আরশিতে অন্যমুখ

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০১/২০১৬ - ১২:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি খুব আয়নাবিমুখ মানুষ (ছিলাম)। ‘ছিলাম’ শব্দটিকে যে কারণে ব্র্যাকেটবন্দী করতে হলো সেই কারণটি জানতে হলে একটি নাতিদীর্ঘ গল্প শুনতে হবে। ঘটনাটি যুগপৎ বিব্রতকর এবং অবিশ্বাস্য।

সেদিন শনিবার। অফিস থেকে ফিরে চোদ্দতলা ফ্ল্যাটের দখিনের বারান্দায় আরাম চেয়ারে বসে প্রাকবর্ষণ মেঘপুঞ্জের রঙ চাঞ্চল্য দেখছিলাম বেলা শেষের আলোয়। বৃষ্টি শেষের মিঠে শীতল বাতাস যখন চোখের পাতায় আদর করে, আপনাতে চোখ মুদে আসে। দিনভর কাজ ক্লান্ত শরীরে এমন ঘুম বিরল নয়, তাছাড়া গত রাতের অনিদ্রাপ্রসূত ঘুমের একটা তাগিদও সক্রিয় ছিল। তবু এখনো বিকেলের চা খাইনি, শিউলি রান্নাঘরে চায়ের কাপে চামুচ নাড়ছে, এমতাবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লে চলবে? কিন্তু চোখের পাতা না পারছে নিজের নিজের ওজন ধরে রাখতে, না পারছে অক্ষিগোলকে আলো দিতে- চোখ খোলা রাখার সমস্ত প্রচেষ্টা বিফলে গেল। ঠিক তখনই স্ফুরিত বায়ুর একটা আনন্দ ঘুর্ণি এসে নাসিকাছিদ্র চুলকে দিয়ে মগজের কোষে একটা আলোড়ন তুলে আমার অস্তিত্বকে দেহজ বন্ধন থেকে মুক্ত করে কোথাও বিলীন হয়ে গেল ।

ঘটাং করে গেট বন্ধ করার শব্দে ঘুম ছুটে গেল আমার। আমি গার্ডরুমের একটা টুলে বসা। পার্কিং এরিয়াতে একটা গাড়ি ঢুকেছে। সঙ্গে সঙ্গে সাত্তার মিয়ার খিস্তি- ‘ওই মনসুইরা রাইতে চুরি করতে গেছিলি নিকি? নাজমুল স্যার আসছে গাড়ির ভেঁউ হুনোস না? এতক্ষণ চিল্লাইতেছি গেট খোল গেট খোল, হারামজাদা নাক ডাকে! এই অবেলায় কিসের ঘুমরে জানোয়ারের বাচ্চা!’

আমি অবাক। এই বেয়াদব বলে কি? আমাকে টুলে বসতে দেখে সে মনসুর বলে ভাবছে নাকি। আমি মনসুর হবো কেন? মনসুর তো এই শিফটের আরেক দারোয়ান। ব্যাটা বলে কি নাজমুল স্যার আসছে। আরে আমি, আমিই তো.....

তখনি চোখে পড়লো নিজের পোষাকে। আমি নাজমুল হলে এই নীল ইউনিফর্ম কেন আমার গায়ে? তাহলে খানিক আগে আমি যে দেখলাম আমি চোদ্দ তলার বারান্দায় চেয়ারে বসে হাওয়া খাচ্ছি! আবার এখন নাজমুল সাহেব নাকি অফিস থেকে এল। কি সব গোলমালের মতো লাগছে। আর কি ফালতু কথা বলে লোকটা! আমাকে দেখেও চিনতে পারছে না আমি কে? কিন্তু এখন যা দেখছি সেটা তো মিথ্যা না। আমার বুকের নেমপ্লেটে মনসুরই লেখা। গালে হাত দিয়ে খসখসে না কামানো দাড়ি গোফ। অথচ সকালেই শেভ করেছি অফিস যাবার আগে। তাহলে খানিক আগের আমিটা কি স্বপ্নের আমি?

ঝিমুনি কাটেনি এখনো। মাথার চুলের ভেতর ঘাম। ঘুমালে ঘাম হয় আমার। আচমকা কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে মাঝপথে থমকে যাওয়া স্বপ্নগুলো যেমন ঘোর লাগে চোখে পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়ায় আমার কাছে সেরকমই লাগছে। আমি কি দীর্ঘ একটা স্বপ্ন দেখে উঠলাম? নইলে নিজেকে আমার নাজমুল সাহেব মনে হচ্ছে কেন? শিউলি রান্না ঘরে চা বানাচ্ছিল, আমাকে বলছিল একটু ধৈর্য ধরে বসতে। আরেকটু হলে চা টা খেয়ে আসা যেতো। আবার এখন মনসুর হয়ে ‘সিকিউরিটি ফাইভ’ কোম্পানীর ইউনিফর্ম পরে বসে আছি।

সাত্তার মিয়া এসে চায়ের ফ্লাক্স হাতে দিয়ে বললো ‘ঐ যা... ভুলু শেখের হোটেল থেকে একটা চা নিয়া আয়, সাথে দুইটা সেঁকা পরোটাও আনিস’। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে সাত্তার মিয়া কোথাও ভুল করছে। নিশ্চয়ই ভুল। যে আমাকে হরদম স্যালুট দেয়। সে আমাকে চা আনতে পাঠাচ্ছে! আমি কি সত্যি মনসুর? কেমন অদ্ভুত লাগছে। প্রতিবাদ করার সাহস পেলাম না। চুপচাপ চা আনতে উঠে গেলাম।

হোটেলে গিয়ে ডান পকেটে হাত দিয়ে বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। মানিব্যাগ কই। আমার টাকা? ক্রেডিট কার্ড? নাহ ওগুলো তো মনসুরের থাকার কথা না। ওসব নাজমুল সাহেবের। আমার মানে মনসুরের বুক পকেটে বিশ টাকার একটা নোট আছে। তবু আমি মনসুর হিসেবে নিজেকে মানতে পারছি না।

চায়ের দোকানী আমাকে দেখে পরিচিত হাসি দিল। কিন্তু এই দোকানে আমি কখনো ঢুকিনি মনে হলো। আমি হাসলাম না। টাকা দিয়ে চা পরোটা নিয়ে ফেরত আসলাম গেটে। চায়ের ফ্লাক্স গার্ডরুমে রেখে গেটের বাইরে এসে উপরের দিকে তাকালাম। এখান থেকে চোদ্দ তলার ফ্ল্যাটটা দেখে যাচ্ছে না স্পষ্ট। বারান্দায় কেউ আছে?

টুলে গিয়ে বসলাম চুপচাপ। সাত্তার মিয়া আধকাপ চা আর একটা পরোটা দিল। আমি বিমর্ষ মুখে চায়ে পরোটা চুবিয়ে খেলাম। গেটে আমার ডিউটি কতক্ষণ? সাত্তার মিয়াকে জিজ্ঞেস করতে ভরসা হলো না। খিস্তি করবে। লোকটার মুখ খারাপ। হাতে ঘড়ি নেই। পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম সময় দেখতে। এটা কার মোবাইল? নকিয়ার ঘষা স্ক্রিনের অতি পুরোনো একটা মোবাইল। সাড়ে ছটা বাজে। মনে পড়লো গেটে ১০টার পর বদল হয় ডিউটি। বুকের ভেতর কেমন অস্থির লাগছে। সবকিছু অস্বাভাবিক।

দশটার পর আমি কোথায় যাবো? মনসুরের বাসা কোথায়? আমি কিছুই মনে করতে পারলাম না। আমার কেবলি মনে হচ্ছে আমি লিফটে উঠে ১৪ বোতামে চাপ দিলে বাসায় পৌঁছে যাবো। কিন্তু ওটা যদি নাজমুল সাহেবের বাসা হয়, তাহলে আমার বাসা কোথায়? আমি রাতে কোথায় খাবো? পকেটে হাত দিয়ে দেখি খুচরা সাত টাকা আছে। পকেটে এত কম টাকা নিয়ে মানুষ কী করে দিন কাটায়?

রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে। খিদে লেগেছে জব্বর। আধকাপ চা আর একটা পরোটা খেয়ে কতক্ষণ টেকা যায়। বাসায় গেলে নিশ্চয়ই খাবার মিলবে। কিন্তু বাসা কোথায়? টাকা পয়সাও তো নাই হাতে। এই সাত টাকা দিয়ে কিভাবে বাসায় পৌঁছানো যায়।

সাত্তার মিয়া ডিউটি শেষের গোছগাছ সারছে। আমি তাকিয়ে ভাবছিলাম কী করা যায়। আমার সমস্যাটা এখনো পরিষ্কার না। ওই স্বপ্নটাই আমাকে ভেজালে জড়িয়ে দিয়েছে। এখন কিছুই মনে পড়ছে না আমার। আমি জানতাম আমি নাজমুল। এই খানিক আগেও। স্বপ্ন কি এতই স্পষ্ট হয়? ওটা স্বপ্ন হলে আমি নিশ্চয়ই মনসুর। যদিও মনসুরের কিছুই জানা নেই আমার। ঠিকানা, পরিবার, বাসা কিছুই জানি না। কিন্তু আমাকে তো কোন একটা বাড়িতে ফিরতে হবে। কোথায় ফিরবো তাই তো জানি না।

একটা কৌশল বের করলাম। নিশ্চয়ই সাত্তার মিয়া মনসুরের বাসা চেনে। সাত্তার মিয়াকে বললাম, ‘ভাই আমার মাথাডা হঠাৎ ঘুরতেছে চোখ খুলতে পারতেছি না। তুমি কি আমারে বাড়িত দিয়া আসবা?’

সাত্তার বললো, ‘ঐ আমি বাড়িত যামু না তোরে বাড়িত পৌঁছামু? আমার বাড়ি চাক্তাই রোড আর তোর সেই ফইল্যাতলী বাজার। তোরে দিয়া পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে তো আমার রাইত ভোর হইয়া যাইবো। তারচে তুই এহানে এট্টু শুইয়া থাক, রাইত আরেট্টু গভীর হইলে ঠিক হয়া যাইবো। তহন চইলা যাইস। আমি বুড়া মানুষ আমারে কষ্ট দিস না।‘

আমি মরিয়া হয়ে বললাম, ‘তুমি না গেলে হইব না ভাই। এট্টু দয়া করো। আমি একলা গেলে মাথা ঘুরাই পইড়া যাবো রাস্তায়’। সাত্তার মিয়া মুখে বিরক্তির সাড়ে তিন কুঁচকি তুলে রাজী হলো।

রওনা দেবার আগে হঠাৎ মনে হলো চোদ্দ তলার ফ্ল্যাটে একটু যাবো? সাত্তার মিয়াকে বললাম, ‘তুমি এট্টু দাঁড়াও, আমি আসতেছি। নাজমুল স্যারের ধারে একখান কাজ আছে’।

সাত্তার মিয়া অবাক হলেও কিছু বললো না। আমি লিফটে উঠে ১৪ বোতামটা টিপ দিলাম অভ্যস্ত হাতে। লিফট উঠছে ধীরে ধীরে। লিফটের আয়নায় আমি নিজের মুখটা দেখে চমকে উঠলাম। এটা আমি? আমাকে আমি আগে কখনো দেখিনি এভাবে! মনসুরের চোয়াল ভেঙ্গে পড়েছে। মুখে কাঁচাপাকা না কামানো গোঁফদাড়ি। বিশ্বাসই হচ্ছে না ওটাই মনসুর, মুনসুরই আমি। তবু লিফট যতই উঠছে মনে হচ্ছে আমি নিজের বাসায় ফিরছি। লিফটের বন্ধ দরোজার দিকে তাকিয়ে ভাবছি এই দরোজাটা আলীবাবা চল্লিশ চোরের গুহার পথ খুলে দিয়ে আমাকে নিশ্চয়ই অভাবিত ঐশ্বর্যের পথ দেখাবে। আমি অধীর আশা নিয়ে একটা মিরাকলের জন্য অপেক্ষা করি।

লিফটের দরোজা খুললো। সেই চিরচেনা লবি। টাইলস মোড়ানো দেয়ালে ঝোলানো লাল রঙের অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র। সিলিং জুড়ে ঝকঝকে ঝাড়বাতি। ওই তো ১৪এফ আমার বাসা। আমার, নাকি নাজমুল সাহেবের? একটু আগে যে মুখটা আয়নায় দেখেছি ওটা তার বাসা হতে পারে না। ওটা বড় জোর স্বপ্নের বাসা।

তবু মিরাকলের আশায় আমি কলিং বেল টিপি। শিউলি মানে শিউলি ম্যাডাম এসে দরোজা খোলেন। আমার বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। ‘কি ব্যাপার মনসুর, এত রাতে কী সমস্যা?’ এমন কঠিন সুরে বললেন, ভয়ে আমার জিব অসাড় হয়ে গেল।

কোনমতে ‘সরি মেডাম। আমি তেরো তলায় যা‌ইতেছিলাম, ভুলে এদিক....’ বলে লিফটের দিকে ফিরে গেলাম। পেছনে দরোজা বন্ধ করার শব্দটা আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল। কোনো মিরাকল ঘটলো না।

মুরাদপুর থেকে বাসে উঠলাম আমরা। জিইসি মোড়ে নেমে গিয়ে রাস্তা পার হলাম। এবার একটা টেম্পুতে। টেম্পু করে অলংকার মোড়। অলংকার মোড়ে নেমে আরেকটা বাসে উঠি। এই বাস গিয়ে থামলো নয়াবাজার মোড়। সেখানে নামতেই দেখি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সাত্তার মিয়া একটা অস্পষ্ট খিস্তি করল রাস্তায় নেমে। আমাকে কিংবা বৃষ্টিকে- বোঝা গেল না।

চুপচাপ হাঁটছি সাত্তারমিয়ার হাত ধরে রেখে। কোনদিকে যেতে হবে জানি না। নিজের বাসাটা চিনতে পারছি না বললে সাত্তারমিয়া মশকরা ভেবে রাস্তায় ফেলেই চলে যাবে। তার চেয়ে অসুস্থতার ভাণ করে থাকি।

হাঁটতে হাঁটতে গলি ঘুপচি পেরিয়ে একটা ড্রামশেডের দরোজা দেয়া ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো সাত্তার মিয়া। এটাই আমার বাসা? কে আছে বাসাটায়? খুব অস্বস্তি হচ্ছে। কয়েকবার কড়া নাড়ার শব্দে দরোজা খুললো ঘোমটা দেয়া একটা মেয়ে। সাত্তার মিয়ার দিকে বিস্ময়সূচক দৃষ্টি। আমাকে দেখে এমন করে উঠলো যেন বহুকালের আপনজন। “কী হইছে তোমার? কী হইছে অর সাত্তারভাই!”

সাত্তার মিয়া আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, ‘তেমন কিছু না ভাবী। শইল এট্টু খারাপ লাগতেছিল। আমারে কইল সঙ্গে আইতে। এবার অসুবিধা নাই। ঘুমাইলে ঠিক হয়া যাবে। খেয়ে একটা ঘুম দে। আমি যাই এলা। বহুত দের হয়া গেল। রাত কাবার হয়া যাইবো পৌঁছাইতে’। বিড়বিড় করতে করতে সাত্তারমিয়া বিদায় নিল।

সাত্তার মিয়া যাবার পর আমি আরো বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার হাত ধরে বললো, ‘কত্ত শুকায় গেছো তুমি! বও, আমি খাবার নিয়া আসি। তুমি মুখ হাত ধুয়া নাও’।

পাশের রান্নাঘর থেকে দ্রুত ভাত বেড়ে আনলো মেয়েটা। বললো ‘আমি অহনো না খাইয়া বইসা আছি। তুমি এত দেরী করলা ক্যান আইজ। কিরাম খারাপ লাগছিল শইলে? খাটনি বেশী হইছে? বইসা আছো কেন, জামাকাপর ছাড়ো, যাও হাতমুখ ধুয়া নাও। বালতিত পানি আইনা রাখছি’।

আমি বাথরুমের আধো অন্ধকারে দেখি একটা বালতির মধ্যে লাল মগ। আমি মগে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। গোসল করতে ইচ্ছে করছে। রাতে আমার গোসল করার অভ্যেস দীর্ঘদিন। অফিস থেকে ফিরে গোসল না করে খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। কিন্তু এখন বাথরুমে পানি বলতে এই এক বালতি। এটা শেষ করলে সারারাত কিভাবে চলবে? এরা বাইরে থেকে পানি এনে বাথরুমে খরচ করে? কলে তো পানির কোন লক্ষণ দেখি না।

হাতমুখ ধুয়ে আসার পর ঘরটাকে ভালোমতন দেখলাম। মেয়েটা মানে বউ অবাক। বললো, ‘খাইতে বসো, কী দেখতাছো অমন কইরা। আজকে ঘরদোর মুছতে পারি নাই। পানি আসে নাই কলে। এই নিয়া চাইর দিন। এরাম আর কয়দিন চলবো? বাড়িওয়ালা খবরও নেয় না। তুমি এই বাড়ি বদলাও’।
আমি চুপচাপ খেতে বসলাম। এই মেয়ে যদি আমার বউ হয় আমি তাকে কী নামে ডাকবো। ওর নাম কি? নিজের বউকে তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না তোমার নামটা কী?

আমার কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। যেখানে চাকরী করি সেখানকার সবকিছু মনে আছে। কিন্তু নিজের ঘরের কিছু মনে নাই। তাহলে কি আমি মনসুর না? আমি কি আসলে নাজমুল? যদি ওটা স্বপ্ন হতো তাহলে আমি মনসুরের বাসা মানে নিজের বাসা নিজের বউ কিছুই চিনতে পারছিনা কেন? কী আজব এক সমস্যায় পড়লাম।

খাওয়া শেষে দরোজা খুলে বাইরে গেলাম। আকাশ একটু পরিষ্কার এখন। বৃষ্টি থেমে যাবার পর মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঠেছে এক ফালি। পেছন থেকে মেয়েটা এসে কাঁধে হাত রাখলো। আমি শিউরে উঠলাম। মায়াভরা গলায় বললো, ‘কী হইছে তোমার? আইজ এত আনমনা কেন? কিছু হইছে? অহনও কী খারাপ লাগতেছে শইল?’

-না, এখন খারাপ লাগে না। চিন্তা কইরো না বউ।
-বউ? হিহিহি তুমি আমারে বউ কয়ে ডাকলা শেষ পর্যন্ত! কত বার কইছি একবার বউ ডাকো। বিয়ার এক বছরেও তোমার মুখে বউ ডাক শুনিনাই। আইজ বউ ডাকলা তুমি শিউলি বেগমরে?
মেয়েটা হাসতেই থাকে। আমি চমকে যাই এর নামও শিউলি শুনে। নাজমুল সাহেবের বউয়ের নামও শিউলি। ঘটনা কোনদিক থেকে কোনদিকে গড়াচ্ছে বুঝতে পারছি না। কোন মতে কাষ্ঠ হেসে বললাম-
-না মানে বউ তো মনে মনে ডাকি। আইজ মুখে কইলাম আর কি।
-রাত অনেক হইছে আসো শুয়া পড়ি

শিউলি হাত ধরে টানলো। আমি আবারো শিউরে উঠলাম। এই মেয়ের সাথে ঘুমাতে হবে আমাকে? এই ভ্যাপসা গরমে? একটা চৌকির উপর কাঁথা বিছানো। কোনায় একটা সবুজ মশারি গুটানো। বালিশ দুটো কী ময়লা! গা ঘিনঘিন করছে। কিন্তু উপায় কি? কোথায় পালাবো? আমি তো চাইলেই স্বপ্নের নাজমুল হয়ে যেতে পারবো না। কী একটা স্বপ্ন এসে আমার সব বদলে দিল। স্বপ্নে ছিলাম নাজমুল এখন মনসুর। সিকিউরিটি মনসুর। যার একটা বউ আছে, বিয়ে করছে বছরখানেক আগে। আবার নাজমুল সাহেবের বউয়ের নামও শিউলি। তাকে দেখে বুকের ভেতর কেমন করে উঠছিল, কিন্তু সে তো আমাকে চিনলো মনসুর হিসেবে। আসলে আমি তো আপাদমস্তক মনসুরই। কিন্তু আমার ভেতরে কেন একজন নাজমুল ঢুকে গেল। কেন আমি ভাবতে লাগলাম আমি মনসুর নই।

শিউলি আমাকে টেনে বিছানায় শুইয়ে মশারি টাঙিয়ে দেয় পরম যত্নে। তারপর সে নিজে এসে ঘনিষ্ট হয়ে শোয়। আমি জানি মেয়েরা কখন এত কাছে আসে। ভয়ে কাঠ হয়ে থাকি তাই। আমার সাড়া না পেয়ে শিউলি ধরে নেয় আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। একসময় সেও ঘুমিয়ে পড়ে, আমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।

একটু সরে আমি ঘুরে শুই। চোখ বন্ধ করে থাকি জোর করে। ঘুম আসে না। কী ভোল চক্করে পড়ে গেলাম বুঝতে পারছি না। বাইরে অনেক দূরে একদল কুকুর হল্লা করছে। একটা রাতজাগা ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল কোথাও থেকে। শ’খানেক মশা মিছিল করছে মশারির বাইরে। সুযোগ পেলে রক্ত চুষে হাড় মাংস এক করে দেবে। আকাশ থেকে পাতাল, পাতাল থেকে আকাশ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি সেই অচেনা ঘরে।

খুট করে কেউ বাথরুমের লাইট জ্বাললো। শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলেও চোখ বন্ধ রাখি। চোখ বন্ধ রেখেও বুঝতে পারছি বাথরুমের দরোজাটা খুললো। সেই আলোতে ঘরটা উজ্জ্বল হয়ে গেছে। বাথরুমের দরোজা বন্ধ হলো, নিভে গেল আলোটা। এরপর আমি চোখ খুললাম। আরে এই তো আমি আমার পরিচিত ঘরে। বাথরুমে গেল শিউলি। আমাদের চোদ্দ তলার ফ্ল্যাট এটা। এই যে আমি, আমি তো এখন নাজমুল! খানিক আগে দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম নিশ্চিত।

কিছুক্ষণ আগে মনসুর হয়ে ফইল্যাতলীর এক ঘিঞ্জি বস্তির চৌকিতে ময়লা বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম, আমার পাশে বড় বড় নিঃশ্বাস টেনে ঘুমাচ্ছিল আরেক শিউলি। কোনটা স্বপ্ন, কোনটা সত্যি। আমি কে?

শিউলি যখন বাথরুম থেকে বের হয়ে আমাকে চোখ খোলা দেখলো তখন বললো, ‘তুমি এখনো ঘুমাওনি? কি ব্যাপার?’

ব্যাপার বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। ঝামেলা লাগতে পারে বললে।

উঠে বাথরুমে গিয়ে আয়নার দিকে তাকালাম প্রথমে। হ্যাঁ এই তো আমি। সেই চিরসুখী নাজমুল। ওই তো চোখ নাক মুখ। ওখানো কোথাও মনসুর নেই। তাহলে খানিক আগে আমি দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম? এখন আমি আমার সত্যি পরিচয়ে উদ্ভাসিত। বাথরুমের বাতি নিবিয়ে বিছানার দিকে যাই। কিন্তু শুতে ভরসা পাই না। আবার ঘুমালে কী হবে? ঘুমাতে আমার ভয় করছে। কেননা আমি যতবার ঘুমিয়ে পড়েছি ততবার আমার পরিচয় বদলে গেছে।

হিসেব করে দেখেছি মনসুর আর নাজমুলের মধ্যে পরিচয়ের ব্যবধান একটা ঘুমের মাত্র। এখন বিষয়টা বুঝতে পেরেছি। এখন যদি ঘুমাই তাহলে জেগে উঠে দেখবো আমি মনসুর হয়ে গেছি। আবার মনসুর যদি ঘুমায় তাহলে জেগে উঠে দেখবে সে নাজমুল হয়ে গেছে। এরকম বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটছে।

তাই না ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। বেডরুম ছেড়ে স্টাডিতে আসলাম। এখানে সব বইপত্র লেখালেখির জিনিসপাতি ছড়ানো। অফিস থেকে ফেরার পর এই জায়গাটাতেই সময় কাটে আমার। ঘড়িতে রাত তিনটা বাজে। মাত্র তিন ঘন্টা, এরপর ভোর হয়ে যাবে। ইলেকট্রিক কেটলিতে চা বানালাম বড় এক মগ। চিনি ছাড়া চা খেয়ে গলাটাকে ঘষামাঝা করলাম। ল্যাপটপ খুলে খুটখাট লেখাজোকার চেষ্টা করতে গেলে টের পেলাম ঝিমানি আসছে। না, না ঘুমানো চলবে না। চোখে পেঁয়াজ ঘষে দিতে হবে প্রয়োজনে। কথায় না কাজে পরিণত করতে হবে ওটা।

সত্যি সত্যি রান্নাঘরে গিয়ে পেঁয়াজ খুঁজতে লাগলাম। এমনিতে কখনো রান্নাঘরে ঢুকি না। কোথায় যে এসব রাখে কিচ্ছু পাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ খোঁজার পর কিচেন টেবিলের নীচে একটা ঝুড়িতে পাওয়া গেল। পেঁয়াজ নিয়ে বসলাম, এবার ছুরি পাই না। ছুরি পাওয়া গেল চামচের বাক্সে। ছুরি নিতে গিয়ে বাক্সটা ফসকে গেল হাত থেকে। ঝনঝনাৎ শব্দের এক রণদামামা বাজতেই শিউলি ঘুম ভেঙ্গে ছুটে এসে দেখতে পেল আমি রান্নাঘরের মাঝখানে আস্ত একটা পেঁয়াজ হাতে দাঁড়িয়ে। সে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকালো যেন আমি মাঝরাতে খিদের জ্বালায় রান্নাঘরের পেঁয়াজ চুরি করছি। পেঁয়াজ আর লাগেনি, সেই দৃষ্টির ঝাঁজেই আমার ঘুম পালিয়ে গেল।

পরদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় গাড়ির হর্ন দিতেই সালাম দিয়ে গেট খুলে দিল সাত্তার মিয়া। গেট পেরোতে গিয়ে গার্ডরুমের টুলে মনসুরকে ঝিমাতে দেখে চমকে গেলাম। ব্যাটা এখন ঘুমাচ্ছে!! কী সর্বনাশ! ঘুমালেই সে তো এখন নাজমুল হয়ে যাবে। দ্রুত গাড়ি পার্ক করে রেখে গার্ড রুমে এসে একটা হুংকার দিলাম। ‘তোদের এতবড় সাহস! ডিউটির সময় ঘুমাস? অসময়ে যে ঘুমাবে তার চাকরী চলে যাবে!! এটা ঘুমানোর চাকরী না!! ঘুমানোর জন্য তোমাদের বেতন দেয়া হয় না!! একদম ঘাড় ধরে বের করে দেবো বদমাশের দল’।

গর্জন শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মনসুর। সাত্তার মিয়া ভীষণ বিব্রত এবং অবাক। সে পুরোনো লোক। আজকে সাত বছর এই ফ্ল্যাটে উঠেছি কখনো কাউকে একটা বকা দেয়া দূরে থাক, সিকিউরিটির দিকে কখনো তাকাতেও দেখেনি। সেই ঠাণ্ডা কলিজার মানুষ আজকে এতটা ক্ষেপে যাবার কারণ কি। আমি ফিরে যেতে যেতে শুনলাম মনসুরকে বকাঝকা করতে থাকলো সে। তোর জন্য স্যার আইজ এত ক্ষেপছে হারামজাদা। জুতায় বাইর কইরা দেবো তোরে। কালকে ভং করলি শরীল খারাপ, বাড়িত পৌঁছায় দাও। দিলাম পৌঁছায়ে। তার এই পুরস্কার দিলি আইজ?’

সাত্তার মিয়ার কথা শুনে লিফটের বোতাম টিপতে ভুলে গেলাম। তাহলে আর কোন সন্দেহ নেই। ওটা স্বপ্ন ছিল না। গতকাল আমিই ছিলাম মনসুর। তাহলে গতকালের নাজমুলটা কি মনসুরই ছিল? রাতে কি সেই ঘুমিয়েছিল শিউলির পাশে? নাকি ঘুমায়নি? শিউলির সাথে কিভাবে কী করে কাটিয়েছে গতরাতটা!! হারামজাদা সেজন্যই এখন ঝিমাচ্ছে?

লিফটে ঢুকে বোতাম টিপে দিলে উপরে উঠতে থাকি। সেই সাথে মাথায় একটা চরম ক্রোধও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। ক্রোধ বাড়তে বাড়তে ক্লান্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এত সময় লাগে ১৪টা ফ্লোর শেষ হতে! হাঁটু মুড়ে বসে যেতে ইচ্ছে করছে এখানেই। ঘুমে জড়িয়ে আসছে দু চোখ। চোদ্দ তলায় উঠে বাসার কলিংবেল টিপতে শিউলী এসে দরোজা খুলে দিল। আমি বাসায় ঢুকে সোফায় বসে জুতো খুলতে খুলতেই কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে।

যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন আমি গেটের টুলে বসা। সাত্তার মিয়ার গালি বর্ষণ থেমেছে। ডিউটি বদলের সময় হয়ে এসেছে। বাড়ি ফিরতে হবে। আমার মন পড়ে আছে চোদ্দতলার ১৪এফ ফ্ল্যাটটিতে। কিন্তু আমাকে এখন টেম্পুতে চড়ে, বাসে ঝুলে ফিরে যেতে হবে ফইল্যাতলী বাজারের ঘুপচি ঘরে, যেখানে ময়লা বিছানায় শিউলি আমার জন্য ভাত বেড়ে বসে আছে।
==============

রহস্যময় ঘটনাটা আমি কারো কাছে বলিনি লজ্জায়, নিজের কাছেও এর কোন ব্যাখ্যা নেই। ধরে নিয়েছি এই পৃথিবীতে ব্যাখ্যাহীন আরো অনেক ঘটনার মতো এটিও থেকে যাবে। চিরকাল আয়নাবিমুখ থেকেও সেই ঘটনার পর থেকে আমাকে প্রতি মুহুর্তে আয়না দেখতে হয়। আমি শুধু ঘরেই আয়না দেখি না, আমার পকেটেও থাকে একটা আয়না। প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময় গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে চেহারা দেখে নেই, বাসায় ঢোকার আগে দেখি পকেট আয়নায়। নইলে ‘মনসুর কী ব্যাপার, কী সমস্যা তোমার!!’ – বলে ঝাড়ি খেতে হবে যে কোন সময়। গেট দিয়ে ঢোকার সময় দেখে নেই মনসুর জেগে আছে কিনা। হ্যাঁ মনসুর জেগে আছে এবং তার হাতেও একটা আয়না।


মন্তব্য

দেবদ্যুতি এর ছবি

অদ্ভুত! পুরো মাথা ঝিম ঝিম করছে এখন। চমৎকার আইডিয়া, চমৎকার গল্প কিন্তু মাথা ঝিমধরানো।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আসলে গল্পটাও লেখা হয়েছিল ঝিম ধরানো এক সন্ধ্যেবেলায়। পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

কেমন যেন একটা ধাক্কা দিয়ে গেল গল্পটা। ভাল লাগল।

-আতোকেন

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ধাক্কাটাই গল্প লেখার সার্থকতা, যদিও পেছনের ঘটনা আরো জটিল। গল্পপাঠের ধন্যবাদ জানুন। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

কি ভয়াবহ গল্প! শেভের সময় ছাড়া আয়না দেখিনা সাধারনত। এখন ঘুমাতেও ভয় লাগবে।

[গল্প দারুন লাগলো, নীড়'দা। কেবল এটা জানানোর জন্যই লগাইলাম।
পরে যদি বদলে যাই, অমুকের দখলে চলে যায় ল্যাপি, তখন! হুমমম?]

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

তাইলে আপনিও আয়নাবিমুখ মানুষ। সাবধানে থাকবেন অতি অবশ্যই। বলা যায় না..... খাইছে

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মন মাঝি এর ছবি

চিন্তা কি, কিম কার্দাশিয়ান বা সানি লিওনের বয়ফ্রেণ্ড হিসেবে ঘুম ভাঙলে অসুবিধা কি???

****************************************

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

উসকানি মূলক কিছু বলবেন না, জনাব! চাল্লু

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

হিমু এর ছবি

চমৎকার লাগলো।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

এক লহমা এর ছবি

খাসা হয়েছে, নীড়ুদা! হাততালি হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

শুধুই খাসা? আর কিছু না? খাইছে

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

এক লহমা এর ছবি

খাসা গল্প কি সামান্য হল? এইরকম একটা গল্প লিখতে পারলে কি খুশীই যে হতাম! মজা হচ্ছে, গল্পটা বার কয়েক পড়েছি, প্রত্যেকবার উপভোগ করেছি, সারাদিন মাঝে মাঝে মনে পড়েছে, বেশ একটা মৌতাত-এর মত লেগেছে। তবে আমেজটা হয়েছে মজার গল্প পড়ার, কোন ভয়ের গল্প পড়ার ধরণের নয়। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

নিজের লেখা কোন গল্প কেউ কয়েকবার পড়েছে, এটা যে কেমন আনন্দদায়ক ঘটনা, বোঝানো যাবে না। এটা খাসার চেয়েও মহা খাসা। অনেক কৃতজ্ঞতা জানবেন। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আয়নামতি এর ছবি

অনেকদিন পর খেললেন এবং বল মাঠ পেড়িয়ে সোজা গ্যালারিতে - ছক্কা! থুড়ি লিখলেন এবং ছক্কাই
হাঁকালেন। দারুণ লিখেছেন ভাইয়া। উত্তম জাঝা নেন। হাসি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

একটু ভুল হলো....ছক্কার বল মাঠে গড়ায় না, সোজা উড়ে গিয়ে গ্যালারিতে ঢুকে পড়ে।
তবু জাঝা নিলাম বুঝে হো হো হো

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আয়নামতি এর ছবি

মাঠে গড়ানো দেখলেন কোথায় ভাইয়া? আমি তো মাঠ পেরিয়ে যাবার কথা বলেছি।
মানছি ওখানে ড় দিয়েছি খাইছে

নীড় সন্ধানী এর ছবি

র এবং ড় এর ওজনের একটা ব্যাপার আছে। র হলো হালকা পাতলা, র হলে উড়ে যেতো, ড় হলো ভারী মানুষ, ড় দিলা বলেই বলটা গড়িয়ে গেল। দেঁতো হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আয়নামতি এর ছবি

পুরাই উত্তরাধুনিক সমাজবিজ্ঞানীদের মত উত্তর হয়ে গেলু কিন্তু ভাইয়া। খাইছে

সাঈদ আহমেদ এর ছবি

বাহ! অনেক দিন পর পড়ার আনন্দ ফিরে এলো। চমৎকার লেখা, গল্প অথবা আত্নজীবনী!

-----------
চর্যাপদ

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়ার আনন্দে আমিও আনন্দিত। আত্মজীবনী হলে সমস্যা আছে, তাই নেহাতই গল্প। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

খেকশিয়াল এর ছবি

দারুণ দারুণ গল্প! ভাল লাগলো বেশ।

কেননা আমি যতবার ঘুমিয়ে পড়েছি ততবার আমার পরিচয় বদলে গেছে।
হিসেব করে দেখেছি মনসুর আর নাজমুলের মধ্যে পরিচয়ের ব্যবধান একটা ঘুমের মাত্র। এখন বিষয়টা বুঝতে পেরেছি। এখন যদি ঘুমাই তাহলে জেগে উঠে দেখবো আমি মনসুর হয়ে গেছি। আবার মনসুর যদি ঘুমায় তাহলে জেগে উঠে দেখবে সে নাজমুল হয়ে গেছে। এরকম বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটছে।

কিন্তু গল্পে বোঝা যায়, এই ব্যাপারটা প্রথমবারের মত ঘটছে, তাই এ জায়গাটা একটু বেখাপ্পা লাগলো। আরো কয়েকবার হলে বা শেষের প্যারাতে অন্যভাবে আসলে মনে হয় ভাল হতো।

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এই বিভ্রান্তির একটা সাইকেল পূর্ণ হবার পরই আমি বুঝতে পারলাম ঘটনাটি বারবার ঘটবে হয়তো। শেষ বাক্যে 'হয়তো' যোগ করলে আরেকটু পরিষ্কার হতো। তবে এটা একটা লুপহোল কোন সন্দেহ নেই। সেটাকে পয়েন্ট আউট করার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

একটা ব্যক্তিগত মত বলি। শুরু আর শেষে ইটালিক হরফে যা কিছু লেখা হয়েছে সেগুলোর কোন দরকার ছিল না। গল্পে মুখবন্ধ বা পরিশিষ্ট থাকলে তা গল্পকে দুর্বল করে দেয়। এর বাইরে মূল গল্প একদম ঠিকঠাক হয়েছে যেমনটা আপনার গল্পগুলো হয়ে থাকে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

গতানুগতিক গল্প লিখতে ভালো লাগে না আজকাল। আগে পিছে লেজটেজ দিয়ে একটু ভিন্নতা আনার চেষ্টা। তবু পড়েছেন বলে অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা। আপনার নামটা দিলে ভালো করতেন।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

খলিলুর রহমান ফয়সাল এর ছবি

লেখকের সাথে আমি একটু ফোনে কথা বলতে চাই অথবা সরাসরি দেখা করতে চাই। আমি ‍সিলেট থাকি। খুবই জরুরী।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ইমেইলে যোগাযোগ করার জন্য-

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ভয়ংকর থিম। অনেকদিন পর ভিন্ন স্বাদের একটা গল্প পড়লাম।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়া ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানুন।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

দারুণ।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়লাম। ইন্টারেস্টিং।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়া ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ নাহিয়েন! হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

এক লহমা এর ছবি

(১) গল্পটা আবার পড়তেও খুব ভালো লাগল। কম গল্প-র জন্যই আমার এমনটা হয়। সচলের সেরা গল্পগুলোর একটা।
(২) এবারের পড়ায় মজা ছাপিয়ে ভয়ের অনুভূতিটা টের পেলেম।
(৩) আবারও একবার 'মনের মুকুর'-কে হাততালি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আরো একবার পড়ে আমার এই হাবিজাবি গল্পকে যে সম্মান দিলে তার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা এবং আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
আমি নিজেও আরেকবার পড়ে নিলাম এবং ভয় পেলাম। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আগের বার খেয়াল করিনি শুরুতে সামান্য পরস্পরবিরোধী বিশেষণ রয়েছে। মেঘপুঞ্জ প্রাকবর্ষণের হলে বাতাস বৃষ্টি শেষের মিঠে শীতল হবার কথা না। সাত্তার, মনসুর ও তার স্ত্রীর ব্যবহৃত ডায়ালেক্টের ধারাবাহিকতায় সামান্য ঘাটতি আছে। গল্পটা যেহেতু আপনার লেখা এজন্য সামান্য ব্যতয়ও চোখে লাগে।

কিছু কিছু গল্পের মূল কাঠামো পাঠকের মগজে স্থায়ীভাবে বসে যায়। পড়ার অনেকদিন পরে যখন গল্পটার অনেক কিছু পাঠকের মনে থাকে না তখনও ঐ কাঠামোটা পাঠকের অবচেতন মনে থেকে যায়। এটা অমন একটা গল্প।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পুরো গল্পটা ফিকশন হলেও আবহাওয়ার ঘটনাটি বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত, ওই বাতাসটার স্পর্শেই গল্পটা মাথার ভেতর খেলতে শুরু করেছিল। তাছাড়া বৃষ্টি শেষের বাতাস তো মিষ্টিই হয়। তবে উচ্চতা ভেদে তাপমাত্রার তারতম্য হতে দেখেছি। একই দালানের উপরের দিকে বাতাস একরকম আবার নীচের দিকে আরেকরকম। আবার বৃষ্টির স্থায়ীত্ব কতক্ষণ ছিল সেটাও একটা ব্যাপার। অল্প সময়ের বৃষ্টি বাতাসকে উত্তপ্ত করে তোলে, অধিক সময় হলে শীতলতা ছড়ায়।

ডায়ালেক্টের ব্যাপারে ঘাটতিটা ঠিক ধরেছেন। ওই বিষয়ে আমার যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। ওটা উত্তরণের সম্ভাবনাও দেখি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রমিত বাংলা দিয়েই চালাতে চেষ্টা করি তাই।

এতদিন পরেও গল্পটি আপনার মন্তব্য আকৃষ্ট করতে পেরেছে বলে অনেক ভালো লাগলো। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বৃষ্টি শেষের বাতাসের ব্যাপারটা গল্পেই স্পষ্ট। কিন্তু তার আগে 'প্রাকবর্ষণ মেঘপুঞ্জের রঙ চাঞ্চল্য' বলায় একটু কনফিউশন তৈরি হয়েছে।

এই গল্পের ডায়ালেক্টের ব্যাপারটার একটা সমাধান হতে পারে যদি সাত্তার, মনসুর আর তার স্ত্রীর মুখে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কোন একটি ডায়ালেক্ট বসিয়ে দিতে পারেন। আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যে পর্যায়ের তাতে আপনার চারপাশের মানুষদের মুখের ভাষা আপনার গল্পে ঠাঁই নিতে বিশেষ সমস্যা হবার তো কথা না।

গল্পটা তিন বছর আগেই পড়েছি। তখন কী কারণে মন্তব্য করা হয়নি সেটা নিশ্চিত না। তখন গল্পটা পড়ে বহুকাল আগে বিটিভিতে দেখা আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, লুবনা আহমেদ, অরুণা বিশ্বাস অভিনীত একটা নাটকের কথা মনে পড়েছিল যেখানে একটা বিশেষ কায়দায় বৃদ্ধ আবুল হায়াত আর তরুণ আসাদুজ্জামান নূরের মধ্যে শরীর অদল-বদল হয়। পড়ে ভেবে দেখলাম আপনার গল্পটা ঐ নাটকটার চেয়ে ভয়ঙ্কর কাঠামোর। তারপর অনেক দিন হঠাৎ হঠাৎ আপনার এই গল্প-কাঠামোটার কথা মনে হতো। সত্যি যদি এমনটা হতে শুরু করে তাহলে একটা (আসলে দুইটা) মানুষ কী অবর্ণনীয় এক অবস্থায় পরবে! ভাবনাটা আবার ফিরে এলো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।