বোকাসূত্র

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বুধ, ১৭/১০/২০০৭ - ১২:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বোকাসূত্র

ভদ্রলোক খুব সিরিয়াস মানুষ। সমাজতন্ত্রে ব্যর্থ হয়ে এনজিওর নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন। সচেতনভাবে চেহারা ও কথাবার্তায় এনজিওমার্কা ভদ্রতা-বিনয় এবং মুখে প্লাস্টিক হাসি ধরে রাখেন সারাক্ষণ। আর অচেতনভাবে পছন্দ করেন সমাজ- রাজনীতি কিংবা উপাসী মানুষ নিয়ে কথাবার্তা

তখন আমার ভাব-ধরা যুগ। বিপ্লব করতে হলে পায়ে থাকতে হয় শক্ত বুট- কোমরে টাইট করে বাঁধা বেল্ট। আমি জিনসের নিচে পরি মিলিটারি বুট আর টিশার্টের নিচে বেল্ট। মাথায় আউলা-ঝাউলা চুলের উপরে বারোমাস উলের কমরেড ক্যাপ। চিকন চেন দিয়ে চশমা; যতক্ষণ না চোখে থাকে তার থেকে বেশি সময় ঝুলতে থাকে গলায়। দরকার থাকুক বা না থকুক কাঁধে একখান বারোমাসি ব্যাগ

এই চেহারা নিয়ে আমি ৯৫ সালে মৌলভিবাজারে ছাত্র ইউনিয়নের মে দিবসের অনুষ্ঠান করে এসে পরের দিন জয়েন করি এনজিওতে। এফআইভিডিবি। আমাকে চাকরি দিয়েছেন আরেক সাবেক কমিউনিস্ট। মোহসীন ভাই। এমনি এমনি দিয়ে দিলেন। না পরীক্ষা না ইন্টারভিউ। প্রথম দিন অফিস করে বের হবার পর তৈয়ব ভাই নাকি মহসীন ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- বস ইনি কী বিশেষজ্ঞ?
- সাবধান। কবিতা বিশেষজ্ঞ
- তা বস এই চুল-দাড়ি কবিতার কী কাজে লাগে?

কাজে না লাগলেও আমি ওসব নিয়েই থাকতাম। এনজিওর বেতনে ভাত খেয়ে এনজিওকে গালাগাল করতাম গলা ফাটিয়ে। আর পরিচয় দেয়ার সময় প্রথমেই বলতাম কবিতার কথা। তারপরে বলতাম নাটকের কথা। তারপরে বলতাম ছাত্র ইউনিয়নের কথা। তার পরে বলতাম- আমি মূলত সাংবাদিক ছিলাম

এনজিওতে থেকে আমি এনজিওর কথা বলতাম না এবং এনজিওর প্লাস্টিক হাসিটা তখনও রপ্ত করা হয়নি আমার

তো সেই ভদ্রলোক। তার বয়স আমার থেকে অনেক বেশি এবং অনেকদিন থেকে এনজিওতে থাকায় হয়তো বাইরে কোনো ভাব নিতে কিংবা ভাবের কথা বলতে ঠিক সাহস পান না। কিন্তু তিনি ভাবধরা লোক খুঁজে বেড়ান এটা আমি জানি। কারণ এনজিওর এইসব উন্নয়ন-ঠিকাদার মার্কা লোকজনের সাথে তো আর বুদ্ধিজীবীগিরি দেখানো যায় না। বুদ্ধিজীবীগিরি দেখানোর জন্য দরকার আরেকজন বুদ্ধিজীবীমার্কা আদম

তিনি আমাকে সম্ভবত একটু আলাদাই ধরে নিয়েছিলেন। আমার রুমে এসে প্রায়ই অতীত কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতেন। সাথে অনিবার্যভাবে সাম্রাজ্যবাদের বদনাম

একদিন সেই ভদ্রলোক আমার রুমে এলেন। তিনি সব সময়ই রুমে এসে প্রথমে ভালো করে আশপাশটা দেখে নেন। প্রসংশা করার মতো কিছু একটা খুঁজে বের করেন। প্রসংশা দিয়েই তিনি কথা শুরু করেন। কিছু না পেলে আমার এ্যাশট্রেগুলো নিয়ে কথা বলেন। আমার অনেকগুলো এ্যাশট্রে ছিল। আমাদের সেই অফিসে যে বিড়ি-সিগারেট-পান খায় না। তাকে আমাদের ইউনিটে চাকরি করার অযোগ্য ভাবা হতো। আমরা অফিসের মিটিংও করতাম বিড়ি খেয়ে খেয়ে। ...আমার ঘরে অনেকগুলো বিভিন্ন ধরনের এ্যাশট্রে যেমন আছে; ঠিক তেমনি দেয়ালের সাথে স্তূপ করে রাখা এ্যারিনমোর মিকচারের খালি কৌটা। ভদ্রলোক যেদিন অন্য কিছু না পান সেদিন তিনি হয় এ্যারিনমোরের দাম কিংবা মিকচার খাওয়ার মধ্যে যে একটা আভিজাত্য আছে সেটা নিয়ে কথা শুরু করেন- যদিও মিকচার খাওয়াটা একটু ঝামেলা। কিন্তু এর ব্যাপারটাই আলাদা...

আমি কী যেন কী কাজ করছিলাম। তিনি এসে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার পেছনের দেয়াল দেখতে লাগলেন অনেকক্ষণ ধরে। আমার পেছনের এবং পাশের দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের কাগজের ছোট ছোট টুকরো লাগানো থাকতো। আমি কোনো ডায়রি ব্যবহার করতাম না। হাতের লেখা খারাপ বলে ভালো কাগজে লিখতামও না। সমস্ত কাজের নোট আমি টুকরা-টাকরা কাগজে লিখে স্কচটেপ দিয়ে পেছনের কিংবা পাশের দেয়ালে সেঁটে রাখতাম। অবশ্য এরমধ্যে একটা ব্যতিক্রমি শিল্প শিল্প ভাবও আছে। ... এই ব্যপারটা নিয়ে ভদ্রলোক বেশ অনেকদিন আমার প্রসংশা করেছেন। এমনকি এগুলো প্রদর্শনের কথাও বলেছেন। বলেছেন-রবীন্দ্রনাথের কাটাকুটি যদি শিল্পের মর্যাদা পেতে পারে তবে আপনার এগুলো পাবে না কেন? এগুলোতে যেমন ছবি আছে ঠিক তেমনি আছে ইতিহাসের ছাপ। এগুলোর ছবি তুলে রাখেন। একদিন দেখবেন এগুলোর উপর মানুষ গবেষণা করবে

কিন্তু আজ তিনি নতুন একটা কিছু পেয়ে গেছেন আমার দেয়ালে। লম্বা কাগজে একটা স্কেচ পোস্টার। একটা ডানাওয়ালা বলদ উড়ে যাচ্ছে আকাশে আর নিচে এক চাষী চাষ করছে একজোড়া ছাগলের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে

অনেক্ষণ পোস্টারটা দেখে ভদ্রলোক নিজে নিজেই মন্তব্য করলেন- তাৎপর্য আছে জিনিসটার
আমি তার দিকে না তাকিয়েই বললাম- না থাকলে কি আর আমার এখানে থাকে?
- তাতো অবশ্যই

ভদ্রলোক আরো অনেক্ষণ ধরে পোস্টারটা দেখলেন। সম্ভবত তিনি ব্যাখ্যা করার মতো কোনো তাৎপর্য আবিস্কার করতে পারছেন না। সোজা বাংলায় বিষয়টা এখনও তার মাথার উপর দিয়ে যাচেছ। যখন কোনোকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যায় তখন তিনি আরো বেশি ভাব নিয়ে চুপ করে থাকেন। আর দুয়েকটা শব্দ বলে অপেক্ষা করতে থাকেন অন্যরা বিষয়টা নিয়ে কী বলে। অন্যদের বলার মধ্যে কোনো ক্লু একবার পেয়ে গেলেই হলো। আঁতলামি কাকে বলে...

ভদ্রলোক ছবিটার কোনো ক্লু পাচ্ছেন না। ছাগল দিয়ে হালচাষ করা বিষয়ে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। আবার উড়ন্ত গরু গরুড় ভারতীয় মিথে সম্মানীত চরিত্র। ...কিন্তু দুটো এক জায়গায়... তাও আবার আমার মাথার পেছনে...

আমিও চুপ। আমি অপেক্ষা করছি ভদ্রলোক কী মন্তব্য করেন শোনার জন্য। কিন্তু ভদ্রলোক হাল ছেড়ে দিলেন- আচ্ছা জিনিসটা দিয়ে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন বলেনতো?

আমি এইবার মুখ তুললাম- বাংলাদেশে এখন গরু দিয়ে হালচাষ কমে গেছে জানেন তো?
সাথে সাথে উনি কথা ধরে ফেললেন। এক শ্বাসে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা- গবাদিপশুর চারণভূমি সংকট- অলাভজনক কৃষি সব বলে ফেললেন টানা দশ মিনিট ধরে। এরপর থামলেন। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত এবার ছাগলের ক্লু আবিস্কার করতে চাচ্ছেন। আমি বললাম- এসব কারণ হয়তো সত্য। কিন্তু সেজন্য চাষের গরু সংকট হচ্ছে না। বাংলাদেশে এখনও চাষউপযোগী যথেষ্ট বলদ আছে। সংকট হচ্ছো ভিন্ন কারণে
- কী কারণ?
- চাষীর বাড়িতে গরু ঠিকই আছে। গরুকে সে ঠিকই খইল-ভূসি-ঘাস খাওয়ায়। কিন্তু সেই গরু দিয়ে চাষ করতে পারে না
- কেন গরুর অসুস্থতা?
- তাও না
- তাহলে?
- ব্যাপারটা হচ্ছে হালের বলদের মধ্যে দুটোই খুব সকালে চাষী উঠার আগেই উঠে যায় ঘুম থেকে। উঠেই একটা চলে যায় প্যাকেজ নাটকে এ্যাকটিং করতে আর আরেকটা চলে আসে এনজিওতে চাকরি করতে। রাস্তায় যেতে যেতে মোবাইলে চাষীকে বলে- বস একটু ম্যানেজ করে নিয়েন। আজকে আর আসতে পারছি না। ফলে চাষীকে বাধ্য হয়েই ছাগল দিয়ে চাষ করতে হয়

ভদ্রলোককে কোনো কিছু ভাবার চান্স না দিয়ে আমি কথাগুলো বললাম এক টানে। তিনি প্রথমে কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করলেন। তারপর থ মেরে গেলেন। তারপর আবিস্কার করলেন তাকে আমি পোস্টারের উড়ন্ত বলদ বানিয়ে দিয়েছি

এইবার তিনি এনজিওমার্কা চেহারা থেকে বের হয়ে এসে ক্ষেপে উঠলেন গলাবাজ পাতি নেতাদের মতো- মুখ সামলে কথা বলবেন
- সামলানোর দরকার পড়ে না। সিস্টেমের কারণেই আমার মুখ মাথার সাথে হাড্ডি দিয়ে আটকানো থাকে

ভদ্রলোক একটা বিড়ি ধরিয়ে আমার রুমে হাঁটলেন অনেকক্ষণ। বারবার পোস্টারটার দিকে তাকালেন- একটা এখানে রাখা ঠিক না
- রুমটাতো আমার। আমাকেই না হয় ঠিক করতে দিন কোনটা থাকবে আর না থাকবে
- লাজ্জা লাগে না? আপনি নিজেওতো তাহলে বলদের একজন
- বলদ না হলে কি আর পলিটিক্স ছেড়ে এসে এনজিও করি?

ভদ্রলোক আবারও কিছুক্ষণ চুপ। আরো কয়েকবার তাকালেন ছবিটার দিকে- একটা কে এঁকেছে?
- শাহ আলম

শাহ আলম আমাদের কলিগ ছিল। শাহ আলমকে দিয়ে ছবিটা আমি আঁকিয়েছিলাম দুই অংশে। একটায় উড়ন্ত বলদ। আর আরেকটায় জোয়াল কাঁধে ছাগল। তারপর দুটো পাতা জোড়া দিয়ে রঙিন পেপারে ফটো কপি করে পোস্টারটা বানিয়ে টানিয়ে রেখেছিলাম নিজের পেছনের দেয়ালে। রেখেছিলাম পাবলিককে ক্ষেপানোর জন্য। ...তবে এই গল্পটা আমার আবিষ্কার নয়। দীর্ঘদিন পরে আমার এক পলিটিক্যাল ফ্রেন্ড আমার হাল হকিকত জেনে আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিল গল্পটা। গল্পটা আমি বহুবার বহু ধরনের লোককে শুনিয়েছি। শুধু যাকে শোনাচ্ছি তার সাথে মিলিয়ে বলদের পেশা বদল করেছি প্রতিবার। যখন ব্যাংকারের সাথে কথা বলি তখন বলি সকালে উঠে একটা বলদ চলে যায় ব্যাংকে। যখন সরকারি চাকরিজীবীর সাথে কথা বলি তখন বলি একটা বলদ সকালে চয়ে যায় সচিবালয়ে...

কনসেপ্ট এবং উদ্দেশ্য শুনে শাহ আলম হেসেছিল অনেকক্ষণ হো হো করে। আর ছবিটা এঁকে ফেলার পর দিতে দিতে বলেছিল- আপনি যে কোনদিন কোনখানে মাইর খাবেন আর আমকেও খাওয়াবেন কে জানে

কলিগ হিসেবে নয়। শাহ আলমকে আমরা চিনতাম আমাদের প্রান্তিক চত্তরের লোক হিসেবে। আমি সম্ভবত তাকে ছোটবেলা থেকেই চিনতাম। কিন্তু তাকে জানলাম নাটকে এসে। সে নাটকেরই লোক। কোনো দলের নয়। অথচ সবগুলো নাটকের লোকই তাকে দেখতো তার নিজের গ্র“পের ছেলে হিসেবে। সরকারি লোক যখন সিলেটের নাটকপাড়া উচ্ছেদ করে তখন কথাকলির অফিসের সাথে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের যে দুটো বিশাল পোট্রেট গুঁড়ো করে দেয় তাও শাহ আলমেরই করা

চুরানব্বই সাল পর্যন্ত আমি পৃথিবীতে এহেন বিষয় নেই যা নিয়ে লিখতাম না। অথবা বলতে হয় আমার চোখের সামনে এমন কোনো বিষয় ঘটেনি যা নিয়ে আমি দু-এক চামচ আঁতলামি করিনি। এবং তা হান্ড্রেড পার্সেন্ট আঁতেল-সূত্র মেনে। মানে যে বিষয় যত কম বুঝি সে বিষয়ে তত বেশি বলি। আর এমনভাবে বলি যাতে সত্যি সত্যি বিষয়টা যে বোঝে তার মাথা আউলা হয়ে যায়। এটাই আাঁতলামির নিয়ম। বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার সময় আফ্রিকার অখ্যাত কোনো লেখকের উদারহণ দেয়া। যার সম্পর্কে শ্রোতা জানে না বিন্দুমাত্র। এবং অবশ্য আঁতেল নিজেও জানে না। কারণ কোনো বিষয় সম্পর্কে সত্যি সত্যি বেশি জানলে সেটা নিয়ে আঁতলামি করা যায় না। আঁতলামি করতে হয় কম জানা কিংবা না জানা বিষয় নিয়ে

আমার আঁতলামি শুধু মুখে ছিল না। ছিল লিখিত আঁতলামি। চুরানব্বই পর্যন্ত আমি কাজ করতাম তিন আঁতেলের পত্রিকা সুপান্থে। মোনায়েম আহমেদ মায়েনিন; যিনি যেকোনো লেখার সাথে ব্রেকেটে লিখে দিতেন বানান রীতি লেখকের নিজস্ব। এবং তারপরে যাচ্ছেতাই বাংলা বানানে লিখতেন হাবিজাবি। তিনি সেই পত্রিকার ফিনেন্সার। প্রধান সম্পাদক ইখতিয়ার উদ্দিন; যিনি বলতেন মায়েনিনের লেখার প্র“ফ দেখার কোনো দরকার নেই। কারণ বানানরীতি যেহেতু লেখকের নিজস্ব সেহেতু যাবতীয় ভুলও লেখকের নিজস্ব। আর একানব্বইয়ে যিনি রাস্তা থেকে ধরে এনে আমাকে সাংবাদিক বানিয়ে দিলেন সেই আল আজাদ পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক। যিনি সব সময় বিশ্বাস করেন তিনিই সঠিক

এই তিন মহারথির মাঝখানে আমি নিতান্ত নাবালক। কিন্তু নাবালক থেকে তো আর আঁতেল হওয়া যায় না। সুতরাং আমিও সাহসী হয়ে উঠলাম আস্তে আস্তে। ...একবার বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের এক সেমিনারে পড়া বদর উদ্দিন উমরের মুল প্রবন্ধ আমি সেমিনারে না গিয়ে- না শুনে এবং না পড়েই নিজে বানিয়ে ছাপিয়ে দিলাম পত্রিকায়। দেখলাম আজাদ ভাই কিংবা ইখতিয়ার ভাই কেউই ধরতে পারেনি বিষয়টা। ব্যাস। আমাকে আর পায় কে। নিউজ বানাতে হলে কি আর ফিল্ডে যেতে হয় নাকি? উর্বর মগজ থাকলেই বসে বসে নিউজ বানানো যায়; শুধু নিউজটা এমনভাবে বানাতে হবে যেন পাবলিকের মাথার উপর দিয়ে যায়। আর হেডিংটা হতে হবে ফাটাফাটি। তাহলেই প্রসংশা। কারণ পাবলিক যে লেখার সামনে নিজেকে যতবেশি বেক্কল হিসেবে আবিষ্কার করে সেই লেখাকে তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মর্যাদা দেয়। ...সেই যুগে আমি খুঁজে খুঁজে দুর্বোদ্ধ শব্দ এনে জড়ো করতাম কবিতার মধ্যেও। পাবলিক পড়ে হা হয়ে থাকতো আর প্লাস্টিক হাসি দিয়ে বলত- দারুণ। আমার ধারণা সেইসব কবিতার অনেক শব্দের অর্থ আমি নিজেও বুঝতাম না। এমনকি এখনও আমার নিজের পুরোনো লেখার অনেক শব্দের অর্থ আমি বুঝি না

তো সেই যুগে চিত্রকলা আমার নাগালের বাইরে চলে যাবে একটা কেমন করে হয়? অবশ্যই না। এবং আমি চান্স পেয়ে গেলাম। শিল্পকলার স্টুডেন্টদের চিত্র প্রদর্শনী। ইচ্ছামতো লিখলাম রিভিউ। তবে শিল্পকলার লোকজন আমাদের নাটকের লোকজনের ঘনিষ্ঠ বলে সমালোচনা করলাম না বেশি। বরং দেশ বিদেশের যত শিল্পীর নাম আমি সংগ্রহ করতে পারলাম সবার নাম উল্লেখ করে তুলনা করে প্রসংশাই করলাম বলা যায়। যদিও সত্যি কথা হলো পেইন্টিংয়ের আগামাথা এখনও কিছুই বুঝি না আমি। তবে এটাও এক ধরনের আঁতলামি। পজেটিভ আঁতলামি বলে এটাকে। এমন কারো সঙ্গে তুলনা করে প্রসংসা করা যার সম্পর্কে প্রসংশাকারী জানে না কিছুই

শাহ আলমের ছবি হয়তো সেখানে ছিল। হয়তো ছিল না। কিন্তু তখন থেকেই শাহ আলম একেবারে ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলো আমাদের। প্রথমে শিক্ষার্থী শিল্পী হিসেবে। তারপর প্রয়োজনীয় মানুষ হিসেবে। আর মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই সে হয়ে উঠল একমাত্র অনিবার্য মানুষ

সিলেট শহর একটা আত্মঘাতী শহর। এ শহরের ইতিহাস মানুষকে বেশিদূর যেতে দেয় না। যে মানুষ বেশিদূর যাবার ক্ষমতা রাখে তাকে হয় পির না হয় সন্যাসী বানিয়ে ফেলে এই শহর। এজন্য সিলেট থেকে আমলা বের হয় কিন্তু রাজনীতিবিদ বের হয় না। কবিতা চর্চা হয় কিন্তু কবি হয়ে উঠতে পারে না কেউ। এর কারণ হয়তো সিলেট শহর এখনও নিজেকে যে দুই মানুষের নামে পরিচয় করায় তারা দুজনই সন্যাসী। শ্রী চৈতন্য আর শাহ জালাল। একজন বাড়ি ছেড়ে গিয়ে আর আসেননি নিজের বাড়িতে। আর আরেকজন বাড়ি ছেড়ে এসে আর ফিরে যাননি নিজের বাড়িতে। একজন সিলেট থেকে সন্যাসী হয়ে বের হয়ে গেছেন। আরেকজন সন্যাসী হয়ে এসে ঢুকেছেন সিলেটে। সন্যাসবাদের মূল চরিত্র দাবি ছেড়ে দেয়া- জীবনের সব রং ছেড়ে দেয়া। অনর্থক আত্মমগ্নতায় ডুবে জীবনের সব স্ট্রাগলকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। জীবনকে আত্মসমর্পন করানো অনর্থক কোনো কিছুর কাছে। সন্যাসবাদ একজনকে সন্যাসী বানিয়ে যতটুকু ক্ষতি করে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করে সন্যাসীর ভক্তসংখ্যা বাড়িয়ে। সন্যাসীরা নিজের জীবন ছেড়ে দেয় শূন্যে। আর ভক্তরা ধরে বসে থাকে সন্যানসীর শূন্যতাকে। এ এক আজব আনুগত্য। এরকম সারেন্ডার অন্য কোথাও নেই। সিলেটের তরুণরা এখনো বড়োদেরকে দীর্ঘ দীর্ঘ সালাম দিয়ে যত সময় নষ্ট করে; অত সময় বাংলাদেশের অন্য কোনো অঞ্চলের কোনো তরুণ সারা জীবনেও নষ্ট করে না। এই আত্মঘাতী শহরে যে একটু কিছু প্রমাণ করে সেই হয়ে উঠে পির। আর পির হয়ে গেলে তার কাজ হয় কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে দুনিয়াশুদ্ধ লোককে মুখে মুখে উদ্ধার করা

শাহ আলম হয় পির না হয় তার গুরু অরবিন্দ দাস গুপ্তের মতো হাল ছেড়ে দেয়া সন্যাসী হয়ে যেতে পারতো। অরবিন্দ দাস গুপ্তের আর কোনো শিষ্যই থাকেনি শিল্পে। তার অন্য চার শিষ্য- পিকলু-আকতার-মুকুল-শেরো; চারজনের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে ‘এ্যাড পামস’ নামে একটা এ্যাড ফার্ম করেছিলেন নব্বইর দিকে। কিছুদিন হৈচৈ আঁকাআঁকি করেছেন এটাকে কেন্দ্র করে। তারপরে বিভিন্নজনের বিয়ের গেট- গায়ে হলুদের স্টেজ এসবের মধ্যে শিল্পচর্চা করে যার যার মতো ঢুকে গেছেন বিভিন্ন খোড়লে। কেউই আর থাকেননি পেইনটিংসে। সম্ভবত সিলেট শিল্পকলা এবং তার শিক্ষক অরবিন্দ দাসগুপ্তের একমাত্র শিষ্য ছিল শাহ আলম; যার অন্য কোনো পরিচয়ই তার শিল্পী পরিচয়টাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। এবং নিজে সে আর্টের স্কুল চালানোর পরও পিরাকি আসেনি তার মধ্যে

ছবি না বুঝলেও শাহ আলমকে তার প্রতিটা কাজ পরের প্রতিটা কাজ দিয়ে ছাড়িয়ে যেতে দেখেছি চোখের সামনে। এবং... তাকে বলেছিলাম... আমার একটা বইয়ের প্রচ্ছদ করে দেবে তুমি...

ঝামেলাটা বাঁধালেন বাবু ভাই। আমিরুল ইসলাম বাবু। এমনিতে তার খোঁজ কেউ করে না। কিন্তু যে কোনো ঝামেলায় ফোনের ডায়ল লিস্টে সবার আগে চলে আসে তার নাম। আর আমরা যারা ছিটকে পড়েছি সিলেটের বাইরে; সিলেটের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের প্রধান গেটওয়ে এই বাবু ভাই

বাবু ভাইর ফোন। শাহ আলম...

কোনো কিছুই মনে হলো না আমার। আমার মনে পড়লো- গরু উড়ে যাচ্ছে আর ছাগল টানছে জোয়াল

মরার সংবাদ শুনলে আমি করার মতো কিছু খুঁজে পাই না। কেমন যেন বোকা বোকা লাগে নিজেকে। বোকা বোধ হয় আরো অনেকেই হয়েছে। নাহলে বাবু ভাইর ফোনের মাত্র দশ মিনিটের মাথায় আমাকে সিলেট থেকে একজন ফোন করলেন। আমার কণ্ঠ শুনেই বললেন- যাক বেঁচে আছো তাহলে...

সত্যিই। অনেক মানুষই হয়তো নেই। এরকম ভাবার মতো বোকা বানিয়ে দিয়েছে শাহ আলম
২০০৭.০৪.০৩ মঙ্গলবার
## ## ##


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার আশেপাশের সাদাকালো কিংবা রঙিন মানুষদের নিয়ে নিজের সাথে নিজের গল্প করার আরেকটি অধ্যায় এই লেখাটি

আরিফ জেবতিক এর ছবি

কিছুই বলে যাই না ,কিছুই না ।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আচ্ছা,রেজওয়ান মারুফ নামে একজন ছড়াকার ছিলেন না,তোমাদের বন্ধু ?তার কোন খবর জানো না কি ?

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

হুমম, কিছুদিন আগে আমার সাথে পরিচয় হলো।
মারুফ আর তুহিন এক বাসাতেই থাকে এখন। মিডিয়া ফ্যাক্টরি বলে একটা প্রতিষ্ঠান আছে ওদের। বিজ্ঞাপন বানায়।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মারুফ লন্ডনে আছে প্রায় ১২ বছর থেকে কিন্তু লন্ডনী হতে পারেনি এখনও
সে আমাকে ফোন করে বলে দেশে আসার টিকিট পাঠানোর জন্য আর
এখানে এলে তাকে আমি থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবো কি না
চাকরি করে শুনেছি। কিন্তু তার কোনো চাকরিই নাকি ১৫দিনের বেশি টিকে না

তার একটা ইমেইল আছে কিন্তু সে ব্যবহার করে না

ভাস্কর এর ছবি

পইড়া আরাম পাইলাম...আর মনে পড়লো সেই দিনটার কথা যেই দিন আমরা কম্যুনিকার মাইক্রোবাসে ভারত কিম্বা পরপারের দিকে রওনা দিছিলাম...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এইবার চিনতে পারলাম
এমন বার্নিশ মারা চেহারা মানুষ নিজের ছবি হিসেবে একেবারে শাহবাগ ব্রান্ড (৮০র দশক) লাগিয়ে রাখলে চেনারতো উপায় নাই...

জ্বি....
আমাদের উন্নয়নবাণিজ্যের অধ্যায়ে নরকযাত্রার যাত্রী তালিকায় আপনারও নাম আছে

শেই হলেই পেয়ে যাবেন

জিফরান খালেদ এর ছবি

দুর্দান্ত হইলো...

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

মানে যে বিষয় যত কম বুঝি সে বিষয়ে তত বেশি বলি। আর এমনভাবে বলি যাতে সত্যি সত্যি বিষয়টা যে বোঝে তার মাথা আউলা হয়ে যায়। এটাই আাঁতলামির নিয়ম।

মজা পাইলাম।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

হাসান মোরশেদ এর ছবি

চুরানব্বই পর্যন্ত আমি কাজ করতাম তিন আঁতেলের পত্রিকা সুপান্থে। মোনায়েম আহমেদ মায়েনিন; যিনি যেকোনো লেখার সাথে ব্রেকেটে লিখে দিতেন বানান রীতি লেখকের নিজস্ব। এবং তারপরে যাচ্ছেতাই বাংলা বানানে লিখতেন হাবিজাবি। তিনি সেই পত্রিকার ফিনেন্সার। প্রধান সম্পাদক ইখতিয়ার উদ্দিন; যিনি বলতেন মায়েনিনের লেখার প্র“ফ দেখার কোনো দরকার নেই। কারণ বানানরীতি যেহেতু লেখকের নিজস্ব সেহেতু যাবতীয় ভুলও লেখকের নিজস্ব। আর একানব্বইয়ে যিনি রাস্তা থেকে ধরে এনে আমাকে সাংবাদিক বানিয়ে দিলেন সেই আল আজাদ পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক। যিনি সব সময় বিশ্বাস করেন তিনিই সঠিক

চোখ টিপি নো কমেন্ট ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এখন পড়লাম।
অনেক ধন্যবাদ লীলেন ভাই, এইসব মানুষ এভাবে চলে যায়!

তাপস শর্মা এর ছবি

গল্পের প্রথম অংশটা মজার, ২য় অংশ প্রক্ষিপ্ত হয়ে ফুটে উঠে, পাঠকের কাছে মনে হতে পারে ( যদি নিজের উপলব্ধি হয় ) নিজের কথাই, যে কথা সাহস করে কেউ বলতে পারেনা, আর এইভাবে লিখে ফেলা-- অসম্ভব। সেই শক্তি এবং সৎ সাহস!!

শেষ অংশে এসে একেবারেই থমকে যেতে হয় শাহ আলম এর মৃত্যু দিয়ে! শিল্প এইভাবেই পুড়িয়ে দেয় সবকিছু।

যেহেতু এই গল্পটাও গল্পের বাস্তবতা নয়, বাস্তবের রূপ নির্মাণ মাত্র তাই সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায় শেষ হয়ে না বলা কিছু দীর্ঘশ্বাস!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।