জাপানের শেষ দিনগুলি

শামীম এর ছবি
লিখেছেন শামীম (তারিখ: রবি, ৩০/০৯/২০০৭ - ৮:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিদায় আসন্ন:

দেখতে দেখতে জাপান থাকার সময় শেষ হয়ে গেল ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ২৩শে সেপ্টেম্বরে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনে করে ফুকুওকা থেকে ভায়া সিঙ্গাপুর হয়ে ঢাকা ফিরে যাচ্ছি।

যাই যাই ভাবটা শুরু হয়েছিলো গত জুন মাস থেকেই। সম্বন্ধীর বিয়ে উপলক্ষে আমার বউ দেশে চলে গেল ১৭ই জুন। আমিও ফুকুওকা গেলাম বিদায় জানাতে। নাইট বাসে করে গিয়েছিলাম। জুলাই মাসে সম্বন্ধীর বিয়ের পরে বউ আবার জাপানে ফিরবে কি না সেটা নিয়ে একটু ধাঁধাঁর মধ্যে পড়ে যাই দুজনেই। কারণ হিসেব মত সেপ্টেম্বরে আমার পি.এইচ.ডি. শেষ হলে আমার ফিরে আসতে হবে। কাজেই ও যদি জাপানে আসেও তাহলেও দেড় দুইমাস পরেই আবার বাংলাদেশে ফিরতে হবে। আর ট্যাকের যে অবস্থা তাতে এ্যাত ঘনঘন আসাযাওয়া করলে সামনে অন্ধকার ... ... তাই কষ্ট হলেও দুজনেই ঠিক করলাম যে, যদি না জাপানেই আমার কোন চাকরী বা পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চারের কাজ জোটে তাহলে ও আর জাপানে আসবে না। আর, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও নেয়া যাচ্ছিলো না কারণ, পোস্ট ডক্টরালের জন্য আবেদনের ফলাফল দেয়ার কথা অগাস্টের ২০ তারিখের দিকে। সুতরাং অন্ততপক্ষে ঐ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শেষ পর্যন্ত আমার আর ওটা হয়নি, যদিও খুব আশা করেছিলাম যে রিসার্চের প্রস্তাবটা গৃহীত হবে। আমার প্রফেসরও খুব ভালভাবে রেকমেন্ড করে দিয়েছিলেন কিন্তু তাও হলোনা।

যা হোক বউ জাপানে ছিল না সেই জুন মাস থেকে। এবং ঐ সময়ে আমার কাজের চাপ অত্যধিক বেশি ... শেষ টার্ম বলে কথা। থিসিস ডকুমেন্টের একটার পর একটা ড্রাফট ঠিক করছি আর প্রফেসরদের পরীক্ষা কমিটি ওগুলোতে গাদা গাদা সংশোধনী দিচ্ছে... হাতে সময়ও কম। এটার কাজ করতে করতে রাত-দিনের হুশ পাই না। তাই বউ যাওয়ার আগে ওকে সময়ও দিতে পারিনি যথেষ্ট। বউ চলে যাওয়ার পরে, সময় দেয়ার দায়িত্ব একটু কমে গেল বটে, তবে স্বাভাবিক জীবন যাপন বাঁধাগ্রস্থ হল প্রবল ভাবে। বউয়ের সতর্ক দৃষ্টির আড়ালে থেকে নিয়মিত ব্যায়াম বাদ পড়ে গেল ... ... অবশ্য এর পিছনে অসম্ভব গরমটাও দায়ী ছিল বহুলাংশে।

গরমের সময়ে মনে হয়েছিলো যে, এই সময়ে বউ এখানে না থেকে খুব ভাল হয়েছে ... এখানে নির্ঘাত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়তো -- ওর ঠান্ডা লাগার ধাত আছে, এয়ার কন্ডিশনার সহ্য হয় না ... তাই বাসায় এ.সি.ও লাগানো নাই। গরমের সাথে অসম্ভব আদ্রতা ... মনে হয় সেটা ঢাকার চেয়েও বেশি। কারণ সম্ভবত আমাদের শহরটার অবস্থান। প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে শহরটা, আর আমাদের বাসার পূর্বদিকে বড়জোর তিন কিলোমিটার দুরেই মহাসাগর, দক্ষিন দিকে দুই কি আড়াই কিলোমিটার দুরে পাহাড়, সুতরাং ভ্যাপসা আবহাওয়া।

থিসিস ডিফেন্স ও ডিগ্রী প্রাপ্তি:

বউ ঢাকায় থাকাতে ওর এই অসহ্য গরম সহ্য করতে না হলেও আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিলো। যা হোক একটু একটু করে সমস্ত কাজ শেষের পথে চলে আসলো আর দোসরা অগাস্টে আমার ফাইনাল ডিফেন্সের তারিখ পড়লো। ঠিক তার পরে পরেই ৫ তারিখে আমার প্রফেসরসহ বাংলাদেশে একটা রিসার্চ ট্রিপের পরিকল্পনা ছিল, যেখান থেকে ১৯ তারিখে আবার জাপানে ফিরবো। সব প্রস্তুতি শেষ, তবে ডিফেন্সের আয়োজনটাকে বলা যায় এলাহি কারবার .... .... কারণ এর আগেও কয়েকজনের পি.এইচ.ডি থিসিস ডিফেন্স দেখেছিলাম এখানে। দর্শক হয় হাতে গোনা কয়েকজন। পরীক্ষক বাদে নিজ ল্যাবের দুই/একজন, স্বামী বা স্ত্রী, আর বাইরের দর্শক বলতে আমি! কিন্তু আমার বেলায় প্রফেসর দাওয়াত দিয়েছিল অনেককে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা ছিল যে মোটামুটি ভাবে ফাইনাল প্রেজেন্টেশনের হ্যান্ডআউটের ২০ কপি করলেই তা দর্শকদের জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু প্রফেসরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করাতে উনি যা বললেন তা শুনে আমি তো অবাক। উনি প্রথমেই ফরেন স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের গ্রুপ মেইলৈ একটা মেইল করিয়েছেন (আমিও সেটা পেয়েছিলাম), তারপর দাওয়াত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করে এমন দুটি সংগঠনের যতজন এই শহরে আছে সকলকে (এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়র্ক এবং রিসার্চ গ্রুপ অব এপ্লাইড জিওলজি), এছাড়া দাওয়াত দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু প্রফেসরকে, সবশেষে উনার ল্যাব থেকে গত ১০ বছরে যতজন পাশ করে গেছে সকলকে। উনি হিসাব দিলেন পঞ্চাশ কপির বেশি করতে হবে, মোট সত্তর কপি করতে বললেন। সব কপি করলাম, স্ট্যাপল করে সেট বানালাম ... এসব করতে করতে আমার অবস্থা কেরোসিন। এদিকে হয়েছে আরেক কারবার ....

আবহাওয়া রিপোর্টে দেখাচ্ছিল যে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে একটা টাইফুন ধেয়ে আসছে এবং সমস্ত পূর্বাভাষ বলছে এটা সরাসরি আমাদের শহরের (মিয়াজাকি) উপর দিয়ে ভূমিকে আঘাত হানবে। তবে সেটা আঘান হানবে ৩রা অগাস্ট সকালের দিকে, সুতরাং ২রা অগাস্টের দুপুরে আমার প্রেজেন্টেশন হতে কোন সমস্যা নাই কারণ ঝড় শুরু হবে মাঝরাত থেকে। ১লা অগাস্টের বিকালের আবহাওয়া রিপোর্টে বলল যে টাইফুন এর গতি পরিবর্তন করে আরও দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে এবং পরদিন দুপুরে আমাদের শহরের উপর দিয়ে ভূমিতে আঘাত হানবে!! সন্ধ্যা ৬:১৫তে প্রফেসর বললেন টাইফুনের কারণে আগামীকালের থিসিস ডিফেন্স পিছিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ (না করে উপায় নাই, কারণ দুপুর ২টা থেকে ৩টা ডিফেন্স আর ঐ সময়েই টাইফুনের কেন্দ্র আমাদের উপর দিয়ে যাবে!)। পিছিয়ে দিয়েছে কবে?? ২০শে অগাস্ট। কারণ আমরা ৫ই অগাস্টে ট্যুরে যাচ্ছি, আর টাইফুনের পরের দুই/একদিন কে কী অবস্থায় থাকে তার ঠিক নাই .... অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে ১৯শে অগাস্ট দুপুরে জাপানে আমাদের শহরে ফিরে পরদিন দুপুরে প্রেজেন্টেশন।

পরিচিত সকলেই (জাপানি সহ) বলছিল.... এ তো খুব ধকল যাবে, বিমান ভ্রমনের জেট ল্যাগ কাটার আগেই প্রেজেন্টেশন। অবশ্য আমি চিন্তিত ছিলাম না কারণ, ইতিপূর্বে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছি। এমনও হয়েছে যে ভোরে ওখানে বিমান থেকে নেমে দুপুরে প্রেজেন্ট করেছি। কাজেই এটাতেও সমস্যা হবে না। যা হোক, ভেবেছিলাম থিসিস ডিফেন্স করে মাথা থেকে এই বোঝা নামিয়ে হালকা মাথায় দেশে যাবো, সেটা আর হলো না। তবে একটা লাভ হয়েছিলো। দেশে কাজের ফাকে (যশোরে) ওখানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারদের এবং যশোরে ডি.পি.এইচ.ই-জাইকা আর্সেনিক মিটিগেশন প্রজেক্টের টেকনিক্যাল কর্মকর্তাদের সামনে প্রায় একই জিনিষ একবার প্রেজেন্টেশন করে নিজেকে একটু ঝালাই করে নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই প্রেজেন্টেশনটা আসলে দেয়ার কথা ছিল আমার প্রফেসরের, কারণ উনি উক্ত প্রজেক্টের টেকনিকাল এক্সপার্ট হিসেবে গিয়েছিলেন। এখানে উপস্থিত সকলেই সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন জন্য বিষয়টার খুটিনাটি ভালো জানেন এবং বোঝেন, ফলে ওনাদের সাথে প্রেজেন্টেশনের পরের প্রশ্নত্তোর পর্বটা থিসিস ডিফেন্সের চেয়ে কার্যকর হবে এটাই আশা করেছিলাম। কারণ থিসিস ডিফেন্সে যাঁরা আসবেন ওনারা আমার কাজ সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না... কাজেই মূল লক্ষ্যটা হবে ওনাদের মাথায় বিষয়টা সম্পর্কে ধারণা দেয়া, বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সুযোগ সীমিত। কিন্তু যশোরের টেকনিক্যাল প্রেজেন্টেশনে বিষয়ের খুব গভীরে গিয়ে আলোচনা/প্রশ্নত্তর পর্ব হয়েছিল কারণ, ওনারা আসলে আমার গবেষণার ফলাফলটাকেই মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করছেন ঐ প্রজেক্টে। আর ওটাতে খুব ভালভাবেই উৎরে গিয়েছিলাম।

মিয়াজাকি ফিরে এসে তাই থিসিস ডিফেন্স করতে কোন অসুবিধা অনুভব করিনি। মোট ৪৩ জন উপস্থিত ছিলো ঐ সময়ে। আর ডিফেন্সের পরে পরীক্ষক কমিটির প্রফেসরগণ বললেন আমার প্রেজেন্টেশন আর প্রশ্নোত্তর পর্ব আশাতীত ভাল হয়েছে। কাজেই সাথে সাথেই দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছিলাম। আমাকে ডক্টরাল সার্টিফিকেট দেয়া হল ১৩ই সেপ্টেম্বর, আর তার দশদিন পরে জাপান ত্যাগ করলাম।

গৃহহীন হওয়ার পর্ব:

ডিগ্রী পেতে অসুবিধা না হলেও ওখানকার বাসা এবং অন্য সবকিছু ছেড়ে আসতে অসম্ভব ঝামেলা পার করতে হয়েছে। প্রথমত বাসা থেকে সমস্ত আসবাব সরাতে হয়েছে। আশেপাশের বিদেশী ছাত্রদের এবং বাঙালী ভাইদেরকে তিল তিল করে গড়ে তোলা প্রথম সংসারের সমস্ত জিনিষ বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে দিতে প্রচন্ড কষ্ট হলো। এরপর পরিষ্কার করতে হলো সমস্ত ময়লা। এখানে ময়লা ফেলার আগে ওগুলোকে ভাগ করে বিভিন্ন ভাগে ফেলতে হয়। দহনযোগ্য, অদহনযোগ্য, প্লাস্টিক, রিসাইকেল, বোতল/ক্যান ... ময়লা ভাগ করার কত যে প্রকারভেদ।

কয়েকমাস ধরে জমানো শুকনা ময়লা বেছে আলাদা আলাদা করে ফেললাম। শুনতে খুব সহজ মনে হলেও কাজটা খুবই বিরক্তিকর এবং সময় সাপেক্ষ ... একটু ব্যাখ্যা করি। দেশে কাগজের প্যাকেটে যেমন জুস পাওয়া যায়, এখানে তেমন দুধ/জুস ইত্যাদি পাওয়া যায়। ঐ প্যাকেট ধুয়ে পানি ঝরিয়ে রেখে দিয়েছেলাম, কারণ ওটাকে স্বাভাবিক ময়লার সাথে দহযোগ্য হিসেবে ফেলা যাবে না। প্রতিটি প্যাকেটকে নির্দিষ্ট আকারে কেটে তারপর সেগুলোকে একসাথে বেঁধে রেখে আসতে হবে রিসাইকেলযোগ্য (পূণর্ব্যবহারযোগ্য) ময়লা হিসেবে। মোট ৬৭টি প্যাকেট জমেছিলো আমার বাসায়।

এরপর আসি ড্রিংকের বোতলের কথায়। বোতলগুলো সাধারণত PET বোতল, ওগুলোকে আলাদা ফেলতে হবে। তবে বোতলের মুখগুলো আবার অন্য প্রকৃতির ময়লা (প্লাস্টিক রিসাইকেল) এছাড়া বোতলের গায়ের লেবেল লাগনোগুলো কাগজের হলে দহনযোগ্য আর প্লাস্টিক/পলিথিনের হলে প্লাস্টিক ময়লা। বুঝুন ঠেলা ... বোতলের মুখ/ক্যাপ একদিকে, লেবেল ছিড়ে আলাদা করে একদিকে আর বোতল আরেকদিকে। ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর গত কয়েকবছরে ব্যবহৃত আর অব্যবহৃত কাপড়চোপড় ... ... নতুন পুরাতন মিলিয়ে মোট দশ বস্তা কাপড় ফেলে দিতে হলো - পূণর্ব্যবহারযোগ্য ময়লা হিসেবে। থালাবাটি কিছু ফেলা হল অদহনযোগ্য ময়লা হিসেবে আর কিছু বিভিন্ন লোকজন নিয়েছে। পর্দা, পর্দা লাগানোর রেইল সব খোলা হল .... .... ...। নতুন টেলিভিশন কিনেছিলাম। কিন্তু ওটা শেষে একটু সমস্যা করতো। তাই ওটা ফেলে দিলাম। টেলিভশন ফেলতে ৩৩০০ ইয়েন ফী দিতে হল!

এরপর ছিল কাগজপত্র আর বই। নিজের বই ছিলো প্রায় ৪০-৫০ কেজি। তার মধ্য শুধু যেগুলোতে নিজের কোন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ওগুলো (১২ কেজির মত) আর দেশ থেকে আগে নিয়ে আসা কাঁথা চাদর মিলিয়ে ২০ কেজি মাল দেশে পাঠালাম পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ... খরচ ১২০০০ ইয়েন। বাকী বইপত্র সব ল্যাবে দিয়ে আসলাম। ওরা যদি সামনে কখনো বাংলাদেশে ট্যুরে আসে তাহলে কয়েকটা বই নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করে আসলাম .... ওখানে জাপানে কেনা বই যেগুলো ছিলো ওগুলোর মূল্য ১০০০০ ইয়েনের বেশি। এছাড়া বিভিন্ন জিনিষ কেনার সময়ে বাসায় প্রবেশ করা কাগজের বাক্স (কার্টন) ফেলতে পারলাম না। এগুলো ফেলতে হয় আলাদা ভাবে। সবগুলো ভাঁজ করে একসাথে নির্দিষ্ট দিনে (অন্যান্যগুলোও নির্দিষ্ট দিনে ফেলতে হয়) ফেলতে হয়। ল্যাবের জাপানি জুনিয়র বললো ওগুলো ল্যাবে রেখে যেতে, পরবর্তী বৃহস্পতিবার ফেলার একটা তারিখ আছে তখন ওরা ফেলে দেবে।

এই সব কাজ করতে করতে শেষের সপ্তাহ দুই মন ও শরীরের উপরদিয়ে স্টীম রোলার গেল। শেষ দুইরাত দুই দিন মিলিয়ে মোট চার ঘন্টা ঘুমিয়েছি। কাজ করতে করতে শরীর এতই অবসন্ন হয়ে যায় যে মনে হয় নিজের শরীরের ভার নিজেই বহন করতে পারি না। রাতে পরিষ্কারের কাজ আর দিনে ল্যাবের শেষ দিকের কাজ যেমন সি.ডি. বানানো, অন্য প্রফেসরের কামলা খাটা, অফিসিয়ালি সমস্ত সার্ভিস (মোবাইল ফোন, ল্যান্ডফোন, ইন্টারনেট সার্ভিস, ভাড়া-বাসা, স্বাস্থ্যবীমা, ক্রেডিটকার্ড, পোস্টঅফিস একাউন্ট, ব্যাংক একাউন্ট, বিদ্যূৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদি) বন্ধ করার জন্য ছোটাছুটি, ফোন করা ইত্যাদি। গাড়িটা ফেলে দিতে চেয়েছিলাম ... গাড়ি ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় ফী (৯৪০০ ইয়েন) জমা দিয়েছিলাম অনেক আগেই। যেই দোকান থেকে গাড়ি কিনেছিলাম ওখানে যখন গাড়িটা কয়েকদিন আগে নিয়ে গিয়ে বললাম গাড়িটাতো ফেলতে চাই, দোকানের মালিক কাগজপত্র দেখে বলে গাড়িটা যথেষ্ট ভাল আছে এখনও (বয়স ১৩ বছর) তাই এটা ফেলো না, কারণ তাহলে ওরা গাড়িটা ভেঙ্গে ফেলবে। তার চেয়ে আমি এটা কিনে নিচ্ছি। নামমাত্র মূল্যে গাড়িটা কিনে নিলেন .. (আমি তো ফেলেই দিতাম .. কাজেই যা পাওয়া যায় তাই লাভ)। সবার শেষের দিন অর্থাৎ গতকাল (২২-সেপ্টেম্বর) বাসার চাবি কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে তারপর গাড়িটা দিয়ে আসলাম ... গৃহহীন ও গাড়িহীন হলাম।

অবশেষে বিদায় মিয়াজাকি:

(গতকাল ২২শে সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ইফতার পার্টি হল বাঙালি বড় ভাইয়ের বাসায়। বাঙালী সাড়ে চার পরিবারের সকলেই এসেছিলো (আমি একা, তাই অর্ধেক পরিবার!)। খুব জমেছিল ইফতার ও তার পরের আড্ডা। তারপর রাত ১১টার বাসে চলে আসলাম ফুকুওকা। আমাকে বাসস্ট্যান্ডে এগিয়ে দিয়ে গেল ওখানের সকল পুরুষগণ। এছাড়া ল্যাব থেকেও ৩জন ছেলে ওখানে এসেছিল বিদায় জানাতে। বিদায় নিতে তেমন কষ্ট হলো না ... খারাপ লাগলো না তেমন একটা। কারণ, গত কয়েকদিনে তিল তিল করে গড়ে তোলা আমাদের প্রথম সংসারটার স্থাবর অংশগুলো দান করতে আর ময়লা হিসেবে ফেলতে ফেলতে কষ্টের যে শেল মনে জমা হয়েছে (অধিক শোকে পাথর) তার তুলনায় এই বিদায় তো তেমন কিছু না। বিদেশের কঠিন পরিবেশে জীবনযুদ্ধের মাঝে আপনজন বাঙালিদের সাথে দেখা হয় হয়তো মাসে একবার ... ... আর সংসারটা ছিল পুরা সময় জুড়ে কত স্মৃতির ধারক হয়ে। তাই বিদায় দিতে তেমন কষ্ট লাগেনি ... ... ...।

মিয়াজাকিকে আসলেই খুব মিস করবো আমি আর আমার বউ - এখানে আমাদের নিজেদের মত করে সংসার করার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।।

এই মুহুর্তে বসে আছি সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে; ৫ ঘন্টা ট্রানজিট। তাই বসে বসে গত কয়েকদিনের স্মৃতিচারণ করে ল্যাপটপটার সদ্ব্যবহার করলাম।


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

চাংগি এয়ারপোর্টে ট্রানজিট থেকে। একেবারে তাজা স্মৃতিচারণ। পোস্টডকটা বছর দুয়েক পরেও করা যাবে। সেই ভালো। এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হবে পিএইচডি'র সাথে।
শুভেচ্ছা।

সাবধান:
একা একা সিএনজি-তে উঠবেন না।
ঈদের আগে সন্ধ্যায় খামোখা বাজার করার জন্য ঘুরাঘুরি করবেন না।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

কনফুসিয়াস এর ছবি

মিশ্র অনুভূতি হলো পড়ে।
আপনার পোষ্ট-ডক্টরালটা হয়ে গেলে আরো বেশি খুশি হতাম হয়তো। তবে এখন অনেক বেশি হিংসা হচ্ছে দেশে ফিরে যেতে পেরেছেন বলে।
ভালো থাকুন।
-যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

সৌরভ এর ছবি

ডঃ জামান, নিপ্পন ছেড়ে গ্যালেন তাহলে।
আলবিদা।

আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, এইরকম করে কাউকে কিছু না বলে সব গুছিয়ে বাড়ি চলে গেলে কেমন হয়।
পারি না। খুব একটা পিছুটান নেই অবশ্য। তারপরও।

দেশে ফিরে চলাফেরার ব্যাপারে একটা টিউটোরিয়াল পোস্ট দিন, বিগ সি। অনেকেরই লাগবে। আমি তো প্রতিবছর ফিরে নতুন করে আবিষ্কার করি সবকিছু।


আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

শামীম এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

বাইরে তেমন একটা যাচ্ছি না .... .... এই মুহুর্তে গ্রামীন ফোনের প্রিপেইডের ইন্টারনেট ব্যবহার করছি .... চরম খরচ। আগামী একসপ্তাহের মধ্যে পোস্টপেইড ইন্টারনেট নিতে হবে। তারপর আরো একটু নিয়মিত হতে পারবো। আপাতত বিদায়।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

অভিনন্দন ড: জামান ...

অভিজিৎ এর ছবি

অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা। আমার পি এইচ ডির শেষ দিন গুলোর কথা মনে করিয়ে দিলেন। আশা করি দেশে গিয়ে একটু স্থিতু হয়ে নিয়মিত লেখালিখি করবেন।
========================
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

তারেক এর ছবি

অভিনন্দন শামীম ভাই। হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

তারেক এর ছবি

অভিনন্দন শামীম ভাই। হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

শামীম ভাই, পড়লাম এবং বুঝলাম ভাবী না থাকার সুযোগে কিভাবে প্রজন্মে আপনার পোস্টের সংখ্যা এক্সপোনেনশিয়াল রেটে বাড়ত। যাহোক অনেকদিন পরে হলেও আপনার লেখা পড়া হল। দেশে ফিরে আশা করি আবার নিয়মিত হবেন। আমার এখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।

পোস্ট-ডক এখন না হলেও পড়ে হবে ইনশাল্লাহ।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

বাংলাদেশে এককাপ চায়ের নেমন্তন্ন।

অমিত এর ছবি

অভিনন্দন আর দেশে চলে যেতে পেরেছেন, এজন্য খানিকটা ঈর্ষা।
পোস্ট ডক'টা ইউ এস এতে কইরা ফেলেন।

______ ____________________
suspended animation...

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

কনগ্র্যাচুলেশনস ড. জামান।
৪৩জন আপনার ফাইনাল ডিফেন্সে এসেছে, এটা একটা বিরাট ব্যাপার! সেজন্য আরেকটা অভিনন্দন

দেশ থেকেও নিয়মিত আপনার ব্লগিং চলবে আশা করি হাসি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনেক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা!!

বাপ্পী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।