লড়াই ক্ষ্যাপা

সত্যপীর এর ছবি
লিখেছেন সত্যপীর (তারিখ: শুক্র, ০৩/০১/২০২০ - ১২:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মোগল সাম্রাজ্যের ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট বাবুর বাদশার জানপহেচান নেতা ছিলেন তার পূর্বপুরুষ আমীর তৈমুর। তৈমুর সমরখন্দে রাজধানী করেছিলেন, তাই বাবুর বাদশারও স্বপ্ন ছিল সমরখন্দ চেপে বসার। তৈমুর দিল্লীজয় করে ফিরে গিয়েছিলেন তাই বাবুরেরও শখ ছিল দিল্লী লুটে ফের সমরখন্দ বুখারায় ঘরের ছেলে ঘরে ফিরত যাবেন। কিন্তু ম্যান প্রপোজেস গড ডিজপোজেস। সমরখন্দ থেকে সেইযে জুয়ানকালে চড় খেয়ে কাবুল পালাতে হয়েছিল আর ফিরে যাওয়া হয়নি। বাকী জীবন সমরখন্দ জয়ের টাকা ও সিপাই জড়ো করার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে নানাবিধ যুদ্ধমুদ্ধ করতে করতে আঁৎকা অক্কা পেয়ে কাবুলে ঘুম গেলেন বাবুর। রেস্টিনপীস।

ফাস্ট ফরোয়ার্ড সোয়াশো বছর। নাতির নাতি শাজাহানের আমল। কাবুল তখন মোগল সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত, সেখান হতে তিনি পুলা মুরাদ বখশকে আরো পচ্চিমে বলখের দিকে পাঠালেন অভিযানে, রিজার্ভ ফোর্স নিয়ে তৈয়ার ছিল আরেক পুলা আওরঙ্গজেব। অপারেশন সমরখন্দ।

বুড়াদাদা বাবুরের স্বপ্নপুরুষ, আমীর তৈমুরের রাজধানী সমরখন্দ। হাঁটু চাপড়ে শাজাহান কইলেন রাজা বানকে আনা রে। ফির না জানা রে। ছম ছমা ছম ছম।

এস্থলে আমরা সংক্ষেপে মোগল আমলের ভূরাজনীতি নিয়ে কথা পাড়ব। অপারেশন বলখ ও মিশন সমরখন্দ বিষয়টা বুঝতে হলে মোগল জুতা পরে মাইলখানেক হাঁটা জরুরী। মোগল হিসাবে আপনার দুইটা শহরের গুরুত্ব অপরিসীমঃ কাবুল ও কান্দাহার। টুইন সিটিজ। যদু আর বংশীধর যমজ ভাই তারা। দুইটা শহরই বাবুর বাদশা হাত করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। এই দুই ভ্রাতার দখল থাকা মানে মোগল হিসাবে আপনার সাম্রাজ্য নিরাপদ।

১৫০৪ এ বাবুর কাবুল দখল করার পরে (অল্পকিছু বছর হুমায়ুনের হাতছাড়া হওয়া সময় ব্যতীত) একবারে নাদির শা আসা পর্যন্ত পর্যন্ত কাবুল গুরুত্বপুর্ণ মোগল সুবা (রাজ্য/প্রদেশ) ছিল। একক মোগল মালিকানা। অন্য ভ্রাতা কান্দাহার কিঞ্চিৎ দুষ্ট, সে ছিল পিং পং বলের মত। ১৫০৮ এ বাবুর বাদশা কান্দাহার দখল করার পরে তার পুলা হুমায়ুন পাকেচক্রে সেইটা আবার সাফাভিদ শাহের হাতে তুলে দেন। পুত্র আকবর আবার মিষ্টি করে কান্দাহার বাগে নিয়ে আসেন কিন্তু তার পুলা জাহাঙ্গীরের আমলে শহর ফের বেহাত হয়ে সাফাভিদের কান্ধে চলে যায়। সেইখান থেকে বিপুল বিক্রমে কান্দাহার ছিনিয়ে নেন জাহাঙ্গীরের পুলা শাজাহান। পিং পং পিং পং পিং পং।

সাফাভিদ সাম্রাজ্য ছিল পারস্যভিত্তিক, মোগল এলাকার বামপাশে। যদু বংশীধর ছিল সাফাভিদের পূর্ব সীমান্তে। যদু কাবুলে পোক্ত মোগল শাসন হলেও বংশীধর কান্দাহার ছিল দুই সাম্রাজ্যের মাঝামাঝি ভাসাভাসা এলাকা।

১৬৪০ সাল। মোগল গদিতে শাজাহান। উজবেকের হাতে বলখ বুখারা সমরখন্দ। মোগলের হাতে কাবুল ও (সদ্য সাফাভিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া) কান্দাহার। দাঁড়কাকের হাতে পেন্সিল।

ভূরাজনীতি ফিনিশ। অনেক বুঝছি। এইবার মূল গল্প।

বলখে খবর গেল কাবুলে বাদশা শাজাহান হাজারে হাজার সিপাই আর ঘোড়া হাতির আঞ্জাম করেছেন। মধ্য এশিয়ায় উজবেক লিডার নজর মুহম্মদ আর তার ভাই ইমাম কুলি খান তখন বালসুলভ মারামারিতে মত্ত। কাবুলে সিপাইর খবরে মারামারি থামিয়ে তারা ভাবল এইশশালা। এ ব্যাটার মতলব কি। ক্যায়া মতলব? সকলেই জানে ও বোঝে যে বলখ বুখারা আসার রাস্তা শুরু কাবুল থেকে, এ কি তবে মধ্য এশিয়া দখলের তালে আছে নাকি।

বলখে ইমাম কুলিকে মোরাল সাপুট দিতে বুখারা হতে ভাই নজর মুহম্মদ একলাখ সিপাই নিয়ে হাজির হয়ে গেল। মোগলের মায়েরে আন্টি। বলখ তখন যেকোন আক্রমনের জন্য তৈরী। বেগতিক দেখে শাজাহান উজবেককে চিঠি ভেজে কইলেন কেন ভুল বুঝো। বলখ দখলে আসিনাই তো। এই একটু শিকার করতে আসছি। কাবুল হল আমাদের রাজকীয় শিকারখানা। এই আর কি। ভয় নাই। রাজপথ ছাড়ি নাই।

মিছা কথা। আসলে শাজাহান বলখ দখলেই আসছিলেন। মোগল নথিতে লেখা আছে শাজাহান বাদশার অভিপ্রায় ছিল বলখ বদখশান হাতে আনা যা কিনা তাদের “মহান পূর্বপুরুষের রাজত্বের অংশ ছিল”। কিন্তু চামে ঝগড়ারত দুই ভাই লাইনে এসে যাবে আর বলখকে সামরিকভাবে পোক্ত করে তুলবে এইটা শাজাহানের হিসাবে ছিলনা।

এদিকে উজবেক গদির লড়াইতে তারপর নানান গিয়াঞ্জাম। বৃদ্ধ ইমাম কুলি ভাই নজর মুহম্মদকে কইলেন যা তরে দিলাম গদি। তুইই হবি ওয়ারিশ। তস্য ওয়ারিশানগণ মালিক দখলিকার সত্ত্বে অত্র নায়েব সেরেস্তায় দস্ত বদস্ত কায়েম মোকররী পত্তনীপাট্টা অথবা কাওলা কবুলিয়ৎ। নজর তো মহা খুশি।

কিন্তু এই ইমারৎ খেসারৎ দলিল দস্তাবেজের খবরে বুখারায় অনেকে হইল বেজার। যেমন নজর মুহম্মদের ছেলে আবদুল আজিজ। সে কইল রে পিতা। আইজ তর একদিন কি আমার একদিন। ওনলি ওয়ান উইল হ্যাভ টুডে। ১৬৪৫ এর কথা। পুত্রের হুমকিধামকিতে গদির ভয় পেয়ে উজবেক পিতা নজর মুহম্মদ তখন চিঠি ভেজলেন - হাঁ ঠিক ধরেছেন - মোগল শাজাহানকে। চিঠির সারাংশঃ বাঁচাও...বাঁচাও…(রিনরিনে নায়িকা স্বর ইন্সার্টেড হিয়ার)।

নায়ক শাজাহান কইলেন ইয়া ভিশুমাইক! নগদে তিনি পুত্র মুরাদ বখশকে বলখ পাঠিয়ে দিলেন ষাট হাজার সিপাই সহকারে। নজর তুমি এগিয়ে চল। আমরা আছি ইত্যাদি। শাজাহান পচুর চিঠি পাঠিয়ে বুঝালেন নজর। আমরা তো আছিই। বলখের রাজত্ব এমনকি বুখারা সমরখন্দের রাজত্বও নাহয় পাইয়ে দেব আবার। সকল ধরনের সাহায্যে আমরা আছি।

নজর মুহম্মদ পুরাতন পল্টিশিয়ান। তিনি এই অঢেল ও সুপ্রচুর মোগল সাহায্য ভুরু কুঁচকে ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্য করতে থাকলেন এবং নিজে উল্টাসিধা হিসেব করে শেষে বুঝলেন সব ঝুট হ্যায়। নিজের দরবারে মোগল দূতকে বললেন মুরাদ বখশ আসলে তার হাতে শহরের চাবি দিয়ে আমি বরঞ্চ হজ্বে যাবগা। আর কাবুল হয়ে যাব যেন শজাহানকে সালাম ও আতর দিতে পারি।

কিন্তু তারপর?

মুরাদ বখশের সেনাপতি রুস্তম খাঁ বলখে ঢুকার অল্প আগে নজর মুহম্মদ দিলেন কাট্টি। কাবুল হয়ে শাজাহানের পা চুমে হজ্বে যাবার বদলে মারলেন পচ্চিমদিকে দৌড়। শাজাহান সে খবরে নজরকে চিঠি ভেজে কইলেন আহা মুরাদের এরকম তাড়াহুড়া করে শহরে ঢোকা কিন্তু একদম ঠিক হয়নি। আমি তাকে বকে দিচ্ছি। তাই বলে বুঝি পচ্চিমে যেতে হয়? বোকা ছেলে। সমরখন্দ জয়ের জন্য গেলে আমাকে বললেই হত, কত সিপাই ঘোড়া লাগে আমি দিচ্ছি।

পাঠক, শাজাহানের কথার চটকে প্রতারিত হইবেন না। নজর মুহম্মদ সঠিক। শাজাহান যতই পুটুপুটু বকা দিন না কেন যে ছেলের গোস্তাকি হয়েছে তাড়াহুড়া করে বলখ ঢোকর জন্য, এর সাথে এইটাও সত্য যে মুরাদের বলখ প্রবেশের সংবাদে শাজাহান কাবুলে আটদিনব্যাপী উৎসবের হুকুম দেন! টাকা কি গাছে ধরে যে যেকোন আজাইরা শহর দখলের সংবাদে আটদিনব্যাপী গানাপিনা চলবে? ককখনো নয়। শাজাহানের চোখে বলখ দখল তিমুরিদ বংশের স্বপ্ন বুখারা সমরখন্দ জয়ের পথে এক ধাপ। নজর মুহম্মদ বড়জোর শাজাহানের চোখে বলখের সুবাদার, এর বেশী কিছু নয়।

নজর মুহম্মদ পালিয়ে পারস্যে সাফাভিদ দরবারে গিয়ে কইলেন বাঁচাও...বাঁচাও…(রিনরিনে নায়িকা স্বর ফের ইন্সার্টেড হিয়ার)।

চোখ ফিরাই বলখে। যদিও মোগল বাহিনী বিনা প্রতিরোধে শহর দখল নিয়েছিল, যুদ্ধজয়ের আনন্দ ছিল অনুপস্থিত। সিপাইরা অখুশি, বৈরী আবহাওয়া। শহরবাসীরা বিয়াদপ। মুরাদ বখশ দুইবার চিঠি ভেজে পিতা শাজাহানকে অভিযোগ করে হে পিতা। বড় ঠান্ডা আর পাহাড়পর্বত। কিসব বালের এলাকা। দ্যাশে যাইতে চাই আব্বা। দ্যাশে যাইবার দেন।

পিতা শাজাহানের কড়া বারণ সত্ত্বেও শেষে মুরাদ বখশ নিজেই বলখ থেকে চলে গেলে তিনি পাঠান সেজো ছেলে আওরঙ্গজেবকে। শাজাহান নিজে তখন লাহোরে। নজর মুহম্মদের বিদ্রোহী পুত্র আবদুল আজিজ বুখারা থেকে বলখ সিপাইসান্ত্রী নিয়ে শহরের বাইরে আওরঙ্গজেবের সাথে তুমুল ফাইট লাগিয়ে দিল।

কোন লাভ হইল না।। মোগল বাহিনী প্রধান আওরঙ্গজেব সেই ফাইটে উজবেক আবদুল আজিজকে এক্কেরে যাকে বলে হোতায়ালাইল।

কিন্তু সুখ নাইরে পাগল। কাবুলে বসে শাজাহান কইলেন আওরঙ্গজেব। বাবা আওরঙ্গ। বলখ তো ব্যাপখ। এইবার আস্তে আস্তে উত্তরে যাউ বুখারার দিকে। আওরঙ্গজেব ও তার বাহিনী সেই নির্দেশে মাথা নেড়ে ঘন ঘন অসন্তোষ প্রকাশ করল। শীত আসছে তখন। ধীরে ধীরে। এই ভয়ানক শীতের সাথে মোগল ভারতের সিপাই সান্ত্রীর পরিচয় নেই। তাযকিরা-ই মুকিম খানি তে ১৬৪৬-৪৭ এর শীতের বর্ণনা আছেঃ “সিপাইরা নিজেদের জন্য জ্বালা আগুনে নিজেরাই পুড়ে যেত, কেউ ঘর থেকেই বেরুত না জমে পাথর হয়ে যাবার ভয়ে।” এইরকম কড়া ঠাণ্ডায় শীতের সাথে অপরিচিত ভারতীয় বাহিনী ধেয়ে যাবে উজবেকের হাত থেকে সমরখন্দ দখলে এই গপ্পো হজম করা কঠিন। সুতরাং মোগল বাহিনী কমান্ডার ইন চীফ শাজাহানকে কইলেন বস। নো ক্যান ডু। এই বালছাল উজবেক জায়গায় সময় নষ্ট করা অর্থহীন। চলে আসি বরং কেমন?

দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে শাজাহান কইলেন ঠিকাছে তবে। আওরঙ্গজেব নজর মুহম্মদকে চিঠি দিয়ে খবর পাঠালেন সুখবর। আইস বলখ, ভয় নাই। নিজের বলখ আমরার হাত থেকে বুঝে নিয়ে যাও, আমি ঘরের ছেলে ঘরে ফিরত যাচ্ছি।

নজর মুহম্মদ সুচতুর শিয়াল। তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন এইভাবে বলখ নিতে গেলে পাব্লিকের কাছে রটে যাবে নজর মুহম্মদ এখন মোগল সুবাদার বৈ কিছু নয়। তিনি এই পেটে ব্যথা, অর্শ্বের বেদনা, পাতলা পাইখানা ইত্যাদি নানান কথায় আসি আসছি করে আর বলখ আসেন না। বিরক্ত হয়ে আওরঙ্গজেব ১৬৪৭ এ ভারত পানে রওনা দেন। আসার পথে নানান আফগান গোত্র মোগল বাহিনীকে উৎপাতের মধ্যে রাখে আর হাজার হাজার সিপাই শীতে বা মারপিটে মারা যায়। যুদ্ধে ততদিনে খরচ গিয়েছে নগদ চার কোটি রুপী, বদলে হাতে এসেছে কাবুল থেকে অল্প দূরের খাচ্চর এলাকা বলখ যার বাৎসরিক ইনকাম ৭০ লক্ষ রুপীর বেশী নয়। বুখারা সমরখন্দ দূর অস্ত। কোটি কোটি টাকা খর্চা করে দুনিয়ার ঐপারে পূর্বপুরুষের জমির পুনর্দখলের চেষ্টা আপাততঃ মুলতবি রেখে লড়াই ক্ষ্যাপা বাদশা শাজাহান বের করলেন তার হিসেব লেখার খাতা।

ভীষণ লড়াই হল। পাঁচ ব্যাটাকে খতম করে শাজাহান দাদা মোলো।


মন্তব্য

Emran  এর ছবি

এইতো আসছেন! এতদিন কোথায় ছিলেন?

যতদূর মনে পড়ে, আওরঙ্গজেব বলখ থেকে ফিরে আসায় শাহজাহান তার উপর খুব একটা খুশী হন্নাই। দাক্ষিনাত্যে সুবাদার হিসাবে আওরঙ্গজেবের নিয়োগ কি বলখ অভিযানের আগে না পরে?

সত্যপীর এর ছবি

চা খাইতেছিলাম। বুঝেনই তো।

দাক্ষিণাত্যের গভর্নর আওরঙ্গজেব বলখ অভিযানের আগেও আছিলেন পরেও হইছিলেন। বলখ অভিযানের ঠিক আগে দিয়া ছিলেন গুজরাতের সুবাদার। সেইখানে আহমেদাবাদে এক জৈন মন্দিরে গরু কুরবানি দিয়া ব্যাপক গিয়াঞ্জাম পাকাইছিলেন শুনা যায়। যাক সে ভিন্ন গপ।

বলখের কোন লং টার্ম ভবিষ্যত নাই এইটা শাজাহান জানতেন। বলখ বুখারা অভিযান পূর্বপুরুষ বাবুরের ইচ্ছার সম্মানে আজাইরা আবেগী পয়সাখরচ ছাড়া কিছুনা, তাই ফিরে আসার আবদারে মুরাদ বখশ আওরঙ্গজেব দুই ছেলের উপরেই শাজাহান বিরক্ত ছিলেন কিন্তু চাপ দেন নাই।

আর যতই বিরক্ত হন এই কথা তিনি জানতেন মিলিটারি কমান্ডার হিসাবে তার চার ছেলের মধ্যে আওরঙ্গজেবই এক নম্বর। আওতঙ্গজেব যখন দাক্ষিণাত্যে শক্তি বাড়াচ্ছিলেন বা পশ্চিম সীমান্তে উজবেক সাফাভিদের হাত থেকে অল্প অল্প করে বিবিধ এলাকা কব্জা করছিলেন, দারা তখন চিকন চালের বিরিয়ানি খেতে খেতে আগ্রায় দর্শনচর্চায় বেছত।

..................................................................
#Banshibir.

Emran  এর ছবি

শাহজাহানের চার ছেলের মধ্যে আওরঙ্গজেব শুধু ময়দানের যুদ্ধে না, ময়দানের বাইরে রাজনীতির যুদ্ধেও ছিলেন এক নম্বর! দারা সারা জীবন শাহজাহানের পাশে থাকার পরেও রাজনীতি শিখে নাই বইলে দরকারের সময় তার পাশে কাউরে পায়নাই। আওরঙ্গজেব খালি একটা জিনিস বুঝে নাইঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাবলিকরে খেপায়ে ভারতের মত দেশে টিকে থাকা সম্ভব না।

কাউনটার-ফ্যাকচুয়াল থট এক্সপেরিমেন্টঃ দারা সম্রাট হইলে কী হইতে পারিত?

সত্যপীর এর ছবি

এটি একটি অপেক্ষাকৃত জটিল প্রশ্ন। দারা সম্রাট হইলে কী হইতে পারিত। মন্তব্যের পাতলা ঘরে এই প্রশ্ন পূর্ণ সামাল দেওয়া জটিল। তবে মন মাঝি ভাইর স্টাইলে লম্বা একটা প্রতিমন্তব্যের চেষ্টা করা যায়।

আওরঙ্গজেব একজন প্রথম শ্রেণীর সেনাপতি, শিখ দাক্ষিণাত্য মারাঠা আফগান সকলের সাথে লড়াই করে মোগল এলাকা বাড়িয়ে গিয়েছেন। দারার হাতে মোগল ভারত থাকলে তার আয়তন অপেক্ষাকৃত ছোট থাকত। দাক্ষিণাত্য দূর্গম এবং অপেক্ষাকৃত দরিদ্র, দারা সম্ভবত এই এলাকা তার মত করে থাকতে দিতেন। ভারতের পশ্চিম সীমান্ত দারার আমলে সাফাভিদ বা আফগানদের হাতে রয়ে যেত বলে ধারণা করি। আওরঙ্গজেব একলা হাতে শিখদেরকে শান্তিপ্রিয় জাতি থেকে যোদ্ধা জাতিতে পরিণত করে গেছেন, দারার আমলে কী হত বলা মুস্কিল। আমার ধারণা শিখদের সাথে দারার ঝালমিষ্টি দোস্তি থাকত।

কিন্তু, এই কথাও সত্যি দারা গোঁড়া মুসলমানের মাথা গরম করে ছাড়তেন, যেরকম আকবর করে গিয়েছিলেন। ভিন্ন ধর্মের সাথে মাখামাখি এবং দ্বীন ই ইলাহি বালছাল দেখে বাদাউনি এবং সেই রকম কট্টর মুসলমানেরা যেরকম দাঁত কামড়াকামড়ি করে গিয়েছিল তার তাত সামাল দেওয়ার মত কূটনীতিক বুদ্ধি, সাহস এবং ভাগ্য কেবল আকবরেরই ছিল। চিকন চালের বিরিয়ানি খেয়ে বড় হওয়া দারা শিকো সেই তাত সামাল দিতে পারতেন না বলে ধারণা করি এবং দেশে একটা বড় ধরনের গণ্ডগোল লাগার উচ্চ সম্ভাবনা ছিল। কী ধরনের গণ্ডগোল এবং কারা তাতে ইন্ধন দিত, শেষমেষ কে জিতত এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আরো কিছু পড়াশোনা প্রয়োজন দেখে ক্ষান্ত দিলাম আপাতত। তবে দারা সকলের সাথে তান দিয়ে সুখে দেশ চালাতেন এবং দারা দি গ্রেটার (এবং পরবর্তীতে তার পুলা সুলেমান দি ম্যাগ্নিফিসেন্ট অব দি ইস্ট) হইতেন এই গল্পে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। আমার ধারণা দারা বেশীদিন শান্তিমত দেশ চালাইতেই পারতেন না, দেশের এলাকা প্রসারণ তো দূরের কথা।

আওরঙ্গজেব দেশটাকে বড় করে দিয়ে গেছেন এই কথা সত্যি, তবে দেশকে তার সাথে দেউলিয়াও করে গেছেন। তার জীবনের শেষদিকে খাজাঞ্চীখানা হাঁ করে বসে থাকত বাংলা থেকে কবে রাজস্ব আসবে আর তার টাকা দিয়ে কবে দাক্ষিণাত্যের বিল মেটানো যাবে। আওরঙ্গজেবের আমলের ক্যাশ ফ্লো ছিল ভয়ানক টাইট। দারা যেহেতু মুসলমানদের উপর কর কমাতেন না এবং বিবিধ (আওরঙ্গজেবের মতে শরীয়া বিরোধী) কর তুলে দিতেন না, তার আমলে দেশ অশান্তির মধ্যে থাকলেও আমার ধারণা খাজাঞ্চীখানা শান্তিতে থাকত এবং তিনি সুখে (স্বল্পদিন) চিকন চালের মূল্য পরিশোধ করতে পারতেন।

মনসবদারি প্রথা সম্পূর্ণ বাদশার হাতে ছিল এবং সঠিক লোককে সঠিক মনসব জায়গির না দিলে বাদশাহী লাটে উঠত। আওরঙ্গজেব এক হাতে এলাকা বাড়িয়ে গেছেন এবং কঠোরভাবে রাজনৈতি ফায়দা হাসিলের জন্য সঠিক মনসব প্রদনা করতেন বা কেড়ে নিতেন। এই প্রজ্ঞা ও ঠাণ্ডা মাথার খুনে মনোবৃত্তি (কিলার ইন্সটিঙ্কট) দারার ছিলনা বিধায় তিনি ভুল লোককে তোষামোদ বা কবিতা উপনিষদ তর্জমার বিনিময়ে জায়গির বিলিয়ে বেড়াতেন, যে কারণে বিপদজনক ব্যক্তি দেশের বিভিন্ন কোণ থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো অথবা দারার বিপক্ষে কামান ফিরাত। ফলাফল টলটলায়মান গদি।

আকবরের আমলে মনসবদার আর আওরঙ্গজেবের আমলে মনসবদারের মধ্যে পার্থক্য দুই তিন জেনারেশনের ঘি। এই দুই জেনারেশন ঘি মাখন খেয়ে অভ্যাস হওয়া মনসবদারেরা পাছায় আওরঙ্গজেবের বেত খেয়েও যেরকম অযোগ্যতার প্রমাণ রেখে গেছে (আওরঙ্গজেব এক চিঠিতে লিখে গেছেন আকবর ডাইনে বাঁয়ে কত যোগ্য সেনাপতি পেয়েছেন আর আমি এক বাংলায় বসানোর জন্য একটা ভালো লোক খুঁজে পেলাম না...) তারা চিকন চালের বিরিয়ানি খেয়ে বড় হওয়া দারার আমলে আরো অপদার্থতার পরিচয় দিত এতে কোন সন্দেহ নেই।

সব দিক বিবেচনা করে আমার মনে হয় দারা খুব বেশিদিন দেশ চালাতে পারতেন না, মোগল গদি তার হাতছাড়া হয়ে যেত অন্য কোন মোগলের হাতে, কিম্বা হয়তো হুমায়ুনের মত মোগল বংশের বাইরের কারো হাতে সাময়িক ভাবে।

(উপরের হিসাবে ইউরোপীয় শক্তির সাথে দারার বাদশাহির সম্পর্ক ইচ্ছে করে বাদ দিয়ে গেলাম। সেইটা আরেকটু লম্বা পরিসরের দাবী রাখে। আওরঙ্গজেব যেরকম ইংরেজ ও অন্যান্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাগা ছুটিয়ে দিয়েছিলেন সেইটা দারা করতে পারতেন কিনা বা করলে রেস্পন্স কিরকম হত সার্বিক বিচারে সেইটা আরেকটু পড়াশোনার বিষয়)

..................................................................
#Banshibir.

মন মাঝি এর ছবি

পীরছাহেব ভাই, আমার লম্বা প্রতিমন্তব্যের "ইশ্টা‌ইলটা" কিন্তুক পেটেন্ট করা। সুতরাং খুপ খিয়াল কৈরা! ইটা নকল করতে হইলে কিন্তু রয়াল্টি দেওন লাগবো!!! তবে ফার্স্ট টাইম অফেন্ডার হিসাবে এইবারের মতো মামলা-মোকদ্দমা না কইরা আপনারে মাপ কইরা আউট অফ কোর্ট লঘুদণ্ড দিলামঃ আমার আন্তর্জাতিকভাবে পেটেন্টকৃত "ইশ্‌টাইল" নকল করার অপরাধে এই সচলায়তনে আপনি জনাব সত্যপীর আগামি ১ সপ্তাহের মধ্যে কবুতর ফারুকরে নিয়া একটা জম্পেশ গল্প দিবেন!!! যথাসময়ে এই জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হইলে আপনার উপর উপন্যাস রচনার খড়গ নামিয়া আসিবে!!! ইয়েস বাঘ মামা, ইয়েস!!!

****************************************

সত্যপীর এর ছবি

ব্যাপক ডরাইলাম। চা খাইতেছি, আরেকটু ভাইবা দেখি আপনের হুমকি প্রস্তাব...

..................................................................
#Banshibir.

Emran  এর ছবি

প্রতিমন্তব্যে গুরু গুরু

আমার মতে দারার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি রাজত্ব করার সুযোগ পাননি; ফলে তাঁর ধর্মীয় উদারনৈতিক মনোভাবকে ভিত্তি করে তাঁকে নিয়ে কিছু মিথ গড়ে উঠেছে।

সত্যপীর এর ছবি

সাক্সেশন বলে এইচ বি ওর একটা অসাধারন টিভি সিরিজ আছে। সেইখানে এক বিলিওনিয়ার সিইও লোগান রয়'র মেজো ছেলে কেবল বাপের গদি দখল করতে গিয়ে হেরে যায়। এক পর্যায়ে সে বাপকে জিজ্ঞাসা করে টেল মি। ডু ইউ থিঙ্ক আই কুড ডু ইট? কাম অন, ইউ ক্যান টেল মি।

বাপ একটু থেমে উত্তর দেয়, ইউ আর স্মার্ট। গুড। বাট ইউ'র নট এ কিলার। ইউ হ্যাভ টু বি এ কিলার।

দিনশেষে লোগান রয়ের কথাই আমার কথা। দারা শিকো ওয়াজ নট এ কিলার। ১৬৫৮ এর মোগল ভারত তার প্রাপ্য ছিল না।

..................................................................
#Banshibir.

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

দারাশিকো আওরংগজেবের মত ঠান্ডা মাথার কিলার ছিল না, ঠিক আছে(যেহেতু সে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও আওরংগজেবের সাথে যুদ্ধে হেরে প্রাণ হারিয়েছে)। কিন্তু আওরংগজেব অমন ক্ষুরধার মস্তিস্ক নিয়েই বা কী ছালডা ছিলেছে? পার্বত্য মূষিক শিবাজীর কাছে বারংবার নাস্তানাবুদ হয়ে ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রনা লাভ করে মৃত্যুবরন করেছে। শান্তিপ্রিয় শিখদের ভয়ঙ্কর যোদ্ধায় পরিণত করে মোগল তথা মুসলমানদের জন্য চরম বিপর্যয়ের সূচনা করেছে। চৌকস রাজপুতদের আনুগত্যে চিড় ধরিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বাংলায় ইংরেজদের অবাধ বানিজ্যের লাইসেন্স দিয়ে তাদের সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হওয়ার বন্দোবস্থ করে গেছে। বাংলায় প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য একজন যোগ্য লোক পাওয়া যায় নি বলে যে হা হুতাশ করেছে, সেটাও স্রেফ রাবিশ কথাবার্তা। তার আমলের মুর্শিদ কুলি খাঁ'র মত যোগ্য এবং বিশ্বস্ত প্রশাসক সারা মোগল ইতিহাসে খুব কমই পাওয়া গেছে। দারাশিকো সম্রাট হলে যে রকম অসন্তোষ ও অরাজকতার আশঙ্কা করেছেন, আওরংগজেব সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে চরম নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে মোগল সাম্রাজ্যের ক্ষতি তার চেয়ে বেশিই করেছে, যার মাসুল দিতে হয়েছে পরবর্তী শাসকদের। মোটের উপর মোগল সাম্রাজ্য ধ্বংসের বীজ বপন আওরংগজেবই নিজ হাতে বপন করেছে এবং তার মাধ্যমে সে এটাই প্রমান করেছে যে মোগল সাম্রাজ্যের ভার বহন করার মত যোগ্যতা তার ছিল না। পক্ষান্তরে দারাশিকো আর যাই হোক, জাহাঙ্গীরের চেয়ে অধিক অপদার্থ নিশ্চয় ছিল না। তা হলেও হয়ত পরিস্থিতিটা মোগলদের জন্য অধিকতর সুখকর হতে পারতো।

Emran  এর ছবি

মুসলমানেরা ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘু সরকার হিসেবে ভারতবর্ষ শাসন করেছে। যতদিন তারা সঙ্খ্যাগুরু জনগণের সঙ্গে একটা কার্যকর সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে, ততদিন রাজত্ব করতে তাদের সমস্যা হয়নি। নিজের ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে রাজনীতিকে পৃথক করতে না পারায় আওরংগজেব এই কার্যকর সম্পর্কের স্থিতাবস্থাকে ধ্বংস করে দেন। এটা রাজনীতিক এবং প্রশাসক হিসেবে তাঁর ব্যর্থতা।

সত্যপীর এর ছবি

পক্ষান্তরে দারাশিকো আর যাই হোক, জাহাঙ্গীরের চেয়ে অধিক অপদার্থ নিশ্চয় ছিল না।

ঘন ঘন মাথা নেড়ে সমর্থন জানাইলাম। কথায় যুক্তি আছে।

দারা শিকো গদিতে আসলে আওরঙ্গজেবের থেকে শান্তিতে দেশ থাকত এই কথা ঠিকই আছে। আমি উপরে কেবল বললাম দারা বাদশা হইলে দেশ এক লাফে এগিয়ে যেত আর আকবর দ্যা গ্রেটের পরে দারা দ্যা গ্রেটার হইত এই গপ ভিত্তিহীন, আমার ধারণা দারার ১৬৫৮ এর মোগল ভারত চালানোর ব্যক্তিত্ব ছিলনা। আকবর ওয়াজ এ কিলার, সো ওয়াজ আওরঙ্গজেব। দারা ওয়াজ জাহাঙ্গীর এট বেস্ট।

এই আর কি।

..................................................................
#Banshibir.

এক লহমা এর ছবি

হাততালি
লড়াই ক্ষ্যাপা বাদশা শাজাহান শেষ বেলায় হাত মুখ ধুয়ে ফেলে প্রেমের অবতার রূপ ধারণ কল্লেন। আর তার লড়াই-দার ছেলে তারে জেলে ঢুকায় দিল। দুনিয়া বড়ই হতচ্ছাড়া জায়গা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সত্যপীর এর ছবি

হ, কুথায় বুখারা বদখশানে চইষা বেড়ায়া তৈমুর নম্বর টু হইবেন আর পূর্বপুরুষ বাবুরের যোগ্য উত্তরসুরি হিসাবে দুনিয়ার রাজা শাহ ই জাহান হইতে পারবেন, তার বদলে উজবেক আর আবহাওয়ার কাছে চড় খায়া বাড়ি ফিরত আসতে হইল। ইন্সাফ নাই।

..................................................................
#Banshibir.

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

পাদটিকাঃ কাবুল হইতে ফিরিবার পথে সাজাহান সাবে কইলেন- হালায় ব্যাক্কলের মত এ্যাকখান কাম কইরা ফালাইছি।

সত্যপীর এর ছবি

বাবুরের মধ্য এশিয়া জয়ের খায়েশ হুমায়ুন থেকে আওরঙ্গজেব সকলেরই ছিল। হুমায়ুন আর শাজাহান চেষ্টা কইরা চড় খায়া বলখ থেকে ফিরত আসছিলেন, আর বাকিরা মনে মনে চাইছিলেন কিন্তু যুইৎ করে আক্রমণ করার সময় সুযোগ হয়ে উঠেনাই।

..................................................................
#Banshibir.

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

শিরোনাম পড়ে কেবলি মনে হচ্ছে বাদশা সাজাহান ওই জরির জামা আর পুঁতির মালাটালা পরে, ক্যাপ্টেন হ্যাডকের (বোম্বেটে জাহাজ) মতন করে জটায়ু স্টাইলে বাঁইবাঁই করে তলোয়ার ঘোরাচ্ছেন! দেঁতো হাসি

ওয়েল্কাম্ব্যাক, সত্যপীর। দুয়াটুয়া কইরা ফুঁক দ্যান, মুইও য্যান ওয়েল্কাম্ব্যাক্কর্বার্পারি। ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মন মাঝি এর ছবি

আমি দু'আ করি আপনি শুধু ওয়েল্কাম্ব্যাক না, এক্কেবারে যেন হোয়েল (whale) হৈয়া হোয়েল্কাম্ব্যাক্কর্বার্পারেন!!! লেখালেখির ব্লু হোয়েল আরকি! হাসি

****************************************

সত্যপীর এর ছবি

এই দিলাম ফুঁ।

..................................................................
#Banshibir.

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একটা বিষয় নিয়ে জীবনে বহুবার লোকজনের সাথে নিষ্ফলা তর্ক করতে হয়েছে। সেটা হচ্ছে, মুঘলরা ভারতীয় ছিল কিনা। আমার কথা হচ্ছে, কয়েক পুরুষ ধরে ভারতে থাকলেও এবং কয়েক পুরুষ ধরে ভারতীয় মায়ের গর্ভে জন্মালেও মুঘলরা মননে মধ্য এশীয় রয়ে গিয়েছিল। এক অবশ্যমান্য ওসিয়তের মতো মুঘল সম্রাটেরা বার বার ভারতকে মধ্য এশিয়ার সাথে জুড়বার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছে। তুরস্ক, তুর্কীস্তান আর পারস্য থেকে সৈন্য-সেনাপতি-আমলা-প্রশাসক-শিল্পী-কারিগর-বুদ্ধিজীবি-ধর্মবেত্তা আমদানী করে ঔপনিবেশিক প্রভুদের মতো ভারতবর্ষের বিশাল ভূমি শাসন-শোষন করে গেছে। মুঘল শাসন ভারতীয়দের শাসনকাল নয়, ঔপনিবেশিক শাসনকাল। বিশেষত বাংলার ক্ষেত্রে মুঘলরা নির্দয়, নির্মম, বহিরাগত, ঔপনিবেশিক শোষক ছাড়া আর কিছু না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

Emran  এর ছবি

মুঘল-পূর্ব মুসলিম রাজবংশগুলিকে আমার কাছে অনেক বেশী "ভারতীয়" মনে হয়। তারা অন্ততঃ ভারতে থেকেও সমরখন্দ-বুখারার স্বপ্ন দেখেনি।

তুরস্ক, তুর্কীস্তান আর পারস্য থেকে সৈন্য-সেনাপতি-আমলা-প্রশাসক-শিল্পী-কারিগর-বুদ্ধিজীবি-ধর্মবেত্তা আমদানী করে ঔপনিবেশিক প্রভুদের মতো ভারতবর্ষের বিশাল ভূমি শাসন-শোষন করে গেছে।

একথা আমার মনে হয় ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতের সকল মুসলিম রাজবংশের ক্ষেত্রে কমবেশী প্রযোজ্য। আসলে ব্যাপারটা হল শ্বেতাঙ্গরা অশ্বেতাঙ্গদের ভূমি দখল না করলে সেটাকে উপনিবেশ বলে মনে করতে লোকের বাধে। আরবরা ইরান এবং মিশর দখল করে সেখানে একধরণের সাংস্কৃতিক গণহত্যা চালিয়েছে; অথচ কেউ বলবে না যে ইরান এবং মিশর ছিল আরবদের উপনিবেশ!

সত্যপীর এর ছবি

মনে মনে পত্যেক মোগল বাদশা মধ্য এশিয়ার গদি দখল করতে চাইলেও আকবর ও তার পরবর্তী বাদশাদের উজবেক ডাইকা লাভ নাই। যে মানুষগুলা ভারতে জন্মায় ভারতে সারাজীবন ছড়ি ঘুরায়ে শেষমেষ ভারতেই অক্কা পাইল, সমরখন্দে বাপদাদার হিস্যার গল্পে তাদের সিটিজেনশীপ পাল্টায় না।

বাংলার হিসাব আলাদা, সেইখানে তারা বহিরাগত গণ্য হইতেই পারেন।

..................................................................
#Banshibir.

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আকবর ও তার পরবর্তী বাদশাদের উজবেক ডাইকা লাভ নাই

কিঞ্চিত দ্বিমত পোষণ করি। কয়েক পুরুষ ধরে ভারতীয় মায়ের গর্ভে জন্মে, ভারত শাসন-শোষন করে, ভারতে মরেও মুঘল শাসন ঔপনিবেশিক শাসন কীভাবে? এর উত্তরটা মুঘলদের শাসন পদ্ধতিটা খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন।

উপরে আমি বলেছি, "তুরস্ক, তুর্কীস্তান আর পারস্য থেকে সৈন্য-সেনাপতি-আমলা-প্রশাসক-শিল্পী-কারিগর-বুদ্ধিজীবি-ধর্মবেত্তা আমদানী করে ঔপনিবেশিক প্রভুদের মতো ভারতবর্ষের বিশাল ভূমি শাসন-শোষন করে গেছে"। অর্থাৎ, যত শতাব্দী পার হোক মুঘলরা ভারতীয়দের আস্থায় নেয়নি বলে তারা ভাড়াটে লোক দিয়ে রাষ্ট্র চালিয়েছে। আর দশটা ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো শিল্প, স্থাপত্য, রন্ধনপ্রণালী, পোশাক ও আচারে মুঘলরা স্থানীয় ধারাকে গ্রহন না করে নিজেদের মননে থাকা সংস্কৃতির ধারাকে চালিয়েছে। কাঁচামাল ও পেশাদারের অভাব এবং আবহাওয়াজনিত কারণে সেখানে স্থানীয় অনেক কিছু মিশে যেতে পেরেছে কিন্তু তার পরেও সেটা আমদানীকৃত ধারা।

মুঘলরা ভারতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেষ্টা করেনি। শের শাহ্‌ তাঁর ৭ বছরের শাসনামলে যতটুকু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছিলেন ৩১৬ বছরের মুঘল শাসনে সেই তুলনায় প্রায় কিছুই হয়নি। মামলুক আমলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ও সংস্কার যতটুকু হয়েছিল মুঘল আমলে তা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক প্রভুদের মতো শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা বাইরের একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে গেছে। অথচ কর্মক্ষেত্রে, যুদ্ধক্ষেত্রে, ব্যবসা-বাণিজ্যে সাধারণ লোকজন লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে হিন্দুস্থানী ভাষা ব্যবহার করত, ফার্সী নয়।

উপনিবেশ মানেই ইউরোপীয়দের মতো সব কিছু লুট করে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়া নয় - সেটা আপনিও জানেন। যে যুক্তিতে সাফাভিদরা দক্ষিণ-পশ্চিম তুর্কিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে, এবং চীনারা পূর্ব তুর্কীস্তান ও মঙ্গোলিয়ায় ঔপনিবেশিক শাসক সেই একই প্রকার যুক্তিতে মুঘলরা ভারতে ঔপনিবেশিক শাসক। পার্থক্যটা শুধু এই জায়গাতে যে ফরগানার সাথে মুঘলদের ভৌগলিক যোগাযোগটা কাটা পড়েছিল।

দাক্ষিণাত্য, গুজরাট, রাজপুতণা, মহারাষ্ট্রসহ মুঘল ভারতের অধিকাংশ জায়গাতে তাদের আচরণ বাংলার সাথে আচরণের অনুরূপ। তাহলে যে যুক্তিতে বাংলা মুঘল উপনিবেশ হয় সেই একই প্রকার যুক্তিতে দাক্ষিণাত্যও মুঘল উপনিবেশ হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সত্যপীর এর ছবি

সমস্ত যুক্তি মন দিয়া কয়েকবার পড়লাম, কিন্তু পুরা সম্মতি দিতে পারলাম না। একে একে আসি।

পার্থক্যটা শুধু এই জায়গাতে যে ফরগানার সাথে মুঘলদের ভৌগলিক যোগাযোগটা কাটা পড়েছিল।

এইটা বড় ভয়ানক পার্থক্য। কেবল ভৌগলিক না তাদের সামরিক রাজনৈতিক সমস্ত যোগাযোগই কাটা গেছিল, কেবল কূটনৈতিক যোগাযোগটা ছিল। ফরগনা সমরখন্দের লোক মোগলদের কোন হিসাব নেয় নাই তো। বিতাড়িত দেশহীন মানুষ আরেক দেশে গিয়ে ছড়ি ঘুরাইলে তাকে কি কলোনি ডাকা যায়?

আকবর হতে আওরঙ্গজেব সকলেরই মনে ইচ্ছা ছিল মধ্য এশিয়ায় ফিরত গিয়ে গদি দখল করা, কিন্তু ইচ্ছায় চিঁড়া ভিজে না। তারা কেউই কিছু হাতে কলমে করে উঠতে পারেন নাই। যদি সত্যই সমরখন্দ কি বুখারা দখল করতে পারতেন (সেইক্ষেত্রে তাদের রাজধানী সমরখন্দ হইত না উত্তর ভারত সেইটাও একটা কথা) তাহলে বিতর্কের আরো অবকাশ ছিল। পুরাটাই তো হাওয়াই স্বপ্নভিত্তিক, আদি ও আসল উজবেকিস্তানের সাথে তাদের সম্পর্ক নাই কোন।

উপনিবেশ মানেই ইউরোপীয়দের মতো সব কিছু লুট করে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়া নয়

আকবর টু আওরঙ্গজেবের নিজের দেশ ফরগনা না। ফরগনা বাবুরের দেশ। সব লুট করে নিয়ে যাওয়ার মত একটা দেশ তো থাকা চাই!

যে যুক্তিতে বাংলা উপনিবেশ হয় সেই যুক্তিতে দাক্ষিণাত্যও হয় এই কথা ঠিক আছে। কিন্তু সেই যুক্তিতে উত্তর ভারত আগ্রা দিল্লী লাহোর আর উপনিবেশ থাকেনা।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন না করার পিছনে ঔপনিবেশিক কারণ নাই বলে মনে করি। মূল কারণ হইতে পারে যে মোগলেরা স্বার্থপর অত্যাচারী শাসক ও শোষক। নিজেদের ছাড়া তারা কিছু হিসাবে গোনে নাই।

..................................................................
#Banshibir.

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।