যে শহরে ফিরিনি আমি-২

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: সোম, ২৮/০১/২০০৮ - ৮:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২৩/০১/০৮
দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট

দুবাই এয়ারপোর্টে নামার পর প্রথমেই আমার যে অনুভূতি হলো-'আমাদের ঢাকা এয়ারপোর্টকে এবার নিঃশর্ত ক্ষমা করে দেয়া যায়!'

ভীষন চকচকে,মারাত্নক রকমের আলোকসজ্জা সব ঠিক আছে কিন্তু সেবার মান? চারপাঁচটা ইমিগ্রেশন পোষ্টে বিরস বদনে বসে আছে ছাঁটা দাড়ী মুখে কয়েকজন । দুয়েকজন স্থানীয় হতে পারে,বাকীগুলো হয় ভারতীয় নয় পাকিস্তানী ।বোরকাওয়ালী এক অফিসার ও দেখলাম বসে বসে ঝিমোচ্ছেন । তাদের চোখমুখে কোন ভাষা নেই,ভব্যতা নেই ।
ইংল্যান্ডের লুটন কিংবা স্কটল্যান্ডের এবারডিনের মতো ছোট এয়ারপোর্টের কর্মীরা ও এর চেয়ে অনেক বেশী আন্তরিক,দক্ষ ও প্রফেশনাল
আমি বৃটেনের পশ্চিমে যাইনি,যাইনি ভারতের পূর্বে । কিন্ত আমার মনে হয় পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পুর্বে যেতে প্রফেশনালিজম ব্যাপারটা কমতে থাকে ।

ভেতরে ঢুকার পর বিশাল বাজার দেখলাম ।
দেখলাম এবং যুক্তি খুঁজে পেলাম না এই বাজারকে নিয়ে মানুষের এতো আগ্রহ,এতো প্রচারনা কেনো? কেন্টের কাছাকাছি ব্লু ওয়াটার শপিং মল কিংবা টেসকো,সেন্সবেরির অনেক শপ এর চেয়ে ছোট হবেনা ।
টেক্স ফ্রি ট্যাগ ঝুলিয়ে রেখেছে । কিন্তু দাম বৃটেনের বাজারের চেয়ে কোন ভাবেই কম না । আমি বাচ্চাদের জন্য কিছু চকলেট আর এক কার্টুন বেনসন কিনলাম । দাম পড়লো প্রায় ৮৫ পাউন্ড !

দোতলায় উঠে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে সারিসারি মানুষকে ঘুমাতে দেখলাম ফ্লোরে । ঠিক কমলাপুর রেলস্টেশন । মাথার নীচে লাগেজ ঢুকিয়ে কার্পেটের উপর ঘুম! একজনের গায়ে তাঁতের গামছা ও দেখলাম । আহারে আমার বাঙ্গাল ভাই!

ভেতরের দিকে ঢুকে একটা ছোট স্ন্যাকস বারে কফি ও ক্রসেন্ট অর্ডার দিলাম । মেয়েটা ফিলিপাইনের হবে,ইংরেজীর বলার অবস্থা সকরুন । কফিতে চুমুক দিচ্ছি,দেখি মলিন পোষাক গায়ে এক মধ্যবয়স্ক তার মুখে দাড়ি চেহারায় ভারতীয় কিংবা বাংলাদেশী ছাপ বাংলা হিন্দী উর্দু মিশিয়ে পানি চাচ্ছে ফিলিপিনো মেয়েটার কাছে । লোকটা খরিদ্দার না । তাই মেয়েটা ঠান্ডা গলায় না বলে দিলো ।
আমার ব্যাগে দুবোতল মিনারেল ছিলো । একটা বের করে লোকটাকে দিলাম । কোন কথা না বলে প্রায় পুরোটা সে গলায় ঢেলে দিলো দ্রুত । তারপর আমাকে একটু ও অবাক না করে আমাদের ময়মনসিংহ কিংবা কুমিল্লার আদি অকৃত্রিম ভাষায় বলে উঠলো - 'আল্লা আপনের ভালো করুক বাবা'

আমি আল্লাহর ভরসায় বসে না থেকে এগিয়ে যাই এমিরেটস এর পরবর্তী ফ্লাইটের দিকে ।

চেকইন করা ছিলো আগেই ।সরাসরি ভেতরে ঢুকেই তো দেখি এলাহীকান্ড ।অন্ততঃ চারপাঁচশো মানুষ একসাথে গিজগিজ করছে । কারো হাতে রেশমী কম্বল, কারো হাতে বিশাল রেডিও আর প্রায় সকলের হ্যাণ্ডবেগ মোটা সুতা দিয়ে বাঁধা এবং বড়বড় করে নাম ঠিকানা লেখা!
একদেশী ভাই সুটটাই পড়া সাথে তার খাঁটি দুবাইওয়ালী বউ । আমি স্বচক্ষে এর আগে পবিত্র দুম্ব্বা দেখিনি ।এইবার হলো ।
আমি এককোনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি কখন এই ডাক আসবে আর এই বিশাল জনসমুদ্রের সাথে মিশে গিয়ে আমি ফুলসিরাত পার হবো ।
ডাক এলো এবং অবধারিত ভাবেই শুরু হলো হুড়োহূড়ি । জগদ্দল পাথর নড়া শুরু করলো । সামনে আরেকটা সরু গেইট ।লাইনের পেছন থেকে দেখলাম গেইটের কাছাকাছে তেড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনজনের একটা দল-সেই ট্রেডমার্ক ,হাতে রেডিও এবং কম্বল । উদ্দেশ্য বোঝলাম ,জনাবদের টার্গেট হলো কিউ এড়িয়ে ভীড়ে মিশে যাওয়া ।
ততোক্ষনে মনস্থির করে ফেলেছি,এরা যদি আমার আগে ঢুকতে চায় তাহলে খাঁটি দেশী কায়দায় ঝামেলা পাকাবো ।
না আমি কিউ অনুযায়ীই এগিয়ে গেলাম । পরে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি থ্রি কমরেডস ঠিক আমার পেছনে! আর তাদের পেছনে সাদা চামড়ার এক বুড়ো,মানবা জাতির প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা তার দৃষ্টিতে ।
থ্রি কমরেডসদের লিডার যিনি তার দড়িবাঁধা লাগেজে দেখি ঠিকুজি লেখা

মোহাম্মদ মন্টু মিয়া
সরাইল
ব্রাম্মনবাড়িয়া

কয়েকশত মানুষের দীর্ঘ সারি এবার ঢুকলো এক অতিসরু টানেলে ।এই বাঁক সেই বাঁক টানেল তো আর শেষ হয়না । কটকটে সবুজ রং দেয়ালের( সিলেটে এই রংকে আমরা বলি 'কউচ্ছা') । এই অসহ্য রং,গাদাগাদি এবার আমার মাথা শুরু করেছে । হঠাৎ খেয়াল হলো-ফায়ার এক্সিট কই?
এই যে কয়েকশত মানুষ এই টানেলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে,এই মুহুর্তে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে,আগুন লাগলে পরিনতি কি হবে?

***************

অনেকের কাছেই শুনেছিলাম,শেষমেষ আমাদের অমিত আহমেদ ও তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলো । এবার হাড়ে হাড়ে টের পেলাম দুবাই-ঢাকা ফ্লাইট, এ রিয়েল পেইন ইন দ্যা এস!
৩৫ হাজার উপরে চলছে এয়ারক্রাফট । লোকজন সীট ছেড়ে প্যাসেজে দাড়িয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে । বাঙ্গালের আড্ডা । কি নেই আড্ডায়?
বিমানবালক ও বালিকাদের সেবার মান পুরোপুরি প্রপাত ধরনীতল । খাবার দেয়ার দুঘন্টা পর ও খালি কন্টেইনার ফিরিয়ে নেয়ার নাম নেই । এক বালিকাকে ডেকে বললাম-এগুলো নিচ্ছো না কেনো?
তার ভুরু কোঁচকানো জবাব-প্যাসেজ খালি না হলে কি করে নেবো?
দুনিয়া বড় নিষ্ঠুর,মাঝে মাঝে সুন্দরী বালিকাদের সাথে ও রুঢ় হতে হয়
কন্ঠ যথাসম্ভব নির্মম করে বললাম-সেটা আমার গুহ্যদ্বারের ব্যথা নয় । আমার খাবার শেষ,তোমাকে এখনই পরিস্কার করতে হবে ।পরিস্কারকরনই তোমার চাকরী বালিকা ।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

দেশীভাইদের সিনেমার চেয়ে দেখবেন দুবাইওয়ালাদের ফাজলামো বেশী বিরক্তিকর ।
এমিরেটস এর দুবাই ঢাকা ফ্লাইটের সার্ভিস মান খুব জঘন্য তবে কড়া করে একবারে ইংরেজীতে ধমক দিলে দেখবেন বালিকারা কেমন নরোম হয়ে যায় চোখ টিপি

আর দুবাইয়ে বেশী শপিং করলে হ্যান্ডলাগেজটা লটে পাঠিয়ে দেবে । ঢাকা এয়ারপোর্টে এসে লাগেজের জন্য বেশ দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয় । সো,একটা লাগেজই লটে দেয়া ভালো ।

হ্যাঁ,দেখা হবে আশা করি ।
যাত্রা নিরাপদ হোক ।
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

কোনোকালে ওই অঞ্চলে যাইনি, ইচ্ছেও নেই। খরচ কিছু বেশি হলেও সই। বাজার বানিয়ে রাখা দুবাই এয়ারপোর্ট নিয়ে মানুষের মুগ্ধতা শুনে শুনে কান ঝালাপালা। যত্তোসব!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

শেখ জলিল এর ছবি

দুনিয়া বড় নিষ্ঠুর,মাঝে মাঝে সুন্দরী বালিকাদের সাথে ও রুঢ় হতে হয়......বাস্তব!

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

সুজন চৌধুরী এর ছবি

আপনিতো ভয় দেখালেন ভাই।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

আমি এর আগে যতবার দেশে গিয়েছি, এমিরেটসেই। অভিজ্ঞতা আপনার বর্ণনার মতোই খাপে খাপ।

এবার গিয়েছিলাম কাতারে। দোহা অনেক ছোট এয়ারপোর্ট। সবচেয়ে মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে ফাস্টফুডের দোকানে। প্রথমে একটা কিউতে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে কি কি নিবো, তার দাম দিয়ে রিসিট নিতে হয়। এরপর রিসিট নিয়ে অন্যত্র জমা দিলে তারপরে খাবার পাওয়া যাবে। বড় সমস্যা হলো, রিসিট নিয়ে খাবার সার্ভ করার ওখানটায় কোনো কিউ নেই। যার যার ইচ্ছেমত পাবলিক রিসিট হাতে ঠায় দাড়িয়ে আছে আর মাত্র দুইজন কর্মী randomভাবে যখন যারটা ইচ্ছা রিসিট নিচ্ছে।

ভব্যতার ব্যাপারটা একেবারেই সত্য। এমনকি ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বসা লোকটিও কোনো বাক্যের সাথে please শব্দটা জুড়বে না।

প্লেনের ভিতরের পরিবেশের জন্য যাত্রীদের দোষটাই সবার চোখে পড়ে। কিন্তু টেকনিক্যালি দায়ভারটা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের। এতদিনের ফিডব্যাক থেকে তাদের বুঝা উচিত কিভাবে এগুলো কন্ট্রোল করা উচিত। ৯৯% যাত্রী যেখানে বাংলায় কথা বলে, অধিকাংশই ইংরেজি বুঝে না, সেখানে এয়ার হোস্টেসরা বাংলা না বুঝলে তো সমস্যা হবেই। যাত্রীদেরকে সভ্য আচরণ করতে টেকনিক্যালি বাধ্য করার দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়, বিরক্তি দেখানোটা বরং তাদের প্রফেশনাল ব্যর্থতা।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

দুবাই এয়ারপোর্টের অভিজ্ঞতা মোটামুটি আমারও তথৈবচ। সমস্যা হলো ওরা বাংলাদেশীদের প্রতি বেশী খারাপ ব্যবহার করে। একটা গুরুগীরিও করে মনে হয়েছে আমার। দুবাইয়ে বসবাসকারী বাংলাদেশী শ্রমিকদের অনেকেই ইন্ডিয়ানদের অধীনে কাজ করে। সেই মনিব-শ্রমিক অভিব্যক্তিটাই ওদের সার্বিক আচরনে প্রকাশ পায়। ঢাকা-দুবাই-মিউনিখ রুটে একবার ইমিগ্রেশনের ইন্ডিয়ান চ্যাংড়া আমাকে রীতিমতোন ভিসা অফিসারদের মতোন জেরা করতে শুরু করলো। উচ্চারণ যথারীতি আমাদের দেশের শ্যালো-এঞ্জিন বিশিষ্ট ভটভটি নৌকার মতোন,
-whad du you sttuddy there?
-materials science
-which subjekkte?
-I just said that
-which subjekkkte, tell me about itte
-You are not gonna understand that
এই পর্যন্ত আলাপ হবার পরে চ্যাংড়া গেল আরেকজনকে ডাকতে। আমার বিরক্ত চেহারা দেখেই হয়তো। সেই লোক এসে বললো (এটার উচ্চারণে তেমন বিভ্রাট নেই),
-What are your majors?
-Didn't you see my visa on the passport? that should explain...
-ya..but can you tell me about your majors?
-How are you supposed to understand that?
-I will; tell me your majors
-well, Advanced Materials techniques, nano-technology...
-is it engineering or IT
-none of them
-which university?
ডয়েচ উচ্চারণে বললাম, উনিভার্সিটেট উলম।
-sorry?
আবারও বললাম। একইভাবে।
ছোকরা এবারে ইউনিভার্সিটির নাম বোঝার চেষ্টা বাদ দিয়ে আমার পাসপোর্টটা নিয়ে কিছুক্ষণ গবেষণা করলো। আমি চোখ কটমট করে তাকিয়ে রইলাম। আমার রাগ সীমা অতিক্রম করছে সেটা বুঝেই হয়তো,
-Ok you can go
বলে আমাকে ইমিগ্রেশন পার করে দিল। এরপরের দৃশ্য আপনার বর্ণনার মতোই।

অমিত আহমেদ এর ছবি

ইমিগ্রেশন কিংবা কাস্টমস এর ঝামেলায় কখনো পড়িনি। বরং একটা রহস্যজনক বাড়তি খাতির পেয়েছি সবসময়। এটা আমার লাক বলতে হবে। আর অতিরিক্ত ভ্রমনের কারণে এখন কোনো কিছুতেই বিরক্ত হই না... সব ধরণের যাত্রী (এবং কেবিন ক্রুদের) একটা ছক কাটা হয়ে গেছে মাথার ভেতর।

লেখা ভাল্লাগলো।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।