সুর-অসুর

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি
লিখেছেন মানিক চন্দ্র দাস [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১৫/০৮/২০১০ - ৮:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুর-অসুর

সিদ্দিক ভাই একসাথে আটটা নতুন বাড়ি বানাচ্ছেন। নিজের জন্যে না। এই বাড়ির ফ্ল্যাট বিক্রি হবে। সেই হিসেবে তাকে ডেভেলপার বলা যায়। সিদ্দিক ভাই অবশ্য নিজেকে কন্ট্রাকটর বলতেই ভালোবাসেন। অমায়িক লোক সিদ্দিক ভাই।

পড়াশোনার পর অনেকদিন বসেছিলাম। চাকরি পাইনি। বাবা মারা গেলেন। মা আর ছোট বোনটাকে নিয়ে পড়লাম পানিতে। সাঁতার জানিনা যে সাঁতরাবো। ডুবেই যাচ্ছিলাম। সিদ্দিক ভাই টেনে তুললেন। আমি কোন পর্যন্ত পড়েছি, কী করতাম, কী করি কোন কিছুই তিনি জানতে চাইলেন না। সোজা চাকরি। কাজ হচ্ছে তার আশেপাশে থাকা। আর কিছু না।

মাঝেমাঝে কিছু কাজ থাকে। সেই কাজ আমি সহজে করে ফেলি। কখনো কখনো রাতে ছাদে বসে থাকতে হয়। বলেছি না, সিদ্দিক ভাই অমায়িক? যখনি ছাদে বসে থাকার দায়িত্ব পড়ে তখনি আমার জন্য এক বোতল স্কচ থাকে। বিদেশী। সাথে বেনসন দু প্যাকেট। চল্লিশটা শলা। কখন যে উড়ে যায় টেরই পাইনা।

আমার টেলিস্কোপের শখ ছিলো। সিদ্দিক ভাই সেটাও দিয়েছেন। আমি রাতে ছাদে বসে আকাশের নক্ষত্র দেখি। চাঁদ দেখি। ভালো দেখা যায়। তাই দেখতে আমার ক্লান্তি নেই। কবিরা চাঁদ নিয়ে নানারকম ভুংচুং বলেছেন, করেছেন। আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে কবিদের এইসমস্ত বিষয় বোঝার চেষ্টা করি। বুঝিনা। চাঁদ বোধহয় দূর থেকেই সুন্দর ।কবিদের কেউ খুব কাছ থেকে চাঁদ দেখেছেন বলে আমার মনে হয়না। দেখলে চাঁদের সাথে নিজের মানসপ্রিয়ার চেহারার তুলনায় যেতে পারতেন না। চাঁদের গায়ে ইয়া বড় বড়, গোল গোল, কালো দাগ। কোন নারীর চেহারা এমন হলে আমি তার প্রেমে পড়তাম কিনা সন্দেহ আছে। কথায় আছেনা, আগে দর্শনধারী তারপর গুন বিচারী...কিছু সুন্দর অবশ্য কাছ থেকে খুব কুৎসিত, দুরে গেলে সুন্দর। চাঁদ ও বোধহয় সেইরকম কিছু। কে জানে!

আমার হাতে স্কচ। তিন পেগ শেষ হলো। চোখ টেলিস্কোপে। নক্ষত্রের আলোরা বেশ উজ্জ্বল। দেখতে বেশ লাগে। ওদিকে তাকালে আর এই নিচের পৃথিবীর পঙ্কিলতা দেখতে ইচ্ছে হয় না। মজার বিষয় হল এই পঙ্কিলতার মাঝেই আমাকে দিন শুরু করতে হয়। দিনও এর মাঝেই কাটে। রাতও তাই। কাঁদার মাঝেই এই অপূর্ব মানব জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। ভাবতে বিষন্নতা অনুভব করি।

চার পেগ শেষ হলো। মাথায় চমৎকার সব স্বপ্ন আসছে। নক্ষত্রেরা আলোকবর্ষ দূরে, স্বপ্নেরা কাছে।
স্বপ্নই না হয় দেখি। চোখ আকাশে রেখে স্বপ্ন দেখতে বেশ লাগে। আকাশ দেখতে টেলিস্কোপ লাগেনা।
টেলিস্কোপ ঠিকঠাক করে রসুলের হাতে দিয়ে দিলাম। রসুল আমার আশেপাশেই থাকে। আমি যেমন সিদ্দিক ভাই এর আশেপাশে, রসুলও আমার আশেপাশে। সে থাকে শুধু রাতের বেলায়। আমি ছাদে থাকলে সে থাকে সিঁড়িতে। মাঝে মাঝে খক খক কাশে। খক খক কাশি দিয়ে রসুল কী বোঝাতে চায় কে জানে।

আকাশ কালো। হঠাৎ কোথা থেকে যেন গান্ডে পিন্ডে মেঘ এসে পড়েছে। নক্ষত্রেরা গা ঢাকা দিয়েছে। রাতের বেলায় মেঘের চেহারাটা ঠিকঠাক খোলেনা। সব মেঘকেই একরকম মনে হয়। কোন মেঘ তরুনী, কোনটা কুমারী আর কোনটা ছেনাল, বোঝা যায়না।
ভ্যাপসা গরম । আমার অবশ্য গরমে সমস্যা হয়না। গরম শায়েস্তা করার জন্য আমার নিজস্ব ব্যবস্থা আছে।
ছাদের উপর বেশ বড় একটা চৌবাচ্চার মতো আছে। আমিই মিস্ত্রীদের অর্ডার করে বানিয়ে নিয়েছি। আমি বললে ওতে জল ছাড়া হয়। রাতের বেলায় যদি ছাদে থাকি এবং যদি খুব গরম পড়ে তাহলে একেবারে জন্মদিনের পোষাকে চৌবাচ্চায় নেমে যাই। ভালো লাগে।

চৌবাচ্চায় নেমে গেলাম। নামার আগে অবশ্য জলের লাইন খুলে দিতে হয়েছে। চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। আস্তে আস্তে জল ভরে উঠছে।

প্রথমে জল পা ছুঁয়েছে । অনুভুতি শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ভেজা। আমার চোখ বন্ধ। জলের অনুভুতিটাকে ধারন করার চেষ্টা করছি। হাতে সোনালী জল। পায়ের নিচে স্রেফ জল। চোখেও জল। নোনা। চোখের জল নাকি নোনাই হয়।

এ কেমন জীবন আমার? কেন এই জীবন? নিঃসংগ, একাকী কিংবা জনারন্য। জনারন্যেও একা...। জল এখন আমার গোড়ালি ছুঁয়েছে। শীতল জল। আমার সমস্ত রোমকূপের মুখ মনে হচ্ছে হা করে আছে। রোমকূপেরাও কি জল খায়? জল এবার উরুতে। হঠাৎ করেই জলের শীতলতা আমাকে নিয়ে নিলো। আমার সমস্ত রোমকূপ শরীরের কালো পূঁতিগন্ধ জলকে দিয়ে নির্মল হচ্ছে।

আমার বুকে জল। এভাবে যদি বুকের কষ্টটাকে জলের হাতে দিয়ে দেয়া যেত! জলের উপর ভাসছি। অথবা জল আমাকে ধরে রেখেছে।
জল পিঠে হাত বোলাচ্ছে। মাঝে মাঝে সন্তানেরা যেমন বাবার বুকে চড়ে বসে।পিছলে নেমে যায় । জলেরা এখন তেমন। আমার যদি একটা সন্তান থাকতো! কিংবা একগাদা... একটা কাঁধ ধরে ঝুলবে, একটা পিঠে...একটা পা কামড়ে ধরবে...আদুল গলায় ডাকবে...বু...বু...বা...ব্বা... ভেতর থেকে ডাক আসবে, ওগো শুনছো? অফিসের দেরী হয়ে যাবে তো! ওদের এবেলা ছাড়ো দেখি...এই দুষ্টুরা এদিকে আয়...মায়ের কাছে আয়...বাবা অফিসে যাবেতো...ছাড় দেখি...নাম্মু...ছাব্বোনা...বা...ব্বা...চল্লেত আনবে তিন্তু...মনে থাব্বে...?
জলের উপরে আলতো করে হাত বোলাচ্ছি। ঠান্ডা। জল মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। নাকি ঢেউ উঠেছে? মৃদু ঢেউ...।

এখন ভাসার জন্য মাথার নীচে একটা বাতাসে ফোলানো বালিশ রাখা হয়েছে। কাজটা করেছে রসুল। কখন আমার কি লাগবে তা সে জানে। জলের উপর ভেসে থাকতে থাকতে আমার মায়ের গর্ভের কথা মনে হচ্ছে। গর্ভ। ঐ জায়গাটাতেও মানবসন্তানকে ভেসেই থাকতে হয়।

মা...আমার মা...কতদিন দেখিনা মা তোমাকে। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমার মা। কি স্নিগ্ধ, মায়াময় হাত...। মা,তোমার গায়ের গন্ধটা চিনি। আমার ধারে কাছে তুমি থাকলে আমি টের পাই। এখন কি তুমি আমার কাছে আছ? নাকি কল্পনা? নাহ। কল্পনা না। সত্যি। ঐতো মা।

হঠাৎ মা নেই। কালো অন্ধকার। আকাশের কাছে আমি। আমি উড়ে বেড়াচ্ছি... ঐতো মেঘ, কালো, সাদা, ছেনাল মেঘ। শরীরটা জলে চেতনা নিলীমায়...।শরীর জলে ভাসছে... আকাশের মেঘের ভেলায় চেতনা...আমার চেতনা। সাদা মেঘের গা ঘেঁষে ছাই রঙ্গা মেঘ। কি নিয়ে যেন কথা হচ্ছে। ভাষা জানিনা। বুঝতেও পারছিনা। কালো মেঘ। এরপরই ছেনালগুলো। কি ঢলানী শয়তানগুলোর! এ ঢলে ওর উপর। ও ঢলে এর উপর। ঢলের উপর ঢল। এদের পেটও কেমন ভরা গর্ভের নারীর মতো। এই অবস্থা নিয়ে কেউ ওভাবে ঢলাঢলি করে? পাগলী সবকটা...

হঠাৎ মোবাইলের রিং বেজে উঠলো। বাস্তবে নামলাম। শরীর জলে, মনটা এখন মোবাইলে। মোবাইলে গান বাজছে।

“আমার হাজার চাওয়া নেই, শুধু একটি চাওয়া তুমি...”

কি অসাধারন একটা গান। কুমার বিশ্বজিৎ। মানুষের কোটি কোটি চাওয়া থাকে। অপূর্ণ ইচ্ছেরা থাকে। সেই ইচ্ছেরা মাঝে মাঝে উঁকি দেয় মনের জানালায়। আর এই মানুষটার কোন চাওয়া নেই। শুধু একটিই চাওয়া...তোমাকে...রক্ত মাংসের মানুষকে এতো আকুল হয়ে চাইবার কি আছে? সব মানুষই এক। কেউ পেটিকোট পড়ে আর কেউ পরে প্যান্ট...সব্বাই এক। কেউ শালা পয়দা করে আর কেউ গায়ে বাতাশ লাগিয়ে ঘোরাঘুরি করে... শালা...হা হাহ হা...আমার হাসি পাচ্ছে।

হা হা হা পায় যে হাসি, হা হা হা পায় যে হাসি ...কে যেন লিখেছিলো? নজরুল নাকি সুকান্ত ? আহারে সুকান্ত... এতো অল্প বয়সে মরে গেলে... কেন যে বাপ স্বদেশ করতে গিয়েছিলে? কি হতো স্বদেশ না করলে? তুমি যে স্বদেশ চেয়েছিলে তা হয়নি...হবেনা...কে জানে হবে হয়তো...

মোবাইল নিশ্চুপ। শান্তি। আমি শান্তি চাই। নীরবতা চাই। নিজেকে দেখতে চাই। দেখতে চাই কতটা কালি ভেতরে জমা হলে মানুষ নিজেকে মানুষ বলে দাবি করে...আমি এখন নিজের ভেতরে ঢুকবো। ভেতরে। কী থাকবে ভেতরে? কালিঝুলি মাখা কোন মানুষ নাকি আমার অজানা কেউ?
ঢুকছি আমি। প্রথমে কপাল। ভ্রু। চোখ। নাক। ঠোঁট। কোথাদিয়ে ঢুকি? কানের ছিদ্র? ধুর...আবারো মোবাইল বাজছে।

“আমার হাজার চাওয়া নেই...”

“ভাইজান মোবাইল বাজতেছে। সিদ্দিক ভাই ফোন দিতেছে। ধরুম?”
রসুল ব্যাটা আমার ঘোরটাই দিলো নষ্ট করে ...
“ধর হারামজাদা।”
“সালাম স্যার। জ্বি।”
“ভাইজান, আপনারে চাইতেছেন...বড় সাহেব।“
“দে।”
“সিদ্দিক ভাই ভালো আছেন?”
“জ্বি ভাইজান। কখন?”
“আচ্ছা। কোন সমস্যা হবেনা।”
“জ্বি ভাইজান। আসসালামুয়ালাইকুম”
“ফোন নিয়ে যা রসুল। পিকাশ নামের আমার এক বন্ধু আসবে। পাঠিয়ে দিস। তুই সিঁড়ি ঘরে থাকিস।“

আমি আবারো রাজ্যের এলোমেলো ভাবনায় ডুবে গেলাম।

একটু পরেই পিকু এসে উপস্থিত।
আমি চৌবাচ্চায় শুয়ে আছি। দাড়াতে ইচ্ছে করছেনা। ও এসে দাঁড়িয়েছে চৌবাচ্চার ঠিক পাশেই। পিকু আমার সেই ন্যাংটা কালের বন্ধু। একসাথে কতো ঘুড়ি উড়িয়েছি। একসাথে গুপ্ত বাবুর সাহিত্য ঝাড়াঝাড়া করে ফেললাম। পিকুর খুব সুন্দর একটা বোন ছিল। আছে। একবার ঐ মেয়েটার সাথে গোত্তা খাবার চেষ্টাও করেছিলাম। স্বর্নলতা। আমি ডাকতাম মহাশ্বেতা বলে। মেয়েটা ফর্সা ছিলো। বেদম ফর্সা। মনে হতো টোকা দিলেই চামড়া ফেটে রক্ত বেরুবে। পিকু আমাকে এমন মার দিলো...আমার পূজার ফুল হয়ে গেল নর্দমার।

“রনক, তুই কি চৌবাচ্চায় শুয়ে থাকবি? উঠবিনা?”
“বন্ধু, আমার গায়েতো কাপড় নেই। তুই বরং নেমে যা। দুইজন ভালোই জায়গা হবে।“
“তোর মতো অতো খায়েস করার সময় নেই। “
“বন্ধু, কার হাতে যে কত সময় তা কে বলতে পারে বল? তুই পারিস? আমি পারিনা। তাই যতোটা সময় বেঁচে আছি। উপভোগ করি। আয় নেমে পড়। তোর জামা খুলতে হবেনা। জামাসহ নেমে যা।“

পিকু চুপচাপ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো। কি করবে বোধহয় বুঝতে পারছেনা।
“কি হলরে ব্যাটা, নেমে যা। কতদিন তোর সাথে দেখা হয়না! কতদিন হবে বলতো?”
“জানিনা রে।”
“আজ জমিয়ে আড্ডা দেবো, কি বলিস?”
“সে পড়ে দেখা যাবে। তোর হাতে কি মদের গ্লাস নাকি?”
“হ্যাঁ। কারণবারি বলতে পারিস। সাথে কিছু নেই। শুধু বরফ আছে। খাবি?”
“নাহ। এ জিনিষ খেয়ে গেলে বউ ঘরে ঢুকতে দেবেনা।”
“না হয় আজ রাতটা এখানে থেকেই গেলি। পরে বউকে কিছু একটা বুঝিয়ে দিস।”
“নারে দোস্ত। বউ যে কি জিনিষ তা তুমি বুঝবেনা। লাইনের বাইরে পা ফেলেছ তো একদম ঘাড়ে গর্দানে সাইজ।”
“হা হা হা হা হা হা হা”
“এতো হাসছিস কেন?”
“তোর মতো ডাকাবুকো ছেলে বৌ এর হাতে শিশু? হা হা হা ...”
“হেসোনা বাছা। বিয়ে কর টের পাবা। আর বউটাও আমার, জানিস, আমি বাসায় না যাওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকে। কি যে দরদ! মায়ের জাত তো! বাড়িতে না যাওয়া পর্যন্ত জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। কি যে একটা পাগলি মেয়ে আমার বউ! ভাগ্য ভালো আমার যে এরকম একটা লাইফ পার্টনার পেয়েছি”
“বেশ ভালোবাসিস মনে হচ্ছে?”
“তো আর কাকে বাসবো শুনি ? আমি কি তোর মত? শালা মাছি। একবার গুয়ে বসিস তো একবার ফুলে।”
“তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। তা অন্যদিকে চোখ দিস না? ”

“শালা এই ভালোবাসা যে ছেড়ে যে অন্য দিকে তাকাবে সে একটা চরিত্রহীন। তুই ভালই জানিস আমি সে রকম না। আমার বউ আমার বাচ্চার মা। সন্মান আমি তাকে দেবনা তো কাকে দেবো বলতো । ছোট্ট একটা মেয়ে আমার। ওদের ছেড়ে আমি থাকতে পারিনা। ভালো লাগেনা। অস্থির লাগে?”

“রাখ তো, এবার বৌ এর কথা একটু ভুলে যা দেখি। দুটো সিপ দে। আয় চোবাচ্চায় নাম। আগে তো ব্যাটা একাই দুবোতল কেরু মেরে দিতি। এটা বিদেশী। স্কচ।”

কি যেন ভাবলো পিকু। অনেকক্ষন। শেষমেশ বললো, “বউ আমাকে খুব ভালোবাসে। তাই বলে সেই সুযোগ নেয়াটা অন্যায়, তোর ডাকও উপেক্ষা করতে পারছিনা।কি করি বলতো?”
“নেমে আয় বাছা আমার। মাত্র দুপেগ। ওতে তোর কিছু হবেনা। যে দুবোতল কেরু মেরে স্বাভাবিক থাকে তার দুই পেগে কিছু হবেনা।“
চৌবাচ্চায় নামলো পিকু। হাতে স্কচের গ্লাস। ছোট্ট ছোট্ট সিপ চলছে। পিকু একসময় পেগের হিসেব ভুলে গেলো ।
“তোদের ডোবাটার কথা খেয়াল আছে?”
“আছে। কে...নো? কি... হয়ে...ছে ডোবাটার?” পিকুর গলা জড়িয়ে গেছে
“কি হয়েছে মনে নেই? ঐ যে সিদ্দিক ভাই তোদের জায়গাটা কিনে নিলো। খুব কেঁদেছিলাম আমরা, মনে আছে ?এখন কি খবর কি রে?”
“জা...নি...না । হা হা হা ...ছোট্ট বয়সের কল্পনা। মনে হত কত বড় দীঘি। দুটো পোষা ব্যাং ছিলো আমাদের ওখানে। পিন্টু-ঝিন্টু। গায়ে আলো পড়লে শরীর চিক...চিক করতো। সো...না ব্যাং...নারে?”
“হ্যাঁ, সোনা ব্যাং। তোর বাবা সেই ডোবায় মাছ চাষ শুরু করলেন। তখন আমরা ব্যাং দুটোকে বয়ামের ভেতর রেখেছিলাম। রাতের বেলায় ব্যাং গুলোকে ডোবায় ছেড়ে দিতাম। খা বাবারা কত পোনা খাবি। ভোর বেলায় আবার বয়ামে। শেষে তোর বাবার হাতে ধরা খেলাম। কি মারটাই না দিলেন। সোনা ব্যাং নাকি তার মাছের পোনা খেয়ে শেষ করে ফেলছে। হাহ হা হা।ব্যাং...পুশতাম...ব্যাং...”

“বন্ধু। আ...মার বাবা তোকে পিটেছে...আমি...সে...জন্যে তোর কাছে মা...ফ চাই। মাফ করেছিস বল? বল...আ...মা...কে...মাফ ক...রে...ছিস।“
পিকু কাঁদছে। আউট। পুরো আউট। আমার জিগরি দোস্ত। পিকু।
আমি শুয়ে আছি। জলের উপর। পিকু সেই পা নিয়ে দলাই মলাই করছে। চোখের জল আর শরীরের আশপাশের জল সব এক। জলের রঙ একই হয় কেন?
আমার চোখে সেই পুকুর। সবুজ জল। তার উপর ছাতার মতো কদম গাছ। তার নীচে মাছেরা খেলতো। এক পাশে পানা। পানার নিচে চিংড়ি। কুঁচো চিংড়ি। গোধূলির আলোয় সবুজ জলে কদমের ছায়া। বর্ষায় কদম ফুলের ছায়াও পড়তো। হলুদ ছায়া। কদমের ছোট্ট ছোট্ট হলুদ সাদা রোঁয়া ছড়ানো জলে। সাঁঝের আলোয় সে রোঁয়াগুলো কি চমৎকার ভেসে বেড়াতো। আমরা দেখতাম। মাঝে কাগজের নৌকা। এদিক ওদিক। এখনও দেখছি চোখের সামনে। রোঁয়া, কদমের গোল গোল ন্যাড়া বল। সাঁঝের আলোছায়ার মাঝে হলুদ-সাদা রোঁয়া। সাদাটে সবুজ ন্যাড়া বল আর সবুজ জল।
এই ডোবা এখন নেই।

পুকুর পাড়ের নোয়ানো গাছ,
খেলতো একটা ছটফটে মাছ...
যখন তখন মাছটা খেলত,
গাছেরা দেখতো গাছেরা হেলতো...

খালি গলায় গান গাচ্ছি। সুমনের গান। আমার খোলা গানের গলা ভাল । পিকু তখনো মাথা কুঁটে যাচ্ছে। কুঁটুক শালা। মালে যে মানুষের কি হয়.........!
হঠাৎ বৃষ্টি। জল এখন আর শুধু পিঠে শুড়শুড়ি দিচ্ছেনা। উপর থেকেও আসছে। কি শান্তির বৃষ্টি ! শরীরের গ্লানি কি এই জলে যায়? যায়না। আমাদের গ্লানি থাকে আমাদের অন্তরের গহীনে কোন এক অতল গহবরে। আমরা ভিজছি। চৌবাচ্চার জলে অদ্ভুত ঠকাস ঠকাস শব্দ হচ্ছে, শরীরে যেখানে লাগছে মনে হচ্ছে টুকরো বরফ লাগছে। বরফ। আহা বরফ। এই বরফ যদি বুকের আগুন নিভিয়ে দিতো!

পিকু, এবার উঠ। বৃষ্টি দেখ। আমার গ্লাসের স্কচে বৃষ্টির ছাট আসছে অল্প। তাতেই চুমুক চলছে। চলুক। মাথা আজ বড্ড ফাঁকা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। হোক ফাঁকা। কি হবে এতো কিছু করে?

আমি পিকুর দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ চকচক করছে। মালের প্রভাব। হাত পা এলোমেলো। একটু পরেই পিকুটা কেমন নিস্তেজ হয়ে গেল। আমি ওকে চৌবাচ্চা থেকে ধরে নামালাম। শালা যেই শুটকা-পটকা। তাতে একটুও কষ্ট হলনা। ওকে নিয়ে গেলাম প্লাস্টিকের কভারের উপর...পাশেই কল আছে। কেউ বমিও করলে কল ছেড়ে দেয়া হয় । মাঝে মাঝে সিদ্দিক ভাইও এখানে বন্ধুদের নিয়ে আসেন। তার কেউ বমি করে । তখন জিনিষটা বেশ কাজে দেয়।

বৃষ্টি থেমেছে। রসুল দৌড়ে এলো।
“ভাইজান ফোন করেছেন।”
“দাও।”
“জ্বী ভাই।“
“হবে ভাই,এখুনি।’

আমি আমার চিলেকোঠা থেকে ছোটখাট একটা চাপাতি নিয়ে এলাম। সিদ্দিক ভাই বলেছেন পিকুর গলাটা দুভাগ করে দিতে। এই আমার কাজ। ব্যাটা নাকি জমি নিয়ে কি ঝামেলা করছে। আমি এগুচ্ছি...গুটি গুটি পায়ে। আমার প্রিয় বন্ধু পিকু আজ তার এই খোলশ ছেড়ে চলে যাবে। কই যাবে কে জানে। সিদ্দিক ভাই বড় অমায়িক মানুষ। হা হা হা হা হা


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

মানিকদা ,
" পিকু আমাকে এমন মার দিলো...আমার পূজার ফুল হয়ে গেল নর্দমার।"
হাহাহা ... ভালো মজা পেলাম...
চমৎকার হয়েছে...স্কচ ধুকাবার পরবর্তী অবস্থার বর্ণনা অদ্ভূত হয়েছে...নিজেকে ও জায়গায় নিতে সমস্যা হয় নি
মোটেও...দুর্দান্ত !!! প্যারাটায় যাবার আগ পর্যন্ত মনে হল না, ভদ্রলোক কি করতে যাচ্ছেন...সম্ভবত আপনি যা যা চেয়েছেন
তা-ই পেরেছেন...বেশ ভালোভাবে-ই পেরেছেন...
চালিয়ে যান দাদা...চালিয়ে যান...অবশ্যই...
ভালো থাকবেন...

মূলত পাঠক এর ছবি

চমৎকার লাগলো। এই গল্পে কাকবৃত্তান্তে যেমন হুমায়ুন আহমেদের ছাপ তেমনটা নেই বলে আরো ভালো লাগলো। লিখতে থাকুন!

তিথীডোর এর ছবি

চলুক চলুক

লিখুন নিয়মিত...

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

Arif Khan এর ছবি

অসাধারন গল্প বুনন!!!এক দমে পড়লাম।২ বার।২ বার ই এক ই রকম লেগেছে।মনে হচ্ছিল মেডিটেশনের গামা লেভেল এ পৌছে গেছি...নিজেকে রনক ভাবতেছিলাম যেমন ভাবনা আসে নচিকেতার পাগলা জগাই শুনলে...ভাবছি স্কচ(হেঈগ) খেয়ে এই গল্প পড়তে পড়তে মেডিটেশনে যাব একদিন...
এই বার অপেক্ষায় থাকব,এই লেখার মন্তব্য দেখতে।অমুক তমুকের ছায়া কে বলে একটু দেখতে চাই...ভাল থাকিস মানিক তোর অসাধারন গল্প বুনন...
আরিফ ভাই

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

মানিক ভাই,

সমায়ভাবে পড়া হচ্ছেনা। তবে আমি অবশ্যই পড়ব এবং মন্তব্যে রেখে যাবো। জেনে খুশী হবেন হয়তো যে আপনার লেখা শুধু আমিই পড়ছি না, আমার বউকেও প্রিন্ট করে দেব বলে ভাবছি।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ভাই,
আপনার কমেন্ট ছাড়া কেমন যেন লাগে...তাই ঐ ঘটনা ঘটিয়েছি। আশা করি রাগ করেননি। ভাবীকেও আমার মতো অভাজনের লেখা পড়াবেন জেনে আমার সন্মানিত বোধ করা উচিত নাকি এরচে বেশী কিছু বোধ করা উচিৎ আমি জানিনা।
ভালো থাকবেন ভাই। পড়ার প্রচুর সময় হোক, এই প্রার্থনা করছি। ভালো থাকবেন।

কৌস্তুভ এর ছবি

মানিক ভাই, আপনার কাক সিরিজটা পড়া হয়নি, কিন্তু এই গল্পটা বেশ লাগল। একটু বেশি চন্দ্রবিন্দু দিয়ে ফেলেছেন কয়েক জায়গায়, যেমন "কাঁদার মাঝেই"।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

কৌস্তুভ ভাই,
কষ্টের সাথে জানাচ্ছি, এই সমস্যা গুলো আমার আছে। সমাধানের চেষ্টা করছি। ডাক্তারি করি তাই ডাক্তারির বই এর পাশাপাশি বাংলা ব্যাকরনের বই পড়ার খুব একটা সময় পাইনা। তাও চেষ্টা করছি এবং করবো আমার এই প্রিয় ভাষা লেখার ক্ষেত্রে দক্ষ হতে। দোয়া করবেন। সমস্যা থাকার পরেও আমার গল্প আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগছে। সময় পেলে কাক সিরিজটাও পড়ে মতামত জানাবেন। ভালো থাকবেন।

অস্থির চিত্ত [অতিথি] এর ছবি

মানিক ভাই... দারুন! কাক সিরিজও ভাল লেগেছে...এটাও দারুন লাগল!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সত্য কথা বলি, 'কাক' সিরিজটা উপন্যাস দেখে আর পড়িনি। ভেবেছি সিরিজ শেষ হলে একবারে পুরোটা পড়ব। এই পোস্টটা গল্প দেখে পড়লাম, পড়ে ঠকিনি। আপনার গল্পের ভাষা চমৎকার। অন্য দশটা দিকে (কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি) মনোযোগ না দিয়ে গল্পে (উপন্যাসে) মন দিন। তাতে আপনার পাঠকেরা লাভবান হবেন।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ষষ্ঠ পান্ডব,
আপনার উপদেশ অবশ্যই আমি মনে রাখবো। আমার লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

mehedihaque এর ছবি

অসাধারণ!
হুমায়ুন-গন্ধান্বেষীদের একটা ভালো জবাব দিয়েছেন দেখে ভালো লাগলো।

তবে গল্পের দু' একটা জায়গা একটু খাপছাড়া লাগলো, মেঘ দেখবার সুররিয়েলিস্টিক বর্ণনার মাঝে হঠাৎ কুমার বিশ্বজিৎ যেন মিস্টার বিনের মত থ্যাপ করে পড়লেন। জানি না এর পেছনে অন্য কোন অভিসন্ধি ছিলো কি না।

আর সিদ্দিক ভাইয়ের চরিত্রটা 'রহস্যময়' হবার বদলে মনে হল 'অসম্পূর্ণ'
যাই হোক, চালিয়ে যান ব্রো!

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

মেহেদী ভাই,
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। চমৎকার একটা কথা বলেছেন। সুররিয়েলিস্টিক বর্ণনার মাঝে হঠাৎ কুমার বিশ্বজিৎ...হা হাহ হা হা হা...। ভালো থাকবেন।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

আমার মনে হচ্ছিলো পিকুকে বুঝি ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হবে!

গল্পের ব্যাপারে উপরে সবাই ভালো ভালো কথা বলে ফেলেছেন। আমি একটু মিসিং লিংক নিয়ে জিজ্ঞাসা করি। পিকুকে রণকের ছাদে (ডেকে) পাঠালো কে? সিদ্দিক ভাই নাকি রণক নিজেই।

পুরো গল্পটি একটানে পড়ে যেতে কোনো সমস্যা হয় নি। চলুক



বিএসএফ—
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ভাই ধূসর গোধূলী,
আপনার দেখার ক্ষমতা অসাধারন। মিসিং লিঙ্ক টা না হয় মিসিং ই থাকুক। কি বলেন? গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

আপনার কাক সিরিজতো চমৎকার দৌড়ুচ্ছে। এর মাঝে এইরকম একটি অসাধারণ গল্প। ধন্যবাদ আপনাকে। দৌড়ুতে থাকুন।

পলাশ পলু এর ছবি

ভাইরে কি যে বলি...। এক কথায় অসাধারন। পাঠক কে গল্পে টানার ক্ষমতা এই গল্পে প্রবল। বেশ কয়েকবার পড়লাম একি রকম লাগল।

চালিয়ে যান তত দূর, যত দূর গেলে পরে আমাদের মত বোকাদের মন্তব্য করতে যেন আলাদা করে সাহস নিয়ে আসতে হয়।

এই দোয়া ই রইল।

সুমন [অতিথি] এর ছবি

সত্যি মানিক, ভালো লিখেছিস।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।