এই বিদ্রোহ, সেই বিপ্লব- ইতিহাসের প্রেতাত্মাদের আঁচড়

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: সোম, ০২/০৩/২০০৯ - ৮:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


এরকম সময় খুব বেশী আসেনা, খুব বেশী আসতে ও নেই- যখন বোধগুলো খুব অবোধ্য হয়ে উঠে, দ্বৈরথে দুলতে থাকে আবেগ, যুক্তি ও বিবেচনাবোধ ।
২৫ ফেব্রুয়ারীর সকাল থেকে এখন পর্যন্ত সময় এরকমই কাটছে । দেশের পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করন থেকে চোখ সরাতে পারছিনা, বিদেশের পত্রিকাগুলো ঘাঁটছি, দেশে ফোন করছি, নানা ব্লগে ব্লগারদের লেখা পড়ছি । কিন্তু নিজে কিছুই লিখতে পারছিনা, লিখতে পারিনি এই ক'দিন ।
ঘটনার পাঁচদিন পর আজ একটু স্থিত হয়ে মনে হলো, অন্ততঃ নিজের ব্লগে লিখে রাখা দরকার এই সময়ের, এই ঘটনার নিজস্ব বিশ্লেষন

১।
১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫ এর ভোরবেলা যখন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার প্রধানকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরই মাঝারী সারির কয়েকজন অফিসার সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রকে প্রথমবারের মতো বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিলো - তখনো রাজনৈতিক নেতৃত্বই ক্ষমতায় ছিলো ।
কিন্তু যে কোন পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে রাখার মতো অতোটা দৃঢ়তা মুজিব শূন্য '৭৫ এ বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ছিলোনা ।
'০৯ এ রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ে শেখ হাসিনা কিন্তু পারলেন সশস্ত্র বাহিনীকে জনগনের প্রতিনিধিদের নির্দেশ মানাতে ।

কিন্তু '৭৫ এর ঘটনাপ্রবাহ মাথায় রেখে কিছুটা শংকা এখনো থেকে যায় কেননা ইতিহাসের প্রেতাত্মারা যে কোন পরিস্থিতিতেই আঁচড় কাটে ।

মুজিব হত্যাকান্ডের পর তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দায়িত্বশীল সামরিক কর্মকর্তারা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারেননি অথবা করেন নি বলেই ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা, খালেদ মোশাররফের ক্যু এবং ৭ নভেম্বরের কথিত সিপাহী বিপ্লব ।

ইতিহাসের কি অদ্ভূত পুনরাবৃত্তি । ৭৫ এর ৭ নভেম্বর সাধারন সিপাহীরা যে সব শ্লোগান ও দাবী দাওয়ার অজুহাতে হত্যা করেছিল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা, এটিএম হায়দার এর মতো চৌকস অফিসারদের - সেই একই শ্লোগান, একই দাবী দাওয়ার অজুহাতে হত্যা করা হয় অফিসারদের ফেব্রুয়ারী ২৫, ২০০৯ এ ।

৭ নভেম্বরের কথিত বিপ্লবের কাঁধে চড়ে ক্ষমতায় চড়েছিলেন জেনারেল জিয়া । ২৫ ফেব্রুয়ারীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করিয়ে বিদ্রোহী বিডিআর আর সেনাবাহিনীর মধ্যে ভয়ংকর সংঘর্ষ বাঁধিয়ে তেমনই কোন অভিষেক কি কারো পরিকল্পনায় ছিলো?

'সাধারন ক্ষমা ঘোষনা ছিলো কৌশলগত ভুল' এরকম প্রচারনা চালিয়ে কি এখনো চেষ্টা করা হচ্ছে সেনাবাহিনীর একটা অংশকে দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উৎখাতের?

২।
সৈনিকদের অভাব,অভিযোগ ক্ষোভ কে পুঁজি করে ৭ নভেম্বর '৭৫ এ বিপ্লব হলো, বিপ্লবের কাঁধে চড়ে জেনারেল ক্ষমতায় এলেন । অভাব, অভিযোগ, ক্ষোভ কিছুই প্রশমিত হলোনা । ৩৪ বছর পর সেই একই পুঁজি খাটিয়ে আরো কেউ কিলিং মিশন সফল করলো ।
সাধারন সৈনিকদের অভাব, অভিযোগ, ক্ষোভ সুদে আসলে কেবল বাড়তেই থাকবে ইতিহাসের প্রেতাত্বাদের সুবিধামতো বিনিয়োগের স্বার্থে ।

৩।
নারীদের অপমান করা কি যে কোন সশস্ত্রবাহিনীর প্রশিক্ষনের অংশ?
'৭১ এর অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের, পার্বত্য চট্রগ্রামে বাংলাদেশের সেনাদের, নাগাল্যান্ড মনিপুরে ভারতীয় জওয়ানদের, ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানায় বিদ্রোহী বিডিআরদের একই চেহারা কেনো?

৪।
যারা নির্বিচারে হত্যা করেছে সেনা অফিসারদের তাদের কোর্টমার্শাল হবে, হওয়া উচিত ।

২০০৫ এর কোন একদিন পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী তুলে নিয়ে গিয়েছিলো এক সদ্য তরুনকে । পরদিন তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ খুঁজে পাওয়া যায় এবং অনুসন্ধানে জানা যায়- ঐ তরুনের নামে এক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীর নাম থাকার পরিনতি এই, ভুলবশতঃ ।

ব্লাডিসিভিলিয়ানদের খুন করার অপরাধে সশস্ত্র কারো কোর্টমার্শাল হবেনা, হওয়া উচিত না ।

তবু রাষ্ট্রের নাম ' গনপ্রজাতন্ত্রী' ।
ফাজলামোটা বেশ গনতান্ত্রিক ।


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

নারীদের অপমান করা কি যে কোন সশস্ত্রবাহিনীর প্রশিক্ষনের অংশ?

তবু রাষ্ট্রের নাম ' গনপ্রজাতন্ত্রী' ।
ফাজলামোটা বেশ গনতান্ত্রিক ।

আর কি কিছু বলার থাকতে পারে?

আমি ব্যক্তিগত ভাবে আর্মির শৃঙ্খলায় বেশ মুগ্ধ। এটাই 'স্বাভাবিক', কিন্তু আরো অনেক স্বাভাবিকের মত এটাও বাংলাদেশে আশাতীত।

প্রাথমিক উত্তেজনার সময়টুকু গেছে, এখন পুরো ব্যাপারটার সুষ্ঠু তদন্ত আর সকল পক্ষে আত্মোপলব্ধি কামনা করি।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

চলুক উত্তম জাঝা!

সাধারন সৈনিকদের অভাব, অভিযোগ, ক্ষোভ সুদে আসলে কেবল বাড়তেই থাকবে ইতিহাসের প্রেতাত্বাদের সুবিধামতো বিনিয়োগের স্বার্থে ।

৭ নভেম্বরের কথিত বিপ্লবের কাঁধে চড়ে ক্ষমতায় চড়েছিলেন জেনারেল জিয়া । ২৫ ফেব্রুয়ারীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করিয়ে বিদ্রোহী বিডিআর আর সেনাবাহিনীর মধ্যে ভয়ংকর সংঘর্ষ বাঁধিয়ে তেমনই কোন অভিষেক কি কারো পরিকল্পনায় ছিলো?

উদ্ধৃতি

নারীদের অপমান করা কি যে কোন সশস্ত্রবাহিনীর প্রশিক্ষনের অংশ?

উদ্ধৃতি

তবু রাষ্ট্রের নাম ' গনপ্রজাতন্ত্রী' ।
ফাজলামোটা বেশ গনতান্ত্রিক ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

হিমু এর ছবি

একটি টিভি চ্যানেলে দেখলাম নিহত ডিজি বিডিআর এর চরিত্রে দেবত্ব আরোপের চেষ্টা চলছে। আমার কাছে এটা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। যারা নিহত হয়েছেন, তারা যোগ্য ও দক্ষ অফিসার ছিলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তারা সবাই পুতপবিত্র ছিলেন, এই দাবীর কোন প্রয়োজন নেই। কারণ অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ডে, কেউই গিয়ে সেনা অফিসারদের দুর্নীতির তদন্ত করেনি, করবেও না। করতে গেলেই গণেশ উল্টাবে।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

তানবীরা এর ছবি

হিমুর সাথে একমত। মরে গেলেই তিনি ফেরেশতা, এই টেন্ডেনসী বন্ধ হওয়া উচিত। বেনজীর মারা যাওয়ার পরও পত্রিকাওয়ালা গুলো মাথার মগজ নাড়িয়ে দিয়ছিলো।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

হিমু এর ছবি

আবারও আহত পাঠকের আর্তনাদঃ আত্মা বানানটি সংশোধিত হোক।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আহত পাঠককে উপশমের চেষ্টা করা হলো হাসি
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তীরন্দাজ এর ছবি

সহমত জানাই!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

আসলে বিডিআর বনাম আর্মি, আর্মি বনাম জনগণ, জনগণ বনাম সরকার - এই ইকুয়েশনগুলো কখনোই একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রের পক্ষে সহায়ক হয় না। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ক্ষমতার অনধিকার চর্চা। আমরা প্রতিনিয়তই এই জিনিসটা এত বেশি দেখি যে, তখন অনধিকারকেই অধিকার মনে হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারটা যদি তখন হয়ে যেত, হত্যাকারীরা পুরস্কৃত না হয়ে তিরস্কৃত হতো, তাহলে আমাদেরকে সেনাশাসনের মুখোমুখি হতে হতো না। এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে যে, সেনাশাসন এলেই আমরা যেন বালিতে মুখ গুঁজে ভাবতে ভালোবাসি, "আহ! সুখে আছি, ভালো আছি। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।" অনধিকার চর্চার বিষয়টা, সমস্যার মূলটা থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। এতগুলো সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুতেও তাই সমস্যার মূলে না গিয়ে ভাবি কিছু বিডিআরকে মেরে ফেলাই বুঝি সেরা সমাধান। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি একটি চর্চার বিষয়। একদিনে হয় না, এর পেছনে ট্রাডিশনেরও বিরাট ভূমিকা। আমাদের ট্রাডিশন সাধারণত ক্ষণস্থায়ী উত্তেজনাকে ছাপিয়ে বিগ পিকচার দেখতে দেয় না।

পোস্ট স্পট অন।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সুমন চৌধুরী এর ছবি
ধুসর গোধূলি এর ছবি
আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ডিটো, বলাই'দা।

অপ্রিয় এর ছবি

নারীদের অপমান করা কি যে কোন সশস্ত্রবাহিনীর প্রশিক্ষনের অংশ?

যখন প্রয়োজন তখন "মানুষকে" অপমান করা পৃথিবীর যে কোন সশস্ত্রবাহিনীর প্রশিক্ষনের অংশ। এ ছাড়া যুদ্ধে জেতা যায় না, কম্যান্ড অনুসারে মানুষের উপর ব্রাশফায়ার করা যায় না। নারীরা তো মানুষই।

+++++++++++++++++++++++++++++
ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই এই পাপীর, তবে বিশ্বাস করি এই আমি বিশ্বাসীদেরই প্রার্থনার ফসল

+++++++++++++++++++++++++++++
ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই এই পাপীর, তবে বিশ্বাস করি এই আমি বিশ্বাসীদেরই প্রার্থনার ফসল

শঙ্খচীল এর ছবি

নারীদের অপমান করা কি যে কোন সশস্ত্রবাহিনীর প্রশিক্ষনের অংশ?

সরাসরি প্রশিক্ষনের অংশ নয়, তবে সব যুগেই এটা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অমোঘ নিয়তি। ধর্ম-যোদ্ধারাও একাজটি "হালাল" করতে "গনিমতের মাল ত্বত্ত" আবিষ্কার করেছেন। আফ্রিকার গোত্র যোদ্ধা থেকে আলেকজেন্ডার, "ক্রসেডার-জেহাদি" আর গ্রীক থেকে হিন্দু পৈরাণিক দেবতাকুল, সবাই একই খেলায় মেতেছেন। ইতিহাসে সব যোদ্ধারাই বীরপুরুষ আর নারীরা তাদের ভোগ্যা। আমরা সৈনিক তৈরী করি "শত্রুদের" উপর নৃ্শংস হতে এবং তা আমাদের স্বার্থেই। তাই ঘটনা-চক্রে নিজেরাই যখন ওদের "শত্রু পক্ষ" হয়ে যাই, "নৃ্শংসতা" তখন স্বাভাবিক ললাট লিখন।
এ দুঃখের দিনে এ ঘটনায় প্রয়াত আমার ছোট বেলার বন্ধুর সাথে সাথে, একজন নাম না জানা চাকমা মা বা যুবতি বোন, কিংবা মং ভাইকে মনে পড়ে!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।