বিপন্ন বনের বিপন্ন মানুষদের উষ্ণতায় (দ্বিতীয় কিস্তি)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৩/১১/২০০৭ - ৯:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

..

জুয়েল বিন জহির

পয়লা কিস্তি

পরাগ রিছিল ফোনে বলেছিল যে, ২৬ তারিখে নাকি সাইন্যামারি গ্রামে ওয়ানগালা হবে। জলছত্রে এব্যাপারে কেউ তেমন কিছু জানে বলে মনে হলো না। ওয়াগালা হলো জুমচাষী মান্দিদের ঐতিহ্যবাহী এক ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। সাংসারেক (মান্দিদের আপন ধর্মের নাম) মান্দিরা একে বলেন ওয়ান্না। এক সময় হাবা বা জুমে উৎপাদিত ফসলাদি দেবতা মিসি আর সালজং এই দুইভাইকে উৎসর্গ করার পরই মান্দিরা তা খেতে পারতেন। সাধারণত কার্তিক মাসে এই ওয়ান্না শুরু হতো। আনন্দ-উৎসব আর আপন বিশ্বাসের চর্চার মধ্যদিয়ে নিজেদের জাতিগত সংহতিকে শাণিত করে নেয়ার এক অন্যতম মাধ্যম ছিল এই ওয়ান্না। একেক গ্রামে একেক দিনে আয়াজন করা হতো এই কৃত্যের। গ্রামের নকমার সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করেই কোন কোন গ্রামে ৩ দিন/৫দিন/৭দিন ধরে চলত এই উৎসবের। তবে তিন দিনের নিচে ওয়ান্না করা যেত না কোনভাবেই। ১৯৫০ সালে শালবনের মান্দিরা জুমচাষের অধিকার হারানোর পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় এই ওয়ান্না। অবশ্য কেবল জুমচাষ বন্ধ হওয়াই নয়, মিশনারীদের কর্মতৎপরতাও এর জন্য দায়ী। ব্রিটিশদের বদান্যতায় মিশনারীরা যখন মান্দি এলাকাগুলোতে তাদের বিশ্বাস চাপানোর কাজটি মোটমুটি পর্যায়ে নিয়ে আসে তখনই তারা ফতোয়া দেয় যে, তাতারা, সুসিমি, মিসি, সালজং, চুরাবুদি প্রভৃতি দেব-দেবতার পূজা আসলে শয়তানের পূজা(!)। আর ওয়ান্নাতে মিসি সালজং এর উদ্দেশ্য যেহেতু জুমের শস্য-ফসলাদি উৎসর্গ করা হয় সেহেতু এটা কোন ভাল(?) কিছু হতে পারে না। প্রভু যিশুতো আর এতে সন্তুষ্ট হতে পারে না(!)। খ্রিষ্টভক্ত হিসেবে এই অজাচারতো(?) আর চলতে দেয়া যায় না। অতএব বন্ধ করে দাও ওয়ান্না, রংচুগালা, গালমাকদুয়া, মানসাসহ সাংসারেকদের সকল কৃত্য। শুধু তাই নয়, মান্দিদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র আদুরি,দামা, রাং, বলথং, নাগাড়া ইত্যাদি বাজানোর উপরও তারা ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। নিজেদের বিশ্বাসের আগ্রাসনকে আরো শক্তিশালী করার জন্য তারা মান্দি বাড়ি থেকে ঐসব বাদ্যযন্ত্র কিনে নিয়ে যায় মিশনে, তারপর সেগুলোকে ঊঁই পোকা দিয়ে খাইয়ে বা পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে মান্দি সমাজকে শুদ্ধ(!?) করে নেন খ্রিস্টান মিশনারিরা। সময়ের ধারাবাহিকতায় মান্দিরা আপন ধর্ম-আপন সংস্কৃতি ছিন্ন হয়ে যখন প্রায় ৯৯.৯৯%(আরো বেশি হবে) খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হন তখন এই মিশনারিরাই আবার নতুন করে ফতোয়া জারি করেন। মান্দিদেরকে নতুন করে বুঝানো হয় যে, তাদের আপন সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে। আদুরি, দামা, রাং, বলথং, আম্বেংগি এগুলোকে রক্ষা করতে হবে; ওয়ানগালা (মিশনারিরা ওয়ান্নাকে এই নামেই ডাকে) পালন করতে হবে। ধন্দে পড়ে যান মান্দিরা। মিশনের ফাদারের উদ্যোগে আবারো শুরু হয় ওয়ানগালা। তবে এটা মিসি-সালজংকে উৎসর্গ করার ওয়ান্না নয়, এটা হচ্ছে "যিশুনা ওয়ানগালা"। আসলে প্রভু যিশুর তরে নিজেকে সমর্পণ করার এক নতুন তরিকা। বিভিন্ন গ্রাম থেকে মান্দিরা জমিতে উৎপাদিত ফসলাদি এনে ফাদারের নেতৃত্বে খ্রিস্টযোগের মাধ্যমে তা প্রভু যিশুকে উৎসর্গ করেন। এখানে সাংসারেক খামালের কোন দরকার হয় না। কেবল মঞ্চ অনুষ্ঠানের সময় ৫ মিনিটের জন্য গ্রামের বুড়োদের দিয়ে আগের দিনের ওয়ান্নার রীতিনীতির কিছু অংশ মঞ্চায়ন করা হয়। যাই হোক বেশ কয়েকবছর টানা চলার পর নানান অজুহাতে মিশন এবার ওয়ানগালা পালন করছে না।

তো সাইন্যামারিতে গ্রামবাসীরা ওয়ানগালা করবে তা বেশ উৎসাহ তৈরি করেছিল আমাদের মধ্যে। দুপুর বারোটার মধ্যেই কিছু মান্দি যুবকদের সাথে মিটিং সেড়ে পঁচিশ মাইল থেকে সঞ্জয়কে নিয়ে রওনা দেই সাইন্যামারির উদ্দেশ্য। দোখলা এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ওয়ানগালা হবে তবে তা আজকে নয়, নভেম্বরের ৭ তারিখে। কী আর করা, সাইন্যামারিতে না গিয়ে চলে আসলাম বচনদার (মান্দি কবি বচন নকরেক) বাড়িতে। গাছগাছালিতে ভরা সুন্দর-ছিমছাম বাড়িতে পাওয়া গেল তাকে। বাড়িতে বরাবরের ন্যায় একাই ছিলেন। বড় মেয়ে সুসিমি বাড়িতে ছিল না, বারোমারি তীর্থে গেছে; ছোট রিম্মত বাড়িতে। আমাদের দেখেই মাসির বাড়িত ভোঁ দৌঁড়। ঝর্ণাদি কর্মস্থল দূর্গাপুরে। যাই হোক, তিনজন চলে এলাম পীরগাছা চায়ের দোকানে। চা-সিগারেট আর আড্ডার ফাঁকেই সেখানে দেখা হয়ে গেল তিরেশ নকরেক এর সাথে। তিরেশদা হলেন একাধারে মান্দি গীতিকার, সুরকার, গায়ক। ১৯৮৪ সাল থেকে আজও পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতারে সালগিত্তাল নামক মান্দিদের এক অনুষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছে না। তার লেখা-সুর করা ও গাওয়া অসংখ্য গান প্রচারিত হয়েছে সেখান থেকে। যে কারণে বাংলাদেশের মান্দি সমাজে উনার রয়েছে বিশাল পরিচিতি। গারো হিলসেও তাঁর নাম পরিচিত। খাবাকনি খাবাক নামের মান্দি টেলিফিল্ম পরিচালনা করে এই পরিচিতির পরিধি আরো বেড়ে গেছে ইদানিং। পীরগাছা থেকে বচনদাসহ আমরা চলে এলাম জনিক আচ্চুর (জনিক নকরেক-সাংসারেক খামাল)। আচ্চুকে বাড়িতেই পেলাম। কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছেন সঞ্জীব দ্রংদের কনফারেন্স থেকে। মান্দি সংস্কৃতির উপর দুই ঘন্টা বক্তৃতা করেছেন। শালবনে আচ্চুর বাড়িই আমাদের মূল ঠিকানা। গত পাঁচবছর ধরে প্রতিনিয়ত জ্বালাতন করে চলেছি এই পরিবারের সকলকে তাদের অকৃত্রিম ভালবাসাকে পূঁজি করে। আচ্চুর সাথে প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে ব্যাগটা বিজন্তীদির ঘরে ব্যাগ রেখে আমরা চলে এলাম দোখলা বাজার। এখান থেকেই সঞ্জয়কে বিদায় জানাতে হয়।

সন্ধ্যার দিকে বচনদা তার মায়ের বাড়িতে নিয়ে যান, তার গুমী (দুলাভাই) বারোমারি তীর্থ থেকে ফিরেছেন, কাজেই ও বাড়িতে চু আজকে নামবেই। সাথে অলিশনদা(জনিক আচ্চুর বড় ছেলে), তিরেশদা। আমরা গিয়ে আসন গাড়লাম উঠোনে। বারন্দায় কিছু চাচ্চ্রি (আত্মীয়) নিজেদের ভেতর কথাবার্তা বলছেন। উনাদেরকে বিদায় করেই আমাদের প্রত্যাশিত চু নামানো হল। অলিশনদা চু ছাঁকতে বসে গেলেন। মিঠুর (বচনদার ছোটভাই) এসে আমাদের গ্লাস ভর্তি করতে লাগল। কথা হচ্ছে অনেক, প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক সব রকমের। তরল পেটে যত জমা হচ্ছে, বচনদা ততই নিজেকে খুলে চলেছেন, বলে চলেছেন নিজের গহীনে জমে থাকা অনেক পুরনো অথচ জীবন্ত নানান কথা....(অসমাপ্ত)


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সেমেটিক ধর্মগুলো বহু ক্ষুদ্র জাতিস্বত্বার সংস্কৃতিকে গিলে খেয়েছে ।
জহির আপনার লেখা খুব ভালো লাগছে । একই দেশের মানুষ হয়ে আমরা কে কবে এঁদের খবর রেখেছি । সংখ্যাগরিষ্ঠের এই উপেক্ষা বড় অশ্লীল ।

পরের পর্বগুলো দ্রুত নামান । এরকম লেখায় সচলায়তন ঋদ্ধ হোক ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসান মোরশেদ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। পরের পর্বগুলো যথাশীঘ্র নামানোর চেষ্টা করব।

মুজিব মেহদী এর ছবি

জুয়েল বিল জহিরের লেখাটা বেশ আগ্রহ তৈরি করল। পরের কিস্তিগুলোও পড়তে চেষ্টা করব।

আচ্ছা শব্দটি 'সাংসারেক' নাকি 'সংসারেক'? আমি ২০০৫ এ আমার ইকোপার্ক উন্নয়ন : জীববৈচিত্র্য রক্ষার নামে জীবন ও প্রতিবেশ বিনাশী তাণ্ডব গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করে আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রংয়ের সাথে তাঁর আদাবরের বাসায় একটা বৈঠক দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে নিশ্চিত করেন শব্দটা 'সংসারেক'। বইতে শেষপর্যন্ত 'সংসারেক'ই মুদ্রিত হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে শব্দটি 'সাংসারেক' কিনা তা নিয়ে আমার নিজেরও সন্দেহ রয়েছে। মান্দিদের ক্ষেত্রে শব্দটা প্রচলিত থাকায় আমি তা ব্যবহার করেছি। ‌'সংসারেক' সম্বন্ধেও আমি ঠিক নিশ্চত না। তবে মান্দিদের আদি ধর্মের অনুসারি সহযোদ্ধা তরুন কবি-গবেষক পরাগ রিছিল আদিধর্মের অনুসারি বিভিন্নজনের সাথে মিশে শব্দটা ‌ 'সংস্রেক' হবে বলে মত দিয়েছেন।
পরবর্তীতে আমি আমার লেখায় সংস্রেক শব্দটাই ব্যবহার করার পক্ষে।

মুজিব মেহদী আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি ভালো প্রসঙ্গের অবতারণা করায়।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

১৯৫০ সালে শালবনের মান্দিরা জুমচাষের অধিকার হারানোর পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় এই ওয়ান্না। অবশ্য কেবল জুমচাষ বন্ধ হওয়াই নয়, মিশনারীদের কর্মতৎপরতাও এর জন্য দায়ী।

যথার্থই বলেছেন। আর দেখুন, কথিত সভ্যতা কিভাবে একটা জাতির জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি-- সব কিছুই গ্রাস করে!

পরের পর্বের অপেক্ষায়...


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

অতিথি লেখক এর ছবি

বিপ্লব রহমান আপনাকে লাল সেলাম।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আপনার লেখাগুলো আমাকে উজ্জীবিত করে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়।
ভালো লাগলো খুব।
পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

আর্ণিশ মান্দার সাথে চু খাওয়ার স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন। আহ্।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

নজরুল আপনাকে ধন্যবাদ অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য।

আচ্ছা, আর্ণিশ মান্দা কোন এলাকার?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আর্ণিশ মান্দা নেতা না কোনো। সাধারণ মানুষ। তার সাথে আমার পরিচয় কবি রফিক আজাদের মারফত। বিরিশিরিতে। রফিক আজাদের একটা কবিতা আছে তারে নিয়া... 'অহর্ণিশ'।

তবে একটা ঘটনা মনে পরে খুব... একবার কবির সাথে পানাহার করতেছিলাম... হঠাৎ খবর আসলো বাঙ্গালী তরুনদল কর্তৃক মান্দি তরুণী ধর্ষনের। ঠিক ঐ মূহুর্তে আর্ণিশের চোখে যে ঘৃণা দেখছিলাম... জীবনেও ভুলবোনা।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সবুজ বাঘ এর ছবি

জুয়েল, নিমন্ত্রণ তো পাইলাম না রে?

অতিথি লেখক এর ছবি

সংস্রেকদের ওয়ান্না হবে ডিসেম্বরের শেষ দিকে। প্রস্তুত থাকেন। বরাবরের ন্যায় এ ব্যাপারে আমি যোগাযোগ করব আপনার সাথে।

কেমিকেল আলী এর ছবি

জুয়েল আসলেই দারুন হচ্ছে লেখাগুলো।
চলতে থাকুক এই সিরিজ।
--------------------------------

কেমন আছিস?

অতিথি লেখক এর ছবি

দুস্ত ভালা আছি। তুমারে ইদানিং কম পাই, ব্যাপারটা কি? খুব একাডেমিক ঝামেলাই আছ নাকি?
আর দারুন হচ্ছে কিনা তা জানি না, তবে আমি আমার মত করেই আরো কয়েকপর্ব লিখব আশা করছি।

শেখ জলিল এর ছবি

এরকম আরও লেখার অপেক্ষায় রাইলাম।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

অতিথি লেখক এর ছবি

ইচ্ছে আছে আরো কয়েকপর্ব লেখার।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।