পাদ্রী মানুয়েলের বিপদ

সত্যপীর এর ছবি
লিখেছেন সত্যপীর (তারিখ: শনি, ১০/০৫/২০১৪ - ৭:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সরাইওলা আমার চোখে চোখ রেখে গম্ভীর স্বরে বলল, কবুতর খুব ভালো পক্ষী। আমি প্রত্যেক বিষ্পতিবার কবুতর পাক কইরা খাই।

তন্দুর রুটি চাবাতে চাবাতে আমি আতকা বিষম খেলাম একটু। শালা বলে কি?!

প্রত্যেক বিষ্পতিবার? আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম, এতো কবুতর পান কই?

আমার চোখ থেকে চোখ নামিয়ে সরাইওলা বলল, পাওয়া যায়। খুঁজলেই পাওয়া যায়। কবুতরের অভাব কি।

আমি মাথা নাড়লাম। কবুতরের অভাব নাই বটে। পাশ ফিরতে দেখি খলিল মহাজন ফিরে আসছেন। পিশাব করতে গিয়েছিলেন, তাই খেলা বন্ধ ছিল কিচ্ছুক্ষণ। বিরাট ঘেরের পায়জামার ফিতে বাঁধতে বাঁধতে খলিল বললেন, এই খেলা নূতন করে সাজাও। পিশাব করতে গিয়ে ফিরিঙ্গি বুড়ার সাথে দেখা, সেও আসছে খেলতে। অই সেলিম যা সর।

সেলিম করুণ মুখ করে আমার দিকে তাকালো। আমি মাথা নেড়ে ইশারা দিলাম কেটে পড়তে। বেচারা বেজার মুখে সরে পড়ল। ভালোই হল, এবার আমাকে দুইজনের পয়সা দিয়ে খেলতে হবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, নূতন করে সাজানোর দরকার কি? এইখান থেকে ধরে খেললেই হয়।

সরাইওলা আহমেদ আর খলিল মহাজন চোখাচোখি করল একটু। খেলা মাত্র শুরু হয়েছে ঠিকই, তেমন এগোয়নি। এখান থেকেও খেলা যায়। খলিল বললেন, ঠিক আছে। তাই হৌক।

আমি কড়িগুলো তোলা শুরু করতেই দেখি কালো লম্বা জোব্বাপরা এক বুড়ামত ফিরিঙ্গি ঘ্যাসঘ্যাস করে লাল দাড়ি চুল্কাতে চুল্কাতে এসে ধপ করে বসে পড়লেন। এই তবে পাদ্রী মানুয়েল আলভারেজ। পাক্কা শয়তানের মত দেখতে।

খেলার দিকে এক ঝলক দেখে আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, এই। খেল কখন শুরু করেছিস?

অযথা তুই তোকারি আমার কোনকালেই পছন্দ নয়। বিরক্তি চেপে বললাম, জ্বী সায়েব। এইমাত্র শুরু করলাম খেলা। দুই দানও হয় নাই। এখান থেকেই শুরু করা যায়।

তোর সাথে? অবজ্ঞাভরে তিনি সরাইওলা আর খলিলের দিকে তাকালেন, এ কে? আমি মোহর দিয়ে খেলি, ঘটিবাটি বন্ধক দিয়ে খেলা লোকের সাথে আমি হাত মিলায় খেলি না।

খলিল মহাজন একটু অস্বস্তির সাথে বললেন, আরে না না। এর নাম কবুতর ফারুক। এ অতি চমৎকার পক্ষীর খেলা দেখায়। রাজা চোগান সিং এর পেয়ারা লোক। এরও সোনামোহর আছে সায়েব।

বটে, বলে আমার দিকে তাকালেন পাদ্রী মানুয়েল, দেখে তো মনে হয় রাজার পাইখানা পরিষ্কার করে। অবশ্য রাজা চোগান সিং বুড়া মানুষ, হুটহাট হেগে দেয় বলে দরবারের মাঝখানে। সেইটা নিয়মিত সাফ করলে পেয়ারা হওয়ারই কথা হা হা হা হা হা।

ফিরিঙ্গি দেখে সরাইয়ের বাকি লোকেরাও কাছিয়ে এসেছিল, এই কথায় কামরাভর্তি লোক ঠা ঠা করে হেসে দিল। আমি বোকার মত হাসলাম একটু, আর মাথা চুল্কানোর ছলে একটু চারপাশ দেখে নিতে থাকলাম। প্রচুর লোক, বিশ তিরিশ জন তো হবেই। আর আছে খলিল মহাজন, তবে সে নিজে হয়তো কাজটা করবে না। সে করাতে পারে, সেইটা সম্ভব। এখানে তার লোক আমার জানামতে জনা আটেক। ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা তার ভাড়াকরা গুপ্তঘাতক থাকাও খুবই সম্ভব।

কয়দান খেলা হবে ঠিক নাই, এই ভিড় আমার ভালো লাগছে না। ভিড় খারাপ জিনিস, হুটহাট যে কেউ হাপিস হয়ে যেতে পারে। সম্ভবত যা ঘটার দ্রুতই ঘটবে, আমার সময় খুব বেশি নেই হিসাবের।

খলিল মহাজনের কড়ি ফেলার শব্দে ফিরে তাকালাম আমি। একটা কড়ি উলটে পড়ে আছে, বাকি পাঁচটা সোজা। খলিলের সাগরেদ কয়টা চিক্কুর দিয়ে উঠল, দাসসস!

তৃপ্তির হাসি হেসে খলিল দশঘর এগুলেন ছকে। দশ পড়লে আরেকদান মারা যায়। খলিল কড়ি ছয়টা হাতে নিয়ে আবার মারলেন। দুইটা কড়ি উলটো পড়ল। পিছনে সকলে বিড়বিড় করে বলল, দো।

এইবার আমার পালা। দেখা গেল তিনটা উলটা তিনটা সোজা। তিন ঘর এগুলাম আমি। এরপর সরাইওলা আহমেদ চাল চাললেন। তিনি খুব আস্তে মারেন, কড়িগুলা বেশিদূর যায়না কেমন এক জায়গায় জড়াজড়ি করে থাকে। দেখা গেল পাঁচটা সোজা আর একটা বাঁকা হয়ে অন্য একটা কড়ির গায়ে আধাখাড়া হয়ে আছে। ঠিক উলটো নয় কড়িটা।

আহমেদ আনন্দে চিৎকার করে বললেন, পাঁ-চি-সি!

ভিড়ের মাঝে হইহুল্লোড় পড়ে গেল। কেউ আনন্দে ডিগবাজি দিচ্ছে, কেউ একটু ধন্দে পড়ে গেছে, আবার কেউ কেউ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আওয়াজে কামরায় কান পাতা দায়।

এদিকে ভয়ংকর রেগে অগ্নিমূর্তি ধারন করলেন পাদ্রী মানুয়েল। জোরে জোরে মাথা নেড়ে তিনি উচ্চকন্ঠে বললেন, হয় নাই। হয় নাই। জোচ্চুরি। এই বেহেঞ্চোদ চোর। পাঁচিস হয় নাই। পাঁচটা কড়ি সোজা ছয়টা সোজা হয় নাই। চোর। হারামী। বাবাকা!

গালির বহর দেখে ভির্মি খেতে হয়। এ নাকি পাদ্রী, নাসারা ইমাম। মাশাল্লা ইমামসায়েবের মুখের যে অবস্থা। তবে এইসব হইহট্টোগোলের মধ্যে মাথা ঠিক রাখা চাই। ঘটনা এখন যেকোন সময় ঘটতে পারে।

মানুয়েলের কথায় পাত্তা না দিয়ে আহমেদের দলের খলিল মহাজন পঁচিশ দান দিতে উদ্যত হলেন। এই দেখে ক্ষিপ্ত মানুয়েল পাদ্রী আচমকা জোব্বার কোমরবন্ধ থেকে বাঁকানো ছুরি একটা বের করে সোজা বসিয়ে দিলেন খলিলের হাতের তালুর উপর।

আচমকা নীরবতা নেমে এল কামরায়। খলিল মহাজন চোখ বিস্ফোরিত করে নিজের রক্তাক্ত হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে থাকেন এক মুহুর্ত, তারপর তার কলিজা ফেটে চিৎকার বের হয়। মহাজনের সাঙ্গোপাঙ্গরা ছুরি তলোয়ার লাঠি যে যা পায় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এগিয়ে যেতে থাকে, আর ঘরে কেয়ামত নেমে আসে। কেউ দৌড় দিল উল্টাদিকে, কেউ লুটপাটে মন দিল, কেউ পিটাপিটির গন্ধে দাঁত বের করে খুশীতে হেসে দিল। আমি ঠাণ্ডা মাথায় বুঝার চেষ্টা করলাম পাদ্রী মানুয়েলের কি অবস্থা। মরেই গেল নাকি? আর সেলিম?

এক বলদ হা-আ-আ-আ আওয়াজ করতে করতে আমার দিকে ছোরা নিয়ে তেড়ে আসছে কানি চোখ দিয়ে খেয়াল করলাম। অল্প কাছে আসার পরে আমি একটু ডাইনে হেলে বলদটারে দিলাম আছাড়। মট করে একটা আওয়াজ হল, পিঠের হাড্ডি ভেঙ্গে গেল মনে হয়। কুড়িয়ে তার হাতের ছোরাটা হাতে নিলাম, মন্দ নয়। এক টুকরা পাথর পড়ে ছিল পাশে, তাইতে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কে কোথায় এবং কেন। মানুয়েলকে কয়জন ধরে পেড়ে ফেলেছে দেখলাম, আর আরেক কোণায় সেলিম একটা বড় তাকিয়ার পিছনে লুকিয়ে আছে। আচ্ছা সেলিম মোটের উপর নিরাপদ বলা চলে। মানুয়েলকে এইবার বাঁচাই কিভাবে সেইটা হইল কথা।

দুই চারজনকে মেরে ধরে সামনে এগুলাম একটু, শুনি মানুয়েল হাত পা ছুঁড়ে বেহেঞ্চোদ বেহেঞ্চোদ করেই যাচ্ছে। ব্যাপক মাথাগরম ফিরিঙ্গি। তাকে পেড়ে ধরে তার উপর চড়ে বসে আছে জন তিনেক। একে বের করি কিভাবে? সমস্যা।

ডানদিক দিয়ে এগুলে সম্ভবত সুবিধা, দরজা আর জানালা দুইটাই ঐদিক দিয়ে কাছে। সেইদিকেই যাওয়া যাক। একটু কাছে যেতেই আচমকা আমার দুই হাঁটুর পিছনে একটা প্রচণ্ড জোরে লাঠির বাড়ি খেলাম। এইটা কোনদিক থেকে আসল খেয়াল করিনাই। পড়ে যাওয়ার পরে আমার গলায় ছুরি ধরে কেউ একজন মুখটা এগিয়ে আনল। ব্যথায় মাথা ঝিমঝিম করছে, তবু মুখটা চিনলাম। সরাইওলা আহমেদ। কানের কাছে মুখ এনে হিসহিস করে বলল, কাল্কা কি বার ফারুক স্মরণ আছে? কাল্কা বিষ্পতিবার। বিষ্পতিবার বিষ্পতিবারে আমি কবুতর পাক করি রে হারামজাদা।

মাথায় একটা কড়া মুগুরের বাড়ি খেয়ে আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসল।

………………………………………………………………

আমার সম্বিৎ ফিরে এল পাছায় লাথি খেয়ে। ধড়মড় করে উঠে দেখি পাদ্রী মানুয়েল মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে আছে। হারামজাদা আজাইরা লাথি মারছে কেন?

আমি একটু সরে বসলাম। ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি আমি কোথায়। উঁচা ছাদঅলা একটা কামরা, অনেক উপরে একটা ফাঁকা ঘুলঘুলি। অল্প আলো। সন্ধ্যা, না ভোর এখন? আরেকটু দেখতে হবে। এত উপরে আমার শীষের আওয়াজ কি যাবে? না মনে হয়। অবশ্য কবুতর ডেকেও তেমন লাভ হবে না, সাথে আছে শুধু সেলিম। সে পড়তে পারে না, লিখতেও পারেনা। সেলিমের সাথে কবুতরবাজির কোন মানে নাই।

এই তুই কে রে?

উত্তর না দিলে আবার পাছায় লাথি দিতে পারে। ফিরিঙ্গির যে মাথা গরম। আমি আস্তে করে বললাম, আমি কবুতর ফারুক।

তোকে ধরছে কেন?

আমি কাঁধ নাড়িয়ে বললাম, আমি কি জানি। পাগল ছাগলের দুনিয়া।

ফিরিঙ্গি কি বুঝল কে জানে। মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে কি বলল। গালাগালি মনে হয়। তারপরে আবার আমার দিকে তাকাল আবছা অন্ধকারে। বলল, তুই কি আমাকে বাঁচাতে আসছিলি? তুই আমার দিকে আসছিলি কেনরে? এরা তোকে ধরে আনল কেন?

আমি আরেকদিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বললাম, আমি কি জানি। আমি দরজার দিকে যাইতে গিয়া ধরা খাইছি।

মানুয়েল কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। শ্বাস ফেলে বলল, হুঁ।

আমি কামরায় কিছুক্ষন হেঁটে দেখলাম। একবারে ন্যাড়া কামরা, কিচ্ছু নাই। এক চিপায় কয়টা গাছের ডাল ফেলে রাখা। আমি একটা চিকন শক্ত ডাল উঠিয়ে কোমরে গুঁজলাম। তারপরে বসে মুতলাম একটু। মুতের পানি পড়তেই দুইটা চিকা হঠাৎ দৌড় দিল, অন্ধকারে দেখিনি। কোনদিকে গেল দেখা দরকার, চিকা নিশ্চয়ই উপরের ঘুলঘুলি বেয়ে আসেনি।

এই শোন, পাদ্রী মানুয়েল আমাকে ডাকলেন, তোর নাম কি বললি?

আমি ঘুরে পাদ্রীর দিকে তাকালাম। বললাম, আপনেরে ধরছে ক্যান?

পাদ্রী একটু চিন্তা করে বললেন, হাত ফুটা করেছি তাই মনে হয়। জোচ্চরের দল। কিন্তু মেরে ফেলে নাই কেন সেইটা একটা কথা। আমার নামে গোয়ায় টাকা চাওয়ার ধান্দা মনে হয়।

আপনে গোয়ায় থাকেন?

আমি সব জায়গায় থাকি। আজ এইখানে কাল ঐখানে। হিদেনের কাছে প্রভু যীশুর বার্তা নিয়ে যাই।

আমি বুঝদারের মত মাথা নাড়লাম যেন সবই বুঝেছি। বুঝি নাই তাও অবশ্য না। এই লোকের যীশুবার্তা ইত্যাদি আমি আজকে প্রথম শুনছি না। রাজা চোগান আমাকে বুঝেই পাঠিয়েছেন। তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন যে এই লোক মানুষের সাথে কুকুরবিড়ালের মত আচরণ করে, আমি যেন পাত্তা না দেই। একবার চোগান সিং এর বিবি অসুস্থ হয়ে পড়লে এই পাদ্রী মানুয়েল একটা কি আরক তৈয়ার করে পাঠালে বিবিজান সুস্থ হয়ে ওঠেন, তাই সম্ভবত রাজাসায়েব পাদ্রীর উপর দিলখুশ।

গায়ে ব্যথা করছে। একটা গড়ান দেই বরং, বুড়া পাদ্রীর সাথে বাতচিৎ সময় নষ্ট।

…………………………………………………………………

ঘুম থেকে উঠলাম আবার লাথি খেয়ে। লাথিছাড়া এক সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারলে বড় ভালো লাগত। চতুর্দিকে খালি লাথি।

তাকিয়ে দেখি সরাইওলা আহমেদ আর খলিল মহাজন, সাথে আরো তিনটে পাণ্ডা। মহাজনের হাতের তালু কাপড় দিয়ে বান্ধা। এক লম্বু পাণ্ডা আমার হাত সামনের দিকে বাঁধতে আসল, সেই দড়ির প্রান্ত বাঁধা এক ঘোড়ায়। ঘোড়ায় বসার আগে সরাইওলা আমার কাছে এসে বলল, আইজ কি বার মনে আছে ফারুক?

আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, আছে। বিষ্পতিবার। বিষ্পতিবার বিষ্পতিবার আপনে কবুতর পাক করেন। সবই স্মরণ আছে। করেন পাক। তেল কষানো আরম্ভ করেন।

ঠাস করে একটা চড় খেলাম।

দ্রুত চারপাশে তাকালাম। অল্প দুরেই কোশ মিনারের কাছে বাঁধা আরো দুইটা ঘোড়া। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। গ্যাঞ্জাম করার এখনই সময়।

আমি কোমরে হাত দিয়ে শক্ত কাঠিটা বের করে আনলাম চোখের পলকে। আহমেদ তখন মাত্র পিছু ফিরেছে। আমি কাঠিটা মুঠি করে সোজা ঢুকিয়ে দিলাম আহমেদের ডান কানের ভিতর পুরোটা।

আ-আ-আ চিৎকার করে বসে পড়ল সরাইওলা আহমেদ, আমি তার কোমর থেকে দ্রুত ছুরিটা বের করে পাদ্রী মানুয়েলের পাশে দাঁড়ানো হতবিহবল লম্বুর দিকে তাকালাম। এক মুহুর্ত দ্বিধা করে সে কোমরের তলোয়ারের দিকে হাত বাড়াতেই আমি ঝাঁপ দিয়ে গিয়ে তার গলায় ছুরিটা বসিয়ে দিলাম।

এই সব দেখে জলিল মহাজন দিল দৌড়, আর সাথে পালাল আরো দুই পাণ্ডা। আমি দ্রুত ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে মানুয়েলের দিকে ফিরে বললাম, ঘোড়া আছে উইখানে আরেকটা। যান উঠেন।

মানুয়েল কোশ মিনারের ঘোড়ার দিকে দিলেন দৌড়। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি একটা ল্যাং মারলাম, ধড়াম করে উলটে পড়ে গেলেন পাদ্রী। তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি তার মাথার পিছনে একটা শক্ত বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে দিলাম। এইবার তার হাত বাঁধা যাক। পাগলছাগল মানুষ কোনদিকে যায় কোন ঠিক নাই। বেঁধেই নিয়ে যাই।

উলটা করে ঝুলিয়ে আমি আবার ঘোড়ায় উঠলাম। কোশ মিনারের কাছে যেতেই দেখি বিরাট গাছের ডালে বসে সেলিম হাত নাড়ছে আর লাফাচ্ছে দাঁত বের করে। আমি হেসে নিচে নেমে আসতে বললাম।

একটু পরে দুইটা ঘোড়া ছুটিয়ে আমরা গোয়ার পথ ধরলাম।

………………………………………………………

গভীর রাত।

বিরাট গীর্জা দালানের সামনে পাদ্রী মানুয়েল আলভারেজকে শুইয়ে দিলাম আস্তে করে, আর মুখের বাঁধন খুলে দিলাম। এতক্ষণ পরে মুখ খোলা পেয়ে পাদ্রী বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে আমাকে বললেন, বেহেঞ্চোদ আমার দড়ি খুলে দে। হারামীর ছেলে…

আমি ঠাস করে একটা চড় দিলাম। অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা আটকে গেল মানুয়েলের। আমি ফিসফিস করে বললাম, বড় বাঁচা বাচছেন। আপনের প্রভু যীশুর কাছে শুক্রিয়া করেন।

পিছু ফিরে সেলিমের সাথে হাঁটা দিলাম আমি। পাদ্রীর চিল্লাপাল্লায় গীর্জার লোকে একটু পরেই তার বাঁধন খুলে দেবে নিশ্চয়ই। চিন্তার কিছু নাই।

যেতে যেতে সেলিম আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ফিরিঙ্গি করছে কি? অরে ধরছিল ক্যান?

আমি হাওয়া খেতে খেতে বললাম, ফিরিঙ্গি একটা ছাগল। সে সুলতান নহবৎউল্লার দরবারে গিয়া কইছে মুহম্মদ নাকি ভণ্ড নবী।

তৌবা তৌবা, সেলিম বলল।

হ, আমি বললাম, পুরা পাগল। এর লাইগা সুলতান নহবৎ লোক পাঠাইছিল এরে খতম করতে। বেটার নসিব ভালো, আল্লায় বাঁচায় দিছে তারে এই যাত্রা। আচ্ছা বাদ দে। এই জায়গার নাম হইল গোয়া। আমার এক আধা ফিরিঙ্গি বন্ধু আছে, রুটি বানায়। তার ঘরে যামু চল।

রুটি বানায়? সেলিমের চোখ চকচক করে উঠল, নানরুটির কারিগর?

নাহ নানরুটি না। এদের রুটি আরেক কেতার। এরা ডাকে পাউরুটি। মিঠা একটু। খাইছস কখনো?

মাথা নেড়ে উত্তেজিত সেলিম বলল, না খাই নাই পাউরুটি। চলেন যাই। পাউরুটি খামু।

আমি হেসে মাথা নাড়লাম, হ চল। পাউরুটি খাইতে যাই।

(শেষ)


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

বাঃ বাঃ বাঃ, এই গল্পটা বেশ পছন্দ হইছে! হাততালি হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সত্যপীর এর ছবি

আমিও লেইখা ব্যাপকানন্দ পাইছি।

..................................................................
#Banshibir.

মেঘলা মানুষ এর ছবি

এক কবুতরওয়ালা নিয়েই একের পর এক চমৎকার জিনিস বের হয়ে আসছে, উড়ুক কবুতর, চলুক লেখা।

শুভেচ্ছা হাসি

সত্যপীর এর ছবি

হ আরো কয়টা লিখুম পরে। আট/দশটা কবুতর ফারুক হইলে পরীক্ষামূলকভাবে একটা ইপাব/মোবিতে হাত দিমু চাল্লু

..................................................................
#Banshibir.

সুবোধ অবোধ এর ছবি

দেঁতো হাসি ভালা নিউজ!

মন মাঝি এর ছবি

চলুক হাসি

****************************************

সত্যপীর এর ছবি

আমাদের পুরানো দিনের গল্প দিয়ে কি চমৎকার নাটক মুভি কার্টুন হয়! কুটি কুটি টাকা থাকলে আমি নিজেই বানাইতাম মন খারাপ

..................................................................
#Banshibir.

মন মাঝি এর ছবি

আমার অবশ্য এটা দেখে ফারুক আর সেলিমের জুটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। হাসি

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

বাদার বিক্রম পড়ার পর থেকে আপ্নার গল্প পড়লেই ভয় লাগে, কখন নায়ক মরল। নায়ক বেঁচে থাকলে হাপ ছেড়ে বাঁচি। আর. আর. মার্টিনের মত নির্মম লেখক বাংলায়ও পেয়ে যাব ভাবিনি।
গল্প চমত্কার, কিন্তু এটা আর আগের গল্পটা একরকম লাগলো।
- অভিমন্যু সোহম

সত্যপীর এর ছবি

একরকম লাগছে? আচ্ছা। একই লোকের জবানী তো সেইজন্য মনে হয়। পরের বার আরো ভ্যারাইটি দিতে চেষ্টা করব বস।

..................................................................
#Banshibir.

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

এই গল্পটার সাইজ ঠিকঠাক মত হয়েছে, পড়ে তৃপ্তি মেটে। কিন্তু দুটি প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব পাওয়া গেল না- সরাইমালিক আহমেদ, আর খলিল মহাজন কবুতর ফারুকের উপর কি কারনে খাপ্পা? আর খাইশটা মানুয়েলকে বাঁচানোর মিশনেই বা ফারুক কেন গেল? রাজার আদেশে?

সত্যপীর এর ছবি

গল্প যেহেতু একজনের জবানীতে তাই দুইপক্ষের মনের ভিতরের খবর গল্পে অপরিষ্কার থাকারই কথা। ফারুক তাই বলবে যা সে জানে। দুই নম্বর প্রশ্ন দিয়া শুরু করি, ফারুকের মিশন কেন অর্থাৎ হোয়াই। তাকে মিশনে পাঠাইছেন রাজা চোগান সিং, পাদ্রী মানুয়েলের উপর তার দিলখুশ। তাই তিনি যখন খবর পাইলেন সুলতান নহবৎ পাদ্রী কিলিং মিশনে হাত দিছেন তখন চোগান সিং ফারুককে মিশন ইম্পসিবলে পাঠান।

এই বার প্রথম প্রশ্ন, আহমেদ আর মহাজন কেন খাপ্পা অর্থাৎ হোয়াই। এইটা সঠিক জানা যায় না। ফারুক জানত পাদ্রী মানুয়েলের উপর হামলা হবে সরাইতে বা গোয়ার পথে, কিন্তু ঠিক কে নহবৎউল্লার লোক তা সে জানে না। হতে পারে মানুয়েলের উপর হামলা হইছে কারণ আহমেদ/মহাজন নহবৎ এর লোক, অথবা তারা হামলা করছে কারণ খলিলের হাত ফুটা করা হইছে।

তবে ফারুকের উপর তারা কেন খাপ্পা? যদি তারা নহবৎ এর লোক হয় তাহলে তারা সন্দেহ করছিল ফারুক মানুয়েলকে বাঁচাইতে আসছে। সেইজন্য খাপ্পা। যদি আহমেদ/মহাজন নহবৎ এর লোক না হয়, তাহলে তারা ফারুকের উপর খাপ্পা এই কারণে হইতে পারে যে সে পাঁচিসি খেলায় মানুয়েলের পার্টনার অর্থাৎ একই দলের লোক। সেইটা কারণ হইতেও পারে।

জটিল দুনিয়া মিয়াভাই।

..................................................................
#Banshibir.

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

হ, দুনিয়া বড়ই জটিল! কবুতর ফারুকের কাহিনীও।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

ভাল্লাগ্ছে পীর্সাব।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

সত্যপীর এর ছবি

আপনের জন্যি সুকবর। হেরেম নিয়ে গল্প আস্তেছে, কবুতর ফারুকের পার্টনার তারাবাঈয়ের জবানীতে। ব্যাপক মসলাদার গল্প নামানোর ধান্দায় আছি, জীবাণুমুক্ত দু'আ দিয়েন।

..................................................................
#Banshibir.

সুবোধ অবোধ এর ছবি

আপনে দেহি আইজ খালি ভালা খবর হুনাইতাছেন। দেঁতো হাসি

তাহসিন রেজা এর ছবি

চমৎকার!!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

সত্যপীর এর ছবি

খাইছে

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক এর ছবি

ঘুম থেকে উঠলাম আবার লাথি খেয়ে। লাথিছাড়া এক সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারলে বড় ভালো লাগত। চতুর্দিকে খালি লাথি।

হিহিহি। রীতিমত দার্শনিক কথা।

গল্প পড়ে অনেক মজা পাইসি। আপনার বই আসতেসে কবে??????? কিনব।

ওয়াইফাই ক্যানসার

সত্যপীর এর ছবি

ইবুকের ধান্দা করতেছি। সুমায় হইলেই খবর পাইবেন।

..................................................................
#Banshibir.

তারেক অণু এর ছবি

কবুতর যা যা যা, নতুন লেখা আয় আয় আয়

সত্যপীর এর ছবি

অইব অইব তাড়া কি। গোয়ান পাউরুটি খানঃ

..................................................................
#Banshibir.

আয়নামতি এর ছবি

এই গল্প পড়ে সেভাবে ডরাইনি কেন জানি। হয়ত কবুতর ফারুক ঠিকই মেরেকেটে বেরিয়ে যাবে এটা জানা বলেই...
কবুতর ফারুক কে কঠিন একটা প্যাচে ফেলে দেন পরের পর্বে। মার মার কাট কাট বেপার সেপার হোক আর কী দেঁতো হাসি

এক বলদ হা-আ-আ-আ আওয়াজ করতে আমার দিকে ছোরা নিয়ে তেড়ে আসছে কানি চোখ দিয়ে খেয়াল করলাম।

আওয়াজ করতে করতে হইলে বেশি জুশ হইত যেন।
ব্যথা' বানানে টাইপো আছে ভাইয়া। 'ঢোলা পাজামার ফিতা...' 'র' হইত কি ওখানে চিন্তিত
তারাবাঈয়ের গল্পটা এ মাসে না দিয়ে জুনের প্রথমদিকে দেন প্লিজ! ঘুরন্তিসে যাবো তু দেঁতো হাসি

সত্যপীর এর ছবি

ধন্যবাদ। করতে করতে, ব্যথা, পায়জামার ঠিক করে দিলাম।

তারাবাঈয়ের গল্প জলদি জলদি আসতেছে না, ভয় নাই। এখনো প্লট খাড়া করিনাই, খালি ঠিক করছি হেরেমের গল্প নামাব তারাবাঈয়ের জবানীতে। মহলের খানাদানার বিশদ বিবরণ দিব ঠিক্কর্ছি চাল্লু

..................................................................
#Banshibir.

সুবোধ অবোধ এর ছবি

কবুতর ফারুক রে ভালু পাই। গল্প সিরাম হইছে ...

সত্যপীর এর ছবি

কইলেন যখন!

..................................................................
#Banshibir.

অনিকেত এর ছবি

ভাই, আপনার গল্প সেইরাম লাগল!! আপ্নে তো পুরাই ভচলুক!!!

সত্যপীর এর ছবি

নিয়মিত ভচকায় যে সেই কি ভচলুক?

..................................................................
#Banshibir.

সাফি এর ছবি

সেইরকম হইছে। পড়ে মজা পাইছি।

সত্যপীর এর ছবি

সাব্বাস। আপনেও গোয়ান পাউরুটি খান তইলেঃ

(দুষ্টলোকের ভয়ে "গোয়ার পাউরুটি" লিখতেই পারিনা, লিখতে হয় "গোয়ান" পাউরুটি ইয়ে, মানে... )

..................................................................
#Banshibir.

স্পর্শ এর ছবি

জম্পেস গল্প! আরো বেশি বেশি ছাড়েন হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

সত্যপীর এর ছবি

অবিশ্যি অবিশ্যি।

..................................................................
#Banshibir.

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

হাততালি ফাটাফাটি হইছে পীরভাই।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

সত্যপীর এর ছবি

হ্যাঁ ফেটে চৌচির!

..................................................................
#Banshibir.

স্যাম এর ছবি

হাততালি হাততালি

সত্যপীর এর ছবি

আপনের পাশে হাততালি দেয় কেডা?

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক এর ছবি

তখন দুধ'চা থাকলে তো 'গোয়ান পাউরুটি' চায়ে ডুবিয়ে সিরাম টেস্ট সহকারে খাইতে পারতো সক্কাল সক্কাল। গপ ভালু পাইছি।

কড়িকাঠুরে

সত্যপীর এর ছবি

নাহ চা পাইতেন না ঐখানে তখন।

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখনীতে চমৎকার নিপুনতা!!!

গল্প বর্ণনার স্টাইলটা বেশ লাগল।।।

--------------------------------------------
--- সোহেল মাহামুদ 0অতি ক্ষুদ্র একজন0
--------------------------------------------

সত্যপীর এর ছবি

হ্যাঁ কবুতর ফারুক অত্যন্ত নিপুণ ব্যক্তি।

..................................................................
#Banshibir.

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আধুনিক যুগে আমাদের আছে মাসুদ রানা। আর মুঘল আমলে ছিল কি কবুতর ফারুক?

হোক না, একটা জম্পেশ সিরিজ হোক কবুতর ফারুককে নিয়ে।

____________________________

খেকশিয়াল এর ছবি

দারুণ লাগলো!

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

সত্যপীর এর ছবি

কইলেই হইল? খাইছে

..................................................................
#Banshibir.

দুর্দান্ত এর ছবি

পাউ মানেও রুটি, আর রুটি তো রুটিই। বিষয়টা অনেকটা "শব এ বরাতের রাত" এর মত।

সত্যপীর এর ছবি

নান মানেও রুটি না? তাইলে নানরুটিরও একই অবস্থা...

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার গল্প। বেশ ভালো লাগলো। ----সাখাওয়াৎ

অর্বাচীন এর ছবি

আমি জুদি ডিরেক্টর হইতাম, আপ্নের গল্প দিয়া নাটুক সিন্মা বানাইতাম। উফ সিরাম হইতো!!! সিরাম হইছে! হাততালি

সত্যপীর এর ছবি

ঐতিহাসিক সেটিংস এ নাটক সিনেমা করা বিপুল বাজেটের ব্যাপার. কম পয়সায় প্যাকেজ নাটকের ডিরেক্টর যাত্রার পোশাক আশাক তলোয়ার দিয়ে দুর্বল নাটক ফিলিম বানাইতে গেলে গল্পের গুরুত্ব হাওয়া হাওয়া এ হাওয়া হয়ে যাবে. গল্পই ভরসা, লিখতে পয়সা লাগেনা. ঐতিহাসিক গল্পের চিত্রায়ন যেকোনো দেশেই অবিশ্বাস্য টাকার ব্যাপার.

..................................................................
#Banshibir.

কল্যাণ এর ছবি

কবুতর ফারুক আইজ থিকা আমার হিরু।

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।