নিউ মেক্সিকোর দক্ষিণের আলমাগড়ড অঞ্চল থেকে আমি রওনা হয়েছি সেই পুয়েবলো নিবাসীদের শহর সান্তা ফের দিকে। আলমাগড়ডতে এসেছিলাম এখানকার এক সফেদ সাদা বালির অদ্ভুত এক মরুভূমি দেখতে। বলা নেই কওয়া নেই, রুক্ষ পর্বতরাজি আর মাইলের পর মাইল জুড়ে ছড়ানো বিস্তীর্ণ অসমতল বুনো ঝোপঝাড়ে ভরা ভূমির মাঝে হটাৎ জেগে ওঠা ডুবো চরের মতো চোখে পড়ে এই বালিয়াড়ির মরুভূমিটিকে। লোকে বলে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত-এ দুটো সময়ে নাকি এই মরুভূমিকে আবিষ্কার করা যায় তাঁর প্রকৃষ্ট রূপে। সূর্যোদয়ের সময়কার মরুভূমিটিকে ধরতে পারিনি, তাই বড় সাধ ছিল সূর্যাস্তের সময়টি পর্যন্ত অপেক্ষা করে সেই অদ্ভুত ধবধবে সাদা মরুভূমির বুকে শেষ বিকেলের অস্তগামী সূর্যের কিরণচ্ছটা দেখবার। সে আশা পূর্ণ হল ঠিকই, কিন্তু হিসেবে একটু গোলমাল শুরু হল যাত্রা শুরু করবার পরই। হটাৎ ঝুপ করে নেমে আসা মিশমিশে অন্ধকারে আবিষ্কার করলাম সেই দু লেনের মহাসড়ক ধরে সামনের দুটি বাতি জ্বালিয়ে কেবল ছুটে চলেছে আমার গাড়িখানাই। আসবার পথে দিনের বেলায় লক্ষ করেছিলাম এখানে দুপাশে সড়কের ধারে বুনো কাঁটার ঝোপ ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই, শহর আর মনুষ্যবসতি তো অনেক দূরের কথা। এখন এই রাতের আঁধারে মনে হল যেন আমার গাড়িটিকে আমি বয়ে নিয়ে চলেছি বিস্তীর্ণ এক মহাসমুদ্রের মাঝ দিয়ে, যেখানে চারপাশের সাথি কেবলই আঁধার আর নিঃশব্দতা। এমন স্থানে কোন জরুরি প্রয়োজন হলে যে থামবো সেটিতেও ঠিক মন সায় দেয় না, কারণ কে জানে সেই ফাঁকে যদি হিংস্র শ্বাপদ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে! প্রতি আধ ঘণ্টাতেই ভাবি এই বুঝি কোন শহরের দেখা পাব! কিন্তু সে আশা গুড়ে বালি। অতঃপর প্রায় ঘণ্টা চারেক একটানা চলাবার পর সান্তা ফে শহরের অস্পষ্ট বাতিরেখা একটু একটু করে দৃশ্যমান হল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।
গত দশ বছরে আমেরিকার প্রায় ত্রিশটি অঙ্গরাজ্যের প্রায় ষাট-সত্তরটি শহরে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে, কিন্তু স্থাপত্যের দিক এমন বৈচিত্রময় শহর আর কোথাও আমার চোখে পড়েনি। কারণ আর সবখানেই ওই একই নকশায় ইট, কংক্রিট আর কাঁচের ইমারতের আড়ালে ঢাকা পরা শহর-নগর আমার নজরে পড়েছে। কিন্তু সান্তা ফে শহরটি সে দিক দিয়ে স্বতন্ত্র এই কারণে যে এ শহরের প্রায় সব বাড়িগুলোই সেই আমাদের দেশের অজ পাড়াগাঁয়ে মাটি দিয়ে নির্মিত বাড়িগুলোর মতোই। ঠিক তেমনই এই বাড়িগুলোর বহির্ভাগের রঙ, আর কোন বাড়িই ত্রিতলের বেশি উচ্চ নয়। উপরের ছাদে ভার বহনের কাজটি ছেড়ে দেয়া হয়েছে আড়াআড়িভাবে পাতা কিছু কাঠের গুড়ির উপর। এই স্থাপত্য ধরনটি স্প্যানিশদের কাছ থেকে পাওয়া। পুয়েবলো নিবাসী আদিবাসীদের অবশ্য স্থাপত্যরীতি ছিল কিছুটা ভিন্ন ধরণের। কিন্তু শতাব্দীর পরিক্রমায় তাদের অনেকেও স্প্যানিশদের এই স্থাপত্যরীতিটিকে বেছে নিয়েছেন তাদের বাসস্থান বানাবার কাজে।
সান্তে ফে শহরে এসে উঠেছি শহরের পুরনো অংশের খুব কাছের এক হোটেলে। সকালে উঠে তাই পাঁচ মিনিটের পথ উতরেই পৌঁছে গেলাম সেই পুরনো অংশের ওয়াটার স্ট্রিটে।
গত চারশো বছরে হয়তো শত সহস্র মেঘের দল উড়ে গেছে সান্তা ফের আকাশ ছুঁয়ে, স্প্যানিশরা এসে পতাকা তুলেছে, গোল বেঁধেছে আদিবাসীদের সাথে, একসময় আবার আদিবাসীরা স্প্যানিশদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে সান্তা ফেকে, এরপর কালের আবর্তনে এক সময় সান্তা ফে চলে আসে মার্কিন মানচিত্রের সন্নিবেশে, গাইতি বেলচা নিয়ে ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা সেই সুদূর ক্যানসাসের টপেকা থেকে সান্তা ফে পর্যন্ত রেলের দুটি পাতকে টেনে নিয়ে এসেছে, তারপর আবার একসময় গৃহযুদ্ধের বারুদ আর আগুনের ছোঁয়া এসে লেগেছে এই শহরের বুকে- কিন্তু এই এতকিছু ঘটে গেলেও কিছু কিছু জিনিস আর কিছু কিছু স্থাপনা আজও কিন্তু বদলে যায়নি এ শহরে। এই যেমন ওয়াটার স্ট্রিটের শেষ মাথার ‘লা ফন্দা’ হোটেলটির কথাই ধরা যাক না কেন। স্প্যানিশ ভাষায় ‘ফন্দা’ শব্দের অর্থ সরাইখানা। ষোলশ শতকের প্রথমার্ধে স্প্যানিশরা যখন প্রথম থিতু হয় এই শহরে, তখনই নাকি এই হোটেল ভবনটির পত্তন, যদিও সে সময়ে এই সরাইখানাটি ঠিক আজকের রূপে ছিল না। এখনকার রূপটি প্রদান করা হয়েছে বিংশ শতকের প্রথম ভাগে। এত কিছু থাকতে এই সরাইখানাটির কথা তুললাম আরেকটি বিশেষ কারণে, আর তা হল শহরজুড়ে ‘ভুতুড়ে বাড়ি’ হিসেবে এই ভবনটির সবিশেষ দুর্নাম রয়েছে। তবে ওই দুর্নামের ভাগীদার হাবার কারণেই অবশ্য রাজ্যের পর্যটক এসে জোটে এই হোটেলে, কে জানে যদি ভাগ্যক্রমে নিশুতি রাতে ভুতের দেখা মেলে! ভুত নিয়ে এই শ্রুতিকথার কারণ হল সেই স্প্যানিশ রাজত্বকালে এই সরাইখানার সামনের বারান্দার অংশটিতে নাকি বসতো উন্মুক্ত বিচার সভা, আর রায়ে যাদের ফাঁসির নির্দেশ হতো, তাদেরকে ওই বারান্দার কার্নিশেই ঝুলিয়ে দেয়া হতো। তাদের লোকান্তরিত আত্মারাই নাকি আজও ঘুরে ফিরে আসে এই সরাইখানায়। তো এহেন ভুতুড়ে হোটেলের নিচতলার এক প্রাতঃরাশের রেস্তরাঁতে দু কুসুমের এক বিশাল মামলেট সহযোগে সকালের আহার সেরে পা চালালাম সান্তা ফে প্লাজা অভিমুখে, যেটিকে বলা যায় এ শহরের মূল প্রাণকেন্দ্র।
এই প্লাজা অভিমুখে যাবার সময়ে আমাকে অবশ্য বার কয়েক যাত্রাবিরতি নিতে হল। কারণ পথের পাশের এক মুদি দোকানে ঝুলন্ত কিছু মরিচ দেখে একটু নেড়ে-চেড়ে দেখবার লোভ সামলাতে পারলাম না। মার্কিন দেশে অদ্যাবধি কোন দোকানে এভাবে ঝুলিয়ে রাখা মরিচের ঝাঁকি আমার চোখে পড়েনি। কাছে গিয়ে পরখ করতে গিয়ে গাঁয়ে লেখা দাম দেখে কিঞ্চিৎ থমকে গেলাম। অল্প এক মুঠো পাকা মরিচের দাম পাঁচ ডলার। মরিচের মতো এমন সামান্য জিনিস দেখে আমার এই ঔৎসুক্যের কারণ হোল নিউ মেক্সিকোতে আসবার পথে উড়োজাহাজে এক স্থানীয় বাসিন্দার সাথে সদালাপ। এ অঞ্চলের গৌরবগাঁথার কিছু নিশানা আমাকে দেবার সময় ভদ্রলোক সবিশেষভাবে বললেন আর যাই করি এখানকার মরিচের ঝাল একটিবার না চেখে যেন ক্যালিফোর্নিয়ায় না ফিরি। আঙ্গুলের সমান থেকে শুরু করে প্রায় এক হাত লম্বা মরিচ, সবই নাকি মেলে এই অঙ্গরাজ্যে। আর দোকানে গেলে এই বিখ্যাত মরিচ চাইবার সময়ে বেয়ারাকে ভালোকরে নির্দেশ দিতে হয় ঠিক কোন পদের মরিচ চাচ্ছেন আপনি, সবুজ নাকি লাল। ওই লাল মরিচ হল, আর কিছুই নয়, আমাদের দেশে আমরা যেটিকে শুকনো মরিচ বলি আর কি। আরেক মজার ব্যাপার হল নিউ মেক্সিকোর এই মরিচকে ইংরেজি বানানে লেখার সময়ে দেখলাম শেষ অক্ষরে ‘আই’ এর বদলে ‘ই’ লেখে, যেটি মিলে যায় চিলি দেশটির বানানের সাথে। কেন তাঁরা এভাবে লেখে সেটা অবশ্য জানা হল না।
এবার আমি ঘুরতে ঘুরতে সেই মরিচের দোকানের মতোই আরেকটি অস্থায়ী দোকানের সামনে চলে আসি। এখানে এক হিস্পানিক মহিলা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত হাতে বোনা নানা পদের শিশু পোশাক দিয়ে তাঁর দোকানটি সাজিয়েছেন। সদ্যোজাত একমাত্র ভাগ্নির জন্যে পছন্দ হয়ে যাওয়া একটি উলের জামা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবার সময়ে বুঝলাম তাঁর দোকানটির অবস্থান আসলে একটি গির্জার প্রাঙ্গণে, গির্জার নাম লরেটো চ্যাপেল। কোলকাতায় এক লরেটো স্কুল আছে বলে জানি, তবে কি এই লরেটো চ্যাপেল সেই লরেটো নানদেরই কোন চ্যাপেল? ভেতরে গিয়ে সেকথা জিজ্ঞেস করাতে জানলাম না তা নয়। কলকাতার লরেটো স্কুলের লরেটো নানরা হচ্ছেন আয়ারল্যান্ডের একটি ক্যাথলিক গ্রুপ, অন্যদিকে এই লরেটোরা হচ্ছেন আমেরিকার ক্যানটাকি অঙ্গরাজ্যের একটি গ্রাম থেকে উদ্ভূত একটি ক্যাথলিক ধারা বা সঙ্ঘ। আরেকটি পার্থক্য আছে, কোলকাতার লরেটোরা তাদের নামের বানাটি লেখেন একটি ‘টি’ দিয়ে, আর এই লরেটোরা তাদের বানান লেখেন দুটি ‘টি’ দিয়ে। এই সঙ্ঘের উন্মেষ ঘটেছিল আঠারো শতকের প্রথমার্ধে, তারপর এটি আমেরিকার দক্ষিণের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে যায়। সেই বিস্তারের অংশ হিসেবেই ১৮৭০ সালের দিকে লরেটো চ্যাপেলটি স্থাপিত হয়েছিলো। আরেকটি বিস্ময়কর ব্যাপার জড়িয়ে আছে এই চ্যাপেলের ইতিহাসের সাথে। এর স্থপতি ছিলেন একজন ফরাসি, নব্য-গথিক ধরণে চ্যাপেলটির বানাবার অনেকটা প্রায় শেষ সময়ে আচমকা তিনি পরপারে পারি জমান। যদিও তখন নির্মাণের প্রায় পুরো কাজটিই শেষ, তারপরও সমবেত ভক্তরা একটি বেশ বড় সমস্যা দেখতে পেলেন। সেকালে এধরণের চ্যাপেলগুলোতে ছাদের কাছাকাছি স্থানে এক ধরণের চিলেকোঠার ঘরের মতো ঝুলন্ত বারান্দা বানিয়ে সেখানে থেকে খোয়া বা সমবেত সঙ্গীত গাওয়া হতো। কিন্তু এই চ্যাপেলের ক্ষেত্রে দেখা গেলো সেই ঝুলন্ত বারান্দা তৈরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেখানে উঠবার মতো কোন সিঁড়ি সেই স্থপতি বানিয়ে যাননি। অন্যদিকে ভেতরের প্রার্থনা হলটি আকারে একেবারেই ছোট হওয়ায় খুব বেশি স্থান নিয়ে সিঁড়ি বানাবার উপায়ও নেই তখন। মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন চ্যাপেলের নানরা, কায়মনবাক্যে তাঁরা প্রার্থনা শুরু করলেন এর কোন আশু সমাধানের জন্যে। এর কয়েকদিনের মাথাতেই নাকি এক অজানা আগন্তুকের আগমন ঘটে এ শহরে। আগোছালো পোশাকের সেই আগন্তুক ঘোষণা করলো সিঁড়ি সমস্যার সমাধান সে করে দিতে পারে, কিন্তু তাকে কাজ করতে দিতে হবে নিভৃতে। তাই সই, বলে চ্যাপেলের ভক্তরা তাকে তিন মাসের জন্যে স্থান ছেড়ে দিলেন। কথিত আছে গাধার পিঠে আনা অল্প কিছু সরঞ্জাম এই যেমন ছুতোর মিস্ত্রীর হাতুড়ি, বাটল, করাত এইসব দিয়ে সেই সময়ের মাঝেই এক ঘোরানো সিঁড়ি তিনি বানিয়ে ফেললেন। বিশ ফুটের সেই সিঁড়িতে তিনি ৩৬০ ডিগ্রী বাঁক রাখলেন দুটি। দেড়শ বছরের পুরনো অপূর্ব সেই সিঁড়িটি দেখতেই আজও বহুলোক ভিড় করে এই চ্যাপেলে। সেই সিঁড়ির সাথে বাড়তি পাওনা হিসেবে থাকে সেই সুদূর ফরাসি দেশ থেকে গড়িয়ে আনা বেশ কিছু মর্মর পাথরের ভাস্কর্য। এগুলোও স্থাপন করা হয়েছিলো সেই দেড়শ বছর আগেই।
লরেটো চ্যাপেলটি আমার মনে এ অঞ্চলের ধর্মীয় ইতিহাস সম্বন্ধে কিছুটা আগ্রহের সঞ্চার করে, আমি তাই পা বাড়াই এ চ্যাপেলের পাশের ক্যাথেড্রালে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ক্যাথেড্রালের সম্মুখ প্রাঙ্গণে অবস্থিত এক আদিবাসী সন্তের ভাস্কর্য আমাকে ব্যতিক্রমী কিছুর সন্ধান দেয়। ইউরোপ আমেরিকার আরও কোন ক্যাথলিক চার্চে আজ অব্দি কোন কালো মানুষ বা আদিবাসী সাধু-সন্তের ভাস্কর্য দেখেছি বলে মনে পড়েনা। কানে এলো আরও একদল পর্যটক সেই প্রাঙ্গণে মিষ্টি এক অমায়িক হাসি সম্বল করে দাঁড়িয়ে থাকা ‘কাতেরি তেকাহিতা’ সন্তের ভাস্কর্যটি দেখে সন্দেহ প্রকাশ করছেন, এটি সত্যিই ক্যাথলিক চার্চ কিনা। সেতো করবারই কথা, কারণ ওই যে বললাম ভ্যাটিকানের আশীর্বাদপুষ্ট সাধু-সন্ত হিসেবে এযাবতকাল অব্দি কেবলই সাদা মানুষদেরই ভাবা হয়, কালো বা আদিবাসীরা হয়তো সেখানে কিছুটা অপাঙতেয়। তাদের উপস্থিতি হয়তো তাই এমনি করে কিছুটা গুঞ্জন, ফিসফাসের উদ্ভব করে। সন্ত কাতেরির সেই ভাস্কর্যটি ছাড়া আরও একটি বিষয় আমাকে অবাক করলো, সেটি হল মূল বেদির পেছনের আলটার পিসটি। এটি নাকি বানিয়ে আনা হয়েছিলো স্পেন থেকে। এই আলটার পিসে মোট বারোটি ফ্রেমে বারোজন সাধু-সন্তের ছবি, তবে আর সবখানে যেমন দেখি সাধু-সন্তরা ক্রশ বা স্বর্গীয় আলো হাতে আশীর্বাদের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকেন, এই আলতার পিসে কিন্তু তেমন না দেখে দেখি কিছু ব্যতিক্রমধর্মী চিত্র। এই যেমন দুজন সাধু-সন্ত দিব্যি স্প্যানিশ গিটার নিয়ে বাদ্য বাজাচ্ছেন, আরেকজন কালো সাধু হাতে বেশ কিছু লম্বাটে রুটির টুকরো হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, আরেকজন সাধু একটি বালককে বিদ্যা শিক্ষায় ব্রতী করছেন, এমনকি একজন আদিবাসী সন্তও আছেন এই বারোজনের ভেতর। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল ক্যাথেড্রালটি কিন্তু ঠিক আজকের এই স্থানে সেই ষোলশ শতক থেকেই ছিল। তবে ষোলশ শতকের প্রথমার্ধে এটিকে তৈরি করা হয়েছিলো অনেকটা স্প্যানিশ স্থাপত্যরীতির মতো করেই। সেটি সেই সময়ে হয়ে ওঠে ধর্মান্তকরণের ঘাঁটি এবং স্প্যানিশ দখলদারদের একটা আত্মরক্ষার স্থান। তাই শুরু থেকেই স্থানীয় আদিবাসীদের শূল নজরে ছিল সেই ভবনটি। ১৬৮০ সালে যেবার আদিবাসীরা একযোগে বিদ্রোহ করে, সেবার প্রথমেই আক্রান্ত হয়েছিলো এ ভবনটি। সেই বিদ্রোহের পর বহুকাল বাদে চার্চটিকে আজকের আদলে পুনর্নির্মাণ করা হয়।
ক্যাথেড্রাল দর্শন শেষ হলে শুনতে পাই কোথা থেকে যেন মিষ্টি এক টুং টাং শব্দ ভেসে আসছে। বুঝতে পারি সেটি আসছে সান্তে ফে প্লাজার দিক থেকেই। আমি তাই আর কালক্ষেপণ না করে হ্যামিলিনের বাশিওয়ালার পিছে ছোঁটা শিশুর দলের মতো সেই সুরের সন্ধানে হাঁটতে থাকি। প্লাজা সংলগ্ন মাঠের ধারে সেই সঙ্গীতের সন্ধান অবশেষে আমি পাই, কিন্তু এমন বিশাল বাদ্যযন্ত্র আমি কোনকালে দেখেছি বলে মনে পড়েনা। প্রায় এক মানুষ উঁচু সেই বাদ্যযন্ত্রটি আবার বাজাচ্ছেন কেবল একজন মানুষ। সেটি দেখতে অনেকটা আমাদের সেই সুতো কাটার ধুনটের মতো, যদিও কাঠের জায়গাটি বেশ পুরু, এতো বড় যন্ত্রটি শিল্পী একা কিভাবে বয়ে নিয়ে চলেন সেও এক প্রশ্ন। এই যন্ত্রের তারগুলো তৈরি হয় নাইলনের সুতো নিয়ে, আর অদ্ভুত পারদর্শিতায় সেই সুতোর বিভিন্ন স্থানে আঙুল বুলিয়ে শিল্পী সৃষ্টি করেন সুরের ইন্দ্রজাল। ও হ্যাঁ, নামই তো জানা হল না এ যন্ত্রের। একটি সুর শেষ হলে সেই সুযোগে আমি সেই শিল্পীর সাথে গিয়ে আলাপ জুড়ে দেই, জানতে পারি বাদ্যযন্ত্রটির নাম ভেরাক্রুজ হার্প। মেক্সিকোর ভেরাক্রুজ প্রদেশ থেকে এই বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভব হেতু নামটি হয়েছে সেই প্রদেশের সাথে মিল রেখে।
সে মাঠের উল্টো দিকেই গভর্নর হাউস, এককালে স্প্যানিশ গভর্নররা বসবাস করতেন এ ভবনে। সেই হাউসের সামনে বিশাল চাতালে সারি বেঁধে আদিবাসীরা নিয়ে বসেন তাঁদের হাতে তৈরি নানা পদের সামগ্রী। সেখানে আছে টারকুইশ পাথরের গলার মালা, কানের দুল, টেরাকোটার পুতুল, উলের টুপি, সিলভারের ব্রেসলেট আরও কত কি। বিক্রি নিয়ে তেমন কোন জোরাজুরি নেই। একেকজন মাটিতে তাদের পসরা সাজিয়ে পেছনে এক চেয়ার পেতে ঝিমিয়ে নিচ্ছেন। কারও শখ হলে সে সেই জিনিশটি তুলে বিক্রেতার ঝিমুনি ভাঙ্গিয়ে তাকে দাম জিজ্ঞেস করতে পারে, তবে পছন্দ হলেও কোন দ্বিধা কাজ করায় যদি কেও ভাবেন আগামীকাল এসে কিনে নেবেন তবে কিন্তু ঠকতে হতে পারে। কারণ চাতালের নিচের এই স্থানটিতে বসবার জন্যে প্রতিদিন সকালে বহু সংখ্যক আদিবাসী লাইন ধরেন, কিন্তু সবাইকে তো আর স্থান দেয়া সম্ভব নয়। তাই প্রতিদিন সকালে লটারি করে কেবল স্বল্প সংখ্যক লোককে এখানে স্থান দেয়া হয়। তাই আজ যিনি আছেন, কাল তিনি এখানে নাও থাকতে পারেন। সুতরাং বুদ্ধিমানের কাজ হল পছন্দ হলে দাম চুকিয়ে জিনিশখানা পকেটস্থ করা। আমার যেমন পছন্দ হয়ে গেলো একটি কাপড়ের আদিবাসী মেয়ে-পুতুল, দাম বারো ডলার। হয়তো একটু বেশি দাম, তাতে কি? এটি তো শুধু কেনা নয়, যেই আদিবাসী মহিলা এটি বিক্রি করতে শনিবারের হাটে ছুটে এসেছেন সেই তিন ঘণ্টা দূরের গালুপ শহর থেকে, তাকেও তো সাহায্য করা হল। সেই মহিলাটির মতো বাদবাকি অনেকেই এক থেকে তিন ঘণ্টা দূরের সুদূর পুয়েবলোগুলো থেকে আসেন শনিবারের হাটে কিছু জিনিশ বেচে দু পয়সা আয় রোজগারের আশায়। এই বিক্রেতাদের মাঝে আরও একটি বিষয় আমি লক্ষ করি। আর তা হল এঁদের অধিকাংশই কিন্তু বেশ মুটিয়ে যাওয়া মানুষ। আসলে এই আদিবাসীদের দেহ-সৌষ্ঠব তো তৈরি হয়েছিলো বনে-বাদাড়ে ঘুরে শিকারের জন্যে, ঝড়-বাদল বজ্রপাতকে আটকে দেবার মাটির ছাদ বানাবার জন্যে। কিন্তু তথাকথিত আধুনিক মানব সমাজ এসে তাদের সব কিছুকেই বদলে দিয়েছে। আধুনিক মানুষের আধুনিকতা তাদের হয়তো দিয়েছে স্বাচ্ছন্দের ঘরবাড়ি, চালাবার যান, কিন্তু সেই সাথে হয়তো শরীরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে বাড়তি মেদ। শুধু তাই নয়, আরও কিছু আর্থ-সামাজিক কারণ দায়ী এর পেছনে। সেসব নিয়ে একদিন কথা হয়েছিলো আমার বন্ধু মার্কের সাথে। মার্ক ওহাইওর ছেলে, ওকে আমি যখন প্রথম দেখি তখন আমি আন্দাজ করতে পারেনি মার্ক আসলে কি কালো মানুষ, সাদা মানুষ, নাকি মিশ্র। কথায় কথায় মার্ক নিজেই একদিন বলে ও নাকি চেরকি গোত্রের মানুষ। চেরকিরা আমেরিকার দক্ষিণপূর্বের একটি আদিবাসী গোত্র। যদিও মার্কের মুখের গড়ন কিন্তু আদিবাসীদের মতো নয়। কারণটি হল মার্কের পরিবারে এসে মিসেছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের রক্ত-সাদা, কালো, এমনকি ভারতীয় পর্যন্ত। তো মার্ক বলছিল এই আদিবাসী গোত্রগুলোর ভেতরের এক সমস্যার কথা। আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে শ দুয়েক বছর আগে থেকে এই আদিবাসীদের জন্যে কিছু সংরক্ষিত স্থান বানানো হয়েছে এবং সেসব স্থানে অঙ্গরাজ্যের কোন আইন বলবদ নয়। বড় অপরাধের জন্যে ফেডারেল আইন আর ছোটখাটো অপরাধের জন্যে সংরক্ষিত অঞ্চলগুলোর আদিবাসীদের নিজেদের আইন, নিজের আদালত আছে। আর এই আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে এক সময় ক্যাসিনা ব্যবসায়িরা তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সেসব সংরক্ষিত স্থানে ক্যাসিনো স্থাপন করে বসে, বিনিময়ে হয়তো ওই এলাকার আদিবাসীরা প্রতিবছর সেসব ক্যাসিনোগুলো থেকে বেশ কিছু পরিমাণে এককালীন অর্থ পায়। এটা সেসব রাজ্যেই করা হয়, যেসব রাজ্যে এমনিতে ক্যাসিনো বানাবার অনুমতি নেই। কিন্তু এতে করে সমস্যা যেটা হয়েছে তা হল, ওই অঞ্চলগুলোর আদিবাসীদের মধ্যে মদ, মাদক আর জুয়ার আসক্তি গেছে বেড়ে। হয়তো বছরের শুরুতে যে থোক টাকাটা তাঁরা পায়, অল্প ক’দিনের মাঝেই মদ-জুয়ার পেছনে সেসব উড়িয়ে দেয়। আর সে জন্যেই তাদের জীবন পদ্ধতিতেও ঘটে যাচ্ছে এক বিশাল পরিবর্তন। মদ-মাদক আর কর্ম-বিমুখতা থেকে উদ্ভূত রোগগুলো খুব দ্রুত দানা বাঁধছে তাঁদের শরীরে, আর সেকারণে সংরক্ষিত অঞ্চলের আদিবাসীদের মৃত্যুহারও বেড়ে যাচ্ছে অস্বাভাবিক হারে। শনিবারের হাটের মুটিয়ে যাওয়া আদিবাসী বিক্রেতাদের দেখে হতাশাক্রান্ত কণ্ঠে মার্কের বলা সেই কথাগুলোই বারে বারে মনে হচ্ছিলো।
গভর্নর হাউসের পেছনের দিকটায় এখন এক জাদুঘর বানিয়ে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্যে খুলে দেয়া হয়েছে। এখানে এক ফলকে যেহেতু লেখা এটি আমেরিকার সবচেয়ে পুরনো প্রশাসনিক ভবন, তাই ভাবলাম অন্তত ভেতরটা না দেখে গেলে কেমন হয়! জাদুঘরে ঢোকার মুখেই সাদামাটা এক অপেক্ষা ঘর, এখানে এসে সাধারণ প্রজারা সেকালের সেই স্প্যানিশ গভর্নর মশায়ের অপেক্ষায় বসে থাকতেন। অমসৃণ পালিশের দুটি চেয়ার, একটি টেবিল, দূরে পাতা একটি তাকিয়া এই নিয়েই ঘরটির সজ্জা। মাথার উপরে ঝুলছে এককালে বঙ্গদেশে যেমন হাত-পাখা ঝুলত ছাদ থেকে, তেমনই এক ঝুলন্ত মোমদানি।
এর পরের কক্ষটি একটু পরিপাটি। এখানে গভর্নর এসে প্রজাদের সাক্ষাত দিতেন, সালিশ বৈঠকে অংশ নিতেন। ঘরটির মেঝেতে পাতা বিবর্ণ এক গালিচা আর দেয়ালে ঝুলছে কাপড়ের টুকরোতে হাতে আঁকা বেশ কিছু চিত্র।
এখানে একটা কথা বলে রাখি, ১৬৮০ সালে যেবার পূর্ণ মাত্রায় আদিবাসীরা বিদ্রোহ করে, সেবার কিন্তু তখনকার গভর্নর আন্তনিও দ্যা অটেরমিন পাততাড়ি গুটিয়ে বাকি হিস্পানিকদের নিয়ে ভেগে গিয়েছিলেন সান্তা ফে ছেড়ে। তারপর বেশ কিছুদিন গভর্নর হাউসে কেবল ঘুঘু চড়েছিল। পরে অবশ্য শক্তি সঞ্চয় করে আরও সৈন্য নিয়ে ফিরে এসে হিস্পানিকরা আবারও সান্তা ফের দখল আদিবাসীদের কাছ থেকে নিয়ে নেই। যদিও বিচ্ছিন্নভাবে আদিবাসীদের বিদ্রোহ আর আক্রমণ চলছিলই। এর মাঝে ১৮২১ সালে মেক্সিকো স্পেন থেকে স্বাধীন হয়ে গেলে সান্তা ফে তথা নিউ মেক্সিকো একটু তফাতে পড়ে যায়। রাজধানীর শাসকদের সেসময়ে তেমন পরিমাণে আর আগ্রহ কিংবা সামর্থ্য ছিলো না মধ্য মেক্সিকো থেকে বহু দূরের এই রাজ্যটিতে দখল রাখবার। তাই ১৮৪৬ সালে যখন আমেরিকার এর দখল পাবার জন্যে আক্রমণ করে বসে, তখন গভর্নর ম্যানুয়েল আরমিহ প্রথমে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী’ বলে চিঁহি চিঁহি করলেও দুমাসের মধ্যেই রণে ভঙ্গ দিয়ে নিউ মেক্সিকোকে আমেরিকার হাতে তুলে দিয়ে মেক্সিকোর দিকে চম্পট দেন। আগে ছিল হিস্পানিকরা, এবার এলো আমেরিকানরা, কিন্তু আদিবাসীরা সেই যে তাদের ভূমি হারিয়েছিল ষোলশ শতকের প্রারম্ভে, তাঁরা কিন্তু সে স্থানেই রয়ে গেলো।
‘যেহেতু তোমার পোশাক আমার মতো নয়, তাই তুমি অসভ্য। যেহেতু তোমার ভাষা আমার মতো নয়, তাই তুমি অসভ্য। যেহেতু তোমার ধর্ম আমার ধর্ম থেকে আলাদা তাই তুমি অসভ্য’- এইতো ছিল ঔপনিবেশিকতার ঝাণ্ডা বয়ে আনা পরদেশীদের কথা। এখানেও তাই স্প্যানিশরা দখল নেবার পরই শুরু করে দিয়েছিল জোরেশোরে ধর্মপ্রচার। জাদুঘরের পরবর্তী অংশে বর্ণিত কিছু ইতিহাসের মাধ্যমে তেমনটাই বুঝলাম। স্প্যানিশরা সেসময়ে আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আদিবাসীদের নির্দিষ্ট সংখ্যক কয়েকটি গ্রামে স্থানান্তর হতে বাধ্য করে আর সেই গ্রাম বা পুয়েবগুলোও এমন জায়গায় স্থাপন করতে বাধ্য করে যার আশেপাশে হয়তো ফ্রান্সিসকান মিশনের কোন চার্চ ছিল। অর্থাৎ সোজা কথায় জোর করে গেলানোর মতো করে ধর্মপ্রচারের এক কৌশল আর কি। আর এভাবেই এক সময় বিলীন হয়ে যেতে থাকে সেই পুয়েবলো নিবাসীদের নিজের ধর্ম, নিজেদের ভাষা। নিউ মেক্সিকোতে এখন মাত্র দশটির মতো পুয়েবলো টিকে আছে। ক্ষয়িষ্ণু হবার পরও সেখানে কেরেস, তানয়ান এবং জুনি নামক তিন তিনটি আদিবাসী ভাষার অস্তিত্ব অদ্যাবধি খুঁজে পাওয়া যায়।
গভর্নর ভবনের জাদুঘরে সবচেয়ে চমৎকৃত হবার মতো স্থান হল একটি ক্ষুদ্র চ্যাপেল। নাহ এটি কিন্তু আদতে এই হাউসের ভেতরে ছিল না, বরং স্প্যানিশ শাসনের আদিকালের স্থানীয় চ্যাপেলগুলো কিরূপ হতো সেই ধারণা দেবার জন্যে সে সময়কার চ্যাপেলের বিভিন্ন দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে একটি পূর্ণ চ্যাপেলের রূপ দেয়া হয়েছে এই ঘরে।
সে দেখে যা বুঝলাম, তা হল সেকালে এমন দুর্গম স্থানে হয়তো ভাস্কর্য গড়ার কারিগর বা পটু কাঠের ছুতোর তেমন মিলত না। তাই মূল বেদির পেছনের আলটার পিসে কোন কাঠের কারুকাজ করা মূর্তি না রেখে রাখা হয়েছে স্থানীয় শিল্পীদের আঁকা যিশু বা মেরীর বিভিন্ন ছবি, যেগুলোকে এ অঞ্চলে বলা হয় সানতো। আর বেদির দুপাশে যিশুর যে মূর্তিগুলো আছে সেগুলোও গড়া হয়েছে স্থানীয়ভাবেই পাইন কাঠ দিয়ে। সেকালে এ অঞ্চলে যারা এমনতর ধর্মীয় ছবিগুলো আঁকতেন তাদের বলা হতো সান্তেরো। তো এই সান্তেরোরা কিন্তু দেবদেবীর ছবিগুলো আঁকতেন আশেপাশে খুঁজে-পেতে পাওয়া উপকরণ দিয়েই। এই যেমন কালো রঙটি তাঁরা তৈরি করতেন চারকোল থেকে, সাদা রং তৈরি করতেন দক্ষিণের অঞ্চলে পাওয়া জিপ্সাম থেকে, হলুদ রঙটি তৈরি করা হতো এক ধরণের সূর্যমুখী ফুল থেকে, বাদবাকি রঙগুলো বানানো হতো বিভিন্ন রঙের পাথর গুড়ো করে। এভাবে পট আঁকা হয়ে গেলে তারপর চারধারে পাইনের আঠা আর জলের এক ধরণের মিশ্রণ দিয়ে বার্নিশ দেয়া হতো। সবকিছুর শেষে চ্যাপেলে অধিষ্ঠান পাবার পর সেই দেবদেবীর সৌভাগ্য হতো ভক্তদের নিবেদন করা খাবার, পোশাক, কিংবা ফুলের গুচ্ছ পাবার। নিউ মেক্সিকোর এ অঞ্চলে সে সময়ে এ ধরণের চ্যাপেলগুলো তৈরি হতো মাটির পুরু দেয়াল দিয়ে। খুব ছোট ছোট অল্প কয়েকটি জানালা থাকতো প্রতিটি চ্যাপেলে, যাতে করে উপাসনালয় আর দুর্গ দু কাজেই চ্যাপেলগুলোকে ব্যাবহার করা যায়।
গভর্নর ভবন আর তাঁর সামনের মাঠটিকে ঘিরে বেশ একটা মার্কেট মতো গড়ে উঠেছে, সেখানে রাজ্যের খাবার আর হস্তশিল্পের দোকানে ঠাসা। দিনের পরের ভাগটি পার করে দিলাম এই দোকানগুলোতে ঢুঁ মেরে। তেমনই একটি দোকান, যেটিকে আসলে দোকান না বলে আদিবাসীদের হাতে তৈরি মৃৎশিল্পের প্রদর্শনী কেন্দ্র বলাই হয়তো ভালো, চমৎকার কিছু মৃৎশিল্পের সম্ভার নিয়ে আমাকে বেশ কিছুক্ষণ তার অদ্ভুত পুরনো এক গন্ধে ভরা চৌহদ্দিতে থাকতে বাধ্য করলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মৃৎপাত্রের পাত্রের উপর অঙ্কিত আলপনা, পাখি, মানব আর পশুর ছবিগুলো দেখার সময়ে একসময়ে নজর পড়লো এক মাঝারি আকারের ফুলদানির গায়ে লাগানো দামের ট্যাগের উপর। দেখলাম মূল্য মাত্র দুশো দশ ডলার। এমন একটি মাঝারি আকারের ফুলদানির এমনতর দাম দেখে অক্কা পাবার দশা হলেও পরবর্তীতে নিউ মেক্সিকোর আল্বাকারকি শহরে একটি আদিবাসী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে পূর্বের মত পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেই কেন্দ্রে একটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছিলো এ ধরণের মৃতপাত্র তৈরির আদ্যোপান্ত প্রক্রিয়া। সেই কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া সম্পর্কে যদি দু কথা না বলি তাহলে হয়তো পাঠকের মনেও আমার মতো দাম নিয়ে কিছুটা খুঁতখুঁতে মনোভাব থেকে যেতে পারে।
মৃৎপাত্র বানাবার উপযোগী মাটি সংগ্রহের পর প্রথমে দলা বানিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেকের পরিশ্রমে পাত্রের উপযোগী আকৃতিতে আনা হয় সেটিকে, সাধারণত আদিবাসী নারীরাই এ কাজটি করে থাকেন। এরপর এক ধরণের লালচে রং দিয়ে পাত্রটি রাঙানো হয়। এবার একে আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করবার পালা। তবে আগুনে পোড়ান মানেই রুটি সেঁকার মতো করে আগুনে ছুড়ে দেয়া নয়। আর এক্ষেত্রে সূর্য দেবতার আশীর্বাদও একটি নিয়ামক হয়ে দেখা দেয়। কারণ এ কাজটির জন্যে প্রয়োজন হয় এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। তেমন দিনে বেশ কয়েকটি পাত্র, যেগুলো হয়তো আগেই বানিয়ে লালচে রঙের প্রলেপ দেয়া হয়েছে, এনে রাখা হয় আদিবাসীদের বসত-ভিটার সামনের উঠোনে। তারপর এই পাত্রগুলোর মাঝের এবং চারপাশের স্থানে গোবরের ঘুঁটে আর পাইন গাছের সরু ডাল জমা করে ভরিয়ে ফেলা হয়। তারপরের ধাপে কিছু লোহার পাত দিয়ে অবগুণ্ঠিত ঘোমটার মতো করে এই চারপাশ আর উপরিভাগকে ঢেকে দেয়া হয়। শতবছর আগে যখন এই লোহার পাতের অস্তিত্ব ছিলোনা, তখন আদিবাসীরা এই ঢেকে দেবার কাজটি সারতেন পুরনো ভেঙ্গে যাওয়া পাত্রের অংশ দিয়ে। এবার বাইরে থেকে একটি কাঠির মাথায় আগুন জ্বেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। মুহূর্তেই দাও দাও করে জ্বলে ওঠে ভেতরের ঘুঁটে–কাঠি আর তাপমাত্রা পৌঁছে যায় কয়েক শ ডিগ্রী ফারেনহাইটে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পোড়াবার পর আগুন নিভে এলে বাইরে থেকে ছাইচাপা দিয়ে আগুনের অবশিষ্ট তেজকে নেভানো হয়। এবার সেই ছাইয়ের স্তুপ থেকে গুপ্তধন খননের মতো করে আগুনে ঝলসে যাওয়া মৃৎপাত্রগুলোকে বের করে আনার পালা। এই বের করে আনার পর দেখা যায় সেই আগের লালচে রং ধারণ করেছে কালচে এক বর্ণ। এরপরের ধাপে বেশ নিষ্ঠার সাথে আদিবাসী মেয়েরা পরের ধাপের অঙ্কনগুলো করে ফেলেন এই পাত্রগুলোর পৃষ্ঠে। এতকাল পরেও কিন্তু তারা সেই আদিকালের মতোই বন-বাদাড়ের গাছের ডাল আর ছাল থেকে বানানো তুলি আর রং ব্যবহার করেন। সুতরাং এতোটা মেহনতের পর যে বস্তুটি দাঁড়ায় তাকে কি ঠিক অর্থের পরিমাপে মাপা যায়?
নিউ মেক্সিকো আর পুয়েবলো নিবাসীদের ইতিহাস ঐতিহ্য দর্শন শেষ হল সেই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে একটি আদিবাসী দলের চমৎকার একটি নৃত্য উপভোগের মধ্য দিয়ে। উড়োজাহাজে চাপবার পরও ঘুংঘুরের শব্দের সাথে সেই সমবেত ‘হ হ হেয়া হেয়া’ সুরটি যেন আমার পেছন তাড়া করে আমাকে পৌঁছে দেয় আমার বর্তমান নিবাসে।
মন্তব্য
সত্যি চমৎকার লাগে আপনার লেখা গুলি পড়তে! এইটা লেখাটিও দারুণ।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
শুনে ভালো লাগলো, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
গুডরিডস
চমৎকার করে ঘুরিয়ে আনলেন জায়গাটা! আহারে, আদিবাসী বেচারারা
গুডরিডস
অদ্ভুত সুন্দর লাগলো আপনার লেখা। বড় লেখা দেখে একটু ঘাবড়ে গেছিলাম, কিন্তু পড়তে পড়তে কখন শেষে এসে পৌঁছালাম খেয়ালই করিনি। এই মুগ্ধতার সময়টির জন্য অজস্র ধন্যবাদ।
সোহেল ইমাম
সময় নিয়ে পুরো লেখাটি পড়বার জন্যে আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
গুডরিডস
ভ্রমণ আর বর্ণনা দুইটাই হিংসা বাড়ায়
ধন্যবাদ লীলেন ভাই
গুডরিডস
[ এক তারেকানুতে রক্ষা নাই, জীবনযুদ্ধ দোসর। এইডা কিছু হইল? ]
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
হে হে
গুডরিডস
ভেরাক্রুজ হার্প ! এই হার্পের অতলান্ত সুরের মোহনায় ভাসার ইচ্ছা জমা রাখলাম ।
আশা করি আপনার সে ইচ্ছে একদিন সত্যিই পূরণ হবে.
গুডরিডস
নতুন মন্তব্য করুন