প্রবাসে দৈবের বশে ০০৫

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: শুক্র, ২১/০৯/২০০৭ - ৭:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কাসেলে এসে লোডশেডিং ব্যাপারটিকে মিস করছি। বোধ হবার পর থেকেই লোডশেডিং আমার নিত্যসঙ্গী। গত পরশু বাইরে থেকে ফিরে এসে দেখি আমার ভোওনহাইমের দরজায় একটি নোটিশ সাঁটানো। সেখানে কাসেল শহরের পাবলিক ওয়ার্কসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামীকাল বৃহস্পতিবার বেলা বারোটা থেকে দু'টো পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ থাকবে না। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নাগরিকের সদয় বিবেচনার অনুরোধ জানাচ্ছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো আমার। কবে আমি আমার ঢাকার বাসায় এমন নোটিশ দেখতে পাবো?

অবশ্য এখানে বিদ্যুতের খরচও সেইরকম। দেশে যেমন সন্ধ্যে হলেই আমরা ঘরে ঘরে বাতি জ্বালিয়ে রওশন করে রাখি, এমনটা এখানে ঘটে না। যে ঘরে কোন কাজ আছে শুধু সে ঘরের বাতি জ্বলবে, নাহলে মাস শেষে বিলের কোপের মুখে পড়তে হবে। বিদ্যুৎ অপচয় কমানোর কয়েকটা উপায়ের একটা হচ্ছে এর দাম বাড়িয়ে দেয়া। ইয়োরোপের কিছু দেশে যেমন গাছ কাটার প্রবণতা কমানোর জন্য কাঠের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে সরকারী উদ্যোগে। কাটা কাঠের ক্রেতা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর তখন।

এখানে চুলোগুলি সব বৈদ্যুতিক, অবশ্য একসাথে সব চুলো চালাতে গেলে সার্কিট ব্রেকার ট্রিপ করে। আমার পড়শী জামুয়েল দেখি সবসময় পাঁউরুটির ওপর দিয়ে চলছে, মাঝে মাঝে চা খাওয়ার জন্য কেবল চুলায় হাত দেয়। আমার রান্নাবান্নার হিড়িক দেখে সে রীতিমতো বিস্মিত। একবেলা খাবার জন্য আমি যেরকম বিষণ্ন মলিন মুখে পেঁয়াজ কাটি, রদ্দা মেরে রসুনকে ন্যাংটো করি, আদা কুচাই এবং বাক্স খুলে আরো আরো মশলা বার করতে থাকি, দেখে সে ভয়ই পেয়েছে এক রকম।

একদফা রান্নাবান্নার পর প্রচুর আবর্জনা জমে যায়। পেঁয়াজরসুনের ছাল চামড়া ছাড়াও হাবিজাবি প্যাকেট জমে যায় একগাদা। এখানে ময়লা ফেলার জন্য সুনির্দিষ্ট বিন আছে। পুরনো কাগজের জন্য অনেকগুলি বিন, কারণ জার্মানরা প্রচুর কাগজ প্রতিদিন কাজে লাগায়। বিজ্ঞাপনের কাগজই জমে যায় একগাদা। ভোওনহাইমের লেটারবক্সের পাশেই একটা বড়সড় বাক্স, সেখানে কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝাই হয়ে যায় বিজ্ঞাপনের কাগজ। রিসাইকেল করার প্যাকেটগুলির গায়ে সংকেত দেয়া থাকে, সেগুলিকে আবার হলুদ প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরতে হবে, অন্যান্য কাঁচ আর ধাতব বর্জ্য সহ। জৈব বর্জ্যের জন্য আছে আলাদা বাক্স। প্রতিদিন শ্টাড্টরাইনিগুঙের বিশাল ট্রাক এসে এই বিনগুলি খালি করে নেয়, এ জন্যে বেশ ভালোই কড়ি গুণতে হয় নাগরিকদের। জার্মানরা রাস্তাঘাটে কোন খোসা ফেলে না, কিছুদূর পর পরই কোন না কোন পোস্টের গায়ে একটা মুয়লআইমার ঝোলানো থাকে, বাসে বা ট্রামে থাকে ছোট বিন, তবে তারা সিগারেটের পোঙা ফেলে রেখে যায় প্রচুর। ইউনিফর্ম পরা রাইনিগুংসফির্মার লোক কাঠের চিমটা দিয়ে বেশ দক্ষতার সাথে সেসব তুলে নিয়ে ফুটপাথ বা ক্যাম্পাস পরিষ্কার রাখে, কাজটা দেখেই বোঝা যায় বেশ কঠিন। আমার ঘরে কোন ওয়েস্টপেপারবাস্কেট নেই, আমি একটা বড়সড় প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি, আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছি, দুই ইউরোর নিচে দাম না হলে কোন বাস্কেট কিনবো না, পৃথিবী উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করলেও না।

কাসেলে মোটামুটি ঠান্ডা পড়ে গেছে, সোয়েটার পরে ঘুরি সবসময়, আর রাতে হীটারটা অল্পস্বল্প ছেড়ে রাখি। এখন শরৎ, জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বেশ দমকা বাতাসে গাছের পাতা ঝরে পড়ছে মন্দলয়ে। বহুদিন পর নিজের ঘরের জানালা দিয়ে আকাশ দেখছি। ঢাকায় আমার ঘরের জানালা দিয়ে পড়শীদের মুখ চোখে পড়তো, তা-ও আবার বালিকাশূন্য পরিবার! হায়, আমার বোধহয় পড়শী বালিকাদের সাথে দাড়িগোঁফ গজানোর পর আর এ জীবনে নষ্টামো করা হলো না!


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

এটা নিয়মিত চলা উচিত।
আহা আমি যখন প্রথম বিদেশ গেলাম তখন ব্লগ ছিল না।
পরে চোখ সয়ে গেলে এত ডিটেইলসে সবকিছু চোখে পড়ে না। অনেককিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সহমত। ধাক্কাটা কিছুদিন পরেই সয়ে যায়।

গায়ে মশলার গন্ধ খেয়াল করেছেন? জামা-কাপড় কোন একটা লকারে রেখে দিন ঘন্টাখানেক। বের করলেই টের পাবেন। তখন কী যে লজ্জা লাগে! মনে হয় এরা কীভাবে এমন বোঁটকা গন্ধ সহ্য করে!

হাসিব এর ছবি

এইটা এক্টা ঠিক্কথাকৈছেন । প্রথম প্রথম বুঝতাম না । পরে ঠেকে বোঝা শুরু করছি ।

সুজন চৌধুরী এর ছবি

ঠিক
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

দুর্বাশা তাপস এর ছবি

দাড়ি গোঁফ ওঠার আগে??

==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।

হিমু এর ছবি
অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

মশলার গন্ধ হইতে সাবধান। এটা খুব ডেঞ্জারাস জিনিস। নিজেদের নাকে সহসা টের পাওয়া যাবে না; কিন্তু কোনো সাউথ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলির আশেপাশে বাসে-ট্রামে-এসবানে বসলে ব্যাক ক্যালকুলেশন করে বের করা যাবে, আমাদের মশলার গন্ধ অন্যদের কাছে কেমন লাগে!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

হিমু এর ছবি

আজকে খিচুড়ি রান্না করেছি। মশলার গন্ধ এখন গোটা বাড়ি জুড়ে ম' ম' করছে। জার্মানদের উচিত এ ব্যাপারটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা, কী বলেন হাসি?


হাঁটুপানির জলদস্যু

সুজন চৌধুরী এর ছবি

খিচুড়ির গন্ধে ম'ম' না খ'খ' বা খি'খি করার কথা
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

হাসিব এর ছবি

হৈবো না । জার্মান, ফ্রেঞ্চরা বিদেশী কালচাররে শ্রদ্ধা করছে এইরম ঘটনা ওগো ইতিহাসে খুইজা পাওন যাইবো না ।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

রোজা রমজানের মাসে হিমুর পোস্টে ক্রমাগত খাওয়া দাওয়ার গল্প উঠে আসায় আমার ধর্মানুভুতি আহত হইছে।

হিমু এর ছবি

বস আমি আপনার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাই। কিন্তু চাকরি থেকে খেদানোর মতো কাউকে পাচ্ছি না। জেলে পাঠানোর মতো কোন কার্টুনিস্টও এই মূহুর্তে হাতের কাছে নাই। আপনার আর কী আব্দার আছে জানাবেন।

ইতি।


হাঁটুপানির জলদস্যু

আরিফ জেবতিক এর ছবি

ঠিক আছে।।লিখিত ভাবে ক্ষমা চাইছেন।
পরে দেশে আসলে আমার বৈঠক খানায় একহালি সম্পাদক (থুড়ি ব্লগার)নিয়া আইসা দেখা কইরা যাইতে হইবো।

হিমু এর ছবি

চারটা চেয়ার জোগাড় করে রাখেন এখনই।


হাঁটুপানির জলদস্যু

বিপ্লব রহমান এর ছবি

খুব উঁচু দরের লেখা। এই প্রবাস পর্ব আরো চলুক। আর পানশালা পর্বও নিয়মিত চাই। পিচ্চিতোষ নিয়ে এখনই কিছু বলতে চাইছি না।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সৌরভ এর ছবি


আমার বোধহয় পড়শী বালিকাদের সাথে দাড়িগোঁফ গজানোর পর আর এ জীবনে নষ্টামো করা হলো না!

অ্যাঁ!



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

দ্রোহী এর ছবি

ঢাকায় আমার ঘরের জানালা দিয়ে পড়শীদের মুখ চোখে পড়তো, তা-ও আবার বালিকাশূন্য পরিবার! হায়, আমার বোধহয় পড়শী বালিকাদের সাথে দাড়িগোঁফ গজানোর পর আর এ জীবনে নষ্টামো করা হলো না!
হিমুর বান্ধবীদের অবশ্য ভিন্নমত এ ব্যাপারে।

কি মাঝি? ডরাইলা?

ফ্রুলিক্স এর ছবি

কাপড়ের গন্ধের ব্যাপারটা প্রথমেই সিনিয়র ভাইয়েরা বলে দেয়ায় খুব একটা অড সিচুয়েশনে পড়তে হয়নি। তবে জিনিসটা আসলেই খুব বিরক্তিকর। একবার গন্ধ হলে অনেক সুগন্ধি মেরেও কাজ হয় না। শুধু রান্নার জন্য একটা ড্রেস এবং বাইরের ড্রেসটা রান্নার সময় স্রাংকে রেখে দিলে এই সমস্যা থেকে মোটামুটি মুক্তি।

কম দামে মুলআইমারের জন্য ফ্লমার্টে যেতে পারেন।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

চলুক এই সিরিজটা।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

তারেক এর ছবি

একটা বই চাই এই সিরিজের। হার্ডকপি। হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।