ভুলটা কোথায়?------১

মূর্তালা রামাত এর ছবি
লিখেছেন মূর্তালা রামাত (তারিখ: বুধ, ০৮/০৫/২০১৩ - ১২:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হেফাযতে ইসলামীর ঢাকায় তাণ্ডব চালানোর দৃশ্য দেখে অনেকের চোখই কপালে উঠে গেছে। কেউ কেউ বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে হেফাযতীরা বাংলাদেশেই বাস করে। অথচ কদিন আগেই শাপলা চত্বরে হেফাযতের প্রথম সমাবেশের সময় এদের অনেকেই সেখানে গিয়েছিলেন, অনেকে তাদেরকে আপ্যায়নও করেছিলেন। আবার তারাই এখন হেফাযতকে ধিক্কার দিচ্ছেন। বলছেন এরা আসলে ইসলাম কী সেটাই ঠিকমতো জানে না, এদের হাতে ইসলাম মোটেই নিরাপদ নয়।

ইসলাম যে হেফাযতে ইসলামীর হাতে নিরাপদ নয় তা তাদের ‌১৩ দফা দেখেই বোঝা গিয়েছিলো। দেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার যে আকাঙ্খা তাতে প্রকাশ পেয়েছে তা কোনমতেই কোন ইসলামের মূল ভাবনার সাথে যায় না। তারপরও ইসলামকে পূঁজি করে হেফাযতের এতো দূরে আসার রহস্যটা কী, তা এখন অনেককেই ভাবিয়ে তুলছে।

এই ভাবনাটি অনেক আগেই ভাবা দরকার ছিল বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো বড় একটি বিষয় নিয়ে মাঠে নামার আগে যথেষ্ঠ গ্রাউন্ড ওয়ার্কের দরকার ছিল। বর্তমান সরকার তা করেনি। সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও অলস থেকেছে। ফলশ্রুতিতে যুদ্ধাপরাধীর তাদের ধর্মীয় নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তৃণমূল মানুষের ভেতর বিচার নিয়ে নেতিবাচক ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছে। সে কারণেই বিচারে কতিপয় যুদ্ধাপরাধীর সাজা হওয়ার পরিণতিতে তাদের দল জামাত-শিবির সারা দেশ-জুড়ে সফলভাবে নৈরাজ্য চালাতে পেরেছে। এই নৈরাজ্যের বিপরীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রচার প্রচারণার ঘাটতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সেই ঘাটতিটুকু পুষিয়ে দেয় শাহবাগের আকস্মিক গণজাগরণ। এই জাগরণটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ কতোটা সচেতন।

শাহবাগ গণজাগরণের সচেতনতার কারণেই যুদ্ধপরাধ বিচার ইস্যুটি বাংলাদেশের মূল রাজনৈতক বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই জাগরণে সামিল হয়েছিল আপামর জনসাধারণ। রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে হঠাৎ জেগে ওঠা শাহবাগ সমস্ত রাজনৈতিক হিসেবে নিকেশ চাল ওলট পালট করে দেয়। শাহবাগকে তার নিজের যায়গায় থাকতে দিলে সমস্যা ছিল না। শাহবাগের জাগরণের সাথে ছাত্রলীগকে গুলিয়ে নতুন ককটেল বানানোর যে চেষ্টা আওয়ামী লীগ করলো সেটুকুই গণজাগরণের জোয়ারকে স্তিমিত করে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ। আওয়ামী লীগের কর্তব্যক্তিরা বুঝলেন না যে ৬০ এর দশকের ছাত্রলীগের ইমেজ আর এখনকার ছাত্রলীগের ইমেজে আকাশ পাতাল ফারাক। গণজাগরণকে অপটুভাবে নিজেদের ঝুলিতে ভরার খায়েসই আওয়ামী লীগের অন্যতম ভুল। তাদের এই খায়েসের কারণেই শাহবাগকে আওয়ামী ছাপ্পড় দিয়ে প্রচার প্রচারণা চালানোর রসদ পেয়ে যায় যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের দলগুলো।

এই প্রচার প্রচরণা চলে হাটে মাঠে ঘাটে। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের কাউকে গ্রাম গঞ্জে গিয়ে গিয়ে এই প্রচারণার জবাব দিতে দেখা যায়নি। এমনকী শাহবাগের ক্রেডিটকে নিজের বলে জাহির করার চেষ্টায় মত্ত আওয়ামী লীগকেও তৃণমূলে যেয়ে এসব অপপ্রচারের জবাব দিতে দেখা যায়নি। যার ফলে এসব একপেশে অপপ্রচার ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে ঘরে। এই সুযোগে অপপ্রচারকারীরা তাদের প্রচারের সাথে নিখুঁতভাবে জুড়ে দিয়েছে ধর্মীয় ইস্যু তথা নাস্তিকতা।

যথাযথভাবে এই ইস্যুটির মোকাবেলা করতেও আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে। আমার দেশ পত্রিকা যখন সত্য মিথ্যা গল্প বানিয়ে এই ইস্যুটির তিলকে তাল বানিয়ে ছেড়েছে তখনও সরকার তথা আওয়ামী লীগ ছিল নিশ্চুপ। তাদের এই নিশ্চুপতার সুযোগেই শাহবাগ হয়েছে রক্তাক্ত। শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়ার কারণেই শাহবাগের তরুণ ছেলেমেয়েগুলোকে তাদের নিজেদের ধর্মের বাইরে বের করে দেয়া হয়েছে। ধর্মকে ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষটি সফলভাবে এই কাজটি করে মূলত যুদ্ধপরাধীদের বিচার চাওয়া না চাওয়াটাকেই একটা ধর্মীয় লেবাস দিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

বাঙালি চেতনাটি যুদ্ধাপরাধীদের কাছে কখনোই তেমনভাবে ধরা দেয় নি। সে কারণে ধর্মই তাদের মূল অস্ত্র। শাহবাগের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিরুদ্ধে এই অস্ত্রটি ব্যবহারের মওকাই তারা খুঁজছিল। আওয়ামী লীগ আগেই শাহবাগকে নিজের ছিল-ছাপ্পড় লাগানোর চেষ্টা করে মূলত তাদের কাজটি সহজ করে দেয়। শাহবাগকে ধর্ম দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারলে তা আওয়ামী লীগকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে- এটা যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত-শিবির ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছিল। সুতরাং এই ইস্যুতে তারা জোরেশোরে মাঠে নামে। ধর্মকে বেপরোয়া ব্যবহার করে যুদ্ধপরাধের বিচার বানচালের এ চেষ্টার বিরূদ্ধেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল ছিল অপরিপক্ক। তারা একদিকে শাহবাগের ব্লগারদের গ্রেপ্তার করে নিজেদেরকে নিরপেক্ষ দেখাতে চেয়েছে, অন্যদিকে হেফাযতে ইসলামীর উত্থানকে মদদ দিয়ে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় জাহির করতে চেয়েছে। দুই নৌকায় পা রাখার এই রাজনীতির ফাঁক গলেই হেফাযত ইসলামী শাপলা চত্বরে সমাবশের অনুমতি পায়। তার না হলে হেফাযত ইসলামী কোনক্রমেই বাংলাদেশের মূল রাজনীতিতে নাক গলাতে পারতো না। (চলবে)

৮/০৫/২০১৩
সিডনী, অস্ট্রেলিয়া।


মন্তব্য

অল্পসল্প এর ছবি

দারুন বিশ্লেষন। যথেষ্ট নিরপেক্ষেতা আছে লেখাটিতে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।