দ্য অ্যালকেমিস্ট/ পর্ব-১ অণুকাহিনী ৪

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৫/১০/২০২০ - ১১:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পরদিন, দুপুরে বুড়ো মেলখিযেডেকের সাথে দেখা করতে গেলো সান্টিয়াগো। ছ’টা ভেড়া এনেছে সাথে।

“খুবই অবাক হয়েছি, জানেন! আমার এক বন্ধু আমার ভেড়াগুলো মুহূর্তের মধ্যেই কিনে নিলো। বলল, ওর নাকি সারা জীবনের স্বপ্ন ও রাখাল হবে। আর আমার এই ভেড়া বেচার ব্যাপারটা, এটা নাকি তারই একটা নিশানা।”

মেলখিযেডেক বলল, “সবসময় এমনই হয়। আর এটাকে বলে অনুকূলতার সূত্র। প্রথমবার যখন তাস খেলবে, দেখবে নিশ্চিত ভাবে জিতবে; সূচনাকারীর ভাগ্য আরকি।”

“এইরকম কেন হয় বলেনতো?”

“কারণ এমন একটা শক্তি আমাদেরকে আবিষ্ট করে থাকে, যেটা চায় আমরা যাতে আমাদের জীবনগল্পের গন্তব্যটাকে বুঝতে পারি; তাই একদম প্রথমের দিকেই সামান্য একটু সফলতার স্বাদ দিয়েই আমাদেরকে ক্ষুধাকে আরো বাড়িয়ে তোলে।”

এরপর মেলখিযেডেক ভেড়া গুলোকে পরীক্ষানিরীক্ষা করা শুরু করল। একটা ছিল খোঁড়া। সান্টিয়াগো মেলখিযেডেককে বুঝিয়ে বললো, খোঁড়া হলেও ওই ভেড়াটাই সবচেয়ে চালাক চতুর আর সবচেয়ে বেশী উলও দেয় ওটা।

“আচ্ছা, এবার বলে ফেলেনতো গুপ্তধনের ব্যাপারটা কি, কোথায় আছে?”

“মিশরে, পিরামিডের কাছে।”

সান্টিয়াগোর এবার ওর চমকে ওঠার পালা। সেই জিপসি বুড়িও একই কথা বলেছিল। কিন্তু বুড়িতো এক পয়সাও নেয়নি!

মেলখিযেডেক বলল, “ধন-রত্ন যদি পেতেই চাও, দৈবইশারা গুলো মেনে চলো। জীবনবিধাতা প্রত্যেকের জন্যেই পথ বানিয়ে রেখেছে। তোমার জন্য যে ইশারা-ইঙ্গিতগুলো রাখা আছে সেসব ইশারা-ইঙ্গিত ধরে ধরে সেই পথ দিয়েই তোমাকে যেতে হবে।”

সান্টিয়াগো কিছু বলার আগেই কোত্থেকে একটা প্রজাপতি উড়ে আসলো। দুজনের মাঝে উড়তে লাগলো। ঠাকুর্দার কথা মনে পড়লো সান্টিয়াগোর। ঠাকুর্দা বলেছিলেন প্রজাপতি উড়ে এসে বসা নাকি ভালো। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনলে বুঝতে হবে, একটা ভালো কিছু হবে; ঘাস ফড়িং আর গিরগিটি দেখলেও তাই। ত্রিপত্রীর যদি তিনটার জায়গায় চারটা পাতা হয়, সেটা দেখতে পেলে শুভলক্ষণ। তেমন প্রজাপতি উড়ে আসলেও নাকি সেটা শুভলক্ষণ।

“সেটাই,” বুড়ো যেন সান্টিয়াগোর মনের কথা বুঝেই বলে উঠল। “তোমার ঠাকুর্দা ঠিকই বলেছেন। এসব আসলেই শুভ লক্ষন।”

বুড়ো মেলখিযেডেক তার উত্তরীয়টা খানিকটা সরাল। সান্টিয়াগো যা দেখলো তাতে ওর আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার দশা। মণি-মাণিক্য বসানো সোনার বর্ম পড়ে আছে বুড়ো। এই তবে সেই চকচকে জিনিস। আগের দিনের কথা মনে পড়লো সান্টিয়াগোর। এই স্বর্ণ বর্মেরই সামান্য অংশ কাল চোখে পড়েছিল। তাতেই যা অন্ধকার দেখেছিল চোখে, বাপরে বাপ! ঈশ্বর, সত্যিই মেলখিযেডেক লোকটা তাহলে রাজা! চোর ডাকাতের হাত থেকে বাঁচতে মনে হয় সাধারন ছদ্মবেশ নিয়েছে।
সোনার বর্মের ঠিক মাঝখান থেকে একটা সাদা আর একটা কালো পাথর তুলে ওকে দিল বুড়ো, “নাও, ধরো। এই পাথরগুলো হলো ইউরিম আর থাম্মীম। কালো পাথরটার মানে ‘হ্যা’, আর সাদাটার মানে ‘না’। যদি কখনো কোনো দৈবইশারার মানে বুঝতে না পারো, এই পাথর গুলো তোমাকে সাহায্য করবে। আরেকটা কথা, সবসময় অর্থপূর্ন প্রশ্ন করো।
“তবে হ্যাঁ, যদি সম্ভব হয় নিজের সিদ্ধান্তটা নিজেই নেওয়ার চেষ্টা করো। গুপ্তধন যে পিরামিডের ওখানে আছে এটাতো তুমি আগে থেকেই জানতে, মানে ওই জিপসি টা বলেছিল। তারপরও এই ছয়টা ভেড়া আমি যে তোমার কাছ থেকে একরকম জোর করেই পারিশ্রমিক হিসেবে নিলাম, সেটার কারন হলো আমি তোমাকে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করেছি।”

সান্টিয়াগো পাথর দুটো নিয়ে ওর পুঁটলিতে রাখলো। এরপর থেকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে হবে।

“একটা জিনিস মনে রেখো, সব একই সুতায় গাঁথা, সবকিছু মিলেই এক, কিছুই আলাদা না। দৈবইশারার ভাব-ভাষা ভুলে গেলে চলবেনা। আর, সবকথার শেষ কথা হলো, জীবনখাতার গল্পের একেবারে শেষ পর্যন্ত যেও, ভুলোনা কিন্তু।
“শোন, যাবার আগে তোমাকে একটা ছোট্ট গল্প বলি।
“এক দোকানদার তার ছেলেকে সুখের রহস্য জানতে পাঠিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী এক সাধুর কাছে। ছোকরা চল্লিশ দিন ধরে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে এসে পৌছাল এক সুরম্য প্রাসাদে। পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় সেই প্রাসাদ। সেখানে থাকে ওই জ্ঞানী লোক।
“প্রাসাদের প্রবেশ কক্ষ দিয়ে ঢুকতেই ছেলেটা বেশ সমাগম দেখতে পেল, যার খোঁজে এসেছে তাকে দেখলনা কোথাও। ব্যতিব্যস্ত অবস্থা। ব্যবসায়ী গোছের লোকেরা আসছে-যাচ্ছে। কিছু মানুষ কোনার দিকটায় দাঁড়িয়ে গল্পে মশগুল। ছোট খাটো একটা বাদক দল মৃদু সুরে বাজিয়ে যাচ্ছে, আর একটা টেবিলে ওখানকার সব থেকে মজার মজার খাবার রাখা। পরে লোকটার দেখা পেল। দেখল লোকটা একে একে সবার সাথে গল্প করলো, প্রায় দুই ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করার পর ছেলেটা ওই জ্ঞানী লোকের দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারলো।
“জ্ঞানী সাধু মনোযোগ দিয়ে ছেলেটার কথা শুনলো। শুনলো, কেন কি উদ্দেশ্যে এসেছে, কিন্তু সুখের রহস্য ব্যাখ্যা করার মতো সময় ঠিক সেই মুহূর্তে লোকটার হাতে ছিলনা তাই ছেলেটাকে সে আপাতত প্রাসাদটা ঘুরেফিরে দেখতে বলল, দেখে ঘন্টা দুই পরে আসতে বলল। ‘সেই সাথে আর একটা কাজ কর,’ একটা চামচে দু’ ফোঁটা তেল নিয়ে ছেলেটার হাতে দিতে দিতে বলল সে জ্ঞানী সাধু, ‘ঘুরে দেখার সময় এই চামচটাও হাতে রাখো, আবার দেখো চামচের তেল যেন না পড়ে।’
“ছেলেটা চামচে চোখ রেখে প্রাসাদের বহু সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে উপরের তলা গুলোতে গেলো, ঘরগুলো দেখলো টেকলো। দু-ঘন্টা পরে ঠিক সময় মত আবার ওই যে যেই ঘরটায় সাধুর সাথে দেখা হয়েছিল ঐখানে ফিরে আসলো।
“ ‘আচ্ছা বলতো, আমার ভোজকক্ষে ইরানি কারুকাজ করা যে পর্দা গুলো আছে ওগুলো দেখতে কেমন? আর ঐ বাগানটা, যা আমার এক দক্ষ মালী তার সুনিপুণ হাতে দশ-দশটা বছর ধরে বানিয়েছে, ওইটা কেমন লাগলো? আমার লাইব্রেরীটা দেখেছো, ওখানে অনেক সুন্দর সুন্দর পার্চমেন্ট আছে, দেখেছ?’ জিজ্ঞেস করল জ্ঞানী সাধু।
“ছেলেটা একটু আমতা আমতা করে বলল, ও নাকি কিছুই দেখেনি। দেখবে কি করে, ও খালি চামচের তেলটা আগলে রেখে পুরো বাড়ি ঘুরেছে, হাহাহা।
” ‘তাহলে আবার যাও, ফিরে গিয়ে দেখো এসো আমার পৃথিবীর বিস্ময়কর সব জিনিস,’ বলল জ্ঞানী সাধু। ‘যদি কারো বাড়িটাই তুমি ঠিক মতো না দেখো, তবে তাকে বা তার কথা বিশ্বাস করবে কিভাবে?’
“ছোকরা এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তেলের চামচ টা তুলে নিয়ে আবার প্রাসাদ ঘুরে দেখতে বেরোল। আর এবারে দেয়াল থেকে ছাদ পর্যন্ত শৈল্পিক যত যা কিছু ছিল সব দেখে নিল। পাহাড় ঘেরা বাগান, কত সুন্দর সুন্দর সব ফুল, কি চমৎকার রুচি জ্ঞানী সাধু লোকটার! তারপর ছোকরা সাধুর কাছে ফিরে এসে একে একে সব বয়ান করলো।
“সাধু জিজ্ঞেস করলো, ‘আরে, তোমাকে চামচে করে যে তেলটা দিলাম তখন সেটা গেলো কোথায়?’
“ছোকরা দেখলো চামচের তেল পড়ে গেছে কখন টেরই পায়নি।
“ ‘শোন ছেলে, তোমাকে আমি একটা উপদেশই দেব,’ বলল সেই সর্বজ্ঞানী সাধু। সুখের রহস্যটা হলো, বিশ্বের বিস্ময়কর জিনিস দেখো ভালোকথা, কিন্তু সেই সাথে নিজের চামচের তেলটার কথাও মনে রেখো।’ ”

সান্টিয়াগো চুপ করে আছে। গল্পের মানেটা ধরতে পেরেছে। ঘুরে বেড়াতে একটা রাখালের ভালো লাগতেই পারে, তাই বলে নিজের মেষপালের কথা ভুললে চলবেনা।

ওর দিকে একবার তাকিয়ে বুড়ো রাজা মেলখিযেডেক নিজের দুহাত এক করে ওর মাথার ওপর কি সব আজব ভঙ্গি টঙ্গি করলো। তারপর ভেড়াগুলো নিয়ে চলে গেলো।

***

তারিফার একেবারে চূড়ায় অনেক পুরাতন একটা দূর্গ আছে, এককালে মুর রা বানিয়েছিল। দূর্গটার দেয়ালের উপর উঠলে ওই দূরের আফ্রিকার এক ঝলক দেখা যায়। সেই বিকেলে সালেম নগরের রাজা মেলখিযেডেক ঐ দূর্গের দেয়ালের ওপর গিয়ে বসলো। মুখে এসে লাগছে লেভান্টারের ঝাপটা। ভেড়াগুলো আছে কাছেই। নতুন মালিক পেয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে ওগুলো, নতুন মালিক, আশপাশের এত সব জায়গা বদল, সব মিলিয়ে কেমন একটা উসখুস ভাব ভেড়ার পালটাতে। তারপরও ওদের সব কথার শেষ কথা হলো একটু খাবার আর পানি।

মেলখিযেডেক দেখলো ছোট একটা জাহাজ বন্দর ছাড়ছে। হয়তো এই সান্টিয়াগো ছেলেটার সাথে আর কখনোই দেখা হবেনা। ইব্রাহিমের সাথেওতো আর দেখা কোনদিন হয়নি, দশ ভাগের এক ভাগ পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়েছিল ইব্রাহিমের কাছ থেকে। নিবেনইবা না কেন, কাজটাতো সেই করে দিয়েছিল।

ঈশ্বরদের মনে আশা আকাঙ্খা থাকা উচিৎ না, তাঁদেরতো আর জীবনগন্তব্য নেই। কিন্তু সালেমের রাজা হিসেবে মেলখিযেডেক মনে প্রানে চাইল সান্টিয়াগো ছেলেটা যেন শেষ পর্যন্ত সফল হয়।

ভাবতেই খারাপ লাগছে, আমার নাম হয়তো ছেলেটা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে, ভাবলো সে। ইস্, নামটা আমার বারবার বলা দরকার ছিল। বললে ছেলেটার মনে থাকত। তাহলে যখনই আমার প্রসঙ্গে কথা উঠত তখনই ও বলত আমি ছিলাম সালেমরাজ, মেলখিযেডেক।

নিজমনে একটু লজ্জিত হয়েই মেলখিযেডেক আকাশের দিকে তাকালো, “প্রভু, সবই এক বিরাট পন্ডশ্রম, তুমিইতো বলেছো। কিন্তু তারপরও, আমার মত বুড়ো একটা রাজার তো মাঝে মধ্যে গর্বের ভাগ নেয়ার ইচ্ছে হতেই পারে, বলো।”

***

কি বিচিত্র এই আফ্রিকা, ভাবলো সান্টিয়াগো।

একটা সরাইখানায় বসে আছে। এটা দেখতে অন্যগুলোর মতই। আসার সময় তাঞ্জিয়েরের চিপা অলিগলিতে দেখছে, সব সরাইখানায়ই কেমন যেন একই রকম দেখতে। একদিকে কিছু লোক জড়ো হয়ে বসে আছে। বিশাল একটা পাইপ থেকে একজন করে ধোঁয়া টেনে সেটা আরেকজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কয়টা মাত্র ঘন্টা গেছে, তাতেই আরেক দেশ, স্পেন থেকে আফ্রিকা। দেখলো পুরুষেরা হাত ধরাধরি করে হাঁটে, মেয়েদের মুখ ঢাকা। আর যাজক গোছের কিছু লোক উঁচু মিনারগুলোর একেবারে মাথার দিকের একটা জায়গায় উঠে সুর করে কিছুক্ষণ কি যেন গায়- আর তখন তার আশে পাশের মানুষজন হাঁটু গেড়ে বসে মেঝেতে কপাল ঠেকায়।

“কিসব নিয়ম টিয়ম এদের,” স্বগতোক্তি করল সান্টিয়াগো।

ছেলেবেলায় গীর্জায় সেইন্ট সান্টিয়াগো মাতামরোসের সাদা ঘোড়ায় চাপা ওই ছবিটা সবসময় দেখত ও, হাতে তাঁর খোলা তলোয়ার, আর তাঁর পায়ের কাছে ছিল আজ এখানে হাঁটু গেড়ে বসা মানুষগুলোর মতোই কিছু মানবমূর্তি। এই অনাত্মীয় পরিবেশে সান্টিয়াগোর এবার কেমন একটা খারাপ লাগছে। অনেক একাও মনে হচ্ছে নিজেকে। আর এখানকার লোকগুলোর চোখে মুখেও কেমন একটা পাজী-পাজী ভাব।

আর তাছাড়া, তড়িঘড়ি করে এভাবে তারিফা থেকে তাঞ্জিয়েরে চলে আসলো, একটা ব্যাপার একদমই মাথায় ছিলনাঃ এদেশে কেবল আরবি ভাষাই চলে। ভাষার কারনেই হয়তো এখন গুপ্তধন পেতে বহু দেরী হয়ে যেতে পারে।

সরাইখানার মালিক ওর দিকে এগিয়ে এলো, পাশের টেবিলের পানীয়টা দেখিয়ে ও সেটাই আনতে বলল। পরে বুঝলো ওটা তিতকুটে একটা চা ছিল। ও ভেবেছিল ওয়াইন। যাইহোক, এসব নিয়ে ভাবার সময় এখন না। যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা; গুপ্তধন, সেটা কিভাবে পাওয়া যাবে, এখন ওর শুধু সেই চিন্তা। ভেড়া বিক্রি করে ভালোই টাকাকড়ি পেয়েছে, জানে টাকার কি আশ্চর্য জাদু। টাকা সাথে থাকলে আর নিজেকে একা মনে হয়না। অচিরেই, বলা যায়না হয়তো কয়দিনের মধ্যে সে পিরামিডের ওখানে পৌছে যেতে পারে। সোনার বর্ম পড়া, বুড়ো একটা মানুষ কেবল ছয়টা ভেড়ার লোভে মিথ্যা কথা বলবেনা।

ওকে দৈবইশারা ইঙ্গিতের কথা বলেছিল বুড়ো। প্রণালী পার হওয়ার সময় সান্টিয়াগো সেসব নিয়েই ভাবছিলো। লোকটা যা বলেছে, জানে বোঝে জন্যই বলেছে। সান্টিয়াগো যখন আন্দালুসিয়ার মাঠে মাঠে ঘুরতো, আকাশ আর জমির দিকে তাকিয়েই ওকে বুঝে নিতে হতো কোন রাস্তা ধরে কোনদিকে যাবে। এক ধরনের পাখী ছিল, সেটাকে উড়তে দেখলে ও বুঝত আশেপাশেই কোথাও সাপ আছে, ঝোপজাতীয় কতগুলো গাছ ছিল, চলার পথে ওগুলো দেখলে বুঝতো কাছেপিঠে কোথাও পানি আছে। ভেড়াদের কারনেইতো এতো সব কিছু শেখা।
ঈশ্বর যদি ভেড়াদের পথ দেখানোর জন্য এতো কিছু করতে পারে, তবে ওকেও পথ দেখাবে, এই ভেবে কিছুটা শান্তি পেলো। চা টা এখন আর আগের মত তিতকুটে লাগছেনা।

“তোমার পরিচয় জানতে পারি?” হঠাৎ কেউ একজন পাশ থেকে স্প্যানিশে জিজ্ঞেস করল।
একটু যেন সস্তি পেল সান্টিয়াগো। দৈবইশারা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই দেখি একজনের আবির্ভাব, ভাবল ও।

“তুমি স্প্যানিশ জানলে কি করে?” ও জিজ্ঞেস করল। আগন্তুক বয়সে তরুণ, পশ্চিমা বেশভূষা। কিন্তু গায়ের রং দেখে মনে হচ্ছে এ শহরেরই কেউ হবে। আকার আকৃতি আর বয়সে ওরই সমান।
“এখানকার প্রায় সবাই স্প্যানিশ বলে। স্পেন থেকে আমরা মাত্র দুই ঘন্টার পথ দূরে।”
“বসো, কিছু একটা নাও, আমি খাওয়াবো,” বলল সান্টিয়াগো। “আর পারলে একটু ওয়াইন দিতে বলি, এই চা টা খুব ফালতু লাগছে।”
“এই দেশে ওয়াইন পাবেনা,” আগন্তুকের জবাব। “ধর্মীয় বিধি নিষেধ আছে এখানে।”

সান্টিয়াগো কথাবার্তার এক পর্যায়ে বলল ওর পিরামিড পর্যন্ত যাওয়া দরকার। ধন-রত্নের ব্যাপারে আর একটু হলেই বলে ফেলত, সামলে নিল। বললে আবার হয়তো এই আরবও ওকে সেখানে নিয়ে যাবার জন্য একটা অংশ দাবী করে বসবে। বুড়োর কথা মনে পড়লো, যা এখনো নিজে হাতেই পায়নি, সেখানে থেকে জনে জনে ভাগ দেবে এই আশ্বাসই বা দেবে কি করে।

“চাচ্ছিলাম তুমি যদি আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারো আমার গাইড হিসেবে পারিশ্রমিক দেবো।”

“সেখানে কিভাবে যেতে হয় কোনও ধারনা আছে তোমার!” আগন্তুক ছেলেটা বলল।
সান্টিয়াগো খেয়াল করলো সরাইখানার মালিক লোকটা কাছেই দাঁড়িয়ে কেমন যেন ওদের কথা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে। ওর একটু অস্বস্তি হলো কথা চালিয়ে যেতে। কিন্তু নতুন দেশে নতুন জায়গায় একটা গাইড পাওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে। তাই কোনো ভাবেই এই ছেলেটাকে হাত ছাড়া করতে চাচ্ছেনা ও।
“পুরো সাহারা মরুভূমি পার হতে হবে,” বলল আগন্তুক। “প্রচুর টাকার মামলা। তোমার কাছে টাকা পয়সা কিছু আছে কিনা সেটাও তো জানা দরকার।”

এ আবার কেমন প্রশ্নরে বাবা, ভাবল সান্টিয়াগো। কিন্তু সেই বুড়ো রাজার কথায় ওর বিশ্বাস আছে ওর। বুড়ো বলেছিল মন থেকে সত্যিসত্যি কিছু চাইলে সবকিছুতেই নাকি বিধি সহায় হয়। ঝোলা থেকে টাকার তোড়াটা বের করে ছেলেটাকে দেখালো। ততক্ষণে সরাইখানার মালিক লোকটাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ড্যাব ড্যাব করে দেখছে টাকাগুলো। আরবিতে আগন্তুক ছেলেটাকে কিসব বলল, ছেলেটাও উত্তর দিল। মালিক লোকটা মনে হলো ক্ষেপে গেছে।

“চলো, বেড়িয়ে যাই,” বলল অগন্তুক বন্ধু। “লোকটা আমাদেরকে চলে যেতে বলছে।”
সান্টিয়াগো এতক্ষণে স্বস্তি পেল। এই জায়গাটা থেকে বেরোতে পারলে বাঁচে। উঠে বিল মিটিয়ে দিতে গেল। ওমা, মালিক লোকটা ওকে খপ করে ধরে সেকি হম্বি তম্বি, কিসব বকেই যাচ্ছে বকেই যাচ্ছে। সান্টিয়াগো নিজেও ভালোই শক্তিশালী। ভাবল লোকটাকে ঝটকা দিয়ে ঠেলে সরে আসবে কিনা। কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে জায়গা, কি দরকার বাবা নতুন একটা ঝামেলা তৈরি করার। সামলে নিল। ওর নতুন বন্ধু্টা এসে মালিক লোকটাকে কষ্টে শিষ্টে সরিয়ে, সান্টিয়াগোকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসলো।

“লোকটা তোমার থেকে টাকাগুলো হাতিয়ে নিতে চাচ্ছিল” বলল নতুন বন্ধু। “তাঞ্জিয়ের আফ্রিকার বাকি অংশের মত না, এটা বন্দর নগরী, আর বন্দর গুলোতে চোর-বাটপারের অভাব হয়না।”

এই নতুন বন্ধুটাকে সান্টিয়াগো বিশ্বাস করতে পারছে। বিপদ থেকে রক্ষা করেছে ছেলেটা। ওর টাকা গুলো খুলে করে গুণলো। বলল,“কালকের মধ্যে আমরা পিরামিডের কাছে চলে যেতে পারি।” টাকাগুলো নিয়ে বলল, “কিন্তু দুটো উট কেনা দরকার আমাদের।”

তাঞ্জিয়েরের সরু গলি ধরে ওরা দুজন এগোল। কত রকম জিনিসের দোকান। খুপরি খুপরি সব। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে বড় একটা চত্বরের মাঝখানে আসলো ওরা। হাট বসেছে মনে হয়। হাজার হাজার লোক, দরদাম চলছে, কেউ বেচছে, কেউ কিনছে; ছুরির বদলে কেউ বেচছে শাক সব্জি, তামাকের স্তুপের পাশে কেউ শতরঞ্চি নিয়ে বসেছে। সান্টিয়াগো একবারের জন্যও ওর নতুন বন্ধুর ওপর থেকে চোখ সরায়নি। সব টাকা ওর কাছে। একবার ভাবলো টাকার তোড়াটা ফেরত চায়, পরে আবার ভাবল সেটা অভদ্রতা হয় কিনা। এখানকার রীতিনীতি তো কিছুই জানা নেই।
“থাক, ওকে চোখে চোখে রাখলেই হবে,” ভাবল ও। জানে, ওর চেয়ে সে নিজেই অনেক শক্তিশালী।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা দোকানে দেখল একটা চমৎকার তলোয়ার, এইরকম জিনিস আগে কখনো দেখেনি। রূপার খোদাই করা খাপ। কালো হাতলের ওপর দারুন সব কারুকাজ। মূল্যবান পাথর টাথর। নিজের কাছে প্রতীজ্ঞা করল, মিশর থেকে ফিরে এই তলোয়ারটা ও কিনবেই কিনবে।

“এ্যাই দোকানদারকে জিজ্ঞেস করোতো তলোয়ারটার দাম কত?” ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলল। আর তখনই খেয়াল হলো তলোয়ার দেখতে দেখতে মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য ছেলেটার কথা মনে ছিলনা।

দম আটকে গেল ওর, যেন হাঁড়-পাজর চেপে ধরেছে হৃদপিন্ড। ঘুরে দেখতেও ভয় হচ্ছে ওর, জানে কি দেখতে পাবে। আরো কিচ্ছুক্ষণ তলোয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকলো, ঘুরে তাকানোর জন্য সাহস দরকার।

চারপাশে সবটুকুই কেবল বাজার। প্রচুর লোকের আনাগোনা, চিৎকার চেচামেচি, বেচা কেনার ধুম, আর রকমারি খাবারের গন্ধ... কিন্তু কোথাও সেই নতুন সঙ্গীকে দেখলনা।

ছেলেটা হয়তো ঘটনাচক্রেই ওর থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে। সান্টিয়াগো নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিল। ভাবল এখানটাতেই থেকে ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করবে কিনা।
কতক্ষন পরে, এক যাজক গোছের লোক কাছের একটা মিনারের চূড়ায় উঠে সুর করে গাওয়া শুরু করতেই বাজারের সবাই হাঁটু গেড়ে বসে মাটিতে কপাল ঠেকালো, সবাই একসাথে মিনারের ওপরের ওই লোকটার সাথে সাথে আওড়ে চলল। সুর করে পাঠ শেষ হওয়ার পর সবাই দোকানের ঝাঁপি নামিয়ে পিঁপড়ের মত পিল পিল করে চলে গেল।

সূর্যও অস্ত যাচ্ছে। চত্বরের ওদিকটার সাদা সাদা বাড়ি গুলোর আড়ালে চলে যাওয়া পর্যন্ত সান্টিয়াগো সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। মনে পড়লো সেইদিনের সেই লাল সূর্যোদয়টার কথা। ও ছিল আরেকটা মহাদেশে, তখনও পর্যন্ত ওর পরিচয় ছিল রাখাল। ষাট ষাটটা ভেড়া ছিল ওর। অধীর অপেক্ষা নিয়ে পথ চলছিল কখন দেখা হবে মনের মানুষের সাথে। সেই সকালে ওর চিরচেনা পথ ধরে যেতে যেতে কত কি ভেবেছিল। পরিকল্পনা করছিল। অথচ আজ যখন সূর্য ডুবছে তখন ও অন্য একটা দেশে। পৃথিবীর এক আজব জায়গায় ও এক ভিনদেশী। এমনকি এখানকার ভাষায়ও কথা বলতে পারবেনা।

কিসের রাখাল কিসের কি, সব কিছু নতুন করে শুরু করাতো দূরের কথা বাড়ি যে ফিরবে সে কপর্দকই নেই।
কোনো এক সূর্যোদয় থেকে কোনো এক সূর্যাস্তে এতো কিছু ঘটে গেল, ভাবছে সান্টিয়াগো। নিজের জন্যে এখন মায়া হচ্ছে। এতো রাতারাতি এমন সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে ভাবতেও পারেনি। জীবনটাই মনে হয় বদলে গেল, আফসোসে মনটা কুঁকড়ে যাচ্ছে!

কান্না আসছে বলে নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা লাগলো। কখনো নিজের ভেড়াগুলোর সামনেও কাঁদেনি। কিন্তু বাড়ি থেকে বহুদূরে এই অচেনা জায়গায় আজ এই জনশূন্য বাজারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ও কাঁদল। ঈশ্বরের এ কেমন অবিচার। নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস করলে কি ঈশ্বর কি এভাবেই তার প্রতিদান দেয়!

ইস, আমার ভেড়াগুলো যখন ছিল, তখন কত ভালো ছিলাম, ওরাও কত আনন্দে ছিল আমার সাথে। আমাকে আসতে যেতে মানুষ কত পাত্তা দিত, ভাবল ও। আর এখন, আমি পথের ফকির, একা একটা মানুষ। শুধু একজন মানুষ আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল বলে সারাজীবন হয়তো আমি অন্যদের সাথে খিটখিটে ব্যবহার করব। মানুষকে আর কোনদিনই বিশ্বাস করতে পারবোনা। নিজে ধনরত্ন গুপ্তধন পাইনি। তাই অন্য যারা পেয়েছে তাদের এখন থেকে দুই চোখে দেখতে পারবোনা। আর পৃথিবীতে এতো তুচ্ছ একটা মানুষ হয়ে টিকে থাকতে হবে ভেবে আমার শেষ সম্বল যতটুকু যা আছে তাই আঁকড়ে ধরে বসে থাকবো...ছি ছি ছি...

আর কি অবশিষ্ট আছে দেখতে পোঁটলাটা খুলল সান্টিয়াগো; জাহাজে খাওয়ার সময় মাখনমাখা রুটির অর্ধেকটা এখনো আছে মনে হয়। কিসের কি, সব মিলে আছে কেবল মোটা বইটা, জ্যাকেট, আর বুড়োর দেওয়া পাথর দুটো।

পাথরগুলো দেখে তাও একটু স্বস্তির পেল। এই দামী পাথর দুটোর জন্য ছয়টা ভেড়া দিয়েছে ও বুড়োকে। পাথর দুটো আবার বুড়োর বুকের সোনার বর্ম থেকে খুলে দিয়েছিল বুড়ো। এই দুটো বেচে অন্তত দেশে ফেরার টিকিটটা কেনা যাবে।

কিন্তু এইবার আমি চালাক চতুর হব। পোঁটলা থেকে বের করে পাথরগুলো নিজের পকেটে রাখতে রাখতে ভাবল ও। এটা বন্দর নগর। আর বন্দর নগরগুলো চোর-বাটপারে ভরা, এই একটা কথা আজকের আগন্তুক বন্ধুটা সত্য বলেছিল।

এখন বুঝলো। ইস, সরাইখানার মালিক লোকটা এইজন্য তখন অমন করছিল। ওই ছেলেটাকে ও যাতে বিশ্বাস না করে সেটাই বারবার বলার চেষ্টা করছিল।

“ইস্, আ‌সলে আমি আর সবার মতই। মানুষ হিসাবে আমি যেমন, দুনিয়াটাকে যেমন দেখতে চাই সবকিছু সেভাবেই দেখি, দুনিয়া যে আসলে কি জিনিস এখনো বুঝলামনা।”

পকেটের পাথরগুলোয় হালকা করে হাত বুলাচ্ছে, ওগুলোর গায়ে হাত রেখে তাপ টা অনুভব করছে ও। এগুলোই এখন সবেধন নীলমণি। এগুলো নেড়েচেড়েই এখন শান্তি। বুড়োটার কথা মনে পড়ল।

লোকটা বলেছিল, “যখন মন থেকে কিছু চাবে, দেখবে সেটা পেতে পুরো জগত সংসার তোমাকে নানা ভাবে এদিক ওদিক থেকে সাহায্য করছে।”
ঘন্টার মাথা। এই হলো তাহলে অবস্থা। খালিহাতে একটা শুনশান বাজার চত্বরে দাঁড়িয়ে। হাতে একটা কানাকড়িও নেই, রাতভর পাহারা দেবার মত কোন ভেড়াও নেই। কি হলো ঘটনাটা তাহলে!

কিন্তু একটা রাজার সাথে যে সত্যিই দেখা হয়েছিল এই পাথর গুলোইতো তার প্রমাণ। সেকি শুধুই রাজা, এমন এক রাজা যে সান্টিয়াগোর জীবনের কথাও জানে।

বুড়ো রাজা বলেছিল, “এই ইউরিম আর থাম্মীম পাথর দুটো তোমাকে দৈবইশারার মানে বুঝতে সাহায্য করবে।” সান্টিয়াগো পাথরগুলো পকেট থেকে বের করে আবার পুঁটলি তে রাখলো। একটা ব্যাপার পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়। বুড়ো বলেছিল সোজা সাপটা প্রশ্ন করতে, কিন্তু সেটা করতে হলেতো আগে জানতে হবে নিজে কি চায়। সেটার জন্য প্রথমেই যেটা জানা দরকার সেটা হল বুড়োর দোয়া এখনো ওর সাথে আছে কিনা। মনে মনে প্রশ্নটা করে না দেখে পুঁটলি থেকে একটা পাথর বের করে আনল। কালো পাথর, মানে ‘হ্যা’। মানে বুড়োর দোয়া এখনো ওর সাথে আছে!

পাথরটা আবার পুঁটলিতে ফেরত রাখল। জিজ্ঞেস করল “গুপ্তধন কি আমি খুঁজে পাবো?”
পুঁটলিতে হাত ঢুকিয়ে কোন একটা পাথর খুঁজে উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু হাতরাতে হাতরাতে দুটো পাথরই মাটিতে পড়ে গেল। পুঁটলিতে যে একটা ফুটো আছে আগে কখনো খেয়ালই করেনি। উবু হয়ে বসে পাথরগুলো খুঁজছে। পেলোও। একদিকে পড়ে ছিল ও দুটো, তুলে নিয়ে থলেতে রেখে দেবে, কিন্তু ওই মুহুর্তেই আবার আরেকটা কথা মনে হলো।
“দৈবইশারার ব্যাপারটা বুঝতে শিখো আর সেই মত কাজ করো,” বুড়ো রাজা বলেছিল।

আচ্ছা, পাথর পোঁটলা থেকে মাটিতে পড়ল, এটা আবার কোন দৈবইশারা নাতো! আপন মনে হাসল সান্টিয়াগো। থাক, আপাতত পোঁটলার ফুটো সারানোর চিন্তা বাদ, পাথরগুলো তুলে ওভাবেই রেখে দিল। কি জানি আবার কখন কোন দরকার হয়। যখন দরকার তখন ইচ্ছামত পাথরগুলো যাতে আবার পড়তে পারে, কে জানে কোনো একসময় পাথর মাটিতে পড়ারই হয়তো দরকার হবে। আস্তে আস্তে যে ব্যাপারটা বুঝতে পারছে সেটা হলো কিছু কিছু কাজে জোরাজুরি করা ঠিক না, যাতে করে জীবনগল্পের গন্তব্যটা এড়িয়ে হারিয়ে না যায়। “নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেব প্রতিজ্ঞা করেছিলাম,” স্বগতোক্তি করল ও।

কিন্তু পাথর যা বলল তাতেতো মনে হচ্ছে বুড়ো রাজার ছায়া এখনো ওর সাথে আছে, কিছুটা আত্মবিশ্বাস পাচ্ছে এবার। জনশূন্য বাজারটায় আবার চোখ বুলালো, আগের মত অত হতাশ লাগছেনা এখন আর। কই এমন আহামরি আজব কোন জায়গাতো না এটা; কেবল নতুন একটা জায়গা মাত্র।
সবসময়তো ওই চেয়েছেঃ নতুন নতুন জায়গা ঘুরবে। ধরাযাক পিরামিড পর্যন্ত যাওয়া হলোনা, কিন্তু এই পর্যন্তযে আসতে পেরেছে এইবা কম কিসে! চেনাজানা রাখালদের কেউইতো মনে হয়না এতদূর এসেছে। ইস, ওরা যদি জানত জাহাজে করে শুধু দুই ঘন্টা আসলেই এত শত পার্থক্য এই জায়গাটার, ভাবল ও। অবশ্য বাজারটা একদম ফাঁকা এখন। কিন্তু লোকে লোকারণ্য ছিল যখন তখন তো দেখেছে। ওরে বাবা, কক্ষনো ভুলবেনা সেই দৃশ্য। তলোয়ারটার কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হল, এমন সুন্দর তলোয়ার জীবনে দেখেনি কখনো। মনেমনে এতসব ভাবতে ভাবতে মনে হল দুটোর মধ্যে যেকোন একটাকে বেছে নিতে হবে এখন; কোথাকার কোন চোর ছ্যাচ্চোর এসে সব টাকা নিয়ে গেল আর অমনি নিজেকে প্রতারিত মনে করে মনোবেদনা নিয়ে বসে থাকবে, নাকি গুপ্তধনের খোঁজে এক রোমাঞ্চকর যাত্রার অভিযাত্রী ভাববে নিজেকে।
“আমি গুপ্তধনের সন্ধানে বের হওয়া এক সাহসী মানুষ,” নিজেকে বোঝালো।

***
কতক্ষণ পর কারো গুঁতো খেয়ে ঘুম ভাঙল। বাজারের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কে যেন জাগিয়ে দিল। বাজারে আবার একটু একটু করে লোক সমাগম হচ্ছে। প্রথমটায় হঠাৎ আশেপাশে তাকিয়ে ওর ভেড়াগুলো খুঁজল, কোন জায়গা বুঝতে পারছিলনা। পরক্ষনেই মনে পড়লো ওতো অন্য একটা দেশে। দুঃখ না পেয়ে বরঞ্চ একটু খুশীই হল। ভেড়াদের জন্য আর খাবার-পানি না খুঁজে এবার গুপ্তধনের খোঁজে বেরিয়ে পড়া যাবে। পকেটে এক কানাকড়িও নেই, কিন্তু তারপরও বিশ্বাস হারালোনা। কি অবাক ব্যাপার, এই গতরাতেই ভাবছিল বইয়ে পড়া দুর্ধর্ষ গল্পের ওর প্রিয় যে নায়কগুলো, ওদের মত হবে, আর আজকেই এই অবস্থা।

বাজারের মাঝ দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলল সান্টিয়াগো। দোকানীরা আবার একটু একটু করে দোকান সাজাচ্ছে। একটা মিষ্টির দোকানের সামনে থামল ও। লোকটা দোকান গোছাচ্ছে। ওও লোকটাকে একটু সাহায্য করলো। দোকানী লোকটার গাল ভর্তি হাসি, সুখী গোছের চেহারা, জীবন জীবিকা নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে, উদ্যম নিয়ে কাজ করছে। লোকটার হাসি দেখে আবার সেই বুড়োর কথা মনে পড়লো- রহস্যময় সেই বুড়ো রাজা।
“মিষ্টির দোকানী মিষ্টি বানাচ্ছে এজন্য না যে পরে একসময় সে দেশ ভ্রমনে বের হবে বা কোন একটা দোকানীর মেয়েকে বিয়ে করে থিতু হবে। সে মিষ্টি বানাচ্ছে কারন সেটাই সে করতে চায়,” ভাবলো ও। ওর মনে হলো ওও সেই বুড়োর মত কাজ কারবার শুরু করেছে। কাউকে দেখেই বুঝতে পারছে সে তার জীবনগল্পের গন্তব্যের কাছাকাছি নাকি গন্তব্য থেকে দূরে সরে গেছে। শুধু মুখের দিকে তাকিয়েই বলতে পারছে। আগে কখনো একাজ করিনি তারপরও এ তো ভালোই সোজা মনে হচ্ছে, ভাবল ও।

দোকান গোছগাছ করে নিয়ে দোকানদার ওকে সেদিনের বানানো প্রথম মিষ্টিটা খেতে দিল। ধন্যবাদ জানিয়ে ও খেলো সেটা, তারপর নিজের পথ ধরল। খানিকটা পথ যেতেই একটা ব্যাপার খেয়াল হলো, যখন ওরা দোকানটা দাঁড় করাতে ব্যস্ত তখন দোকানী লোকটা আরবিতে বলছিল, আর ও স্প্যানিশে কথা বলছিল। তবুও কথা বুঝেতে সমস্যা হয়নি। সত্যিই অদ্ভুত, এই ভাষার একটা নাম থাকা দরকার যে ভাষায় কোনো শব্দের দরকার হয়না, ভাবল সান্টিয়াগো।
ভেড়াদের সাথে কথা বলার সময়ও এমন হতো ওর, আর এখন মানুষের সাথেও হচ্ছে।
অনেক নতুন নতুন জিনিস চোখে পড়ছে এখন। তবে হ্যাঁ কিছু জিনিসের অভিজ্ঞতা আগেই হয়েছে, নতুনত্বের কিছু নেই, কিন্তু ব্যাপারটার সত্যিকার উপলব্ধি আগে কখনো হয়নি, এখন হচ্ছে। এতোই অভ্যস্ত ছিল কিছু কিছু ব্যাপারে যে আলাদা করে সেসব জিনিস খেয়ালই করা হয়নি কখনো। হঠাৎ মনে হলো, আমি যদি এই দেশের ভাষার কোন কিছু না জেনেও লোকের কথা বুঝতে পারি, তাহলেতো, বাকি পৃথিবীর বেলায়ও সেই কথা খাটে।
আস্তে ধীরে, ভেবে চিন্তে ঠিক করলো এখন তাঞ্জিয়েরের এই সরু অলিগলি গুলো দিয়ে কিছুক্ষন হাঁটবে। হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঠান্ডা করবে। ঠান্ডা মাথায় দৈবইশারা টিশারা নিয়ে একটু ভাবা যাবে। এই কাজে অনেক ধৈর্য্য দরকার। আর রাখালদেরতো ধৈর্য্যের কমতি নেই। আবারও ও টের পাচ্ছে, অ্দভুত একটা দেশে এসেছে ঠিকই কিন্তু আন্দালুসিয়ার বিস্তীর্ন প্রান্তরে ভেড়া চড়ানোর সময় যা যা শিখেছিল সেইসব জিনিসই এখন কাজে দিচ্ছে, ব্যাপারটা খারাপ না।
“সবই এক সুতোয় গাঁথা,” বুড়ো রাজা বলেছিল।

(চলবে)

পাওলো কোয়েলো

অনুবাদ- জে এফ নুশান

পর্ব-১ অণুকাহিনী ৩
পর্ব-১ অণুকাহিনী ২
পর্ব-১ অণুকাহিনী ১


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।