'আই এম এ স্লেইভ,ম্যান-আই এম'

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: শুক্র, ২৬/১০/২০০৭ - ৯:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

উইকএন্ডের সকাল,ঘুম ভেংগেছিলো ব্রিগস এর ফোন পেয়ে ।
ব্রিগস এর সাথে পরিচয় বছর দুয়েক আগে । তখনো ছাত্র আমি,রেষ্টুরেন্ট এ কাজ করি । এসেছিলো খেতে । তারপর টুকটাক কথাবার্তা । দারুন উচ্ছ্বল প্রানবন্ত স্কটিশ ।
নাইজেরিয়ায় 'শেল' এর তেলখনিতে কাজ করে । কড়া বেতন। প্রতিদিন ৬৪০ ডলার । প্রতি পাঁচ সপ্তাহ পর পর দু সপ্তাহের ছুটি । ছুটি পেলেই চলে আসে বাড়ীতে, দারুন সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড এর কাছে ।

ব্রিগস ফোনে কথার তুবড়ী ছুটায় । 'বিকেলে -লায়ন এন্ড লাম্ব-পাবে চলে আসো,একটা সারপ্রাইজ আছে' ।
লায়ন এন্ড লাম্ব এ গেলাম যখন সন্ধ্যা ঘনিয়েছে প্রায় । বাইরে থেকেই ব্রিগস এর গলা শুনি । দারুন ফুর্তিতে আছে মনে হয় । ও স্কচের পাগল । কয়েক পেগ গিলেছে নিশ্চয়ই এর মাঝে । ভেতরে ঢুকে ওকে দেখি কোনার টেবিলে । টেবিলে আরেকজন ।

সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজই বটে!
কুচকুচে কালো একটা মেয়ে । এতকালো-এতো উজ্জ্বল তীব্র কালো ইংল্যান্ডবাসী আফ্রিকান কিংবা ক্যারাবিয়ানরা নয় । সারা পাব জুড়ে সাদাচামড়ার লোকজন । এর মধ্যে এতো তীব্র কালো মেয়েটা সারপ্রাইজই বটে । ব্রিগস খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে পরিচয় করায়- 'আমার বৌ,নাইজেরিয়া থেকে নিয়ে এসেছি'

আমি হাই হ্যালো বলি । মেয়েটার জড়োসড়ো,ইংরেজী ভাংগা ভাংগা,পোষাক আশাকে কেমন সারল্য । ব্রিগস আমার পছন্দ জানে । ভদকা উইথ ব্ল্যাক কারেন্ট নিয়ে আসে,সাথে বাদাম । মেয়েটা বিয়ার খাচ্ছে । আমি ভদকায় চুমুক দিতে দিতে ব্রিগস এর দিকে তাকাই কপাল কুঁচকে ।
ও হাসে, হো হো হো । 'স্টেফানী ফাকড মি ম্যান । ও চলে গেছে । আমি এই মেয়েটাকে বিয়ে করেছি । আই এম হ্যাপি উইথ হার । আই লাভ হার । সি ইজ রিয়েলি কিউট,ইজ নট ইট?'

হুম । কিউট । বেশ কিউট । মেয়েটাকে একপাশ থেকে জেনিফার লোপেজ এর মতো লাগছিলো হঠাৎ । জেনিফারের নতুন ছবি 'বর্ডার টাউন' দেখেছি কয়েকদিন আগে ।
নাফটা চুক্তির আওতায় আমেরিকান ব্যাবসায়ীরা ইন্ডাস্ট্রি তৈরী করছে মেক্সিকোর সীমান্ত শহর গুলোতে । পরিবেশের বারোটা বাজাচ্ছে । দরিদ্র তরুনীরা কাজ করছে । ১২-১৬ ঘন্টার একটানা শিফট । ন্যুনতঅম মজুরী । মধ্যরাতে,ভোররাতে মেয়েরা বাড়ী ফিরে । কোম্পানী নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়না । ফলে এই সব শ্রমজীবি মেয়েরা প্রায়ই ধর্ষন,ধর্ষন শেষে হত্যাকান্ডের শিকার হয় । 'বর্ডার টাউন' দেখতে গিয়ে আমার হঠাৎ করেই একটা দেশের প্ত্রিকায় পড়া একটা ঘটনা মনে পড়ে গিয়েছিলো । গার্মেন্টস শ্রমিক একটা মেয়েকে ধর্ষন শেষে ঘাড়ের রগ কেটে ফেলে রাখা হয়েছিল । তিনদিন চারদিন পর ও সেই মেয়ে মারা যায়নি । সেই মেয়ের নাম আমার মনে হচ্ছিলোনা । আমি মনে করতে পারছিলাম না,আদৌ সেই বর্বরতার কোন বিচার হয়েছিলো কিনা?

আমি,ব্রিগস ও ব্রিগসের নাইজেরিয়ান বৌ এটা সেটা নিয়ে গল্প করি । চারপাশের সাদা মানুষেরা ভদ্রতার মুখোশ পড়ে পাথর হয়ে বসে আছে । আমার কেনো জানি অস্বস্তি হচ্ছে । মনে হচ্ছে এই কালো মেয়েটাকে নিয়ে সবাই উপহাস করছে মনে মনে । মেয়েটা ধীরে ধীরে সহজভাবে গল্প বলে । নাইজেরিয়ার দারিদ্র,নাইজেরিয়ার তেল,সাদা চামড়ার তেল বেনিয়াদের কালো মেয়ে বিয়ে করার প্রবণতা এই সব ।

আমাদের পেগ শেষ হয় । আমি উঠে আসি বারে । স্কচ,ভদকা ও বিয়ারের অর্ডার দেই । মেয়েটাকে বসিয়ে রেখে ব্রিগস ও আসে পেছন পেছন । ওকে একা পেয়ে আমি কিছুটা তরল হই ।চোখ টিপে জিজ্ঞেস করি- 'কালো মেয়ে কেমন সার্ভিস দেয়,হে?'
এই ফাজলামোতে ব্রিগস বেশ ঝলমলিয়ে উঠে । খলখলিয়ে বলে- সি ইজ এ স্লেইভ,ম্যান,সি ইজ এ স্লেইভ ইন বেড'

আমি এক চুমুকে পুরো পেগ গলায় ঢালি । মেয়েটার নাম রাহেলা,মেয়েটার বাড়ী বাংলাদেশ,মেক্সিকো কিংবা নাইজেরিয়া । আমি তার এক অথর্ব ভাই ।
আমি ও দাস,দাসানুদাস ।।


মন্তব্য

ভাস্কর এর ছবি

মেয়েটার বাড়ি তো এই পৃথিবীতেই...পুরুষের পৃথিবীতে...

পইড়া তব্ধা খাইয়া থাকলাম খানিক্ষণ...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

আরিফ জেবতিক এর ছবি

ধ্রুব হাসান এর ছবি

এই ভোতাঁ অনুভূতিটা বড় কষ্টের......জাষ্ট গিলে ফেলতে হয় প্রতিদিন তরল পদার্থের সাথে......ভদকা উইথ ব্ল্যাক কারেন্ট শেষ পর্যন্ত থেমেছিলো কত সংখ্যায় গিয়ে ?......feeling sorry for U and myself. দাসানুদাস হয়ে থাকাই হয়তো আমাদের নিয়তি...জানিনা...

হিমু এর ছবি

আহ, ভিনটেজ হাসান মোরশেদ। একদম বিঁধে যায়, পালক কাঁপতে থাকে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমি নিজেও আসলে তব্দা খাইয়া থাকি দুনিয়াদারী দেইখা
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সিলেটি না
এটা মনে হয় আন্তঃবিভাগীয় শব্দ হাসি
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তারেক এর ছবি

আমিও দাস, দাসানুদাস। এইরকম কষ্ট দ্যান কেন এরকম লিখে?
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

তোর আচরণ প্রভুর মতন, আমি ক্রীতদাস। আমার পাগলা ঘোড়ারে কই থেইক্যা কই লইয়া যাস।

মদন এর ছবি

কি কথা বলে লেখাটিকে সম্মান দেয়া যায় তা জানা নেই..
শুধু বলি - "অসাধারন"

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

জটিল হইছে! কেমনে যে এইরকম লেখতে পারেন?

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

কইতে ভুইল্যা গেছিলাম। অফলাইনে পড়ছিলাম - মনটা খুব খারাপ হইছিল।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

জীবন!!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

অপমানের কিরিচ চালিয়ে দিয়েছেন ভাই!
প্রথম কালো এক জোড়া নারী-পুরুষকে লন্ডনে এনে খাঁচায় করে প্রদর্শনী দেয়া হয়েছিল। বেশ কয়েকটি মেয়েকে জ্যান্ত চিরে বিজ্ঞানীরা চিকিত্সা গবেষণা করেছিলেন। কালো মেয়েদের যোনী চেরায় বিশেষ আগ্রহ ছিল তাদের_মানে শাদা বিজ্ঞানীদের। সেসময়ের মানবতাবাদে তা বাধেনি, কারণ তখনও ধারণা ছিল আফ্রিকানরা ঠিক মানব নয়--মানবেতর।
সাহেবরা এদেশে এসেও বাদামি মেয়েদের রক্ষিতা রাখতো। তাদের ছেলে-পিলে হতো। দু-একজনকে নিয়েও যাওয়া হয়েছিল বিলেতে। আমাদের অনেকের গায়ের রং ও নীল চোখ দেখলে সেসব ধর্ষণের কথা মনে পড়ে।

''''''''''''''''''''''''''''''''''''
বহুদিন হলো নিকষ কুঠার ফেলে এসে ভুলে
দাঁড়িয়েছি আজ মেঘের কিনারে এসে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।