ - ৪:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে বেশকিছু কথাবার্তা হচ্ছে – এবং এর অধিকাংশই অত্যন্ত আশঙ্কাজনক, সেই সাথে হতাশাজনক তো বটেই। হার্ড ইমিউনিটির পক্ষের যে যুক্তিগুলো সেগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এখানে অর্থনীতি, বাণিজ্য, সমাজ ব্যবস্থা, মানুষের বিহেভারিয়াল ব্যাপর গুলি আলোচিত হলেও, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপারটিই কিন্তু একেবারে পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে । আর সেটা হচ্ছে ‘জীবন’ । এবং এটি কেবল হতাশার কথা তাই নয়, এর চেয়ে বড় উব্দেগের আর কিছু এই মুহুর্তে হতে পারে না ।
আমাদের দেশে মানুষের সঙ্খ্যাটা অনেক বেশি বলেই কি তাদের জীবন এত মূল্যহীন ?

হার্ড ইমিউনিটির কার্যকারিতার ব্যখ্যায় যাবার আগে এটি কীভাবে কাজ করে তা সংক্ষেপে বলা যাক । কোন একটি অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ যখন একটি ভাইরাসের প্রতি ইমিউন বা প্রতিরোধী হয়ে ওঠে তখন বলা যায় যে ঐ বিশেষ জনপদটি সামষ্টিকভাবে ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা অর্জন করেছে । এবং তখন কোন একজন ব্যক্তি যদি আক্রান্ত হয়, তবে সে যাদের সংস্পর্শে আসে তাদের অধিকাংশই যেহেতু আগে থেকি ইমিউন তাই, রোগটি আর খুব বেশি মানুষকে সঙ্ক্রমণ করতে পারে না ।

সাধারনত একটি দেশের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ যখন সংক্রমিত হয়ে যায় তখন দেশটি Herd Immunity তে পৌছায় । তবে এই সংখ্যাটা একেবারে বিবলিকালি সত্য নয়, কোন মহামারি কতটা সঙ্ক্রামক তার উপর নির্ভর করে এই সঙ্খ্যাটাও কম-বেশি করতে পারে ।

হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে আমাদের ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগকে (অথবা আরো বেশি) করোনাতে আক্রান্ত হতে হবে - শুধু তাই নয়, যারা বেচে থাকবে তাদেরকে পুরোপুরি করোনা প্রতিরোধীও হয়ে উঠতে হবে । ব্যপারটা একই সাথে ফ্যান্টাসি এবং হরর এর সংমিশ্রণ । ফ্যান্টাসি এ কারণে যে আমাদের কাছে এখনো কোন রকম তথ্য প্রমাণ নেই যেটা দাবি করে যে একই মানুষ একাধিকবার করোনায় আক্রান্ত হতে পারে না, বরং একাধিকবার আক্রান্ত হবার খবর আমরা দেখেছি – এবং সেটা কেবল বৃদ্ধ রুগ্ন মানুষের ক্ষেত্রে নয়, একেবারে সুঠাম কমবয়সী মানুষের ক্ষেত্রে ঘটেছে । অন্যদিকে হরর বা ভয়াবহ একারণে যে আমাদের ১৮ কোটি মানুষের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ মানুষ বলতে কিন্তু বোঝায় একটি অবিশ্বাস্য রকমের বড় সঙ্খ্যা । যদি করোনা আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫ ভাগও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং শতকরা ১ ভাগ মৃত্যুবরণ করে তবে সেই সংখ্যা কত ভয়াবহ হবে সেটা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলির ধারণ ক্ষমতার কথা চিন্তা করলে ভয়াবহতার তীব্রতা আরো অনেকগুন বেড়ে যায় ।

ব্রিটেন প্রথমদিকে হার্ড ইমমুনিটির এই বিপদজনক কথা ভেবেছিল । তবে বিজ্ঞানী ফার্গুসনের মডেলে তাদের প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর প্রেডিকশন দেখে তাদের টনক নড়ে ওঠে এবং তারা এই ভয়ঙ্কর চিন্তা থেকে সরে আসে ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগত্বত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ডাঃ মারিয়া ভ্যান কারকোভ তাই সরকারগুলিকে বারবার সাবধান করছেন অপেক্ষা করবার জন্য । একটা কার্যকরী ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া আমাদের এখনো দ্বিতীয় কিছু ভাববার সময় আসে নি ।

হার্ড ইম্যুনিটির’ জন্য সুইডেন এর উদাহরণ অনেকে ব্যবহার করেন। সুইডেন অনেক স্বল্প জনসংখ্যার একটি দেশ বলে পারসন-টু-পারসন সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি কম ছিল। তাছাড়া সেদেশের জনগণ অনেক সচেতন – কিন্তু তারাও সাম্প্রতিক সময়ে পার্শিয়াল লক ডাউনের কথা ভাবছে । সুইডেনে যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ২৫ জন মানুষ বসবাস করে, সেখানে বাংলাদেশের প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১১০০ জনেরও অধিক (ঢাকা শহরে ৪৭,৪০০ এর অধিক) মানুষ বাস করে – অর্থাৎ স্যাটায়ারিক ভাবে বলা যায় বাংলাদেশের জনবসতির ঘনত্বের সাথে তুলনা করলে সুইডেন সবসময়ই সোশ্যাল আইসোলেশনে থাকে । তাই কোনভাবেই এই দুই দেশের তুলনা বাস্তব সম্মত নয় ।

এতদিন দেশ lockdown করার পর এখন হার্ড ইমিউনিটির কথা বললে জনগণ ব্রিভান্ত হবে।পাশাপাশি যারা এতদিন সোশ্যাল ডিস্টেন্সের নিয়ম মেনে চলছিল তারাও নিয়মের প্রতি উদাসীন হবে । কাজেই হার্ড ইমিউনিটির কথা না বলে আমাদের উচিত হবে:

(১) দেশজুড়ে টেস্ট করার পরিমান আরো বাড়ানো । বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০০০-৫০০০ টেস্ট করা হচ্ছে অর্থাৎ প্রতি ১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে মাত্র ৩৬৩ জন । যা যথেষ্ট নয়।

(২) টেস্ট করে পাওয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের ট্রেসিং করতে হবে। অর্থাৎ, আক্রান্ত ব্যক্তির টেস্ট পসিটিভ আসার আগে তার দ্বারা যারা সংক্রমিত হতে পারে তাদের চিহ্নিত করা। এভাবে ট্রেসিং করে ঝুঁকির মাঝে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের জানাতে হবে এবং কোয়ারেন্টাইন করতে হবে।

(৩) সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসলে কেবল তখনই ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরুর দিকে যাওয়ার চিন্তা করা যায় । সেক্ষেত্রে গার্মেন্টস, শপিংমলসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরী করতে হবে যাতে তারা কর্মক্ষেত্রে সকল কর্মচারীর জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে । এবং শুধু কাগজ-কলমের নীতিমালা নয়, বরং সেই নীতির বাধ্যতামূলক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিসিনফেক্ট্যান্ট ব্যবহার, প্রবেশের পূর্বে তাপমাত্রা পরিক্ষা করা, স্যানিটাইজার সরবরাহ এবং ব্যবহার করা, কেউ অসুস্থ হলে নোটিফাই করা বাধ্যতামূলক করা, দুজন কর্মচারীর মাঝে নিরাপদ দূরুত্ব (রোগত্বত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের পরামর্শ অনুযায়ী) নিশ্চিত করা এবং করোনা প্রতিরোধে বেসিক ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসব নীতি মেনে না চললে জরিমানাসহ শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে ।

(৪) জনগণের মাঝে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং এবং হাইজিন-এর (হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, মাস্ক ব্যবহার করা) চর্চা করার জন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য সোশ্যাল ক্যাম্পাইনের ব্যবস্থা করতে হবে – এবং তা হতে হবে নিয়ম মেনে । আমরা অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দেখেছি ৫০ ব্যাগ রিলিফ দিতে শতাধিক মানুষের বহর নিয়ে শোডাউন করতে – এতে জনস্বাস্থ্য আরো ঝুকির মধ্যে পড়বে ।

(৫) অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখার জন্য চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে ।

পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশই এখন করোনার সাথে লড়ছে – যার যা কিছু আছে সবটুকু সম্বল নিয়ে। বাংলাদেশের লড়াই চলছে – তবে এখনই কোনভাবেই হাল ছাড়ার সময় নয় । এই যুদ্ধে আমাদের বিজয় ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নিয়ে ভাববার বিলাসিতা দেখাবার সুযোগ নেই । সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারবে করোনাকে রুখে দিতে ।

ডা. শাহরিয়ার রোজেন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
এবং
মুহম্মদ রহমান, পিএইচডি গবেষক


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

লেখাটির জন্যে ধন্যবাদ, রোজেন এবং রহমান।

সচলায়তনে কিছুদিন আগে প্রায় অভিন্ন সারকথা নিয়ে আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো। জনস্বাস্থ্য বা সংক্রামক রোগ/ব্যাধিজান নিয়ে গবেষণা করেন, এমন অনেকের বক্তব্য আপনাদের সাথে মিলে যাচ্ছে। নীতিনির্ধারকরা এ কথার মূল্য না দিলে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাবে।

জার্মানি, ইসরায়েলসহ আরো কয়েকটি দেশে সীমিত পরীক্ষাসামগ্রী দিয়েই পরীক্ষার আওতা বাড়াতে সম্ভাব্য রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে সমাহার-পরীক্ষা (pool testing) করা হচ্ছে, এমনটা কিছুদিন আগে খবরে পড়েছিলাম। আমাদের দেশে এ কৌশলটি কি কাজে লাগানো যায় না (যদি ইতোমধ্যে কাজে লাগানো না হয়ে থাকে)?

সোহেল ইমাম এর ছবি

হার্ড ইমউনিটি নিয়ে আলোচনা বেশ চলছে কিন্তু প্রায় লেখাতেই দেখা যাচ্ছে এ ব্যাপারে কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। অর্থনীতির ভেঙ্গে পড়ার ব্যাপারে অনেকেই বেশ উদ্বিগ্ন, এবং সেটাও হয়তোে একেবারে ফেলে দেবার যুক্তি নয়। কিন্তু আপনি যেরকম বললেন

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপারটিই কিন্তু একেবারে পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে । আর সেটা হচ্ছে ‘জীবন’ ।

আর এটাই ভাবাচ্ছে, এই অর্থনীতি, বাণিজ্য নিয়ে ভাবার সময় হয়তো জীবনটাই পিছে পড়ে যাবে গুরুত্বের দিক দিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ের দিকে তাকিয়ে তাই ভীত হচ্ছি।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

১। নানান পরামিতির জটিল মিথস্ক্রিয়ার হিসেবে প্রতিটি দেশই তো আলাদা। এক দেশের সাফল্যের টোটকা আরেক দেশে খাটবে না- সেটা বুঝতে পারছি। এমন জনসংখ্যাবহুল দেশের জন্য 'হার্ড ইমিউনিটি তত্ত্ব' প্রয়োগের অন্য কোন 'নিরাপদ পদ্ধতি' কি সম্ভব?

২। সচলে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সবকটি লেখাই এসেছে জীববিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিদ কিংবা রোগতত্ত্ববিদ লেখকদের কলমে। অর্থনীতির জ্ঞানসম্পন্ন সচলেরা কি এর সম্ভাব্য আর্থ-সামাজিক অভিঘাত নিয়ে লিখবেন? কিংবা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে যারা পারদর্শী, তাঁদের অনুরোধ জানাই সম্ভাব্য রাজনৈতিক অভিঘাত নিয়েও লেখার জন্য।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।