হাসিনা' কে ঘিরে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিময়তা ।। শেষপর্ব

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৯/০৭/২০০৭ - ৬:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পরদিন বিকেলবেলা ।
বড়মামার হাত ধরে যাই একটা বাড়ীতে । দোতলা কিংবা তিনতলা । সাধারন । একেবারেই বৈশিষ্টহীন । এরচেয়ে কতো কতো জমকালো দালানবাড়ী আমাদের মফস্বল শহরেই ।
সে বাড়ী তখনো বংগবন্ধু জাদুঘর হয়নি । পুলিশ প্রহরা নেই ।কোনো প্রটোকল নেই । বাড়ীর গেটে দাঁড়িয়ে আমি তাকাই দোতালার বারান্দায় ।

হাসিমুখ একটা মানুষ হ...পরদিন বিকেলবেলা ।
বড়মামার হাত ধরে যাই একটা বাড়ীতে । দোতলা কিংবা তিনতলা । সাধারন । একেবারেই বৈশিষ্টহীন । এরচেয়ে কতো কতো জমকালো দালানবাড়ী আমাদের মফস্বল শহরেই ।
সে বাড়ী তখনো বংগবন্ধু জাদুঘর হয়নি । পুলিশ প্রহরা নেই ।কোনো প্রটোকল নেই । বাড়ীর গেটে দাঁড়িয়ে আমি তাকাই দোতালার বারান্দায় ।

হাসিমুখ একটা মানুষ হাতনাড়ছেন সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে। জনতা তাঁর নামে উচচারন করছে জয়ধ্বনি । এই ছবিটা ৭১ এর মার্চের কোন একদিনের ।
পাঁচবছর পর সেই বাড়ির দেয়াল ক্ষতবিক্ষত বুলেটে। সিঁড়িতে গড়িয়ে সেই হাসিমুখ। অন্যকক্ষ গুলোতে তার স্ত্রী,তিনপুত্র,পুত্রবধুদের লাশ ।

এই বাড়ীর সীমানায় ঢুকলেই আঁকড়ে ধরে শোক ও বিষাদ । গাঢ় হয়ে আসে নিঃশ্বাস । ভারী হয়ে আসে বাতাস । আমি বড় মামার হাত ছেড়ে দেই । একা একা হাঁটি এই ঘর থেকে সেই ঘর । গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেয়াল,সিগারেটের পাইপ, দেয়ালে লেগে থাকা থোকা থোকা রক্ত, থোকা থোকা । রাসেল লুকিয়েছিলো কোন আড়ালে?
আমি আড়াল খুঁজি । ১৩ বছরের কিশোর আমি । এতো মৃত্যুর বিভীষিকা চেপে ধরে আমার কন্ঠনালী ।

বড়মামা খুব নীচুস্বরে জিজ্ঞেস করেন-'চলে যাবি?'
আমি মাথা নাড়ি। চলে যাবো । চলে যাবো । এই বাড়িতে আমি আর আসবোনা কোনদিন ।

আমরা মুলদালান থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসি । বের হয়ে যাবো । হঠাৎ,হঠাৎ করেই প্রচন্ড বাতাস আর বজ্রসহ বৃষ্টি । হয়তো কালবৈশাখি ছিলো সেটা । আমরা পাশের আমগাছের নীচে দাঁড়াই । বৃষ্টিতে ভিজতে থাকি ।

একটু পর পেছনের বারান্দায় এসে দাঁড়ান এক মধ্যবয়স্ক মহিলা । মামাকে উদ্দেশ্য করে বলেন-'আপনারা বৃষ্টিতে ভিজছেন কেনো? ভিতরে এসে বসুন'

আমরা ভিতরে যাই । একটা কাঠের ডাইনিং টেবিল । কয়েকটা চেয়ার । আমরা বসি । সেই ভদ্রমহিলা ও বসেন ।

এবার তাঁর দিকে তাকাই । বয়সে আমার মায়ের মতোই মনে হয় । আমার মায়ের মতোই ছোটখাটো,অনুজ্জ্বল গায়ের রং,বৈশিষ্টহীন চেহারা ।তার পরনে একটা তাঁতের শাড়ী । আটপৌড়ে । আকাশের মতো রং ।

মামার সাথে তার টুকটাক কথা হয় । মামা সাংবাদিক । পরিচয় জানার পর রাজনীতির আলাপ আরো গাঢ় হয় । আলাপের মাঝখানে সেই মহিলা একবার উঠে ভিতরে যান । ফিরে আসেন প্লেটভর্তি ঝালমুড়ি আর চা নিয়ে । বাইরে তখনো ঝড় । আলাপ চলছে ।
এই মহিলা একরাতে হারিয়েছেন আরেকবোন ছাড়া পরিবারের সকলকে ।

সেই বৃষ্টিমুখর বিষন্ন বিকেলবেলা একটি কিশোর নির্বাক তাকিয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে গাঢ়বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকা এক খুব সাধারন মহিলার দিকে ।

[
তারপর থেকে তাঁর ঐ ছবিটা আমার চোখে ভাসতো প্রায়ই । ভাসতো যখন তিনি জাহানারা ইমামের পাশে বসতেন ঘাতক দালাল নির্মুলের অংগীকার নিয়ে,যখন তিনি জড়িয়ে ধরতেন তার বাহুতে কোন নির্যাতিত সংখ্যালঘুকে ।
এই ছবিটা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম যখন তিনি রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ । যখন তার পড়নে নেই আর আকাশ রংয়ের তাঁত ।যখন তাঁর গলায় উঠে এসেছে মুক্তোর মালা ।

এই ছবিটা স্মৃতিতে ফিরে এসেছিলো ২১ আগষ্টের সেই ভয়ংকর দিনে ।
আবার হারিয়ে ফেলেছিলাম যখন তিনি চুক্তিবদ্ব হয়েছিলেন মধ্যযুগীয় বর্বরদের সাথে,বিকিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিরোধের সকল পরম্পরা ।

১৬ জুলাই সেই ছবিটা ফিরে আসে আবার । ।
]

****
****

এই লেখাটা একটা তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ার স্বরুপ,এর বেশী কিছুমাত্র নয় ।

ধৈর্য ধরে যারা পাঠ করেছেন ,কৃতজ্ঞতা তাঁদের সকলের প্রতি ।


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

স্পষ্ট করেই বলি, ফাঁকি দিলেন। লেখার শুরুতে যে বিস্তারের আভাস দেখছিলাম, কী সুন্দর এগোচ্ছিলো গত পর্ব পর্যন্ত, তা কেমন আচমকা সমাপ্তির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। যেন আতসবাজির খেলা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

জুবায়ের ভাইয়ের সাথে একমত।
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

অমিত আহমেদ এর ছবি
??? এর ছবি

আমার মনে হয়, লেখার শিরোনামের প্রতি অবসেসড না থেকে লেখাটিকে তার নিজের মত বেড়ে উঠতে দিলে ভাল হত। শিরোনামের "হাসিনা" হয়ত চাপ সৃষ্টি করছিলেন দ্রুত প্রসঙ্গ হয়ে আসার জন্য! হাসি

অমিত এর ছবি

অসাধারণ লাগল। আরও কয়েক পর্ব পেলে ভাল লাগত, কিন্তু একটা লেখা কোথায় শুরু হবে এবং কোথায় তার শেষ হওয়া উচিত এটা লেখকের উপরই ছেড়ে দিলাম।

_____ ____________________
suspended animation...

আরিফ জেবতিক এর ছবি

পুরো সিরিজটি ভালো লেগেছে।

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

নিঘাত তিথি এর ছবি

তাতক্ষনিক প্রতিক্রিয়া, তার সাথে আচমকা জুড়ে বসা স্মৃতি। আমার ভালো লেগেছে, ভীষন।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

নজমুল আলবাব এর ছবি

এই ছবিটা স্মৃতিতে ফিরে এসেছিলো ২৩ আগষ্টের সেই ভয়ংকর দিনে ।
আবার হারিয়ে ফেলেছিলাম যখন তিনি চুক্তিবদ্ব হয়েছিলেন মধ্যযুগীয় বর্বরদের সাথে,বিকিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিরোধের সকল পরম্পরা ।

২১ আগস্ট হবে

ফারুক হাসান এর ছবি

শেষ হয়ে গেল বলে পুরো সিরিজটা আবার পড়লাম।
মুগ্ধতা নিয়ে।
এরকম আরো লিখুন। শুভকামনা।

-----------------------
এই বেশ ভাল আছি

অপালা এর ছবি

আমার মনে হয় প্রতিটা মানুষ ই ডায়েরি পরতএ পছন্দ করে, তা সে নিজের হোক বা অন্যের।আর তা যদি হয় সুলিখিত তাহলেতো কথাই নেই।আপনার এই সিরিজে শেখ হাসিনা কে ছাড়িয়ে গিয়েছে আপনার লিখার ধরন,যা পাঠককে াগ্রহী করে তুলেছে,এই সিরিজ টা পড়তে,আর একটা অতৃপ্তি নিয়ে শেষ করতে।

ধ্যাত লেখক শেষ করলেন না।

ঝরাপাতা এর ছবি

আমিও ভেবেছিলাম আরো কয়েক পর্ব হবে। আপনার লেখায় সেসময়ের পরিবেশ, অনুভূতি, যন্ত্রণা সব জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠছিলো চোখের সামনে। অনায়াসে আরো অনেক কিছু বলতে পারতেন। আপনার চিরন্তন মিতভাষী স্বভাবই মনে হয় আমাদের বঞ্ছিত করলো আরো কয়েকটা পর্ব হতে। অসাধারণ লেগেছে পুরো লেখাটা।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।