তক্ষক

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: রবি, ০১/০৭/২০০৭ - ৬:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.

১।
আইপডটা কানে গুঁজে দেবো কিনা ভাবছি ।

নিতান্ত অভদ্রতা হয়ে যায়, কিন্তু কোনো বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিনা । বয়স্ক ভদ্রলোক একটানা কথা বলে যাচ্ছেন ।
কথা বলা শুরু করেছেন অন্ততঃঘন্টা খানেক । আমি কিছুটা বিস্মিত ও হচ্ছি বটে । এই শীর্নশরীরের প্রায় বৃদ্ধ মানুষটা এতো কথা বলার শক্তি পাচ্ছেন কি করে?

যাচ্ছি ট্রেনে । এক জেলা শহরে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে । সুন্দর রোদেলা দিন । ট্রেনে ভীড় কম । জানালার পাশে বসেছি। পাশের সীট খালি ছিলো । চমৎকার বাতাস ।আইপডে লোপামুদ্রার গান । উপভোগ করছিলাম ।
প্রতীতির কথা মনে পড়ছিলো । পড়শু ডেটিং হলো আসিফের ফ্ল্যাটে । মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । গল্প এখন শেষ পর্যায়ে । আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই,ছিলো ও না কোনোদিন । তবু হয়তো আমার মনে পড়বে প্রতীতিকে, প্রতীতির ও আমাকে মনে পড়বে কোনো অবসরে ।
প্রতিবার ডেটিংয়েই প্রতীতি আমাকে শরীর দেয় আর দেয় এক একটা চমৎকার কবিতার বই । ও মেয়ে নিজে কবিতা টবিতা পড়েনা কিন্তু আমাকে পড়ায় । সম্পর্ক হওয়ার আগে কোন একদিন বোধ করি ওকে জানিয়েছিলাম আমি, কবিতায় আমার প্রেমের কথা । আমার অনেক কিছুতেই পরে ও আর বিশ্বাস রাখেনি, কিন্তু এই অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারটা মনে গেঁথে রেখেছে ।

ব্যাগ খুলে কবিতার বইটা বের করি । জয় গোস্বামীর কবিতা সংগ্রহ । আমি জয়ের কবিতার তেমন ভক্ত নেই । বড্ড বেশী লিরিক্যাল । তবু এই ছুটেচলা রোদেলা দুপুর, প্রায় নির্জন রেলের কামরা, হুহু বাতাস- আমি প্রতীতির প্রতি প্রেম ও কবিতার প্রতি কামবোধে আক্রান্ত হই ।

আইপড খুলে গলায় ঝুলিয়ে রাখি । বিশ্রাম নাও লোপামুদ্রা। ইতঃস্তত পাতা উল্টাই । বিন্যস্ত অক্ষর ও ছন্দের সমাবেশ । একটা পাতায় চোখ আটকায়ঃ

' একফোঁটা রক্ত শুধু ঝরে পড়ল,মাটি ফেটে গেলো আঘাতে?
শিশুদের মরামুখ ভেসে উঠল কি একবার?
তা কেউ দেখেনি,বড় মেঘ করে এসেছিল ।
নইলে দেখা যেত এই ফাঁকা
খেয়াঘাটে
চাঁদ চেপে ধরে আছে রক্তে ভেসে যাওয়া নাড়ী তার ।'

কেমন । কেমন যেনো লাইনগুলো ।অকারনে আমার গা কেঁপে উঠে ।

২।
-'দেখলেন ঘটনা । এইবার কিন্তু খেলা জমবো । সব চোর ধরা পড়তেছে'
ভদ্রলোক আবার কথা শুরু করেছেন ।
তার কোলের উপর কটকটে হলুদ রংয়ের খবরের কাগজ । এই আরেক আপদ শুরু হয়েছে আজকাল । ত্রানের টিন,রিলিফের কম্বল,ঘুষের টাকা,তেরশো নদী,ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল গিলে খেয়ে ধরা পড়ছে বন কর্মকর্তা,পুলিশের দ্বিতীয়কর্তা,রানীমাতার জৈষ্ঠ্য সন্তান । আর এইসব নিয়ে সিনেমা সিনেমা গল্প জুড়ে দেয়া চায়ের টেবিল থেকে ট্রেনের কামরা পর্যন্ত । বিরক্ত লাগে । যন্ত্রনাময় দিনকাল ।
-'আল্লাহর রহমত ছিলো, তাই দেশটা বেঁচে গেলো । আগামী ২০ বছর সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় থাকা দরকার,কি বলেন?'

আমি মনে মনে গালি দেই । 'মর্ষকামী ভোদাই পাবলিক' । এই সব পাবলিকের কারনেই হাঁটুতে ঘিলুওয়ালারা ছড়ি ঘোরায় । যখন তখন রাস্তায় কানধরে উঠবস করাবে তবু পাবলিকের প্রীতি দূর হয়না ।
মুখে কিছু বলিনা । খামোখা কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । আর দিনকাল আসলেই খুব সুবিধার না ।

ট্রেনের গতি কমে আসছে । প্লাটফর্মে ঢুকতে আর খুব দেরী নেই । ভদ্রলোক কোমর উঠানো শুরু করেছেন । এবার তার ব্যাগ গোছানো শুরু করবেন নিশ্চিত । ট্রেন থামার আগেই দরজায় গিয়ে ভীড় জমাবেন, সেটা ও নিশ্চিত প্রায় । মনে মনে আরেক প্রস্ত গালি দেই ।
-'তা বাবাজী এসে গেলাম প্রায় । অনেক কথা বললাম । কিছু মনে করেননি তো । আমারো একটা ছেলে আছে । আপনার বয়সীই হবে । না , আপনার চেয়ে আরেকটু বড়ো'
অর্থহীন কথা । আমি আতংকিত হই । নতুন কোন গল্প শুরু হয় বোঝি ।
-'তবে আমার ছেলেটা আপনার মতো নয়'
-আমার মতো নয়, মানে?

নিজের অজান্তেই এই প্রথম আমি তার কথার জবাব দেই ।
-আমার ছেলেটা পংগু । একটা মাত্র ছেলেই আমার
সর্বনাশ । লোকটা এখন পংগু ছেলের গল্প ফেঁদে সাহায্য না চাইলেই হয় ।পোষাক আষাকে ভদ্রলোক যদি ও । বিশ্বাস কি? যা দিনকাল পড়েছে । আমার আর কথা না বাড়ানোই নিরাপদ ।

তবু কি আশ্চর্য! আমিই পালটা প্রশ্ন করি । আমার কন্ঠ কি কিছুটা আর্দ্র?
-দুঃখিত । কি হয়েছিলো ওনার? কোন অসুখ,কোন দুর্ঘটনা?
-দুর্ঘটনা? হ্যাঁ । তা দুর্ঘটনা ও বলতে পারেন
কি এক অদ্ভুত কারনে আমার খুব আগ্রহ হচ্ছে এই বৃদ্ধের পংগু ছেলেটার কথা জানতে ।
-বলুন না প্লিজ? কি হয়েছিলো?
-১৯৯০ । মনে আছে বাবাজী? বয়স কতো তখন? ১০/১২? আমার ছেলেটা তখন ১৮ । কলেজে পড়ে । আন্দোলন করে । আর্মি পিটিয়ে ওর কোমরের হাড় আর দুপা ভেংগে দিয়েছিলো। বুট দিয়ে থেঁতলে দিয়েছিলো ওর পুরুষাংগ'

আমি বেদনার্ত হই । অন্ততঃ হওয়া উচিত । একজন বাবার মুখ ঝুলে পড়েছে তার একমাত্র পুত্রের পংগুত্বের গল্প বলতে গিয়ে ।
কিন্তু আমি বেদনার্ত হইনা । এই বকবকে বুড়ো একটু আগেই বলছিলেন এই দেশে যেনো আরো ২০ বছর সেনা শাসন থাকে । এই বুড়োকে আমি মনে মনে গালি দিয়েছিলাম 'মর্ষ্কামী ভোদাই' বলে ।আমার এবার তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গালি দিতে ইচ্ছে করে
-আমি দুঃখিত । কিন্তু আপনিই আগে বললেন অন্ততঃ আরো ২০ বছর সেনাশাসন দরকার । অথচ আপনার ছেলে ওদের হাতেই । আসলে আপনাদের মতো মানুষদের জন্যই...'

ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকছে এবার । গতি প্রায় থেমে এসেছে । বৃদ্ধ তার ব্যাগ গুছিয়ে হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলেন । ফিরলেন । ফিরে এলেন আমার কাছে । আমার চোখে চোখ রাখলেন । কেমন ঘোলাটে । গা শিউরে উঠে । গলা নামালেন । হিসসিস করে বললেন-
২০ নয়, ২০০ বছর ধরে আমি আর্মির শাসন চাই । প্রত্যেক মা-বাবার একটা করে ছেলে গুলী খেয়ে মরুক নয়তো পংগু হয়ে পড়ে থাক বিছানায়, আমার ছেলের মতো ।

বাইরে চমৎকার রোদ । তবু কেনো জানি সহসা তীব্র শীতের কাঁপুনি আমার সমস্ত জুড়ে। গন্তব্য পৌঁছে গেছি । উঠা দরকার । উঠতে পারছিনা । পারছিই না আর ।


মন্তব্য

কেমিকেল আলী এর ছবি

আপনার লেখা সবসময়ই মনকে আলাদা ভাবে স্পর্স করে যায়।
এইটাও তার বাহিরে নয়।
ধন্যবাদ

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

থাক পঙ্গু হয়ে পড়ে থাক।

আমিও মর্ষকামী হই।
-----------------------------------------------
গাধারে সাবান দিয়া গোসল দেয়ানোটা গাধাপ্রীতির উজ্জ্বল নমুনা হতে পারে; তবে ফলাফল পূর্বেই অনুমান করা সম্ভব, গাধার চামড়ার ক্ষতি আর সাবানের অপচয়।

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অদ্ভুত! দারুন পার্সপেক্টিভ!

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

??? এর ছবি

অনেক দ্রুত শেষ হয়ে যায় সচলায়তনের গল্প। মর্ষকাম নিয়ে আরো আগানো যেত হয়ত। কিংবা প্রতীতি-প্রসঙ্গ আরো অর্থবহভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারত এই আবহে।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

শুরু চমৎকার, এগোচ্ছিলো ভালোই। পরিসর সংক্ষিপ্ত হওয়ায় একটু নাটকীয় লাগে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আরিফ জেবতিক এর ছবি

টুইস্টটা দারুন।
আপনাকে আমি বিপ্লব দিলাম।

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

অজি আশেকান কিংবা দেশীয় খালিফদের উৎপাতে এসব লেখা ব্লগে আসেনি অনেকদিন। এখন থেকে এরকম রেগুলার চাই!

অচেনা এর ছবি

একটা বড় লেখার প্রস্তুতি নেও গুরু।

---------------------------------

যত বড়ো হোক ইন্দ্রধনু সে সুদূর আকাশে আঁকা,
আমি ভালোবাসি মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা॥

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- ভদ্রলোকের স্বভাবটা চাপা। আরও অনেক কিছুই বলতে পারতেন, বলেন নি। নাকি লেখক বলাতে চান নি?
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

নজমুল আলবাব এর ছবি

ভাবনাটাকে খুলে দিয়ে তুমি বাবা থাক বেশ আরামে। এই ভাবনা কতটা যন্ত্রনা দেয় তাকি জান? ২০ কিংবা ২০০ এই চিন্তায় হিম হয়ে আসে শরির...

ঝরাপাতা এর ছবি

সুমন রহমানের মতো আমিও প্রতীতীকে খুঁজছিলাম কিন্তু। তবুও নজমুল আলবাবের মতোই চিন্তায় হিম হয়ে শরীর। প্রশ্ন থেকেই যায়।
_______________________________________
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

পড়া এবং সদয় মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা সবার প্রতি
নিজের লেখা নিয়ে আলোচনা এবং প্রতিআলোচনায় এখনো আমি সেই স্কুলবেলার মতোই সলাজ ও বিব্রত ।
তবু কিছু চমৎকার ও জরুরী মন্তব্য নিয়ে কথা বাড়াচ্ছিঃ

সুমন রহমান
'অনেক দ্রুত শেষ হয়ে যায়' । না এটা সচলায়তনের গল্পের দোষ/গুন/বৈশিষ্ট নয় । এটা আমার গল্পের । ধরা যাক বছর বারো ধরে গল্প লিখছি । দু একবারের ব্যাতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল গল্পই এরকম 'অনেক দ্রুত'শেষ হয়ে গেছে ।
কিঞ্চিত শ্লথ গতিতে শেষ হয়েছিলো এরকম একটা মাত্র গল্প আমি লিখতে পেরেছিলাম, যা 'প্রথম আলো' র সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপিয়েছিলেন সাজ্জাদ শরীফ ৯৯ সালে । সেটা তার বদান্যতাই ছিলো বোধ করি । বেশ ক'বছর পাড়ি দিয়ে এখন নিজের বিবেচনায় সেই গল্পটাকেই আমার সবচেয়ে স্থুল গল্প মনে হয় ।

সে যাক ।হ্যাঁ গল্প আরো কিছু হতে পারতো । প্রতীতিকে ঘিরে আরো কিছু গল্প হতে পারতো । ১৮ বছর বয়সে পংগু হয়ে আরো ১৭ বছর ধরে যে বিছানায় পরে আছে তাকে নিয়ে ও গল্প বাড়ানো যেতে পারতো । একটা গল্পকে ঘিরে এরকম আরো কিছু সহগল্প পাশাপাশি চলতে পারতো , অথবা গল্প এবং সহগল্পগুলো মিলে একটা উপন্যাসের আবহ ও তৈরী হতে পারতো ।

কিন্তু হয়নি । কেনো হয়নি? দুটো ব্যখ্যা আসতে পারেঃ

১।গল্পকারের হয়তো সেই দক্ষতা কিংবা সাহস নেই গল্পকে আরো টেনে নিয়ে যাবার । এমন হলে,কথা এখানেই শেষ ।

২। গল্পকার হয়তো চাননি । কেনো চাননি?এই গল্প আসলে যা বলতে চায়, তার প্রেক্ষাপটে প্রতীতির সাথে প্রেমের গল্পসল্প জানাটা কি তেমন জরুরী আসলেই?
পুরো গল্প কিছুটা সময়ের স্ন্যাপশট মাত্র(ইমরুল হাসান, আসলেই তাই)। সেই স্ন্যাপশট একটা স্পেসিফিক ম্যাসেজ দিতে চায় । সেটা নানা আয়তনে,সালাংকার কিংবা অলংকার বিহীন ও হতে পারে । হতে পারে রুলটানা কাগজে গুটিগুটি হাতের দীর্ঘচিঠির মতো কিংবা হতে পারে ইমেইলের মতো দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া ।

এইরে, নিজের লেখার জাস্টিফিকেশন করা শুরু করলাম নাকি? থামি তবে এই বার ।
ভালো থাকুন সব্বাই । আবারো কৃতজ্ঞতা ।

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

দ্রোহী এর ছবি

হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল!! প্লটের কথা কি বলবো, খবর পাইলে নেতারা বাড়ী বানাইবো!
__________
কি মাঝি? ডরাইলা?

ফারুক হাসান এর ছবি

ভাল লেগেছে। আরো পড়তে চাই

-----------------------
এই বেশ ভাল আছি

??? এর ছবি

হাসান মোরশেদ, আমার মন্তব্য আপনাকে বিব্রত করে থাকলে দুঃখিত। আপনার মন্তব্য পড়লাম।

আয়তনে ছোট হওয়া গল্পের জন্য খারাপ কিছু না। আজকাল অনেক গল্পের খামোখা ফেনানো দেখে-দেখে আমার নিজের গল্পও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে! গল্প লেখক হিসেবে আমি আপনার কাছে নবিশ, মাত্র দুবছর ধরে লিখি গল্প। কিন্তু গল্পের পাঠক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা এর কিছু বেশি। আমি সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মন্তব্য করছি।

গল্প নানান রকমের হতে পারে। হতেই পারে। কাফকার প্যারাবলগুলো, বোর্হেস-এর কিছু, বা পিটার বিকসেল-এর গল্প এমনকি আপনার গল্পের চেয়েও ছোট। শাহাদুজ্জামান-এর একটা গল্প পড়েছিলাম, মাত্র এক প্যারা। কৈ, তাদের ব্যাপারে তো এমন কিছু বলা হচ্ছে না। তাহলে, গল্প ছোট হয়ে যাচ্ছে, এমন অভিযোগ আপনার কেন শুনতে হবে?

গল্প নানান রকমের... এই সত্য মাথায় রেখে কথাগুলো বলছি। বিশ্বসাহিত্যে এমন ধরনের মিনি গল্পের অভিজ্ঞতা থেকে আমি যা বুঝি, তাতে মনে হয়, এই বিশেষ ফর্মটার প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার ঘনত্ব। আপনার গল্পে তার উপস্থিতি ছিল বলে আমার মনে হয়নি। আপনার গল্পটি শুরু হয়েছিল প্রগলভ একটা ন্যারেশনকে আশ্রয় করে (প্রতীতি প্রসঙ্গ)। সেই প্রসঙ্গটা মূল গল্পের মধ্যে কতটুকু জরুরি, এই প্রশ্ন কেউ করতেই পারে, যেহেতু আপনি গল্পের "স্থুলতায়" অবিশ্বাসী। সে প্রসঙ্গটি আরেকটু ডিটেইলে বলি:

মানুষের মর্ষকামিতা এই গল্পের একটা প্রসঙ্গ। কিন্তু উপসংহার নয়। উপসংহারে সেই বৃদ্ধকে বরং স্যাডিস্টিক লেগেছে (আমার পাঠ ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন)। পাশাপাশি, প্রতীতি-প্রেম/ডেটিং একটা আলগা বিষয়, কিছুটা অর্থহীন যেন বা, শরীরী এবং ছাড়া-ছাড়া, মুখস্থ রিচুয়ালের মত পালিত হতে-থাকা। এই প্রতিদিনের মুখস্থ রিচুয়ালে গল্পের নায়ক কিন্তু তার প্যাসিভ ভূমিকার বাইরে আসতে চায় না, যেমন তাকে দেখা গেছে ট্রেনের পাবলিক ডিসকাশনের ব্যাপারে। কিন্তু ঐ পাবলিক ডিসকাশনের ব্যাপারে সে কিন্তু জাজমেন্টাল, মনে মনে বলছে "মর্ষকামী ভোদাই পাবলিক"! অথচ প্রতীতি বিষয়ে, যতদূর লেখা হয়েছে, কোনো জাজমেন্ট নাই। যে চরিত্রটি আধাঘণ্টার অভিজ্ঞতায় একজন মানুষকে মনে-মনে "মর্ষকামী" সার্টিফাই করে দিচ্ছে, সে তার জীবনে-আসা একটি নারী সম্পর্কে এতদিনের অভিজ্ঞতার পরেও চুপ থেকে যাচ্ছে কেন?

কেউ বলবেন, চুপ থাকছে কোথায়, বলেই তো দিয়েছে প্রতীতির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তারপর ডেটিং করতে এসেছে সে, শরীর দিয়েছে (শরীর কী একজনই দেয়?)। হ্যাঁ। তথ্য আকারে এসব আছে ঐ গল্পে, এই জায়গায় লেখক চাইছেন পাঠক নিজে যাতে জাজমেন্টাল হয়ে ওঠে। একই গল্পে, আর্মি প্রসঙ্গে লেখক নিজেই জাজমেন্টাল, গোড়া থেকে। প্রতীতি বিষয়ে যিনি এত ধৈর্যশীল, মন্তব্যের ব্যাপারে পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন দায়িত্ব, তিনিই আবার সামান্য পরে আর্মি বিষয়ে সব কথা নিজেই বলছেন!

এর কারণ, হাসান মোরশেদ, আমার মতে আপনার উপসংহারটুকু। যে টুইস্ট-টুকু উপসংহারে পাওয়া গেছে, সেটা লেখককে এ ধরনের প্রণোদনা দিতে পারে। ফলে, অনেকগুলো বিষয় হঠাৎ করেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়, বা সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। যে লোকটিকে গোড়াতে "মর্ষকামী ভোদাই" মনে হচ্ছিল, সে যে ভিতরে ভিতরে আরো জটিল ঘৃণায় সিক্ত, ঘৃণার আরো চরম রূপটি প্রকাশ করার জন্য হিস হিস করছে, সেই অংশটুকু সত্য? নাকি মানুষের আর্মি-সম্পর্কিত মর্ষকামিতার বোধ সত্য? নাকি দুইই সত্য? এর মধ্যে প্রতীতির প্রেমের স্মৃতি কী ম্যাসেজ বয়ে আনে? প্রতীতি কি মর্ষকামী? নাকি তার চাকরিপ্রার্থী প্রেমিককে মর্ষকামী বলা যায়? এদের ম্লান শরীরী প্রেমের সাথে গল্পটির তীব্র ঘৃণাময় উপসংহারের সম্পর্ক কোথায়? এসবের ফয়সালা এই গল্পে পাওয়ার উস্কানি আছে, কিন্তু গল্প তার আগেই শেষ। এর ফলেই পাঠক নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি জারি করতে বাধ্য হচ্ছে। গল্পটাকে তার এজন্যই ছোট ছোট লেগেছে।

কথায় কথায় আলাপ অনেক বড় হয়ে গেল। আশা করি আমার বক্তব্য আমি স্পষ্ট করতে পেরেছি।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সুমন রহমান
ভুল বোঝার কোন সুযোগই নেই স্যার ।আমার নিজের লেখার চেয়ে এই আলোচনা, প্রতিআলোচনাটাই বরং আরো বেশী প্রানবন্ত মনে হচ্ছে ।
'বিব্রত' শব্দ প্রয়োগ আসলে 'বিনীত ' অর্থে । দু এক ফোঁটা লেখালেখি যাই হোক,তার আবহে আমি নির্লিপ্ত ঘরানার । লিখে ছেড়ে দিলাম, যা হয় হোক- এরকম আর কি ।
ব্যবচ্ছেদ ও বিশ্লেষনে আপনার মুন্সীয়ানার অনেক পুরনো ভক্ত আমি । সুযোগ হয়নি এর আগে,কোনভাবে এই প্লাটফর্মে দেখা হয়ে গেলো বলে জানিয়ে দিলাম ।
অদিতি ফাল্গুনীর লেখা নিয়ে আপনার দুর্দান্ত সমালোচনা পড়েছিলাম । সুমন রহমান কে চিনি তখন থেকেই । দিন তারিখ মনে নেই । খুব সম্ভব 'প্রথম আলো' সাময়িকীতেই ।

ভালো থাকুন । লেখালেখির সমালোচনা ও যে সাহিত্য হয়ে উঠে সেটা বারবার প্রমানিত হোক ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

??? এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ হাসান মোরশেদ, আপনার উষ্ণ প্রশংসার জন্য। সমালোচনা বিপজ্জনক জিনিস, পদে পদে অপ্রিয় হয়ে-ওঠার ঝুঁকি থাকে। এ যাত্রা সৌভাগ্য যে, আপনার সাথে হল না। সেটা হল না আপনার ইতিবাচক অংশগ্রহণের কারণেই। অদিতির গল্পের যে সমালোচনা আমি করেছিলাম, তার ফলশ্রুতিতে তার সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্ভাবনা অংকুরেই শেষ হয়ে গেছিল! এখন তিনি আমার স্থায়ী নিন্দুকে পরিণত হয়েছেন, এমন শুনতে পাই।

দৃশা এর ছবি

কোথাও নেই ঝুম ঝুম অন্ধকার "তক্ষক" ডাকা নিশুতিতে
রুপকথা শুনে শিউরে ওঠে রাঙ্গা...
সপ্নে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলি ফুল
আলোর আকাশ উড়ে এসে ছোঁয় না কপাল
.....................

কঠিন হইছে।

দৃশা

ফারুক হাসান এর ছবি

দারুণ!!
গল্প এবং সমালোচনা দুটোই।
আমি ইন্সপায়ার্ড হয়ে নিজেও একটা গল্প ঝেড়ে দিলাম মাত্র।
একটাই আশা, তক্ষকের লেখক এবং সমালোচকের পায়ের ধুলি [url]http://www.sachalayatan.com/next/node/971এইখানে[/url]

-----------------------
এই বেশ ভাল আছি

তারেক এর ছবি

অসাধারণ!

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কৃতজ্ঞতা দৃশা,ফাহা,তারেক ।

সুমন রহমানঃ

নিরীহ সাহিত্য সমালোচনার প্রতিক্রিয়া এতো জোরদার হলে কেমনে কি? আমার তো বরং উলটো টাই মনে হয় । একজন লেখকের বরং কৃতজ্ঞ হওয়া দরকার তার পাঠক এবং অতি অবশ্যই তার সমালোচকদের প্রতি ।
একজন পাঠক তার সময় বিনিয়োগ করছেন লেখকের লেখা পাঠের জন্য । সমালোচক আরো অধিকতর সময়, শুধু সময় নয়-তার নিরীক্ষা ও বিচারবিশ্লেষন ক্ষমতা ও বিনিয়োগ করছেন বটে ।
আপনি সুমন রহমান, আমি হাসান মোরশেদের লেখা সময় নিয়ে পড়ার,ধৈর্য ধরে আলোচনার করার দরকারটা কি?না করলে ও পারতেন ।

না অপ্রিয় হয়ে উঠার আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই বরং কৃতজ্ঞ হবো ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শ্যাজা এর ছবি

খুব ভালো লেখা।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আজ আবার পড়লাম।
মোরশেদ ভাই:
আপনার কী কখনো মনে হয় না, আপনার লেখা গল্পগুলো বই আকারে প্রকাশ ও সংরক্ষণের দরকার আছে। সেটা আমার মতো মুগ্ধ পাঠকের প্রয়োজন মেটানো এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছানোর তাগিদেই - - -।
আগামী বইমেলায় আশা করতে পারি?

হাসান মোরশেদ এর ছবি

শিমুলঃ
মন্তব্য খেয়াল করা হয়নি আগে,দুঃখিত ।

হ্যাঁ মনে হয় । অবশ্যই মনে হয় । তবে তার আগে অতি অবশ্যই মনে হয়, আনোয়ার সাদাত শিমুল কিংবা নজমুল আলবাবের মতো দুর্দান্ত গল্পকারদের লেখা বই আকারে পাঠকের কাছে যাওয়া দরকার । তারপর না হয় আমি সাহস করি ।

আনোয়ার সাদাত শিমুল কি পাঠকের এই ইচ্ছের দাম দেবেননা?

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হায় অলিভ সময় ।
শমন শেকল ডানা !

ovaga এর ছবি

জেলাশহরে ইন্টারভিউ দিতে আইপডঅলা যায়... হাসান মোরশেদের কাছ থেকে এটা আশা করিনি।

স্পর্শ এর ছবি

গ্লপ অসাধারণ! আইপডের ব্যপারটা চোখে লাগেইনি। তবে এরকম শক্তিমান লেখকের গল্পএ এইসব ক্ষুদ্র ত্রুটি বিচ্যুতি গল্প কে অমর হতে বাধা দেয়।

[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

স্পর্শ এর ছবি

গল্প অসাধারণ! আইপডের ব্যপারটা চোখে লাগেইনি। তবে এরকম শক্তিমান লেখকের গল্পএ এইসব ক্ষুদ্র ত্রুটি বিচ্যুতি গল্প কে অমর হতে বাধা দেয়।

[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

রায়হান আবীর এর ছবি

গল্পটা খুবি ভাল্লাগছে...

=============================

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।