ষষ্ঠ তলার একটি জানালা

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/০৫/২০১৬ - ১:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


নভেম্বর মাসের শেষ ভাগেই আমেরিকার মধ্য পশ্চিমাঞ্চলে বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়লেও টেক্সাসের ডালাস অঞ্চলে ঠিক ততটা অনুভূত হয় না। যদিও বিষণ্ণ কালচে মেঘ সারাটা আকাশ জুড়ে সমাচ্ছন্ন হয়ে সূর্যকে আগলে রাখে এই পুরোটা সময় জুড়েই। তাই শীতের হুল ফোঁটানো অত্যাচার না সইলেও মন ভালো করা ফুরফুরে দিনের দেখা পেতে এ অঞ্চলের মানুষকে অপেক্ষা করতে হয় আরও প্রায় মাস দেড়েক। সে দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ১৯৬৩ সালের ২২ সে নভেম্বর দিনটি একটু ব্যতিক্রমীই বটে। তাপমাত্রা সেদিন ততটা নিচে নামেনি, আর মিষ্টি এক রোদ এসে ভাসিয়ে দিয়েছে পুরো শহরকে। হয়তো রোদের কাছেও আছে সেদিনকার দিনে শহরবাসীর আমুদে মেজাজের খবর। ডালাসের প্রায় দশ লক্ষ অধিবাসীর প্রায় এক পঞ্চমাংশই সেদিন গায়ে এক হাল্কা সোয়েটার চাপিয়ে বেড়িয়ে এসেছে রাজপথে, তাঁদের গন্তব্য লাভ ফিল্ড বিমানবন্দর থেকে বেড়িয়ে যাওয়া এক রাজপথ। কারণ এই পথ মাড়িয়েই গাড়ি হাঁকিয়ে যাবেন তরুণ এক প্রেসিডেন্ট, যিনি তার ব্যক্তিত্ত্বপূর্ণ নেতৃত্বের কারণে সুপরিচিত এবং নন্দিত। কিন্তু কে জানত সেদিনের সে আনন্দঘন সকাল ঘণ্টা খানেক মাঝেই ঢেকে যাবে বিষাদের কালো ভেলায়!

সেদিন ডালাস নামক বর্ধিষ্ণু এই শহরে এয়ার ফোর্স ওয়ানের সিঁড়ি বেয়ে যার নামবার কথা তিনি প্রেসিডেন্ট কেনেডি। তখনও ডালাস এখনকার মতো বৃহত্তর ডালাসে রূপান্তরিত হয়নি। আমাদের ঢাকায় যেমন তেজগাঁও পুরনো বিমান বন্দরটি একসময় ছিল নাতিব্যস্ত ঢাকার একমাত্র বিমান যোগাযোগ মাধ্যম তেমনি ডালাস শহরে তখন লাভ-ফিল্ড বিমান-বন্দরটি ছিল বিমান চলাচলের একমাত্র ভরসা। সেই ডালাস অবশ্য গত কয়েক দশকে বদলে গেছে রাতারাতি। এখনকার সময়ে ডালাস বলতে কেবল ওই শরটিকে না, বরং ওই শহরকে ঘিরে গড়ে ওঠা আরও দশ বারোটি শহরের গুচ্ছকে বোঝায়। তাই কেও যখন বলেন ডালাসে থাকি বা ডালাসে চললাম তখন বুঝে নিতে হয় তিনি আসলে বোঝাতে চাইছেন ওই ডালাসের আশেপাশের কোন অধুনা প্রতিষ্ঠিত কোন শহরকে। ক্রমবর্ধমান এই জনগোষ্ঠীর চাপেই যথারীতি এক সময় বিশাল আরেকটি নতুন বিমান-বন্দর চালু হয়। জৌলুস আর গুরুত্ব হারায় পুরনো লাভ-ফিল্ড বিমান-বন্দরটি। এই সুবিশাল ডালাস মহানগরীর একটি ছোট শহরেই আমার ছোট মামার বাড়ি, আর সেই মামার বাড়ির মধুর হাড়ির লোভে আমাকে প্রতি বছর অন্তত একবার হলেও ডালাসে পা রাখতে হয়। এবার এসেছি দিন তিনেকের জন্যে, শেষ মুহূর্তে আমার স্ত্রীর ছুটি না মেলায় ওকে ফেলে এবেলা একাকীই আসতে হয়েছে। মামির হাতে বানানো নানা পদের মিষ্টি খেয়ে আর জম্পেশ আড্ডা দিয়ে বেশ কাটিয়ে দিলাম দুটো দিন। তৃতীয় দিনে মামির কাজ থাকলেও মামা আগেভাগে ছুটি নিয়ে রেখেছেন পুরো তিনটি দিনই আমার সাথে কাটাবেন বলে। হটাৎ মনে হল ঠিক ঘরে বসে গুলতানি না মেরে একটা ছোট্ট ট্রেন ভ্রমণ বা কোথাও ঘোরাঘুরির মাঝে সময়টা কাটালে কেমন হয়। দশ বছর আগে আমি যখন ডালাসে ছিলাম তখনও এ শহরে ট্রেন লাইনগুলো পুরো শহরব্যাপী ব্যাপ্ত হয়নি। কিন্তু এ ক বছরের মাঝে চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। এখন আরও বেশ কিছু লাইন এ ওদিক ছড়িয়ে গিয়ে বিশাল মহানগরীর অনেখানেই শুধু ট্রেনে যাবার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম মামার বাড়ির খুব কাছের এক স্টেশন থেকে ডালাস ডাউন টাউনের ওয়েস্ট এন্ড স্টেশনে যাবার পরিকল্পনা নিয়ে, আমার মূল গন্তব্য সেই ওয়েস্ট এন্ড স্টেশনের পাশের এক লালচে ইটের সাত তল বিশিষ্ট এক ইমারত, ১৯৬৩ সালের সেই ২২ শে নভেম্বরে একটি দুনিয়া কাঁপানো ঘটনার কারণে এই ভবনটি ইতিহাসে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। সে নিয়েই আমার এই নিবেদন।

ওয়েস্ট এন্ড স্টেশনে নেমে কোনটি যে সেই লালচে ইটের সিক্সথ ফ্লোর জাদুঘর সেটি চিনে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কারণ স্টেশনের খুব সন্নিকটে ওই ভবনের সামনের সামিয়ানার নিচে অপেক্ষারত দর্শনার্থীদের কোলাহলই ভবনটিকে আলাদা করে চিনে নিতে সাহায্য করে। সিক্সথ ফ্লোর জাদুঘরটি হল সেই ভবন যেখানে থেকে কেনেডির আততায়ী ছুঁড়েছিল লক্ষ্যভেদী তিনটি বুলেট। ভবনটি সাত তল বিশিষ্ট হলেও সেই আততায়ী অবস্থান নিয়েছিল এল্ম স্ট্রিট অভিমুখী ষষ্ঠ তলার একটি জানালায়। এই জাদুঘরে আমার আগমন এই প্রথম নয়, প্রায় ন বছর আগেও একবার এসেছিলেম এখানে। এবারের আগমন বলা চলে কিছুটা স্মৃতি রোমন্থন। কেনেডিকে হত্যা করবার পর প্রায় দু দশক পর ডালাসের একটি প্রতিষ্ঠান প্রথম উদ্যোগ নেয় ভবনটিকে সংরক্ষণ করে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করবার। তবে এই জাদুঘরে কয়েকটি বেশ বড় ধরণের হতাশ হবার মতো ব্যাপার আছে। প্রথমটি হল কেনেডি হত্যায় ব্যবহৃত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামতের অনুপস্থিতি। সেগুলোর অধিকাংশই নাকি আছে মেরিল্যান্ডের কেন্দ্রীয় মহাফেজখানায়। আর দ্বিতীয় কারণটি বেশ অদ্ভুত। আর সেটি হল জাদুঘরের ভেতরে কোথাও ছবি তোলা যাবে না, কেন সেটি আমার কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। এটি তো আর বিশেষ কোন নিরাপত্তা বিঘ্নিত এলাকা নয়, তবে কেন এই নিষেধাজ্ঞা কে জানে! তৃতীয় ব্যাপারটি হল বেশ চড়া দামের প্রবেশ টিকেট। এখানে ঢোকবার জন্যে ষোল ডলারের টিকেট কিনতে হয়। শুধুমাত্র কেনেডির কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র, আলোকচিত্র, তথ্যচিত্র এবং সেই আততায়ীর ব্যবহৃত স্থানটি দেখবার জন্যে এই মূল্য আমার কাছে একটু বেশিই মনে হয়েছে। জাদুঘর ভ্রমণ শেষে নিচের সুভেনির শপ থেকে একটি বই কেনবার সময়ে আরেকটি ব্যাপার খেয়াল করে এই উচ্চ মূল্যের টিকেটের কার্য-কারণের একটা হদিশ পেয়েছিলাম। সাধারণত আমেরিকায় এ ধরণের জাদুঘরগুলো হয় অলাভজনক এবং সে ক্ষেত্রে সেসব জাদুঘরের সুভেনির শপ থেকে কিছু কিনতে গেলে বিক্রয় কর দিতে হয় না। কিন্তু এ জাদুঘরে কিন্তু আমাকে বিক্রয় কর পরিশোধ করতে হয়েছিলো, তাই সে থেকে মনে হয়েছিলো এই জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণকারী সংগঠনটি হয়তো পুরোপুরি অলাভজনক নয়, হয়তো বা সে কারণেই প্রবেশ টিকেটে তারা উচ্চ মূল্য ধার্য করেছে।

যেহেতু ভেতরে ছবি তোলবার অনুমতি নেই, তাই ভেতরের ছবি তুলে ক্যামেরায় ভরবার আর সুযোগ পেলাম না। এ ফ্লোর সে ফ্লোর পেরিয়ে উঠে এলাম ষষ্ট তলার সেই কুখ্যাত স্থানটিতে। ১৯৬৩ সালের সে সময়টাতে এই ভবনটি ব্যবহৃত হতো ডালাস অঞ্চলের স্কুলগুলোতে বই বিতরণের একটি ডিপো হিসেবে। এখানের ষষ্ট তলায় বিভিন্ন কাঠের বাক্সে ভরে ভরে সেই বই রাখা হতো। আর এটিকেই সুযোগ হিসেবে ব্যাবহার করে আততায়ী অসওয়াল্ড। নভেম্বরের কয়েক সপ্তাহ আগে সে এই অফিসে চাকরি নেয়, আর সুযোগ বুঝে একদিন এক কাগজের প্যাকেটে করে তার মানলাইশার স্নাইপার রাইফেলটিকে এনে লুকিয়ে রাখে কোন এক বাক্সের মাঝে। তারপর সেই নির্ধারিত দিনে জানালার পাশে রাখা বাক্সগুলোর স্তূপগুলোকেই সে ব্যবহার করে আড়াল হিসেবে। সেদিন এই ঘরে যেভাবে বাক্সগুলো ইতস্তত ছড়ানো ছিল আজও ঠিক সেভাবেই বাক্সগুলো রাখা। যে জানালা গলিয়ে অসওয়াল্ড তার রাইফেলের নল তাক করেছিলো সেই জানালার কাছে এসে আমি নিচের এল্ম স্ট্রিটের দিকে তাকাই আর সেদিনের শোভাযাত্রাটির কথা ভাবতে চেষ্টা করি। জানালার ঠিক নিচে দেখা যায় কয়েকটি গাছের কচি সবুজ পাতা। এই গাছ এবং গাছের পাতা কিন্ত লক্ষ্যভেদের পক্ষে সহায়ক নয়। তবে প্রশ্ন হল সেই ১৯৬৩ সালেও এই গাছগুলো ছিল কি না। এই জাদুঘরে কেনেডির মৃত্যু পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলের কয়েকটি ছবি রাখা আছে, সেগুলো দেখলে মনে হয় সে সময়েও এই গাছগুলোর অস্তিত্ব ছিল। তবে হ্যাঁ, এখন এপ্রিল মাস। গ্রীষ্মের শুরু, আর সে সময়টি ছিল নভেম্বরের শেষ। সুতরাং এই গাছগুলো সে সময়ে থাকলেও হয়তো সেই পড়ন্ত নভেম্বরে এতটা পত্র-বহুল ছিল না। তবে এই গাছের প্রসঙ্গ যদি বাদ দিই, তবুও আরও দুটি ব্যাপার চিন্তা করে দেখবার মতো। আর সে দুটো ব্যাপার হল এই ষষ্ঠ তলার জানালা থেকে প্রেসিডেন্টের চলন্ত গাড়ির দূরত্ব এবং বাতাসের গতি। কোনও আনাড়ি রাইফেল চালনাকারীর পক্ষে এতটা দূর থেকে, তায় আবার সে আমলের স্নাইপার রাইফেল দিয়ে লক্ষ্যভেদ করা কিছুটা দুরূহ। তবে অসওয়াল্ড তেমন কোন সাধারণ স্নাইপার নয়। যুবাকালে সে মার্কিন মেরিন বাহিনীতে স্নাইপার হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। তাই তার জন্যে এই লক্ষ্যভেদ খুব একটা জটিল কোন কাজ ছিল না। আরও একটি কারণে তার প্রত্যাশা পূরণ সহজ হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্ট কেনেডি এক ডিক্রি জারি করেছিলেন যে তিনি এখন থেকে কোন জনসমাবেশে যেতে হলে হুড খোলা গাড়ি ব্যাবহার করবেন, তিনি চেয়েছিলেন যাতে তিনি আরও বেশি করে জন-সান্নিধ্যে আসতে পারেন। ডালাস বিমানবন্দর থেকে তার সভাস্থলে যাবার পথটিকেও এ জন্যেই একটু লম্বা করে শহরের মধ্যে দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছিলো, যাতে শোভাযাত্রাটি আরও বেশি সংখ্যক মানুষের গোচরীভূত হয়। সেটাই কাল হল কেনেডির। শুধু তাই নয়, খুব সম্ভবত সে আমলে প্রেসিডেন্টের যাত্রাপথ সম্পর্কেও লোকজন আগেভাগে জানতে পারত, নতুবা অসওয়াল্ডের পক্ষে হয়তো এমন নিখুঁত পরিকল্পনা কয়েক সপ্তাহ আগেই করা সম্ভব হতো না।

এখানে একটা কথা যোগ করে রাখি, কেনেডি খুনের আর সব আলামত না দেখতে পেলেও একটি বিশেষ আলামত দেখবার সৌভাগ্য কিন্তু আমার হয়েছিলো বছর ছয়েক আগে। তবে সেটি অবশ্য মেরিল্যান্ড কিংবা এই ডালাসে নয়, বরং সেই সুদূর মিশিগানের ডিয়ারবর্নে। আর সেই আলামতটি ছিল সেদিন কেনেডির ব্যবহৃত সেই লিমুজিনটি আর এটি প্রদর্শিত হচ্ছিলো ডিয়ারবর্নের ফোর্ড জাদুঘরে। বিশের দশক থেকে প্রায় আশির দশক পর্যন্ত আমেরিকার সব রাষ্ট্রপতিদের লিমুজিনের জোগান যেত ফোর্ড কোম্পানি থেকে। এই গাড়িগুলো অবশ্য কিনে নিয়ে হতোনা, বরং বছর প্রতি কয়েক শ বা হাজার ডলার হিসেবে লিজ নেয়া হতো। কেনেডির ব্যবহৃত লিমুজিনটিও সেভাবেই লিজ নেয়া হয়েছিলো। ওই হত্যাকাণ্ডের পর সাথে সাথেই সে গাড়িটিকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ওয়াশিংটনে, তারপর সিনসিনাটির এক কারখানায় কিছু পুনঃমেরামত করে একে বুলেটপ্রুফ কাঁচ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। তারপর কিন্তু এই অপয়া গাড়ি আরও প্রায় এক দশক প্রেসিডেন্সিয়াল গাড়ি বহরে ছিল। যেহেতু গাড়িটির মূল মালিক ফোর্ড কোম্পানি তাই লিজ শেষ হবার পর গাড়িটির স্থান হয় সেই ফোর্ড জাদুঘরে।


ছবি: ফোর্ড জাদুঘরে প্রদর্শিত প্রেসিডেন্ট আইজেন হাউয়ারের একটি লিমুজিন

আমি এর পর নেমে আসি জাদুঘরের সামনের রাস্তাটিতে, ঠিক উল্টো দিকে সবুজ এক চিলতে বাগান আর তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে মেইন স্ট্রিট নামক আরও একটি রাজপথ। জাদুঘরের সংলগ্ন এল্ম স্ট্রিটের পাশের ফুটপাথে পর্যটকদের ভিড় সদা লেগেই আছে। তাঁদের ঔৎসুক্য ওই স্ট্রিটের ঠিক যে দুটি জায়গায় কেনেডি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সে দুটি স্থানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা। বলাই বাহুল্য তাঁদের এই আবদারে ব্যাহত হচ্ছে সেই পথগামী যানবাহনের চলাচল, কেও কেও আবার মহা বিরক্ত হয়ে বাজিয়ে দিচ্ছে ভেঁপু।


ছবি: এলম স্ট্রিটের এ পথেই কেনেডির গাড়ি বহর চলেছিলো

আমি সেই এল্ম স্ট্রিট পেড়িয়ে ওপাশের সেই ছোট্ট সবুজ পার্কটিতে গিয়ে দাঁড়াই, আর সেখান থেকে ষষ্ট তলার সেই জানালাটিকে দেখতে থাকি। কিছুটা বোঝার চেষ্টা করি এ এলাকার মানচিত্র এবং সেদিনের সেই ঘটনাবলী। হিউস্টন স্ট্রিট থেকে বাম দিকের এল্ম স্ট্রিটে মোড় নেয়া মাত্র কেনেডিকে প্রথম গুলিটি করা হয়, যদিও এটির শব্দ শুনে আশেপাশের অনেকে ভেবেছিলেন পটকা ফাটার শব্দ। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই করা হয় দ্বিতীয় গুলিটি, সেটি প্রথম স্থান থেকে কয়েক গজ দূরের এক স্থানে কেনেডিকে আঘাত করে। এই বুলেটটির অব্যর্থ আঘাতেই কেনেডি লুটিয়ে পড়েন, আর সাথে সাথে ছুটে আসে তৃতীয় গুলিটি। এই গুলিটি চলবার সময়ে কেনেডির গাড়ি বহরের সর্বশেষে থাকা এক মোটর সাইকেল আরোহী পুলিশের দৃষ্টি যায় সেই লালচে ভবনের ছাদ থেকে হটাৎ উড়ে যাওয়া কবুতরের ঝাঁকের দিকে। ঠিক ওই ভবন থেকেই যে গুলি আসছে সেটি বুঝে নিতে তার বেগ পেতে হয় না। ঝড়ের গতিতে সে পৌঁছে যায় সেই ভবনে। কেনেডিকে গুলি ছোড়া হয়েছিলো ঠিক দুপুর সাড়ে বারোটায়। এর ঠিক দু মিনিট বাদে ওই লালচে ভবনের দোতলায় খুনি অসওয়াল্ডের সাথে সেই পুলিশের মুখোমুখি দেখা হয়, অর্থাৎ গুলির ঠিক দু মিনিট বাদে। কিন্তু সে সময়ে অসওয়াল্ড বেঁচে যায় তার বড়কর্তা পুলিশের কাছে তাকে নিজেদের এক কর্মী বলে পরিচয় দেয়ায়, যদিও এর পরবর্তী এক ঘণ্টার মাঝেই অসওয়াল্ড চূড়ান্ত ভাবে ধরা পড়ে।

কিন্তু অসওয়াল্ডই কি কেনেডির প্রকৃত খুনি? সে নিয়ে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা, অনুসন্ধান, গবেষণা হয়েছে গত পাঁচ দশকে। কেও কেও প্রশ্ন করেন মাত্র দু মিনিটের মাঝেই ছ তলার সিঁড়ি বেয়ে কি দোতলায় নেমে আসা সম্ভব? আবার কে কেও প্রশ্ন তোলেন অসওয়াল্ড আততায়ী ঠিক আছে, কিন্তু তাকে এ কাজে কে লাগাল? সেই রহস্য কিন্তু আজও জানা যায়নি। কারণ আদালতে নেবার পথে অসওয়াল্ড নিজেও খুন হয়ে যায় কিছু কাল বাদে। তাই তাকে কি আদৌ কেও এ কাজে লাগিয়েছিল কিনা সেটি আজও রহস্যাবৃত। অনেকে বলেন সিআইএ নিজেই যুক্ত ছিল এ কাজে, কিউবা-মিসাইল সঙ্কটের সময়ে সোভিয়েত ইউনিওনের সাথে সামরিক সংঘাতে না গিয়ে কূটনীতির মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেয়ায় সিআইএ নাকি ক্ষুব্ধ হয়েছিলো কেনেডির প্রতি। আবার অনেকের প্রশ্ন কেনেডির ঘাড়ে বা মাথায় যে গুলিগুলো লেগেছিল সেগুলো কি সত্যিই পেছনের ওই লালচে ভবন থেকে ছোড়া হয়েছিলো? নাকি সামনের কোন স্থান থেকে ছোড়া হয়েছিলো? এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যে বেশ কিছু বাঘা বাঘা কমিশন তৈরি হয়েছিলো, কিন্তু তারা কেওই সন্দেহাতীতভাবে তাঁদের অনুসন্ধান শেষ করতে পারেননি। ফলে জনমনে যে সন্দেহের বীজ ছিল সেটিই পরে মহীরুহে রূপান্তরিত হয়ে ডালপালা বিস্তার করে চারিদিকে।

ইতিহাসের এইসব মারপ্যাঁচের চিন্তা একসময় মাথা থেকে সরিয়ে মামাকে নিয়ে কাছের এক ফোয়ারার কাছে বসি আর পাখিদের ঠুকরে সেই ফোয়ারা থেকে জল খাওয়া দেখি। এর মাঝেই কখন যেন বেলা পড়ে আসে, মামা বলেন, ‘চল ভাগিনা বাড়ি যাই’।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

মের্কিন মুল্লুক খুবই সুন্দর একখান দেশ, রাস্তা ঘাট কি সুন্দর আর ফকফকা, দেখলেই চাটবার মুঞ্চায়। মের্কিন মুল্লুক যামু, ট্যাকা দ্যান।

সত্যপীর এর ছবি

এইসব বালের কমেন্ট ছাড়ার দরকার কী?

..................................................................
#Banshibir.

সত্যপীর এর ছবি

চমৎকার!

বাবুশকা লেডির ঘটনা কি সত্য?

..................................................................
#Banshibir.

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

পীরদা আর সব লিঙ্কের মতো এই বাবুস্কা লেডির ঘটনাও একটু ধোয়াশা। আর এই লেডি থেকে থাকলেও তার সাথে হত্যার কোনো যোগ আছে কিনা সেটাও আরেক প্রশ্ন। হয়তো হতে পারে এমনিতেই কেও ছবি তুলেছিল, তারপর আর সেই ছবি বা নিজেকে প্রকাশ করতে চায়নি।

হাসিব এর ছবি

ইন ফ্যাক্ট ডালাস শহরটা বাজে একটা শহর। গেলে এলম স্ট্রিটে মেক্সিকান রেস্ট্রুরেন্টে ঢু মাইরেন।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ চেষ্টা করবো পরের বার ( আমি ভেবেছিলাম আপনি জার্মানি তে থাকেন )

হাসিব এর ছবি

আমি জার্মানিতেই থাকি। ড্যালাসের ঐ জায়গা গুলোতে গিয়েছিলাম ঘুরতে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

তাহলে আগে বার্লিনের কিছু ভালো খাবারের জায়গার পরামর্শ দিন, এই গ্রীষ্মে আসবার পরিকল্পনা আছে

সোহেল ইমাম এর ছবি

আপনার লেখনীর মুগ্ধতাতেই পড়ে গেলাম। কেন জানি প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যাকাণ্ড নিয়ে কখনও আগ্রহ তৈরী হয়নি। কিন্তু আপনি কথা বলছেন সুতরাং কান না পেতে পারা যায়না। ভালো লাগলো।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আমি আমার মত ছোটখাটো ভাবে তুলে ধরতে চেয়েছি, বলতে চাইলে তো আরো অনেক কিছুই লেখা যায় এ ব্যাপারে, কিন্তু আর বেশি ভার বাড়াতে চাই নি. আপনার ভালো লেগেছে শুনে আমারও ভালো লাগলো। ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

খালি খালি পপ্পন খেলেই হবে?

মাসুদ সজীব এর ছবি

বরাবরের মতোই হাততালি

ডালাস যখন ছিলেন, অস্টিন কি এসেছিলেন? ক্যাপিটাল ভবন ঘুরে থাকলে সেটি নিয়ে ও লিখতে পারেন হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ সজীব ভাই, হ্যা গিয়েছিলাম, তবে সে মেলাকাল আগের কথা, স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে। দেখি ভবিষ্যতে আবার কখনো গেলে লেখা যাবে সে নিয়ে

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো। সেই সাথে সেই জাদুঘরে যাবার প্রবল ইচ্ছাও জাগলো। যদি যায় আপনাকে আর এই লিখাকে স্মরণ করে একটি লিখা লিখব।
এ্যানি মাসুদ

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আপনার সেই লেখার অপেক্ষায় রইলাম। আপনি কি ডালাসের আশে পাশেই থাকেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

নাহ। ১,৫৪৯মাইল দূরে আছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।