ছান্নুর প্রশ্ন: আমাদের কী কিছুই করার নেই

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৫/০৯/২০০৭ - ১:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লেখাটি জুবায়ের ভাইর ব্লগে মন্তব্য হিশেবে প্রকাশিত। তার পরামর্শে ফের এখানে পোষ্ট করলাম

....................................................................................

আমার শহরের কাহিনী।

হাতে ব্রেসলেট, মাথায় ঝাকড়া চুল, গলায় চেইন। নাম ছান্নু। বাবা মায়ের বড় আদরের সন্তান। জিপিএ ৫ পেয়েছে। বড় ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র হতে হবে এই স্বপ্ন দেখে এবং দেখিয়ে তার বাবা ছেলেকে ছেড়ে দেয় নিজের চেনা জগত থেকে। লঞ্চঘাট পর্যন্ত আসে বাবা-মা ও একমাত্র ছোট বোন। লঞ্চ এসে গেছে। মায়ের চোখ মোছা শুরু হয়ে গেছে। যেন সুদুর চীন দেশে যাচ্ছে তার ছেলে।

''মা তুমি শুধু শুধু কাদছো। ৩ মাসের কোচিং। তার পরতো ফিরে আসছি। কেদোনা মা। দেখ সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার অস্বস্তি লাগছে।

মা তার পরেও কাদে বলে তুই প্রতিদিন ফোন করবি। কখনো ফোন বন্ধ রাখবি না। কোন সমস্যা হলেই ফোন করবি। আর বাজে ছেলেদের সাথে মিশবি না।

মা তুমি যে কি। ওখানে বাজে ছেলে পাব কোথায়। ভাল ছাত্ররাই ওখানে যায়। পড়াশুনা করতে। মা তুমি কোন চিন্তা করো না বলে মায়ের চোখ মুছে দেয়। মা আলতো করে চুমু খায়, বলে ভাল থাকিস।

ছান্নু ঢাকায় এসেছে ২ মাসের মত হবে। ফার্মগেটে ভর্তি কোচিং করছে। ইন্দিরা রোডে আমার সাথে একই রুমে থাকছে। অসম্ভব ক্ষ্যাপাটে। যা বিশ্বাস করবে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হাজরো যুক্তি দাড় করাতে তার সময় লাগে না। খুব দ্রুত। একটা বিষয় আমি বিস্মিত হই। ও ট্রাডিশনাল রাজনীতির পক্ষে। আমরা বলি পচে যাওয়া সমাজ। ও বলে সেখানে যারা টিকে আছে রাজনীতি করছে তারা নিশ্চিত ভাবে কৌশলী ও বুদ্ধিমান। না হয় এখানে, এই সময় টিকে থাকা যায় না। আর যারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারে না তাদের দিয়ে মঞ্চে বক্তৃতা দেয়া যায় দেশ চালানো যায় না। তার দর্শন ম্যাকিয়াভেলী।

বিষয়ের সুক্ষ্মতা আর সুক্ষ্ম বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য কি ইদানিং এটাই ওর গবেষণার বিষয়। আমাকে জিগ্যেস করেছিল। আমি বলেছি মূর্খদের জ্ঞানের কথা জিগ্যেস করতে নেই। ওরা মাঝে মাঝে মাঝে কিছু ভাবের কথা বলতে পারে কিন্তু জ্ঞানের কথা না। ও হাসে। বলে আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। জানার আগ্রহ নাকি কমে গেছে আমার। ও হাল ছাড়ে না খুজে খুজে এক বন্ধুকে বের করে। সে বলে তার আঙ্কেল কোন এক বিখ্যাত ফটোগ্রাফার বাসাবোতে থাকে সে নাকি খুব জ্ঞানের কথা জানে। তাকে জিগ্যেস করা যেতে পারে।

সঠিক তারিখ মনে নেই। খালেদা সরকারের শেষ দিকে। বাসাবোর সেই বিখ্যাত ফটোগ্রাফার এর সাথে দেখা করতে চলে যায়। আমাকে ফোন করে জানায় আসতে একটু রাত হতে পারে। বিখ্যাত লোকদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে খুব উত্তেজিত। আমাকে জিগ্যেস করে, ভাই ছোট একটা বাচ্চার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত এরকম একটি বিখ্যাত ছবি তুলেছেন তার নাম কি। রশীদ হায়দার বা এরকম কেউ হবে। তবে আমি কর্নফার্ম না, তাকে উত্তর দেই। সে বলে তার সাথেও দেখা হতে পারে। সম্ভাবনা আছে।

তো আমি কি করতে পারি?

না, মানে .. ও আমতা আমতা করতে থাকে।

আমি জানি ও কি চায়। বলি আচ্ছা নিয়ে যা। তবে সাবধানে রাখিস। গরিবের শথের ক্যামেরা নষ্ট হলে কিন্তু ফুল জরিমানা দিতে হবে।

তার পর রাত ১১ বাজে ওর খবর নেই রাত ১২ বাজে খবর নেই। ওর ফোন বন্ধ। বাড়ি থেকে আন্টি ফোন করে ছান্নুর ফোন বন্ধ কেন। আমি বলি এক বন্ধুর বাড়িতে গেছে । হয়তো মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। আন্টি বলে বন্ধুর নাম্বার দাও। আমি অপারগ। তাকে বলি চিন্তা করবেন না। আমি খোজ নিয়ে জানাচ্ছি।

পরদিন সকাল ৮টায় ছান্নুর ফোন। ভাই তুমি একটু রমনা থানায় আসবে। আমি হতবাক হয়ে যাই। কেন কি হয়েছে? তুমি আস না, ভাই, প্লিজ।

থানা পুলিশ আমি এমনিতে ভয় পাই। নিরীহ ধরেনের গোবেচারা টাইপ আমি। ঘরের বসে বই পড়ে, অফিস করে, ইটিস পিটিস করাই আমার কাজ। থানা পুলিশ করবে পাড়ার বড় ভাই, রাজনীতিবিদ ....

(লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে, তাই আসল ঘটনাটা বলি)

ওই দিন রাত আনুমানিক ৮টার দিকে ও মৎস্ ভবন এলাকা থেকে রমনার দিকে হেটে আসছিল। এ সময় ২ জন আরমি ওকে থামতে বলে। ওর ভাষায় শুনুন

কি নাম?
জি, ছান্নু
বাড়ি কই?
বরিশাল
ও বরিশাইল্যা
জি বরিশাইল্লা
হাতে কি
ব্রেস লেট
ও তাইতো দেখছি, গলায় লোহার দড়ি (চেইন), চুল বড় মস্তান, তা কি করেন
জি লেখা পড়া করি
কোথায়
ঢাকায়
ঢাকায় কোথায়
ফার্মগেটে
কই পরিচয়পত্র দেখি
না মানে আমি কেবল কোচিং করছি পাশ করলেই ভর্তি হব।
কোচিং করছেন তার আইডি কার্ড
জি আনিনি, ব্যাগের ভিতর রয়েছে
আইডি কার্ড কি ব্যাগের ভিতর রাখার জিনিস, তা হলে ব্যগের ভিতরে রাখছেন কেন

ছান্নুর ভাষায় - এটা কোন প্রশ্ন হলো, ব্যাগ নিয়ে কোচিং করি, তো সেটা ব্যাগে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

ও বলে, আমি আর্মি ভাইকে বলি, ভাই আমার একটু দ্রুত যেতে হবে।

আর্মির ভাষায়: ..... বাচ্চা, তোর জরুরী কাজ তাতে আমার কি, শালা "বাঞ্চোদ" সন্ত্রাসী কাজ করিস। বাবার টাকা এনে ঢাকায় বসে মাইয়া নিয়া ফুর্তি করিস। গাজা খাস ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

সান্নু অবাক হয়। এরকম আচরনের জন্য ও প্রস্তুত ছিল না। কখনো এরকম আচরণ দেখেনি। তাই কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পরে। একটু ক্ষ্যাপাটে টাইপের হওয়ায় হয়তো জেদ চেপে যায়। ও বলে গালি দিবেন না।
.... বাচ্চা গালি দিব না তো আদর করবো

ভদ্রলোকরা ও রকম বিশ্রি ভাষায় গালি দিয়ে কথা বলে না

তবেরে বাঞ্চোদ, ভদ্রতা শেখাও, ........ বাচ্চা আয় তুই দেখ ভদ্রতা কাকে বলে ....... কলার ধরে টেনে নিয়ে যায় রাস্তার ওপাশে দাড়ানো গাড়ির কাছে।

তার পর ওকে লাথি, থাপ্পড় দিয়ে নিয়ে যায় রমনা থানায়। নাপিত এনে রাত্রেই সব চুল কেটে ফেলা হয়। গলার চেইন, হাতের ব্রেসলেট ফেলে দেয়। সারা রাত্র হাজত ভরে রাখে। সকাল বেলা হাজত থেকে বের করে থানার ডিউটি অফিসার বলে তোর আত্মীয় স্বজন কে কে আছে তাদের ফোন করে থানায় নিয়ে আয়।...

*****

জুবায়ের ভাই,

"বড় চুল রাখা, হাতে ব্রেসলেট পড়া, জিন্স টি শাট পড়া কি বাংলাদেশের আইনে কোন অপরাধ? বা ও গুলো যারা পরে তারা সবাই সন্ত্রাসী, মাইয়া নিয়া ফুর্তি করে?

যদি অপরাধ না হয় তা হলে কি আমাদের কিছুই করার নেই?"

এ কথা গুলো ছান্নুর। আমাকে বলে ছিল। আমি উত্তর দিতে পারি নি। অক্ষম। আপনার উত্তর জানা থাকলে জানাবেন। ছান্নু বড় কৃতজ্ঞ থাকবে। আমিও।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

প্রিয় অতিথি লেখক,
এতো বড় একটা লেখা দিলেন! আর নিজের নামটা দিতে ভুলে গেলেন? নামটা জানান প্লীজ।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আগেও মনে হয় পড়েছিলাম। আমিও বড় চুল রাখি। এইসব শুনে খুব ভালনারেবল মনে হয় নিজেকে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

আরিফ জেবতিক এর ছবি

মাহবুব মুর্শেদ,অতিথি হিসেবে পোস্ট বা কমেন্ট করার সময় নামের কলামে বিল্টইন হিসেবে "অতিথি"শব্দটি আসে।
আমার পরামর্শ এই বিল্টইন শব্দটি তুলে দিন।
তখন পোস্ট বা কমেন্ট করতে হলে অবশ্যই নাম বা নিক লিখতে হবে,এবং এটা আমাদের জন্য ভালো হবে।

অনেকেই হয়তো তাড়াহুড়োতে নিক বা নাম লিখতে ভুলে যাচ্ছেন।

------------------------------
অতিথি লেখকের পাসওয়ার্ড ও নিক নেমটি কি স্থায়ী ভাবে প্রথম পাতায় রাখা যায় না?তাহলে নতুন লেখকরা এসে বিষয়টি সম্মন্ধে জানতে পারবেন।
-----------------
অতিথি লেখকের অটো লগ আউট সময় বেধে দেয়া দরকার।এটা হতে পারে বড়ো জোর ৩০ মিনিট।তারপরেই তিনি লগআউট হবেন।
৩০ মিনিট একটি পোস্ট লেখার জন্য যথেষ্ঠ।
পরবর্তীতে অন্য লেখক সুযোগ পেলেন।
কমেন্ট করার জন্য তো আর লগইন থাকা লাগছে না,তাই না?

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

লাসভেগাস যাচ্ছি এক কনফারেনসে। ফিরে এসে করে দিবো।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

লিখাটা পড়লাম। প্রচন্ড গতিময়।
আপনার করা প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা, আবার সবারই অজানা। এদেশে ধর্মের লেবাস পরে জায়নামাজে মাথা ঠুকতে ঠুকতে কপালে দাগ ফেলে দেওয়ারাও তাদের লেবাসকে ব্যবহার করে আকাম-কুকাম করতে। আর ছান্নুদের চুল সামরিক স্টাইলে না ছাঁটলেই যত দোষ! ঢাকার অধিকাংশ ছিনতাই কারীর বেশভূষাই একেবারে ক্লিনশইভড ভদ্রলোকের।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অতিথি এর ছবি

মাহবুব ভাই. 'রেনেসা' নামে লেখা চলবে।

অছ্যুৎ বলাই - একদম ঠিক।

সৌরভ এর ছবি

ওরা বিপ্লব নিয়ে আসে । ভাবতেই আবার প্রস্রাবের চাপটা প্রচণ্ড হয়ে উঠলো রাশেদের । ওরা রাতে আসে, আসার দিনটার নাম দেয় বিপ্লব দিবস; এসেই ওরা রাস্তায় ছেলেদের চুল ছাঁটে, মেয়েদের ঘোমটা পরায় ।
..
চুলের উপর ওরা এতো ক্ষাপ্পা কেনো? চুল কি বিদ্রোহের মুক্তির প্রতীক? নাকি ওরা চুল ছাঁটার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুর যোগ্য নয়?

"ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল , হুমায়ুন আজাদ"

হুমায়ুন আজাদকেই স্মরণ করা ছাড়া আর কী করতে পারি?



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

অমিত আহমেদ এর ছবি

সত্য ঘটনা?


একটা ঝলসে যাওয়া বিকেল বেলা, একটা লালচে সাগরের জলে
যায় ভেসে যায় স্বপ্ন বোঝাই, নৌকা আমার কাগজের...

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ভেতরের চেয়ে বাহিরটা যাদের কাছে মূখ্য তাদের কাছে এরচেয়ে বেশী কি আশা করা যায়?
আর্মির ট্রেনিংটাই তো সেরকম!!
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

রেনেসা (guest) এর ছবি

সবাইকে ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ছান্নুর রুপের যে বর্ননা দিলেন এই রুপের ছেলেদের দিকে মানুষ একটু ভ্রু কুচকেই তাকায়......সুতরাং আর্মিদেরও দোষ দিতে পারছিনা

( জয়িতা )

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।