ফেয়ার মাউন্ট স্ট্রিটে ছাত্রজীবন-২

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২৩/০৫/২০১৬ - ৬:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ফেব্রুয়ারি মাসের এক তারিখেই আমরা উঠে যাই আসলাম ভাইয়ের সেই ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে। এই বাড়িটি ফুল ফার্নিস্ড। তবে তাই বলে ভাবার কারণ নেই যে বাড়িটি ভর্তি আধুনিক সব আসবাব। পুরনো আমলের সোফা, রং চটা কার্পেট, খাট, ড্রেসিং টেবিল এই নিয়ে তিন রুমের ফ্ল্যাট। তৃতীয় রুমটি এক চিলতে, সেটিকে ভাড়ার ঘর বিসেবেই সাধারণত ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আছে আসলাম ভাইয়ের রেখে যাওয়া বেশ কিছু জিনিশ, যার ভেতরে একখানা ছোট টেলিভিশনও আছে। এইসব নিয়ে এবং পেয়েই আমরা মহা খুশি। আমাদের অন্য ভারতীয় সহপাঠীরা যেখানে এক রুমে চার পাঁচ জন করে গাদাগাদি করে থাকে, সেখানে আমরা মাত্র দু জনে এভাবে তিন রুমের ফ্ল্যাট নিয়ে আছি এ তো দিব্যি খাসা ব্যবস্থা। যদিও ফ্ল্যাটটি প্রকৌশল বিভাগের ভবন থেকে কিছুটা দূরে, সকালে হেঁটে যেতে মিনিট পনেরর মতো লাগে। তাতে তেমন কোন সমস্যা আমাদের অনুভূত হয় না। আমাদের বাদবাকি সহপাঠীরা অবশ্য থাকে আমাদের স্কুলের ঠিক উল্টো দিকের কিছু ভাড়া বাড়িতে। তাদের বাড়ি থেকে রাস্তা পেরুলেই স্কুলের সীমানা শুরু হয়।

বনি ভাইকে আমি আগে থেকে চিনতাম না। বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিভাগটি ছিল আমার বিভাগের ঠিক উল্টো দিকে, কিন্তু উনার সাথে আমার এখানে আসবার পরেই পরিচয়। স্বল্প সময়েই বুঝতে পেলাম ফ্ল্যাট-মেট হবার জন্যে তিনি আমার প্রকৃষ্ট সঙ্গী। কারণ ব্যক্তিগত জীবনে আমি যেমন কিছুটা পরিপাটি মনোভাবের তিনিও তাই, আর এই বিষয়গুলো একই বাড়িতে থাকবার জন্য খুবই আবশ্যক। আমরা ওই বাড়িতে উঠবার পরদিনই লেগে গেলাম সাফ সুতরোর কাজে। আসলাম ভাই এই বাড়িটিকে মোটামুটি একটি আবর্জনার স্তূপ বানিয়ে গেছেন। ভদ্রলোক প্রায় এক দশক আগে এদেশে এসেছিলেন ডিভি লটারিতে, তারপর ঢুকে যান এ শহরের এক সফটওয়্যার কোম্পানিতে। তিনি একাই এই তিন রুমের পুরনো ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়ে থাকতেন।

কেইনের এনে দেয়া একটি কার্পেট ওয়াসার দিয়ে আমরা নিজেরাই পুরো বাড়ির কার্পেট ধুয়ে ফেলি। এবার ঘরগুলো পরিষ্কারের পালা। ঠিক হয় প্রথমে আমরা হাত লাগাবো আসলাম ভাই যে ঘরটিতে থাকতেন সে ঘরটিতে। এ ঘরটি বনি ভাই বরাদ্দ নিয়েছেন আর আমি নিয়েছি উল্টো দিকের ঘরটি। আসলাম ভাইরের ঘরটির পুরনো বাতিল জঞ্জাল ফেলতে গিয়ে একটি বাক্স ভর্তি কিছু দ্রব্য আমাদের গোচরীভূত হয়, যেগুলো আমাদের দেশের পথ-শিশুরা পেলে ভেতরে বাতাস ভরে বেলুন ভেবে আকাশে উড়িয়ে দেয়। এই আবিষ্কারের উত্তেজনায় বনি ভাই ফোন হাতে নিয়ে তৎক্ষণাৎ আসলাম ভাইকে ফোন করেন। তখন হয়তো বাংলাদেশে গভীর রাত। ধড়মড় করে উঠে বনি ভাইরের মুখে এই প্রাপ্তি সংবাদ শুনে আসলাম ভাই চুপসে যান। তিনি মিনমিন করে বলতে থাকেন আমরা যা ভাবছি আসলে তা নয়, ওই জিনিসগুলো তিনি একাকী সময়ে ব্যবহার করতেন প্রকৃত দৃশ্যের ইম্প্রভাইজেসনের জন্যে। এই বলে তিনি আমাদের কিছু উৎকোচ সাধেন। মানে আমরা যদি এই প্রাপ্তি সংবাদ বাঙালি সমাজে না চাউর করি তাহলে তার ফেলে যাওয়া সব জিনিসের দাবি তিনি ছেড়ে দেবেন। আমাদের কাছে সে সময়ে সেই ফেলে যাওয়া জিনিসের মূল্য সলোমনের গুপ্তধনে হাতিয়ে পাওয়া দ্রব্যের সমতুল্য। আমি তাই দূর থেকে বনি ভাইকে চোখের ইশারা করি, রাজি হয়ে যান, প্রস্তাব মন্দ নয়।

ক্যানসাসে ঠাণ্ডা যতোটা না পড়ে তার চেয়ে বেশি পীড়া দেয় বাতাসের বেগ। প্রতিদিন সকাল নটার আগে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই ক্লাসের উদ্দেশ্যে। আর সেই ঝড়ো বাতাস আমার নাক আর চোখের জল এক করে ফেলতে বাধ্য করে। ওদিকে সোয়েটারের ফাঁক গলে হুল ফোঁটায় ফেব্রুয়ারির কনকনে সকালের শীতলতা। অনেকে বলছেন তারপরও নাকি আমাদের ভাগ্য ভালো। এ বছর এখনো বরফ পড়েনি, বরফ পড়লে এ পথে হেঁটে স্কুলে যাওয়া নাকি আরও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফেয়ার মাউন্ট স্ট্রিটের পথ ধরে আশেপাশের কিছু পড়ো বাড়ির জং ধরা গেট পেড়িয়ে যাবার সময়ে হটাৎ আমার একদিন খেয়াল হয় চারধার যেন অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ, শহরে কারফিউ দিলেও হয়তো বা এতটা শব্দহীন হয় না। ঢাকা শহরের উচ্চ ডেসিবলের পরিমণ্ডল থেকে এসে এই নীরবতা আমার কাছে বড্ড অস্বাভাবিক ঠেকে, আমি কান খাড়া করে অন্তত কোন পাখির ডাক শোনার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার বুটের খসখস শব্দ ছাড়া এ চরাচরে আর শব্দপূর্ণ কিছুর অস্তিত্ব ধরা পড়ে না। শুধু ডান ধারের বাড়ির খাবার ঘরের জানালার পেছনে আমাদের দিকে জ্বলজ্বলে চোখ করে তাকিয়ে থাকা একটি নিঃসঙ্গ কুকুরকে ঠাহর করতে পারি। তার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে হিমেল মেরু প্রান্তরে একাকী চলমান অভিযাত্রীর মতো গরম দস্তানায় মোড়া হাতদুটো পকেটে ভরে আমি পেরিয়ে যাই এ পাড়ার ইউনাইটেড চার্চের সম্মুখের সফেদ সিঁড়ির প্রান্তসীমা।

জাবের ভাই বেশ পড়ুয়া ধরণের লোক, সারাদিন ব্যস্ত থাকেন নিজের পড়াশোনা নিয়ে। তাই আলম ভাই মাঝে মধ্যে তাকে ফেলে একাই আমাদের বাড়িতে আসেন চা-টা খেতে আর আড্ডা দিতে। এমন আড্ডার দিনে একদিন আলম ভাই একটি গুমোর ফাঁস করে বলেন জাবের ভাইয়ের একটি মেয়ে বন্ধু আছে, মেয়েটি জাবের ভাইয়ের সাথেই পড়ে। জাবের ভাই তাকে মাঝে মধ্যে বাড়ির কাজ একসাথে করবেন বলে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন। আমি এ সময়ে মুখ ফসকে বলে ফেলি, ‘ও জাবের ভাইয়ের তাহলে এফেয়ার আছে”? জিভ কেটে আলম ভাই বলেন ও কথাটি আর কখনো বোলনা ভায়া। এ দেশে ‘এফেয়ার’ বলতে পরকীয়া প্রেম বোঝায়, আর এমনি প্রেম বলতে ‘ডেট করছি’ বলতে হয়। শুধু তাই নয়, এরপর হটাৎ মনে পড়েছে এমন ভাবে আমাকে বললেন, ক্লাসে যে ব্যাগ নিয়ে যাও তাতে কি কি নিয়ে যাও? আমি প্রশ্নের মাথা-মুণ্ডু উদ্ধার করতে না পেরে মাথা চুলকে বলি, এই তো ক্লাসে যা যা কিছু লাগে সবই, এই যেমন ধরুন বই, খাতা, দুটো কলম, পেন্সিল, রাবার। “থামো থামো”, আলম ভাই আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দেন। “শেষেরটি কি বললে”? “কেন? রাবার”। “ওটি এখানে ক্লাসে বলেছে তো ফেঁসেছ, এ দেশে রাবার বলতে কনডম বোঝায়, তাই এখানে ওই বস্তুটিকে বলতে হবে ইরেজার”। আমি মনে মনে “ইরেজার, ইরেজার” আউরিয়ে শব্দটিকে মনে গাঁথবার চেষ্টা করি।

আমেরিকান শব্দ নিয়ে এমন বিভ্রম এবং বিভ্রান্তিতে কিন্তু আরও বেশ কয়েকবার পড়তে হয়েছিলো। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে হটাৎ একদিন সকালে আবিষ্কার করলাম আমাদের বাথরুমের গরম জলের কল দিয়ে রীতিমতো হিম শীতল জল পড়ছে, যা হাতে পড়া মাত্র মনে হচ্ছে যেন হাতটি চুবিয়ে দিচ্ছি কোন বরফের পিণ্ডের ভেতরে। বিলম্ব না করে ফোন করলাম বাড়িওয়ালা কেইনকে, “কেইন আমাদের গিজার নষ্ট হয়ে গেছে বোধহয়, গরম জল আসছে না”। ওপাশ ঠেকে কেইনের পাল্টা প্রশ্ন, ‘কি নষ্ট হয়েছে বললে? গিজার? গিজার আবার কি”? আমি আবারও বলি, “আরে গিজার, গিজার”। কেইন তবুও বোঝে না, অগত্যা আমি একটু অন্যভাবে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি, “আরে ওই যে যন্ত্রটি, যেটি ঠাণ্ডা জলকে গরম করে সেটি মনে হয় নষ্ট হয়েছে”। এবার কেইন বুঝতে পারে, “ও আচ্ছা তাই বল, তোমাদের ওয়াটার হিটার নষ্ট হয়েছে”। তক্ষুনি জানলাম এদেশে গিজারকে ওয়াটার হিটার বলে। ভাষা নিয়ে আরও একটি গল্প আছে, সেটি বলবার আগে আমার এক সহপাঠীর পরিচয় দিয়ে নেই।

দক্ষিণ-ভারত থেকে আগত সত্য আমার ক্লাসেই পড়ে, গাঁয়ের বর্ণ শ্যাম, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। এমন দাড়ি অবশ্য শুধু সত্যের নয়, দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ ছাত্রের মুখেই। আমরা বাংলাদেশীরা তাই মাঝে মাঝে বলাবলি করি আগে থেকে জানলে দেশ থেকে কয়েক বান্ডিল বলাকা ব্লেড এনে বিনামূল্যে এই দক্ষিণ ভারতীয়দের মাঝে বিতরণ করা যেত, কে জানে তাতে হয়তো বা বেচারারা মুখের এই রুক্ষ জঙ্গল থেকে রক্ষে পেত। সত্য শুধু যে আমার ক্লাসেই পড়ে তা নয়, আমি যে ল্যাবে কাজ করি সেখানেও ও কাজ করে। ছোকরা ইংরেজিতে বেশ চটপটে, আমার মতো এক সেকেন্ড সময় নিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলে না। আমি ওর এই গুণটি দেখে মনে মনে ভাবি আহা দেশ থেকে আরও কেন এই ভাষায় দখল নিয়ে এলাম না। আমার এই মনো-আক্ষেপের মাঝেই একদিন সত্য এসে আমাকে বলে পরের সেমিস্টারে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টের পদে আবেদন করতে গেলে জলদি একটি স্পোকেন ইংলিশের পরীক্ষা দিতে হবে, পাস করলে তবেই মিলতে পারে সে পদ। আমি বেশ চিন্তায় পড়ে যাই, একেই আমি ইংরেজি বলি কিছু ধীরে ধীরে, তার উপর আবার এমনতর পরীক্ষা? সত্যের অবশ্য তেমন কোন ভাবনা নেই, ও সেদিনই রেজিস্ট্রেশন করে এসে আমাকে জানালো প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকানোর জন্যে ও একেবারে তৈরি। আমি ওর আত্মবিশ্বাসী আচরণে নিজেকে নিয়ে আরও কুঁকড়ে যাই। পরের সপ্তাহে আমি ল্যাবে প্রবেশ করে দেখি সত্যের মুখ কালবৈশাখীর মেঘের মতো কালো, সে স্পোকেন ইংলিশের সেই পরীক্ষাটিতে ফেল করেছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সত্যের মতো এমন চোস্ত এংরেজি বলনেওয়ালা লোক যদি ফেল করে, তবে তো আমার মতো লোক হাওয়ায় উড়ে যাবে। আমার সেই ল্যাবের জানালা দিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনের চত্বরের বাঁধানো বসবার স্থানটি দেখা যায়। আকাশ-পাতাল দুশ্চিন্তার মাঝে সেদিকে তাকিয়ে আমার চকিতে মনে হয় একবার লাইব্রেরিতে ঢু মেরে দেখলে কেমন হয়, যদি এই পরীক্ষা-সংক্রান্ত কিছু বই পেয়ে যাই, দেখাই যাক না একটু চেষ্টা করে। সেদিনের বাকি ভাগটা আমি কাটিয়ে দেই লাইব্রেরিতে, আর বিকেলের দিকে হাসি ফোটে আমার মুখে। আমি ততক্ষণে ধরে ফেলেছি সত্যের ফেল করবার পেছনের কারণটি। এই পরীক্ষাটিতে আসলে এমন কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেয়া হয় যেখানে বক্তার বিলাতি ইংরেজি ব্যবহার করবার সম্ভাবনা অত্যাধিক, আর সেটি করলেই নম্বর কেটে নেয় সবচেয়ে বেশি। এই যেমন কেও যদি কুকির জায়গায় বলে বিস্কুট, ডাম্পস্টারের জায়গায় ডাস্টবিন, মলের জায়গায় মার্কেট, কিংবা আই-গ্লাসের জায়গায় বলে স্পেকট্যাকেল তবেই সেরেছে। সুতরাং আমি বুঝে গেলাম যেসব ব্যাপারে আমেরিকানরা বিলাতি শব্দ এড়িয়ে তাঁদের নিজস্ব আমেরিকান প্রতিশব্দ ব্যবহার করে, তেমন কোন শব্দের একটি লিস্টি আমাকে জানতে হবে। ওই লাইব্রেরির একটি বইতেই তেমন একটি লিস্টি পেয়ে গেলাম, আর সেটি থেকে লব্ধ জ্ঞানকে সম্বল করে আমি সেই স্পোকেন ইংলিশ পরীক্ষাটি উতরে গেলাম প্রথম দফাতেই।

আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন শাওন ভাই নামে একজন। তিনি কিন্তু আমাদের সমবয়সী নন। ভদ্রলোক আমেরিকায় এসেছিলেন সেই আশির দশকে, তার পরের দু দশকে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করে কয়েকটি বড় কোম্পানিতে চাকরি করেন। তবে কোন এক অজানা কারণে সেইসব ছেড়ে-ছুঁড়ে তিনি এখন আমাদের স্কুলে একটি খণ্ডকালীন শিক্ষকের চাকরি করেন, থাকেন এই গরীব ছাত্র পাড়ায়। বেশ ধার্মিক তিনি, দিনের বেশ বড় একটা সময় তিনি পড়ে থাকেন কাছের এক মসজিদে। লোকটির যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তা হলো তার নিখাদ সরলতা। তিনি কারও কোন সাতে-পাঁচে নেই, তিনি আছেন তার মতো। নিজে যেমন পরনিন্দা করেন না, তেমনি কোন অন্য কারও পরনিন্দায় অংশগ্রহণও করেন না। আরও একটি বিষয় আছে, তিনি নিজের অতীত বা ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কথা বলা পছন্দ করেন না। সেজন্যেই তিনি যে গ্রিন-কার্ডের অধিকারী এটি জানার পরেও আমরা ঠিক তাকে জিজ্ঞেস করতে সাহস পাই না তিনি কিভাবে সেটি পেলেন, কাজের সূত্রে, বিবাহ সূত্রে, নাকি অন্য কোন সূত্রে। বনি ভাইরের অবশ্য এ নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল, তিনি এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই একটি থিয়োরি দাঁড় করান এবং আমাকে সে থিয়োরির ব্যাপারে মতামত প্রদান করতে বলেন। এই যেমন একদিন বললেন, শাওন ভাই খুব সম্ভবত কোন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে বিয়ে করে গ্রিন-কার্ড বাগিয়েছেন। আবার একদিন বললেন, “ইউরেকা। পেয়েছি, আজ এক জায়গায় পড়লাম আমেরিকায় একসময় খেত-খামারে কাজ করলে চাষি কোটায় গ্রিন-কার্ড পাওয়া যেত। আমাদের শাওন ভাই নিশ্চয়ই তেমনভাবে চাষি হয়ে গ্রিন কার্ড বানিয়েছেন আশির দশকে, নতুবা উনি এতদিন ডুব মেরে ছিলেন কেন”? আমি বনি ভাইয়ের কথা কেবল শুনে যাই, আর হু হা করি, কেমন করে শাওন ভাই গ্রিন-কার্ড পেয়েছেন সেই কৌতূহল আমাকে তেমন স্পর্শ করে না। আমাকে বরং স্পর্শ করে লোকটির কিছু ভালো লাগবার মতো পাগলামি।

দীর্ঘদিন ছাত্র পাড়ায় থাকবার ফলে শাওন ভাই রূপান্তরিত হয়েছেন এ পাড়ার এক বটগাছে। অনেকে আসে যায়, রয়ে যান কেবল শাওন ভাই। বিদায় বেলায় তিনি সেই ছাত্রদের কাছ থেকে রেখে দেন তাদের ফেলে দেয়া বা রেখে যাওয়া তৈজসপত্র আর সেসব পরে তুলে দেন নতুন আসা ছেলেদের। দেবার সময়ে গম্ভীরভাবে বলেন, “এটা কিন্তু আপনাদেরকে একেবারেই দিচ্ছিনা, আপনারা এগুলো ইউজ করতে থাকেন, চলে যাবার সময়ে আবার আমাকে ফেরত দিয়ে যাবেন”। শাওন ভাই এভাবে বহু ছাত্রের উপকার করেছেন। এক বিকেলে আমি আর বনি ভাই আমাদের বসবার ঘরে বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় দরজায় টক টক শব্দ। আমরা দরজা খুলে শাওন ভাইকে হাতে একটি ছেড়া-খোঁড়া ল্যাপটপ ব্যাগসহ দেখতে পাই। একগাল হাসি নিয়ে তিনি বলেন, “দাওয়ায় বসে রোদ পোহাবার সময়ে হটাৎ দেখলাম আমাদের বাড়ির পাশের ডাম্পস্টারে কে যেন এই ল্যাপটপ ব্যাগটি ফেলে গেল, আমি ওমনি দৌড়ে গিয়ে তুলে নিয়ে এলাম। ভাবলাম আপনারা নতুন ল্যাপটপ কিনেছেন, আপনাদের লাগলেও লাগতে পারে”। ব্যাগটির অবস্থা অবশ্য রীতিমতো শোচনীয়, ঠিক ব্যবহার করবার মতো নয়। শাওন ভাই বিদেয় নিলে বনি ভাই বেজায় চেতে গেলেন, “এই ভাঙ্গারিলাল কি আমাদের এতটাই ফকির ভেবেছে যে রাস্তার কুড়িয়ে পাওয়া জিনিশ এনে আমাদের সাধছে”? সেই থেকে বনি ভাই আড়ালে আবডালে শাওন ভাইকে ডাকা শুরু করলেন ‘ভাঙ্গারিলাল’ বলে।

আমাদের এই প্রতিবেশী পরোপকারী লোকটি কিন্তু আরও অনেক মজার মজার চমক নিয়ে হাজির হন। শীতের শেষে একটু যখন গরম মিষ্টি আবেশ ছড়ানো শুরু হয়েছে চারিদিকে তখন একদিন তিনি আমাদের বাড়িতে এলেন একটি প্রস্তাব নিয়ে। প্রস্তাবটি হল আমাদের প্রত্যেককে পাঁচ ডলার করে চাঁদা দিতে হবে, সেই টাকা নিয়ে তিনি কিছু সবজির বীজ কিনবেন এবং সেগুলো লাগাবেন আমাদের এই তিন বাড়ির মাঝের খালি জায়গাগুলোতে। শুধু তাই নয় আমাদের পালা করে মাটি কোপাতে হবে, জল দিতে হবে। ফসলের ভাগ সবার সমান সমান। সে না হয় বুঝলাম কিন্তু সেই খেতে জলের ব্যবস্থা কি করে হবে? সে হদিশও তিনিই বের করে দিলেন। আমাদের বাড়ির বাইরের দিকেই একটি জলের কল আছে, তিনি ওই পাঁচ ডলারের চাঁদা দিয়ে একটি জলের পাইপও কিনবেন। তারপর সেই কলে পাইপ লাগিয়ে সবজির খেতে জল দেয়া হবে। বনি ভাই, ‘ভাঙ্গারি লালের যত সব ফালতু আইডিয়া’ বলে গাই গুই করে রাজি হলেন, আমি অবশ্য বেশ সানন্দেই রাজি। ঢাকা শহরে কোনদিন সবজি খেত চোখে দেখেনি, এই প্রবাসে যদি তেমন কিছু করা যায় তবে মন্দ কি? শাওন ভাই ওরফে ভাঙ্গারিলাল ভাই বীজ কিনে আনলেন। শুরু হল আমাদের চাষবাসের প্রাথমিক প্রস্তুতি। কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে প্রথমে আমরা বীজতলা তৈরি করলাম। তারপর মাটি ভিজিয়ে বোনা হল বীজ। প্রতিদিন আমরা পালা করে বিকেলের সময়ে জল দেই আর বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম এবং পূর্ণাঙ্গ সবজি বৃক্ষে রূপান্তর দেখি। আমাদের সেই গাছগুলোয় এক মাসের ভেতরেই ঝেঁপে ফল আসে। ঢেঁড়স, টমেটো আর বেগুন এমন পরিমাণে উৎপন্ন হয়, আশেপাশে হাট-বাজার থাকলে আমাদের উদ্বৃত্ত সবজি বেঁচে নির্ঘাত দু পয়সা রোজগার করতে পারতাম। এসময়ে হটাৎ একদিন কেইন এসে আমাদের বাড়িতে হাজির। স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসিখানি মুখে ছড়িয়ে বললেন, “এই যে ছাত্রসকল ব্যাপারখানা কি বলত, তোমরা কি এ পাড়াকে বন্যায় ভাসিয়ে দেবে নাকি”? “কেন কেইন কি হয়েছে”? “গতকাল তোমাদের বাড়ির জলের বিল পেলাম, এ মাসে প্রায় দুশো টাকা অতিরিক্ত বিল এসেছে। ব্যাপারখানা কি বলতো বন্ধুরা”। আমাদের জলের বিল ভাড়ার অন্তর্গত, তাই ও নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হতো না। কিন্তু এবার নিশ্চয়ই কোন গোলমাল হয়েছে। আমরা সত্যি কথাই কেইনকে খুলে বললাম। শুনে ও হাসতে হাসতে বলল, “তোমরা সবজি ফলিয়েছ প্রায় পঞ্চাশ ডলারের, আর জল খরচ করেছ প্রায় দুশো ডলারের। মাই ডিয়ার ইয়ং ম্যান নাউ ইউ ডিসাইড হুইচ ইস মোর প্রফিটেবল”। আমেরিকায় জলের বিল সব ঋতুতে এক থাকে না, গ্রীষ্মের সময় যখন চাহিদা বেড়ে যায় তখন জলের বিলও সে হারে বেড়ে যায়। আমরা সেটি না জেনে আচ্ছাসে বাইরের কল থেকে আমাদের খেতে জল দেয়ায় বেচারা কেইনের ঘাড়ে এই বাড়তি বিলের বোঝা চেপেছে। অন্য কেও হলে হয়তো আমাদের কাছে এই অতিরিক্ত জলের বিল বাবদ নির্ঘাত পয়সা দাবি করে বসতো, কেইন কিন্তু আমাদের সাথে শুধু এসব হাল্কা আমোদ আর বিলের ব্যাপারটা জানিয়েই বিদেয় নিলো। আমি আবারও ভাবতে বসলাম মানুষটি এতো ভালো কেন?

এপ্রিল মে মাসের দিকে এখানে আবহাওয়া বেশ শুষ্ক হয়ে পড়ে। দমকল বিভাগ থেকে বারে বারে সতর্কবাণী দেয়া হয় আগুনের ব্যাপারে সজাগ থাকতে। কিন্তু এদেশে এতকাল থাকার পরও খেয়ালি শাওন ভাই একটি গুরুতর ভুল করে বসেন। সঙ্গত কারণেই আমাদের সেটি জানবার কথা না, তাই আমরাও সেই ভুলটি শোধরাতে পারিনি। এক সন্ধ্যে রাতে তিনি এসে আমাদের বলেন সেদিন সারা বিকেল ধরে তিনি আমাদের উঠোনের সব পাতা জমিয়ে এক জায়গায় নিয়ে রেখেছেন। এখন তার পরিকল্পনা হল উঠোনের মাঝে একটি ড্রামের ভেতর সেইসব পাতা জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেবেন, এতে নাকি বেশ ভালো সার হবে, আমাদের সবজি খেতের জন্যে একেবারে উপযুক্ত। কিন্তু এমন কাজে তিনি আমাদের সাহায্য চান। আমরা এর মাঝে তেমন কোন সমস্যা দেখতে পাই না, তাই পায়ে একটি জুতো গলিয়ে বাইরে এসে পাতাগুলো সেই ড্রামে ভরতে উনাকে সাহায্য করি। পাতায় আগুন দেয়া মাত্র দাও দাও করে জ্বলে ওঠে ড্রামের ভেতর। এরপর মিনিট পাঁচ কি দশের ভেতরেই আমরা আমাদের উঠোনের প্রান্তে সাইরেন বাজিয়ে দুটি দমকলের গাড়িকে থামতে দেখি। হয়েছে কি, এর মাঝেই আশেপাশের কোন বাড়ির প্রতিবেশীর নজরে পড়েছে এই আগুন জ্বালাবার ব্যাপারটা আর তারাই হয়তো ফোন করে দমকলকে জানিয়েছে। দমকলের ওস্তাদ এসে এমন বালসুলভ কাজের জন্যে শাওন ভাইকে বেশ করে বকে দিলেন। আর আমরাও বুঝে গেলাম এভাবে যত্রতত্র আগুন ধরানো এ দেশে অন্তত চলবে না।

এ বাড়িতে আমার শোবার ঘরটি বেশ। খাটের পাশেই এক বিশাল জানালা আর তার অন্য দিকে আমার পড়বার টেবিল। জানালার ওধারে পাশের বুড়োবুড়ির বাড়ির লন। মধ্য গ্রীষ্মের তাজা হাওয়া পেয়ে লনের সবুজ ঘাসগুলো শনশনিয়ে বেড়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে পড়বার সময়ে বিরতি নিয়ে আমি লনের সবুজ ঘাস আর দূরের আরেক বাড়ির চিমনীর মাথায় লাগানো ঘূর্ণায়মান পাখার দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকি। ঠিক এমনই কোন মুহূর্তে একদিন আমার ফোন বাজে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে আমাদের বাঙালি সমাজের একজনের গলা, “সারাদিন বসে বসে শুধু পড়াশোনা করলে হবে? জলদি ফুটবল খেলার পার্কে চলে এস। মজা দেখতে পাবে”। আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি ফোন কেটে দেন। এই পার্কটি আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটা পথে মাত্র পাঁচ মিনিট, গরমের দিনে অনেকেই যায় সেখানে ফুটবল খেলতে। আমি কোন সম্ভাব্য কারণ না ভাবতে পেরে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পার্কে কি হল সেটি দেখতে বেরিয়ে পড়ি।

পার্কে পৌঁছুবার পর সেখানে ক্রীড়ারত একজন, যিনি আমাকে ফোনটি করেছিলেন, অন্যদিকে ইশারা করে আমাকে বোঝাতে চান কেন তিনি আমাকে ডেকেছেন। সেদিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি এবং প্রচণ্ডভাবে বিরক্ত হই। কারণটি হল বাঙালি সমাজের এক সাহসী নারী সেদিন এসেছেন ফুটবলারের জার্সি পোশাক পড়ে বাদবাকি সবার সাথে খেলবেন বলে। কিন্তু আমাদের সঙ্কীর্ণ সমাজ কি আর তা মেনে নেবে? যেখানে আমাদের স্বদেশেও আজ প্রমীলা ফুটবলের জয়জয়কার, সেখানে এই মার্কিন দেশে বসে তারা সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছেন কেন একজন বাঙালি নারী তাদের সাথে খেলতে এসেছেন সেই জন্যে। ওদিকে আবার বাঙালি সমাজের দুই বুড়ো ভাল্লুক এরই মাঝে খবর পেয়ে চলে এসে মাঠের অন্য ধারে ঘাপটি মেরে বসে আছেন, ব্যক্তিগত জীবনে যারা যথেষ্ট রক্ষণশীল চিন্তাধারার বাহক। লালসার দৃষ্টি নিয়ে তারা হা করে তাকিয়ে আছেন মাঠের দিকে। স্বজাতির এই ভণ্ডামি আমার কাছে বড় কুৎসিত বলে মনে হয়, আমি সেখান থেকে নিজেকে তক্ষুনি প্রত্যাহার করে বাড়ি ফিরে আসি।

আমাদের ছাত্র পাড়ায় আরও বেশ কয়েকটি স্নাতক পর্যায়ের বাংলাদেশী ছেলে থাকে। এরা কেও সরাসরি এসেছে দেশ থেকে, আবার কেও এসেছে মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এই ছেলেদের মাঝে দুটি ভাগ আছে। এক ভাগের ছেলেরা এসেছে বেশ ধনাঢ্য পরিবার থেকে। পড়বার খরচ নিয়ে তাঁদের তেমন মাথা ব্যথা নেই। দেশ থেকে অঢেল টাকা আসে আর তারা চোঙ্গা ফুঁকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আরেক ভাগের ছেলেরা এসেছে বেশ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। এদের জীবনটা দুর্বিষহ। এরা অনেকেই এদেশে এসেছে ‘কাজ করেই পয়সা কামিয়ে পড়াশোনা করা যায়’ এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে। আমেরিকায় গত দু দশকে স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়ার খরচ বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। তার সাথে তাল মেলান খুব সহজ নয়। এই ছেলেরা তাই আসবার কিছু দিনের মাঝেই সপ্তাহে ষাট-সত্তর ঘণ্টা কাজে লেগে যায়, পড়াশোনা তখন শিকেয় ওঠে। কেও কেও প্রাণপণে চেষ্টা করে কোর্সগুলো ঠিকভাবে নিয়ে ভালোভাবে পাস করবার, অনেকে সেটি থেকেও একসময় বিচ্যুত হয়ে যায়। হতাশায় তখন ডুবে যায় তারা, বছরের পর বছর দেশে যাওয়া হয়ে ওঠে না, মা-বাবা পরিবারের সাথে তৈরি হয় মানসিক দূরত্ব, বুকের মাঝে কেবল জমতে থাকে অভিমান। তারা জানে এই যে কাজ করে মাসের খরচ তুলে টিকে থাকা এর কোন সীমানা নেই, এই পথে চলে এদেশে থাকার বৈধ কাগজ জোগাড় করা দুঃসাধ্য। অনেকেই অবশ্য তখন ‘ঝটপট দু মিনিটে ম্যাগি নুডুলস’ এর সন্ধানে নামে। কোনভাবে যদি এদেশের কোন মেয়েকে বিয়ে করে গ্রিন-কার্ডটি বাগানো যায় তবেই তো কেল্লা ফতে। সেটিতে অনেকে সফলকামও হয়, কিন্তু শেষ অবধি যে পড়াশোনার জন্যে তারা এদেশে এসেছিলো সেই প্রকৃত উদ্দেশ্যটিই আর সমাধা করা হয়ে ওঠে না। জীবন সংগ্রামে পড়া এই শ্রেণিটিকে খুব কাছ থেকে দেখবার কারণে আজকাল কেও যদি আমার কছে আমেরিকায় স্নাতক পর্যায়ে পড়বার ব্যাপারে পরামর্শ চায়, তবে আমি তাদেরকে প্রথমেই বলি, বস্তা ভরা টাকা ছাড়া ওভাবে পড়তে যাবার কথা চিন্তা করো না, যদিও সে পরামর্শটি শুনতে কেও সবিশেষ পছন্দ করে না। তারা বোধহয় আমার মুখ থেকে শুনতে চায়, আমেরিকা একটি স্বপ্নের দেশ, ও দেশে গিয়ে পয়সা কামিয়ে লেখাপড়া করা ডাল ভাতের মতো ব্যাপার। কিন্তু যাই হোক, আমি তাদেরকে মিথ্যে আশা দেবার জন্যে মিথ্যে করে কথা বলতে পারি না।

আমাদের শৈশবে যেমন প্রায় রাতে নটা থেকে দশটা পর্যন্ত আমরা হা করে টেলিভিশনের সামনে বসে নাটক দেখতাম, অনেকটা তেমনই ভাবে আমাদের এই ফেয়ার মাউন্ট স্ট্রিটের বাড়িতেও প্রতি রাতে নাটকের জন্যে বরাদ্দ একটি সময় আছে। বনি ভাই আর আমি সেই নাটক দেখতে গিয়ে ঢাকা আর বাংলাদেশের স্মৃতি-কাতরতায় মগ্ন হই, পরিচিত কোন স্থান হটাৎ নাটকের দৃশ্যে ধরা পড়লে চেঁচিয়ে উঠি। বনি ভাই থাকতে না পেরে অনেক সময় বলে ওঠেন, “একটা হেলিকপ্টার থাকলে এখনই ঢাকা শহরের ওই জায়গায় গিয়ে একটা চক্কর মেরে আসতাম”। কিন্তু এই যে আকুলতা, প্রিয় স্থানগুলোকে দেখবার ব্যাকুল অভিপ্রায় এ সবই কি আমাদের মাঝে অটুট থাকবে সেদিনের দিন থেকে বহু বছর পর? সেটি গ্রীষ্মের এক বিকেলের কথা। আমাদের পাড়ার নির্জন কংক্রিট বাঁধানো পথটিতে বৈকালিক হাঁটার সময়ে বনি ভাইকে এই প্রশ্নটি করি আমি। কিছুক্ষণ পথের দিকে তাকিয়ে তিনি বলনে, “কয়েক বছর আগে জাফর ইকবাল স্যারের একটি লেখা পড়েছিলাম, সেখানে তিনি বলেছিলেন প্রথমে নাকি সবারই এমন হয়। বহু বছর এ দেশে থাবার পর একটা সময়ে এই অনুভূতিগুলো নাকি ভোঁতা হয়ে আসে”। ফেয়ার মাউন্ট স্ট্রিটে আমার সুখ, দুঃখ, আনন্দ, হতাশা আর স্বপ্ন নিয়ে কেটে যাওয়া দিনগুলোর পরে বয়ে গেছে আরও দশটি বছর। আজ এতদিন পর কেন যেন বনি ভাইয়ের বলা সেই কথাটি বড্ড মনে পরে, তখন আনমনে নিজেকেই শুধাই, “স্বদেশের জন্যে আমার মনের মাঝে বিছিয়ে রাখা ফুলগুলো আজ কি সত্যিই শুষ্ক প্রায়”?


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

লেখার শেষে চলবে, চলতে পারে এসব নাই কেন ভাই। এই মজার লেখাটা কি দুই নম্বরেই শেষ করে দিবেন। মন খারাপ

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হ্যা এই লেখাটা আপাতত দুইয়েতেই শেষ. ধন্যবাদ

সত্যপীর এর ছবি

চমৎকার। লিখে চলুন।

..................................................................
#Banshibir.

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ পীরদা

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

২ নিয়ে ২ নাম্বারি- চলবে না! চলবে না! রেগে টং

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ইয়ে মানে এবার একটু দু নাম্বারি করতেই হচ্ছে জনাব।

Emran  এর ছবি

চলুক

বেশী তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল!

আর কনডম নিয়ে আপনারা মনে হয় একটু ওভাররিঅ্যাক্ট করেছিলেন চোখ টিপি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

তখন ছোটো ছিলাম, দুনিয়ার হল হকিয়ত তেমন বুঝতাম না, তাই, চোখ টিপি

অতিথি লেখক এর ছবি

ছেড়ে যাবার বহু বছর পর একবার এক কাজে বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকতে মনে হয়েছিল - আহা! আমি আমার নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছি! কিন্তু আমার প্রতিদিনকার ভাবনায় কি 'বুয়েট' থাকে? উত্তর হচ্ছে - না। প্রবাসিদের কাছে দেশটাও একসময় ওমন কিছু হয়ে যায়।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ঠিক বলেছেন

নীলকমলিনী এর ছবি

খুব ভাল লাগল। নিজেদের ছাত্র জীবনের কথা মনে পড়ে গেলো। আমরা ৮৪ তে উইচিটা গিয়েছিলাম আমাদের বন্ধুর কাছে। আমরা ছিলাম কার্বন্ডেল ইলেনয় তে। তখন সেমেস্টার শেষ হলেই আশেপাশের ক্যাম্পাসে বন্ধুদের কাছে যাওয়া হতো। ছাত্রদের সবার জীবনের গল্প একী। হিমুর প্রবাসে দৈবের বশে পড়তে খুব ভালো লাগতো। ছাত্র জীবনে আর্থিক টানাটানি থাকলেও এখন মনে হয় সে সময়টায় সবচে স্টেস কম ছিল। ফ্লি মার্কেট থেকে একটা পুরানো জিনিশ কিনে কি আনন্দই না হতো, এখন নুতন জিনিশ কিনেও অনেক সময় সেটা হয় না।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

কি অদ্ভুত যোগাযোগ, আমি এই কালই কার্বনডেল শহরটির কথা ভাবছিলাম। ঠিক দশ বছর আগে ২০০৬ সালে ওখানে গিয়েছিলাম এক কনফারেন্সে। কি সুন্দর ছিমছাম বিশাল বিশাল গাছে ঢাকা এক শহর. আমরা সেখান থেকে কেশ নদীর সওয়াম্প এলাকায় কেনুইং ও গিয়েছিলাম, অপূর্ব এক স্মৃতি। ভাবছিলাম আবার সেখানে যাব কিনা। আপনারা যখন ছিলেন তখন বোধ হয় ওখানে কোনো বিমান বন্দর ছিল না. আমি ২০০৬ তে যাবার দু এক বছর আগে বিমান বন্দর চালু হয়েছিল. গুজরাটি মালিকের যে হোটেলে ছিলাম সেখাকার রিসেপসনিস্ট ভদ্রলোকটি আবার ছিলেন এক বাংলাদেশী। তিনিই বললেন শহরে বেশ কযেক ঘর বাংলাদেশী আছেন, যাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কর্মসূত্রে যুক্ত।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আপনার বর্ণনার সাবলীলতা সত্যিই মুগ্ধ করেছে। আপনি যতবার ফেয়ার মাউন্ট স্ট্রিট বলেছেন, ততবারই আমার কিছুদিন আগের ফেলে আসা রাস্তাটার কথা মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল হয়ত আমার পাশের বাড়িরই কোন একটা অ্যাপার্টমেন্টে আপনি থাকতেন।

পরের পর্ব না দিয়ে লাখো পাঠকের মনে দুঃখ দেবেন না। নইলে .... (প্রচ্ছন্ন হুমকির ইমো শয়তানী হাসি )

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ, যে থ্রেট মারলেন, দেখা যাক!

নীলকমলিনী এর ছবি

আমি কারবনডেল আসি ৮০ তে। তখন এয়ারপোর্ট ছিল। খুব ছোট। ৮ সিটের প্লেইন আসত। আমাদের সময় ছাত্র স্পাউস মিলিয়ে ৩০ জন ছিল। ৮৫ এ চলে যাই। এরপর কয়েক বছর খুব একটা বাংলা দেশী স্টুডেন্ট আসেনি। এরপর আবার আসতে শুরু করে। এখন মনে হয় সব সময় ৩০ থেকে ৪০ থাকে। ক্যাম্পাস টি বন কেটে বানানো, গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট হউজিং ও। সেজন্য ই এত সুন্দর।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

সেইন্ট লুইস থেকে যে প্লেনে আমি কার্বন্ডেলে গিয়েছিলাম সেটিও ৮ কি ১২ সিটের ছিল. বেশ ছোটো প্লেন, প্রতিটি মুভমেন্ট বোঝা যায়, সেজন্যে একটু ভয়েরও।

বন কেটে যে ক্যাম্পাসটি বানানো হয়েছে, সেটি বোঝা যায় চারধারে বিশাল সব গাছের আধিক্য দেখে

অতিথি লেখক এর ছবি

আগের পর্বটি পড়া হয় নি তাই দুই পর্ব একসাথে পড়ে নিলাম। চমৎকার আপনার লেখনি, অসাধারণ আপনার বর্ণনা। সামনের বইমেলায় যদি আবারও বই বের হয় তাহলে এই লেখাগুলো সেখানে সংযুক্ত করবেন আশা রাখছি। দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য ইচ্ছে করে না বলব না কিন্তু কেন জানি কখনোই সেটেল হওয়ার ইচ্ছে জাগে না। হোম সিকনেস অত্যাধিক বলেই হয়ত। আপনার লেখা চলতে থাকুক সেই কামনা রাখছি।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ রূপক ভাই, আমেরিকা নিয়ে লেখাগুলো একত্র করে বই বের করার ইচ্ছে আছে, তবে হয়ত সময় লাগবে আরো.
সামনের বই মেলায় হয়তো বলকান নিয়েই আরেকটি বই আসতে পারে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সুসংবাদ বটে। এখন থেকেই অপেক্ষায় রইলাম সামনের বইমেলার।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

তিথীডোর এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো। চলুক

বাহির/বাহিত হয়েছে-- এ জাতীয় শব্দ গুরুচণ্ডালীর অস্বস্তিকর অনুভূতি তৈরী করে। মন খারাপ

ছাত্রজীবনের স্মৃতি নিয়ে এরকম আরো লিখুন। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ তিথীডোর, শব্দের ব্যাপারটা পরবর্তীতে মাথায় থাকবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।