তবু কোথাও নিঃশ্বাস আছে, আছে পরিত্রান [ পর্ব দুই ] [আপডেট]

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: রবি, ১০/০৭/২০১১ - ৫:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লীলাময়ী লালাখাল

এবং জাফলং খুন হলো।
উন্নয়ন এলো। চওড়া রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে বোমা মেশিন এলো, মাটির অনেক গভীরে লোহার হাত পা ঢুকিয়ে বোমা ফাটিয়ে পাথর তোলা শুরু হলো, ক্রাশার মেশিন বসলো- বিকট শব্দ আর ধোঁয়া ছড়িয়ে পাথর ভাঙ্গা চলতে থাকলো। পিয়াইন নদীর স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল, যার নীচে জ্যন্ত সব পাথর, নদীতে স্নান করতে আসা খাসিয়া রমনী- সবাই মারা গেলো। জাফলং এখন এক ড্রাগন ঘুমানো এক বিরাট হাঁ, বালুর শ্মশান- জাফলং যেতে বিশ্রী লাগে।

জাফলং যাবার বেশ আগে সারীঘাটে তাই নামি। এখান থেকেই মেঘালয় পাহাড়ের হাতছানি শুরু। আরো উত্তরে মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে এসেছে সারী নদী। সারীঘাট হয়ে চলে গেছে গোয়াইনঘাটের দিকে, মিশেছে গোয়াইন নদীর সাথে। এই সারীঘাট থেকে নৌকা নিয়ে পূবের দিকে যেতে যেতে মেঘালয় পাহাড়ের আরো কাছ ঘেঁষে লালাখাল। প্রথম গিয়েছিলাম বছর আঠারো আগে, তখনো ইঞ্জিন নৌকার উৎপাত শুর হয়নি।
এখন সময় কম লাগে। ঘন্টা দেড়েকের মতো। এতো বছর পর যেতে যেতে সারী নদীর পানিতে হাত বুলাই, পান্নার মতো সবুজ পানি কি এখনো তেমনি আছে নাকি ইঞ্জিন নৌকার পুড়া তেলে ক্রমশঃ মলিন হয়ে যাচ্ছে?
বাংলাদেশে অন্য কোন নদীর পানির এই রঙ হয় কিনা জানিনা। সেন্ট মার্টিনের পানির মতো পান্না সবুজ। ৭০০ বছর আগে ইবনে বতুতা সিলেট এসেছিলেন আসাম হয়ে। তার বর্ননায় এক স্বর্গীয় নদীর কথা জানা যায়, যে নদীর পানি ছিলো এমন সবুজ।
ইবনে বতুতা কি মেঘালয় পাহাড় বেয়ে এই নদী হয়ে সিলেট এসে পৌঁছেছিলেন?
6 7
5 4
1
8
3

ঘোর বর্ষায় লালাখাল
লালাখালের বিজ্ঞাপিত সুন্দর শীতকালে। তবে আরেকটু আগে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে লীলাবতী শুরু করেন সুন্দরের লীলা। পানি ক্রমশঃ সবুজ হতে থাকে।
কিন্তু বর্ষার নিজস্ব সুন্দর আছে, আর সেটা যদি হয় সিলেটী বর্ষা- তবে রঙ ঢঙ অন্যরকম নিঃসন্দেহে। বর্ষায় সারি নদীর পানি সবুজ থাকেনা, পাহাড়ী ঢল নামে, পানি ঘোলা হয়ে যায় কিন্তু মেঘালয়ের থোকা থোকা মেঘ যখন নেমে আসে লালাখালের টিলা আর নদীর সাথে কথা বলতে- সুন্দর তখন আর অধরা থাকতে পারেনা।

দুদিন প্রবল বৃষ্টির মধ্যে লালাখাল গেলাম। নৌকায় নয়, গাড়ী নিয়ে। সারি নদীর তীর ঘেঁষে অপ্রসস্ত সড়ক, মাঝখানে কাঁচা দু মাইল। বেশ কষ্টকর যাত্রা কিন্তু মেঘের হাতছানি, এড়ানো কি সম্ভব?

8
7
6
5
4
3
2




বিছনাকান্দি- বিছিয়ে রাখা সুন্দর

তবু লালাখাল হয়তো গিয়েছেন কেউ কেউ, কিন্তু বিছনাকান্দি যেনো এক লুকিয়ে রাখা মুক্তো- সুন্দরের অনুচ্চারিত বিস্তার। এপ্রিলের এক রোদ্দুর মাখা দিনে আমি আর নজমুল আলবাব মোটর সাইকেল নিয়ে বের হই। জাফলং রোড নয়, শহরের অন্য প্রান্ত দিয়ে যাত্রা শুরু। এয়ারপোর্টের দিকে যে রাস্তা, পর্যটন মোটেলের কাছে গিয়ে মোড় নিয়েছে হাতের ডানে আমরা সেদিকে এগোই। মিনিট পনেরো পরে চ্যাংগের খালের সেতুর উপর উঠি। সোজা রাস্তা চলে গেছে কোম্পানীগঞ্জ/ভোলাগঞ্জ। আমরা ডানে গোয়াইনঘাট সড়ক ধরি। একযুগ আগে গহীন জংগল ছিলো, বর্ষায় ছিলো থৈ থৈ হাওর। এখন বেশ ভালো পাকা সড়ক। যেতে যেতে দৃশ্যপট বদলায় দ্রুত। কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে কৃষক মাঠে যাচ্ছেন, আলবাবের আগ্রহ মানুষে, সাটার টিপে। মানুষে আমার আগ্রহ কম, আমি সাদা সাদা বকের সারি দেখি। রাস্তা উত্তরে বাঁক নিতে নিতে হঠাৎ করেই মেঘালয় পাহাড় ঝলমলিয়ে উঠে। যতো এগোই ততোই পাহাড় সন্নিবর্তী হয়, আমি পাহাড়ের ঘ্রান পাই।
ঘন্টাখানেক চলার পর আমরা বামে মোড় নেই আর সড়ক সোজা চলে যায় গোয়াইনঘাটে। আরো কিছুদূর আসার পর হাদারপাড় বাজার। পাথর বোঝাই ট্রাক্টরের দেখা মেলে, আমি ট্রাক্ট্ররের ট্রেইল অনুসরন করি। অনুসরন করতে করতে পাহাড়ি নদী, নদী নেমে এসেছে একেবারে কাছে চলে আসা মেঘালয় পাহাড় থেকে। ট্রাক্ট্ররগুলো বিপুল বিক্রমে নদী পেরুচ্ছে, খালি ট্রাক্টর যাচ্ছে, পাথর ভর্তি হয়ে ফিরে আসছে। আমরা একটা বারকী নৌকা জোগাড় করি, নজমুল আলবাব হোণ্ডায় চড়ে নৌকায় উঠে বসে।
তারপর সহসাই চলে আসে বিছ্নাকান্দি- সুন্দর আহ সুন্দর।
[এখানে কিছু মানুষের গল্প জমা হয়, শেষ সীমানা পিলার অতিক্রম করে ভারতীয় ভূ-খন্ডে ঢুকে পড়া বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষ আর তাদের অভিযোগের গল্প। সীমান্ত ফাঁড়ীর জোয়ান আর সুবেদার রজব আলীর গল্প-তাদের অসামান্য আতেথিয়তা- এইসব গল্প থাক অন্য কোন মানবিক দিনের জন্য। প্রকৃতির সুন্দর কিছুটা সময়ের জন্য হলে ও মানুষের গল্পকে ভুলিয়ে রাখে, রাখুক]
DSC_0030
DSC_0070
DSC_0090
DSC_0142
DSC_0150
DSC_0158
DSC_0065


মন্তব্য

মৌনকুহর. এর ছবি

জাফলং এখন এক ড্রাগন ঘুমানো এক বিরাট হাঁ, বালুর শ্মশান- জাফলং যেতে বিশ্রী লাগে।

সহমত। বেশ কয়েক বছর পর গতবার ছুটিতে সেখানে গিয়ে মনে হয়েছে, সময়টা পুরোই ফালতু নষ্ট হল।

ছবিগুলো দুর্দান্ত হয়েছে। চলুক

হাসান মোরশেদ এর ছবি

জাফলংকে এখন মাফ করে দেয়া উচিত।
সিলেটের আশেপাশে আরো অনেক চমৎকার জায়গা আছি, খুঁজে খুঁজে বের করছি। প্রকৃত ভ্রমনকারীদের এসব জায়গায় আসা উচিত, যেমন বিছনাকান্দি জাফলং এর চেয়ে সুন্দর এবং সিলেট শহর থেকে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তানিম এহসান এর ছবি

সারি নদীর তির বেয়ে যেতে যেতে আমি নৌকার গলুইয়ে বসে পা দিয়ে রেখেছিলাম জলে, শীতল সারি নদীর বাঁক বাঁকে অসামান্য প্রকৃতী খেলা করে। আপনার সারি নদীর জলের বর্ণনার সাথে পুরোপুরি একমত। লালাখাল যাত্রা চোখের তৃপ্তি দেয়, সেই তৃপ্তির আবেশ জড়িয়ে থাকে, চাইলেই মনের ভেতর থেকে টুক করে বেড়িয়ে পড়ে। আপনার সিলেট যে কি অসাধারন সুন্দর!!

এবং সেইসাথে জাফলঙ এর মরে যাওয়া সবকিছুর সাথে সাথে ক্রমশ বেড়ে উঠা হোটেল, মোটেল আর রেস্টুরেন্ট এর ভীড়ে, আর সব জায়গার মতই বাংলাদেশ উন্নত হতে থেকে থেকে তার মাংস চামড়া সব খসে খসে পড়ে, ভেতরের কংকালে জমে থাকা ঘুঁনগুলো শ্যাওলার আচ্ছাদন সরিয়ে সরিয়ে ঝাড়ে বংশে বাড়ে আর আমরা এখনও চোখের ভেতরে জমে থাকা সবটুকু ক্ষমতা নিয়ে পরিত্রান খুঁজতে খুঁজতে হাতড়ে বেড়াই কোথাও যদি দুদন্ড শান্তির দেখা মেলে!!

খুব ক্ষুব্ধ, বিষন্ন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আপনার লেখায় সময়টা খুব সুন্দর কেটে গেলো।

পরিত্রানের সাথে দেখা হয়না আজকাল, বেচারা বোধকরি ছুটি নিয়ে চলে গেছে কংসদ্বীপে!!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আশা রাখি খুব ক্ষুব্দ, বিষন্ন সময় কেটে যাবে।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তানিম এহসান এর ছবি

থাকুকনা, মাঝে মাঝে এমন সময় থাকতে হয় হাসি

কবি-মৃত্যুময় এর ছবি

বিছানাকান্দি যেতে হবে এর পরেরবার!!! যথারীতি খুবসুন্দর বর্ণনা আর ছবিও। চলুক

ভালো থাকবেন ভাইয়া। হাসি

তারাপ কোয়াস এর ছবি

আপানার এই লেখা পড়তে পড়তে একটা ভার্চুয়াল টুর হয়ে গেলো। সবুজ পানির নদীটা অদ্ভুদ সুন্দর লেগেছে সাথে দূরের পাহাড়ের ছবিগুলাও (আমি আবার পাহাড় ভালু পাই হাসি )। পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি।


love the life you live. live the life you love.

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

চমৎকার লেখা আর ছবিগুলো। অসাধারণ। চলুক

ইবনে বতুতা ...................................... সিলেট এসে পৌছেছিলেন?

এই এক জটিল পাব্লিক। যেখানেই গেছে সেখানেই নাকি ২-৩-৪ টা করে বিয়ে করে এসেছে! অ্যাঁ

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

২-৩-৪ টা করে বিয়ে করে এসেছে

আপনে জনাবের উপর অবিচার করলেন। তাঁর ভ্রমন কাহিনী পড়লে জানা যায়- ভ্রাম্যমান হেরেমখানা তার সাথে সাথে ঘুরতো।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

এম আব্দুল্লাহ এর ছবি

চমৎকার ছবি।
পরিবেশ রক্ষার জন্য জনস্বার্থে মামলাগুলো (Public Interest Litigation) বেশ কার্যকরী।
কেউ কে এ বিষয়ে জনস্বার্থে মামলা করতে পারেনা? আজকে বিডিনিউজে (http://www.bdnews24.com/bangla/details.php?cid=2&id=164561) দেখলাম, "ঢাকার আশপাশের চার নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে আদালতের নির্দেশ অমান্য হয়েছে অভিযোগ করে পাঁচ সচিবসহ ১১ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ"।
বেলা (BELA) এক্ষেত্রে বেশ কাজ দেখিয়েছে।
ধন্যবাদ।
এম আব্দুল্লাহ

কৌস্তুভ এর ছবি

আঃ, কি সুন্দর!

তিথীডোর এর ছবি

ছবিগুলো দারুণ।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মন মাঝি এর ছবি

আহ্‌, অপূর্ব ! অপূর্ব ছাড়া আর কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না !

১। '৮০ দশকের কোন এক সময় তামাবিল গিয়েছিলাম। আপাদমস্তক জঙ্গলে-ঢাকা টিলার সারির মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা নির্জন পথে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। মনে হয়েছিল একটা অপার্থিব রূপকথার জগতে চলে এসেছি। অন্তত ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতিকোষে চিত্রটা সেরকমই। সেই স্মৃতি পুঁজি করেই বছরখানেক আগে প্রায় আড়াই দশক পরে আবার গিয়েছিলাম সেই স্বর্গ খুঁজে বের করতে। হা হতোম্মি ! কোথায় কি! না স্বর্গ, না মর্ত্য, কিছুই খুঁজে পেলাম না !!

২। এবারে জাফলং-ও গেলাম। আপনি যথার্থই বলেছেন। হতাশ হয়েছি।

৩। সেণ্ট মার্টিনের পানিটা ঠিক পান্না-সবুজ না মনে হয়। এটা সম্ভবত 'এ্যাকুয়ামেরিন' - বিশেষ করে দ্বীপের পশ্চিম তীরে যেদিকে লঞ্চ-টঞ্চ যায় না। পান্না-সবুজ নাফ নদীর পানি (নাকি টারকোয়েজ-ব্লু বা সব্জে-নীল; অন্তত আগে?)। এখানেও গিয়েছিলাম যথাক্রমে আড়াইদশক এবং বছর দেড়েক আগে। প্রথমবারের অনুভূতি প্রায় অনির্বচনীয়। অভিভূত হয়েছিলাম ভাষার বাইরে ! নাফ নদী দেখে মনে হয়েছিল দুপাশে সবুজ রত্নখচিত নিরবচ্ছিন্ন পাহাড়ের সারিকে গলায় হারের মত পরে ছুটে চলা তরল-পান্নার তৈরি এক চপলা বালিকা। এবারে গিয়ে দেখলাম সেই চপলা বালিকা একদম থত্থুড়ে বুড়ী না হলেও, অনেক রঙ চটে বিবর্ন ম্রিয়মান মলিন প্রৌঢ়া হয়ে গেছেন। সেই ঝকঝকে স্বর্গীয়, অপার্থিব ভাবটা আর নেই। পানিতে টুরিস্ট লঞ্চের পোড়া ডিজেল, হাজার হাজার টুরিস্টের ফেলা আবর্জনা। বাংলাদেশের দিকের পাহাড়গুলি কেটেকুটে প্রায় সাফ, নয়তো গাছপালা মাটিটাটি কেটে টাক মাথা আর তোবড়ানো চোয়াল নিয়ে মুখ ব্যাদান করে আছে। ভীষন হতাশ হয়েছিলাম। আমি তখন জানতাম বাংলাদেশে এমন নদী আর নেই - সেই সবে ধন নীলমনি (প্রায় আক্ষরিক অর্থেই!) -টারও এই দশা দেখে, এভাবে হারাতে দেখে, খুব খারাপ লেগেছিল। যারা নিদেনপক্ষে দুই-তিন দশক আগের নাফের চেহারা দেখেননি তারা বোধহয় ঠিক বুঝতে পারবেন না কি বলতে চাইছি। নাফ ও মার্টিন কিন্তু এখনও সুন্দর।

৪। কিন্তু আপনার লেখা আর ছবি দেখে ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম। না, এখনও আছে! নাফের মত হোক বা অন্য রকম হোক, এটাও নিজের মত করে অপূর্ব। ঝকঝকে সব্জে নীল বা নীলচে সবুজ পানি, সবুজ গাছপালা আর সোনালি আভাযুক্ত মাটির রঙ ছবির মধ্যে পাশাপাশি একটা মোহময় কনট্রাস্ট সৃষ্টি করছে।

৫। তবে এসব জায়গায় ইঞ্জিন বোট অসহ্য ! এখানে পাল তোলা নৌকা দরকার। গত বছর হাকালুকিতে নৌকায় ঘোরার আশা নিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জের নদী ঘাটে (পোস্ট অফিস/বাংলো ঘাট?) গিয়ে নোংরা-চিটচিটে চিপা ইঞ্জিন বোট আর তার মাথা খারাপ করে দেয়া ভটভটানিতে অস্থির হয়ে শেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে চলে এসেছিলাম। শীতের সময় ঘিলাছড়াতে হাকালুকি হাওর-পারে টি-গার্ডেনের কোলে, চা বাগান - রাবার বাগানে ঘেরা একটা নির্জন সুনসান টিলার ওপর গিয়ে মাঝেসাঝে থাকি। মাত্র কয়েক কদম দুরেই আবার হাকালুকি। শীতের সময় পায়ে হেটে প্রায় শুকনো হাকালুকি চষে বেড়িয়েছি। সকাল ৭ টা থেকে সন্ধ্যা ৭-টা পর্যন্ত যদ্দুর সম্ভব। কিন্তু মনোমত নৌবাহনের অভাবে টইটুম্বুর জলে ভাসা হলো না এখনও। টাঙুয়ার কথা হয়তো আলাদা, কিন্তু হাকালুকিতে দেখলাম মৌসুম পেরোলেই পানি খুব দ্রুত সরতে শুরু করে।

৬। জাফলং-এর পিয়াইন নদী দিয়ে বর্ষার সময় বা পরপর ছাতক পর্যন্ত যাওয়া যায় কিনা জানেন ? ম্যাপে বোধহয় দেখেছিলাম এই নদী ছাতকের দিকে গেছে। এটা একটা চমৎকার নৌভ্রমণ হতে পারে, কেননা পিয়াইন নদী বোধহয় প্রায় পুরোটাই মেঘালয় পাহাড় ঘেষে।

৭। আমার উইশ লিস্টে আরেকটা গোপন ইচ্ছা রয়ে গেছে। জাফলং গিয়েই এর সূত্রপাত। অনেকের কাছে হয়তো খানিকটা ছেলেমানুষি মনে হবে। আমার উঁচু পাহাড়ি পথে রেলভ্রমণ করার খুব ইচ্ছা। হাসি স্রেফ রেলভ্রমণটাই। এক জাগায় হলেই হলো। এটা বোধহয় খুব বেশি নেই কোথাও। বাংলাদেশে তো নয়ই। কাছাকাছি দার্জিলিং-এ আছে শুনেছি। আর আছে শুনেছি সিলেটের জকিগঞ্জ বর্ডার পার হয়ে ভারতের করিমগঞ্জ থেকে গৌহাটি পর্যন্ত। এটা না কি এক্কেবারে ফাটাফাটি। অন্য এক জীবনে, বহু আগে, আমার একটা এমন অভিজ্ঞতা আছে বটে - পাকিস্তানের করাচি থেকে কোয়েটা পর্যন্ত। আকাশছোঁয়া নিস্পাদপ রুক্ষ পাথুরে পর্বতের ঘাড়ে চড়ে, অপার্থিব একটা টের‍্যাইনের মধ্য দিয়ে গায়ে কাঁটা দেয়া রেলযাত্রা। কিন্তু ওখানে আর যাওয়া হবে না, সম্ভব হলেও না। জাফলং-এ পিয়াইন নদীর বাংলাদেশ অংশের মাথায় (?) নদী তলদেশে দাঁড়িয়ে ভারতীয় অংশের পাহাড়ের উপর এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে সংযোগকারী ঝুলন্ত সেতুর উপর দিয়ে ক্ষুদে ক্ষুদে মালবাহী ট্রাকগুলির অতি সাবধানে দুলতে দুলতে যাওয়া দেখতে দেখতে এই কথা গুলিই মনে পড়ছিল।

****************************************

হাসান মোরশেদ এর ছবি

জাফলং তামাবিল নিয়ে ক্ষোভের কোন প্রশমন হতে পারেনা। মানুষ নিজ হাতে কিভাবে প্রকৃতিকে হত্যা করে তার জ্বলজ্যান্ত প্রমান জাফলং, যে নদীর পানি একসময় স্কটিকের মতো স্বচ্ছ ছিলো, পানিতে নেমে পর্যটক বিভ্রান্ত হয়ে যেতো নীচে তাকিয়ে, কী চমৎকার শীতল- সেই পানিতে এখন স্পীডবোট দৌড়ানো হয় পর্যটক সাহেবেরা টাকা দিয়ে স্পীডবোটে ঘুরেন- ফলে সেই স্ফটিক স্বচ্ছ পানি এখন ঘোলাটে, মরা মাছ ভেসে থাকে। পাথর তুলতে তুলতে পুরো এলাকা একটা বিশাল গর্ত!
এসব নিয়ে আলাদা লেখার ইচ্ছে ছিলো, বিছনাকান্দি গেলে কষ্ট পাবেন, পাথরের লোভে মানুষ বসতভিটা পর্যন্ত খুঁড়ে ফেলেছে। শুধু কি প্রয়োজন নাকি জাতিগতভাবে আমাদের কান্ডজ্ঞানহীন লোভ? অথচ সীমানা পিলার পেরুলোই ওপাড়ে কি চমৎকার সবুজ এখনো ওরা ধরে রেখেছে। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের সীমানা পেরিয়ে ভারতের ভূ-খন্ডের ভেতর বসত গেড়ে ফেলেছে অথচ ভারত তার প্রকৃতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখার জন্য সীমানা পিলার ঘেষে কোন জনবসতি গড়তে দিচ্ছেনা।
লালাখাল ও এরকম থাকবেনা। ভীড় বাড়ছে। ইঞ্জিন নৌকার পুড়া তেল তো আছেই, সেই সাথে স্মার্ট পর্যটকদের ছুঁড়ে ফেলা খাবারের প্যাকেট! এদেশের মানুষের এখনো ট্যুর কালচার গড়ে উঠেনি। প্রকৃতি দেখতে যায় স্যুট টাই পড়ে, বিরিয়ানীর প্যাকেট সাথে নিয়ে। স্কটল্যান্ডের অনেক জায়গায় দেখেছি, হাজার হাজার পর্যটক আসে কিন্তু ম্যাকডোনাল্ডস স্থাপনের অনুমতি নেই কারন এসব খাবার লোকজন বাইরে খেয়ে প্যাকেট ছুড়ে ফেলে।

পিয়াইন হয়ে ছাতক থেকে ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত যাওয়া যায়- তারপর ভোলাগঞ্জ থেক জাফলং। আমার কৈশোর ছাতকে কেটেছে। ছাতকে দুটো নদী একসাথে প্রবাহমান। সুরমার জল ঘোলা, পিয়াইন কালো। ছাতক থেকে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে ছিলো পাথর পরিবহনের। সেইসব রোপওয়েতে লোকজন ও উঠতো। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। স্কুলবেলা আমরা ও গিয়েছি। সম্ভবতঃ এই রোপওয়ে ও বন্ধ হয়ে গেছে।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আয়নামতি1 এর ছবি

দুটো পর্ব এক সাথে পড়ে নিলাম। প্রথমে এটাকে রাজনীতির উপরে লেখা পোষ্ট ভেবে এড়িয়ে গেছি। না পড়লে মিস করতাম। আমার কোনদিনই যাওয়া হবেনা এমন সব চমৎকার জায়গাগুলোতে! ছবি আর লেখায় খানিকটা হলেও ইচ্ছেপূরণ হলো। তালেবান/তালিবান মানে 'ছাত্র' এটা আমিও জানতাম না! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে দেঁতো হাসি

ফাহিম হাসান এর ছবি

দুটো পর্বই চমৎকার!!

পাঠক এনায়েৎ ইউ এস ইসলাম এর ছবি

অসাধারণ সুন্দর ছবি আর চমৎকার বর্ণনা। লালা খালের জল ‘পান্না সবুজ’। যথার্থই বলেছেন। ঊনিশ-বিশ হলেও হতে পারে। ছবিতে অবশ্য ওরকম আসেনি। গত শীতেও গিয়েছিলাম। জলের রঙটি আগের মতোই আছে। তবে পর্যটকদের নৌকা থেকে ছুড়ে ফেলা নানা বস্তু ভাসছে জলে। আমার ধারণা চুনা পাথরের বিক্রিয়ার ফলে জলের রঙটি এমন। আর জাফলঙ’তো মরেই গেছে। পড়ে আছে তার লাশ। অসংখ্য যন্ত্র দানব কুরে কুরে খাচ্ছে সে লাশ। আর আছে হাজারে–বিজারে পাথর শ্রমিকের হল্লা। বাতাসে ভাসে ঘাম আর বর্জ্যের গন্ধ। এখন জাফলঙ যেতে পথের দু’পাশের দৃশ্যই যা উপভোগ করা যায়। তবে পথের পাশের সেই প্রাচীণ বৃক্ষগুলো আর নেই। তাদের গায়ের অলংকার বুনো অর্কিডেরাও আর নেই। সেখানে দাড়িয়েঁ আছে নতুণ লাগানো বিদেশি জাতের গাছের সারি। কিছু দেশি জাতের গাছও আছে। অনেকটা আফগান-ইরাকের যৌথবাহিনীর মতো সারিবদ্ধ দাড়িয়েঁ। যেনো কোন সুবাদারের নির্দ্দেশের অপেক্ষায়। চ্যাংগের খালের মূল নাম শিং নদী। কবে কোন এক মহারতি লীজ নেয়ার স্বার্থে এটাকে খালে রূপান্তরিত করেন। তবে এমুহুর্তে এতদ্বিষয়ক কোন রেফারেন্স আমার হাতের কাছে নেই। বিছনাকান্দি হতে পারে নতুন একটি স্পট। সে দিকে গিয়েছি তবে এতোটা গভীরে যাওয়া হয়নি। ওদিকে যাওয়ার পথ এবং উপায় এখনও ভালো করে জানা হয়নি সবার। ভালো লাগলো আপনার লেখাটি। অনেক ভালো।

বন্দনা- এর ছবি

ছবিগুলা দেখে মন ভরে গেলো ভাইয়া। এইসব জায়গায় যাওয়ার এখনো সুযোগ হয়নি। তবে ভবিষ্যতে সুযোগ আসলে মিস করবোনা ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

সারি নদী লালাখাল... অপূর্ব...
বিছানাকান্দি যাওয়া হয়নি
থাক, ওসব সুন্দরগুলোর খোঁজ দিয়েন না, পেলেই আমরা আবার চিপস সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে নোঙড়া করতে হাজির হয়ে যাবো
শাবল কোদাল নিয়ে হাজির হয়ে যাবেন তেনারা...

থাক... কিছু কিছু জায়গা থাক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।