ঢাকা শহর ঢাকা যতোক্ষণ

নাদির জুনাইদ এর ছবি
লিখেছেন নাদির জুনাইদ (তারিখ: শনি, ১০/০৬/২০১৭ - ১:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কলকাতার তথ্যচিত্র নির্মাতা কিউ-এর একটি সাক্ষাতকার পড়ছিলাম। একটি বর্ণনা খুব ভাল লাগলো। কিউ বলছেন, কোনো শহর নিজেকে যদি শহর হিসেবে পরিচয় দিতে চায় তাহলে তার কিছু কারণ থাকা দরকার। কিউয়ের মতে, কলকাতার সেই কারণগুলোর ক্ষয় হতে হতে এখন এমন একটি জায়গায় এসেছে যে শহরটার রং ধূসর না, মনে হচ্ছে বাদামি। আমার মনে হলো বর্তমান ঢাকা সম্পর্কে ঠিক এমন একটি চিন্তাই আমার ভেতরে ছিল। আমি প্রকাশ করতে পারছিলাম না, আর কিউ মোক্ষমভাবে কলকাতা সম্পর্কে তা প্রকাশ করেছেন। ঢাকায় আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা। উচ্চশিক্ষার জন্য বছর পাঁচেক দেশের বাইরে কাটিয়েছি। এছাড়া বাকী জীবন কেটেছে এই শহরে। আশির দশকে স্কুল জীবন। তখন নীল আকাশ আর লালচে রোদের যে বিকেল এই শহরে দেখতাম সেই নীল আর লাল এই শহরে এখন আর দেখতে পাই না। দেখি না তারা জ্বলতে থাকা নীলচে-কালো আকাশের নীচে সুন্দর সন্ধ্যা যখন পাওয়া যেতো তাজা বাতাস। সেই স্নিগ্ধ পরিবেশে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াতো অনেকে। বিভিন্ন বাড়ি থেকে ভেসে আসতো কমবয়সী ছেলেমেয়েদের সংগীত রেওয়াজ করার সুর। বিভিন্ন বাড়িতে গান শেখার একটা চর্চা ছিল তখন।

ঠিক এই ব্যাপারটি দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের ১৯৫৮ সালে তৈরি করা ছবি 'পরশ পাথর'-এ। একটি দৃশ্যে সন্ধ্যাবেলা ছবির মূল চরিত্র পরেশ দত্ত’র স্ত্রী বাড়ির জানালাগুলো খুলে দেয়ার সাথে সাথেই কানে ভেসে আসে পড়শীর বাড়িতে কমবয়সী মেয়ের গানের রেওয়াজ করার সুর। ১৯৫৮ সালে কলকাতার সন্ধ্যার সাথে ১৯৮০’র দশকের ঢাকার সন্ধ্যার তেমন অমিল ছিল না। অথচ এখন মনে হয় কতোদিন হয়ে গেছে ঢাকায় সন্ধ্যাবেলা কোনো বাড়ি থেকে মিষ্টি কন্ঠে কমবয়সীদের রেওয়াজ করার সুর শুনতে পাই না। ঢাকায় সন্ধ্যাবেলা এখনো মানুষ বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটে নিশ্চয়ই (নাকি তারা বসে থাকে অজস্র টিভি চ্যানেলের সামনে, আর কমবয়সীরা ব্যস্ত তাদের স্মার্টফোন বা কম্পিউটার নিয়ে?) কিন্তু সন্ধ্যার পর বা অন্য কোনো সময়ও এই শহরে হাঁটা আর আনন্দদায়ক নয়। গত তিন দশকে এই শহরে যতো মানুষ আর যানবাহন বেড়েছে, আর তৈরি হয়েছে মানুষের নতুন বাসস্থান তাতে করে শহরের কোনো এলাকাতেই আর হাঁটার মতো নিবিড়, কোলাহলমুক্ত পরিবেশ নেই। সব জায়গায়ই মস্তিষ্ককে পীড়িত করে গাড়ির হর্ণের তীব্র শব্দ। বহু দোকান, রেস্তোরা, আর অ্যাপার্টমেন্টের ভিড়ে এই শহরে বিশুদ্ধ, স্বস্তিকর বাতাস পাওয়াও কঠিন এখন।

কিন্তু ঢাকা শহরে লাল-নীল রং তো আগের চেয়ে অনেক বেশি এখন। প্রতি রাস্তার পাশে দিনে চোখে পড়ে নানা বিজ্ঞাপনের বহু রঙিন বিলবোর্ড। ঢাকা এখন শপিং মলের শহর। আর রাতে এইসব মলে, দোকানে, রাস্তার বিজ্ঞাপনে জ্বলে লাল নীল আলো। কিন্তু বাজারের প্রচার তুলে ধরা সেই আলোতে লাল রঙের প্রতিবাদী, রাগী, রোমান্টিক, শক্তিশালী রূপটি কি আমাদের মনকে স্পর্শ করে? আর ঢাকার বর্তমান সন্ধ্যাগুলিতে বিভিন্ন রাস্তায় যে নীল আলো দেখা যায় সেই নীলে চিন্তাশীলতা বা ভাবনার গভীরতা কোথায়? যে গভীরতা মনের বিষণ্ণ আর সেই সাথে উষ্ণ দিকগুলি অনুভব করতে সাহায্য করে আমাদের সেই কাব্যময় অনুভব তো চটক আর চাকচিক্য বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা নীল আলোতে নেই। বরং আকাশের নীল রং এই শহরে ঢেকে দিয়েছে উঁচু সব অ্যাপার্টমেন্ট আর অফিস বিল্ডিং। দিন দিন এই উচ্চতা কেবল বাড়ছেই। আর বাধা পাচ্ছে সূর্যের আলো, নীল আকাশের দিকে কোনো দুপুর বা বিকেলে তাকিয়ে কল্পনায় হারিয়ে যাওয়ার অভ্যাসই গড়ে উঠছে না আকাশ দেখতে-না-পাওয়া এই সময়ের কমবয়সীদের। বাজারের চটক প্রচার করা লাল-নীল আলো কোনো কবিতা তৈরি করে না। আর তাই ঢাকা শহরের রাস্তায় এখন আর কোনো কবিতাও নেই। ঝাঁঝাঁলো রাজনীতিও কি আছে এখন এই শহরের রাস্তায়? রাজনৈতিক অন্যায় তো থেমে যায়নি এখানে। বরং অতীতে যে অন্ধচিন্তার অনুসারী আর স্বার্থবাজরা ছিল দুর্বল, তারা এখন আর শক্ত রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় না। স্বার্থের প্রয়োজনে অন্ধত্ব আর অসহিষ্ণুতা দেখেও বাড়ছে নির্বিকারত্ব। কিন্তু রাজনীতি আর কবিতা তো ব্যবসায় নয়। আজ ‌‍‌ব্যক্তিগত লাভের উদগ্র বাসনা পরাজিত করছে মূল্যবোধকে। আর আদর্শবিহীন স্বার্থচিন্তার শহরে প্রকৃত ফুল তো ফুটবে না। এমন শহরে জল ঢালা হবে আগাছায়, যত্ন করা হবে প্লাস্টিকের ফুল। প্লাস্টিকের ফুলের চাকচিক্য আজ ঢেকে দিচ্ছে ঢাকা শহরের পুরনো প্রকৃত ঔজ্জ্বল্য। প্লাস্টিকের ধূসরতা আজ এই শহরে। প্রকৃত সুবাস আর রং আমরা দেখতে পাই না।

প্যারিসে ১৯৬৮ সালে তরুণরা পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ আর বিক্ষোভ শুরু করেছিল, তা শেষ পর্যন্ত সফলতা পায়নি। একটি শোষণমূলক শাসনকাঠামো তারা চিরতরে ভেঙ্গে দিতে পারেনি। কিন্তু সেই তরুণদের চিন্তাশীলতা, প্রতিবাদের নান্দনিক রূপ আর অভিনবত্ব পরবর্তী দশকগুলিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী প্রতিবাদকে অনুপ্রাণিত করেছে। তারা যে দেয়াল লিখন আর পোস্টার ব্যবহার করেছিল ১৯৬৮ সালে, তা আজও মনকে ঝাঁকুনি দেয়, আমাদের গভীরভাবে ভাবতে সাহায্য করে। যার আরেকটি অর্থ হলো সেই বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি আর চটকের চর্চা টিকে আছে সমাজে এখনো। চটক আর চাকচিক্যের অবিরাম প্রচার দিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে তার আসল দায়িত্ব, যে দায়িত্ব হলো সমাজে ঘটতে থাকা অন্যায় আর অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা, তাকে প্রতিনিয়ত কিভাবে ঠকানো হচ্ছে তা নিয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া। নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন:

"দিশেহারা মানুষকে নেশায় বুঁদ করে রাখার জন্য যেমন মদের দোকান দরকার, সেরকম টেলিভিশন সিরিয়াল দরকার, সোপ অপেরা দরকার, নোংরা প্রোগ্রাম দরকার, ব্ল-ফিল্ম দরকার। এগুলো অঢেল সাপ্লাই বা বিশাল বিতরণের ব্যবস্থা দরকার। মানুষ যদি চুপ করে যায়, মানুষ যদি একটা ধোঁয়ার মধ্যে থাকে, সে কোনো প্রশ্ন করবে না।"

এই ক্রমশ বাড়তে থাকা ধোঁয়াই যেন আজ ধূসর করে তুলেছে ঢাকা শহরকে। আজ যদি আমাদের টেলিভিশন নাটক বা বিজ্ঞাপনের দিকে তাকাই যা চোখে পড়ে তা হলো জাঁকজমকপূর্ণ এক প্রদর্শনী বা স্পেকট্যাকল। কোথায় গেল সত্তর, আশির দশকে আমাদের নাটকে যে গভীরতাপূর্ণ বক্তব্য থাকতো সেই চিন্তাঋদ্ধতা? আজ বিনোদন প্রদানই যেন একমাত্র উদ্দেশ্য। অজস্র শপিং মল আর ফাস্ট ফুডের দোকানও তো এই শহরে স্পেকট্যাকলই সৃষ্টি করছে প্রতিমুহূর্তে। সেই যে ফরাসি প্রতিবাদী তরুণরা বলেছিল: “জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর সাজসজ্জার মধ্যে চোখ কেবল দেখতে পায় সাজিয়ে রাখা পণ্য আর তাদের দাম।" দুই কোটি মানুষ বসবাস করে যে ঢাকা শহরে সেখানে চিন্তাশীল বই পাওয়া যায় এমন বিশটি দোকানও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ প্রতি বছর বাড়ছে পোশাক আর ফাস্ট ফুডের দোকান। আর মানুষ প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিচ্ছে সেই পরিস্থিতি। ফরাসি তরুণদের আরেকটি কথা মনে পড়ে যায়: “আমি অংশগ্রহণ করছি, তুমি অংশগ্রহণ করছো, সে করছে, আমরা করছি, তোমরা সবাই অংশগ্রহণ করছো। আর তারা লাভ করছে।" এই 'তারা' কাদের দ্বারা গঠিত তা জানার জন্য ভাবা দরকার। তাদের পরিচয় জানার পর আমার করণীয় কী তা নিয়েও চিন্তা করা দরকার। কিন্তু ভাবা প্র্যাকটিস কী করছে এই সময়ের মানুষ? চিন্তা করা যে প্রয়োজন তা কি তারা বুঝতে পারছে? এই শহরে মানুষের লোভ আর অপরিণামদর্শিতার জন্য হারিয়ে যাচ্ছে গাছ, খোলা মাঠ আর জলাশয়। বাড়ছে কংক্রিটের জঙ্গল। আর ফরাসি তরুণরা যথার্থই বলেছিল: “কংক্রিট লালন করে অনীহা আর উদাসিনতা।"

কেবল সব রকমের ক্ষুধা মিটলেই কী একজন প্রকৃত মানুষ জীবনে সার্থকতা আর আনন্দ খুঁজে পাবেন? নিয়মিত পেট ভরে খেতে পারলে মানুষ না খেয়ে মারা যাবে না, কিন্তু মানুষ যদি ভোগ করার চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু কখনোই না ভাবে তাহলে সেই চিন্তাহীন মানুষের সাথে গৃহপালিত মুরগি বা পশুর পার্থক্য কোথায়? আমাদের দেশে মানুষ এখন পেটভরে খেতে পারছে, নিম্নবিত্তের মানুষের হাতেও আছে মোবাইল ফোন। কিন্তু সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ মানুষকে গভীরভাবে চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করছে না। এই পরিবেশে এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রও আর গভীরভাবে ভাবতে আগ্রহী নয়। কল্পনার সমুদ্রে কী করে জাহাজ নিয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে ভেসে পড়তে হয়, তা তাদের ধারণার বাইরে। বই পড়া জরুরি এই শহর তাকে আর তা শেখায় না। তাকে বাধ্য হয়েই সময় কাটাতে যেতে হয় রেস্তোরায়। প্রতিদিন তার চোখে পড়ে পণ্যের জাঁকজমকপূর্ণ প্রচার, আর অগভীর বিনোদনের নানা উপকরণ। এই মানুষরা কী করে লিখবে কবিতা, আগ্রহ খুঁজে পাবে ইতিহাসে, তৈরি করবে চিন্তাশীল চলচ্চিত্র আর শিখবে সেই রাজনীতি যা তৈরি করবে নতুন মানুষ যারা, নবারুণ ভট্টাচার্যের ভাষায়, “অন্যের জন্য বাঁচার মধ্যে নিজের জীবনটার সার্থকতা খুঁজে পাবে?" ঢাকা শহরের এমন রূপই এখন চোখে পড়ে যেখানে অগভীর চর্চার প্রতাপ দূরে ঠেলে দিচ্ছে গভীর ভাবনার গুরুত্ব। আর গভীর চিন্তা করার ক্ষমতা না থাকলে মানুষ বুঝতেও পারে না কোন গুরুত্বপূর্ণ দিকটি তার জীবনে নেই, এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে স্থানে রাউফুন বসুনিয়া গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন সেখানে স্থাপিত তার ভাস্কর্যটি আজ অযত্নে মলিন হয়ে আছে। যে তরুণরা সেই ভাস্কর্যের বেদীতে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে প্রায়ই আড্ডা দেয় তারা জানেও না রাউফুন বসুনিয়া কেন মারা গিয়েছিলেন। তা জানা কেন জরুরি তা বোঝার ক্ষমতাও সেই ছাত্রদের নেই। টিএসসির পাশে ড. মিলন স্বরণে করা স্মৃতিস্তম্ভটিতে বসে ভাত খায় পথে ফুল বিক্রি করা মানুষরা, তাদের ভাত-তরকারির কিছু কিছু পড়ে থেকে নোংরা হয়ে গিয়েছে স্থানটি। সেখানে অবলীলায় ঘুমাচ্ছে কেউ কেউ। কারো কোনো মাথাব্যথা নেই ড. মিলনের স্মৃতি জড়ানো এই স্থানটি কেন এমন বিবর্ণ আর নোংরা হতে দেয়া যায় না তা নিয়ে। এই স্থানগুলির বিবর্ণতা নির্দেশ করছে ঢাকা শহরের বর্তমান মানুষদের মনের জড়তা আর নিষ্প্রভতা। পুরনো স্মৃতি, প্রয়োজনীয় স্মৃতি আজ মলিন এই শহরে কারো লাভের জন্য তৈরি করা চটক আর চাকচিক্যের কাছে। কিন্তু এই জৌলুস কোনো উজ্জ্বলতা আনতে পারে না কারণ তা মানুষের মন করে তুলছে অগভীর আর ক্লেদাক্ত। একটি বাউল গানের কথাগুলো এমন: “ওরে ঢাকা খুলে দেখলে পরে, থাকবে না তোর সাবেক মন/ ঢাকা শহর ঢাকা যতোক্ষণ।" বিভিন্নভাবে গানটির কথাগুলো ব্যাখ্যা করা যায়। আমার কাছে এই মুহূর্তে মনে হয় ঢাকা শহর ততোক্ষণই আমার কাছে ঢাকা শহর যখন পুরনো দিনের মতো এই শহরের পথে আমি দেখবো কবিতা, দেখবো না অন্ধচিন্তার অনুসারীদের আস্ফোলন আর নিজ স্বার্থের জন্য তাদের তোয়াজ করার হীন চেষ্টা। এই শহরে আমি দেখবো সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার সাহসী রাজনীতি, দেখবো না সস্তা চটকের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত সুন্দরকে বোঝার চিন্তাশীলতা। ফরাসি তরুণরা বলেছিল: "মানুষের আগে এসেছিল অরণ্য, পরে আসবে মরুভূমি।" ঢাকা শহরকে ঢেকে রাখা এই ধূসরতা, এই বাদামি বিবর্ণতা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে মরুভূমির কথা। কিন্তু ঢাকা আমার কাছে ততোক্ষণই ঢাকা যতোক্ষণ তা মরুভূমি নয়।


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

ঢাকা আমার শহর নয়, তবু নিজের শহরকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলার অনুভূতির খানিকটা আমাকেও সংক্রমিত করলো। আমরা যারা ঢাকার বাইরে থাকি তাদের অনেকের কাছেই ঢাকা দেশের একমাত্র জীবিকার শহর। অন্য যে কোন শহরে বড় হলেই শুনতে হয় ঢাকা যেতে হবে অথবা বসে আছিস কেন ঢাকা না গেলে চাকরি হবেনা। সারা দেশ থেকে প্রতি বছর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঢাকার দিকে ছুটছে। এদের জীবিকা আর থাকার ব্যবস্থা করতে করতে একটা শহর কতদিন মানুষের শহর থাকে সেটাই দেখার বিষয়।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সত্যপীর এর ছবি

আর বাধা পাচ্ছে সূর্যের আলো, নীল আকাশের দিকে কোনো দুপুর বা বিকেলে তাকিয়ে কল্পনায় হারিয়ে যাওয়ার অভ্যাসই গড়ে উঠছে না আকাশ দেখতে-না-পাওয়া এই সময়ের কমবয়সীদের। বাজারের চটক প্রচার করা লাল-নীল আলো কোনো কবিতা তৈরি করে না।

আর পাঁচ দশ বছরের ভিতর সচলায়তনে ২০০০ সাল বা তার পরে ঢাকা শহরে বড় হওয়া লেখকেরা লিখতে শুরু করবেন। আমি তাদের চোখে ঢাকা শহর দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। স্মৃতি সততঃ সুখময়। আমার ধারণা সেই আকাশ-দেখতে-না-পাওয়া উঁচু দালানে বড় হওয়া মানুষদের স্মৃতিচারণ হবে আকর্ষনীয়। সেই লেখকেরা আমাদের মতই কর্কশ ঢাকা শহরটাকে ভালোবাসাভরে স্মরণ করবেন।

..................................................................
#Banshibir.

নাদির জুনাইদ এর ছবি

২০০০-এর পর যারা এই শহরে বড় হয়েছে তারা এই শহরের পথে, গণমাধ্যমে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, রাজনীতিতে কী তেমন গভীরতা দেখতে পেয়েছে যা গত শতকের ষাট, সত্তর, আশি এবং এমনকি নব্বইয়ের দশকের তরুণরা দেখেছিল? এটাই আমার প্রশ্ন আর ভয়ের জায়গা। স্মৃতিকথা তো লিখতেই পারে সবাই। কোনো স্থানের প্রতি ভালোবাসাও প্রতিনিয়তই তৈরি হয়। ২০০০-এর পরবর্তী প্রজন্মেরও ভালোবাসা থাকবে ঢাকার প্রতি। আমি কেবল হতাশ আর চিন্তিত যে ঢাকা আর আগের মতো গভীরতা তৈরি করছে না মানুষের মনে। আর গভীরতা না থাকলে চিন্তাও মূল্যহীন আর হালকা। তা স্মৃতিকথা হোক, নাটক হোক আর অরগানাইজড রাজনীতি হোক। পশ্চিম বাংলার এক তরুণ অ্যাকটিভিস্ট তমোঘ্ন হালদার বলেছিল, "আমরা যারা দু-হাজারের পর টিনএজার, আমাদের সেই অর্থে কোনো সংকট ছিল না, কোনও ক্রাইসিস ছিল না।" এখানেই আমার বক্তব্য। আগের দশকের তরুণরা যে কঠিন সময় দেখেছে এবং পথে নেমে কবিতা আর রাজনীতি দুই-ই প্রত্যক্ষ করেছে, ২০০০-এর পরের পরিবেশে তা সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। তাই স্মৃতিকথাও আর কোন গভীরতা তৈরি করবে, বা আদৌ স্মৃতিকথা তৈরি হবে কি যদি প্রতিদিনের সামাজিক আর রাজনৈতিক জীবনেই অগভীর বিষয় প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা প্রতিনিয়ত দেখা যায়?

মন মাঝি এর ছবি

আপনি আছেন কোথায়? পল্লবগ্রাহীতা, আত্নপরতা আর চালিয়াতিই এখন অর্ডার অফ দা ডে। আপনাদের ঐসব লেখাপড়া, স্বপ্ন, কল্পনা, আদর্শ, মূল্যবোধ, চিন্তাশীলতা, কবিতা, রাজনীতি, বিপ্লব, মহতের প্রেরণা, গভীরতা-টতা ইত্যাদি এখন এক অবসলিট হাস্যকর নিয়াণ্ডার্থাল জেনারেশনের স্টুপিডিটি। এগুলির জন্য আক্ষেপ করে এখন আর হাস্যস্পদ হতে যেয়েন না, প্লিজ! হাসি

****************************************

নাদির জুনাইদ এর ছবি

ঠিকই বলেছেন। আত্মকেন্দ্রিকতা এখন গ্রাস করে নিয়েছে মানুষের মন। আর চালিয়াতি বেড়েছে, বাড়ছে। সমাজে অসুস্থতার চর্চা চলতে থাকলে চালিয়াতিই তো বাড়বে।
আক্ষেপ তো করিই। তবে আক্ষেপের সাথে তীব্র সমালোচনাও করবো। তাতে অনেকে রাগ হবেন হয়তো। কিন্তু সমালোচনার মাধ্যমে তাদেরই লজ্জা দেয়া আর আঘাত করা প্রয়োজন।

সত্যপীর এর ছবি

আগের দশকের তরুণরা যে কঠিন সময় দেখেছে এবং পথে নেমে কবিতা আর রাজনীতি দুই-ই প্রত্যক্ষ করেছে, ২০০০-এর পরের পরিবেশে তা সম্পূর্ণই অনুপস্থিত।

২০০০ সালের পরের তরুণদের সময়ও অতি কঠিন। তাদের চ্যালেঞ্জ তাদের মত। পথে নেমে কবিতা আর রাজনীতি প্রত্যক্ষ করেনি বলে তাদের চিন্তার গভীরতা কমে যাবে বা চিন্তা হবে মূল্যহীন আমি সেই আশঙ্কা করিনা।

তাই স্মৃতিকথাও আর কোন গভীরতা তৈরি করবে, বা আদৌ স্মৃতিকথা তৈরি হবে কি যদি প্রতিদিনের সামাজিক আর রাজনৈতিক জীবনেই অগভীর বিষয় প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা প্রতিনিয়ত দেখা যায়?

প্রতিদিনের সামাজিক আর রাজনৈতিক জীবনে অগভীর বিষয় প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা নিয়ে দ্বিমত নাই। তবে তারই মধ্যে জীবনের লড়াইকে লেখায় উঠিয়ে আনার মত তরুণ লেখক আসবেন বলে আমার মনে হয়।

..................................................................
#Banshibir.

নাদির জুনাইদ এর ছবি

"২০০০ সালের পরের তরুণদের সময়ও অতি কঠিন। তাদের চ্যালেঞ্জ তাদের মত।" -- তাদের মতটা কী? আমি তো কোনো মত দেখতে পাই না ইদানীং। মত থাকলে তো ভালই হতো। কবিতা, রাজনীতি, গণমাধ্যম, সংগীত, সিনেমা কোথায় নতুন মত? যে মত এসেছে তরুণদের মাধ্যমে? নতুন মত সৃষ্টির জন্য তো ভাবা দরকার। কিন্তু 'প্রতিদিনের সামাজিক আর রাজনৈতিক জীবনে অগভীর বিষয় প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা' যা নিয়ে আপনারও দ্বিমত নেই, সেই পরিবেশে তো ভাবা প্র্যাকটিস করে না কেউ। কারণ ভাবনার গুরুত্ব কে দিচ্ছে? গভীরতা উৎসাহিত করা হচ্ছে কোথায়? গভীরতা থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানে রাউফুন বসুনিয়া আর ডঃ মিলনের স্মৃতিস্তম্ভ এমন অবহেলায়, অযত্নে থাকতো না। আরো অনেক উদাহরণই তো উল্লেখ করা যায়।

যে পরিবেশে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে অর্থ আর খ্যাতি আর ক্ষমতা, আর অবহেলা করা হচ্ছে কবিতা আর প্রকৃত রাজনীতি আর আদর্শিকতা তেমন পরিবেশেও কমবয়সীদের চিন্তার গভীরতা ঠিকই থাকবে তা কী করে আশা করতে পারি? পারি না, আর তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় পাই। সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশে দিন দিন অগভীর বিষয় প্রাধান্য পাবে আর তা দেখেও আমরা যদি আশা করি যে তরুণদের চিন্তায় গভীরতার ঘাটতি আসবে না, তাহলে আমাদের আশা পূরণ হবে না। আমাদের কাজ করতে হবে গভীরতা ফিরিয়ে আনার জন্য। নাটক, চলচ্চিত্র, সাহিত্য, রাজনীতি, শিক্ষা সব ক্ষেত্রে। তখন আমাদের আশা করা যৌক্তিক হবে। আর দুই একজন মানুষ মিলে চেষ্টা করলে চলবে না। চেষ্টা করতে হবে বৃহৎ পরিসর থেকে। রাষ্ট্রকে যুক্ত করতে হবে এই চেষ্টায়। দুই-একজন তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল সুলেখক নিশ্চয়ই নেতিবাচক পরিস্থিতি টিকে থাকলেও উঠে আসবেন। কিন্তু সেই দুই-একজন থাকার পরও পুরো সমাজ অগভীর থাকতে পারে। আমাদের সমাজে যেন অগভীর মানুষের সংখ্যা কম হয়, আমাদের সেই চেষ্টা করতে হবে। আপনার মতো আশা আমি করতে পারছি না এখনই। কারণ দেখতে পাচ্ছি অগভীরতা, চটুলতা, লোভ ছড়িয়ে পড়ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায়, আর তা থামানোর জন্য যথেষ্ট কাজ করা হচ্ছে না। আগে সেই কাজটা আমি-আপনি-সে মিলে করি, কাজ হোক, তখন ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হবো। এখনই পারছি না।

সত্যপীর এর ছবি

ঠিক আছে।

..................................................................
#Banshibir.

হামিদ এর ছবি

তরুনদের মাঝে চিন্তার চর্চার অনুকুলে পরিবেশ দেশে আর নাই। নিজের পিঠ নিজে থাবড়ান আর নিজের ঢোল নিজে বাইড়ানর এমন মোক্ষম সময় নিজের তারুন্যে পেলে আজ যারা অতরুন, তারাও হয়ত ভেসে যেত।

মানুষের তাড়না, প্রবৃত্তি, প্রবনতার ভিত তৈরি হয় কৈশোরে। গুটি কেটে প্রজাপতি বের হবে নাকি তেলাপোকা, সেটা গুটির ওপরই নির্ভর করে। কোনো কিশোর যদি বাড়ি থেকে চিন্তার চর্চা না শিখে, বাড়ির বাইরে কোথাও তা শিখার সুযোগ তার আর নাই। কোথায় কার কাছে গিয়ে সে চিন্তার মুল্য শিখবে? কখন শিখবে? আমরা তার খেলার মাঠ রাখি নাই, পড়ার লাইব্রেরী রাখি নাই, পরিবেশনের মঞ্চ রাখি নাই। পিঠে বইয়ের বোন্দা, মোবাইলে ফাস হওয়া প্রশ্ন আর সমাজে ক্ষনিকের হাততালির মুলা ঝুলিয়ে ব্লগে বসে আপসস করছি তরুনেরা কবিতা রাজনীতি শিখে না। এ আপসস অন্যায্য।

ঢাকা শহরে নিজের রুটিনের বাইরে এখন একটার বেশি ট্রিপ দেওয়ার সময় থাকে না কারও হাতে। ঐ একটা ট্রিপ তরুনেরা কোথায় দিবে? চিন্তা করতে গেলে অশোক বৃক্ষের মত একটা কিছুর তলে হাজিরা দিতে হয়। ঢাকায় কোথায় আছে ঐ অশোক বৃক্ষ? খুটি না পেলে লতা বাড়বে কিভাবে?

চিন্তার জন্য তরুনেরা সমাদর না পেলে চিন্তা তারা করবে না। আপনারা তরুনদের জন্য বেশি করে ইভেন্ট আয়জন করেন যেখানে তারা তাদের চিন্তার ছাপ রেখে সমাজের চোখে আদৃত কোন অর্জন দেখাতে পারবে।

তিথীডোর এর ছবি

কেবল সব রকমের ক্ষুধা মিটলেই কী একজন প্রকৃত মানুষ জীবনে সার্থকতা আর আনন্দ খুঁজে পাবেন? নিয়মিত পেট ভরে খেতে পারলে মানুষ না খেয়ে মারা যাবে না, কিন্তু মানুষ যদি ভোগ করার চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু কখনোই না ভাবে তাহলে সেই চিন্তাহীন মানুষের সাথে গৃহপালিত মুরগি বা পশুর পার্থক্য কোথায়? আমাদের দেশে মানুষ এখন পেটভরে খেতে পারছে, নিম্নবিত্তের মানুষের হাতেও আছে মোবাইল ফোন। কিন্তু সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ মানুষকে গভীরভাবে চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করছে না। এই পরিবেশে এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রও আর গভীরভাবে ভাবতে আগ্রহী নয়। কল্পনার সমুদ্রে কী করে জাহাজ নিয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে ভেসে পড়তে হয়, তা তাদের ধারণার বাইরে। বই পড়া জরুরি এই শহর তাকে আর তা শেখায় না। তাকে বাধ্য হয়েই সময় কাটাতে যেতে হয় রেস্তোরায়। প্রতিদিন তার চোখে পড়ে পণ্যের জাঁকজমকপূর্ণ প্রচার, আর অগভীর বিনোদনের নানা উপকরণ। এই মানুষরা কী করে লিখবে কবিতা, আগ্রহ খুঁজে পাবে ইতিহাসে, তৈরি করবে চিন্তাশীল চলচ্চিত্র আর শিখবে সেই রাজনীতি যা তৈরি করবে নতুন মানুষ যারা, নবারুণ ভট্টাচার্যের ভাষায়, “অন্যের জন্য বাঁচার মধ্যে নিজের জীবনটার সার্থকতা খুঁজে পাবে?" ঢাকা শহরের এমন রূপই এখন চোখে পড়ে যেখানে অগভীর চর্চার প্রতাপ দূরে ঠেলে দিচ্ছে গভীর ভাবনার গুরুত্ব। আর গভীর চিন্তা করার ক্ষমতা না থাকলে মানুষ বুঝতেও পারে না কোন গুরুত্বপূর্ণ দিকটি তার জীবনে নেই, এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ।

এই অংশটুকু বাঁধিয়ে রাখার মতো। চমৎকার লাগলো! চলুক

ঢাকা আমার শহর নয়। এখানে জন্মাইনি, বড় হইনি, পড়াশোনা করিনি। বুড়োবয়সে ঢাকাবাসী হয়েছি চাকরির খাতিরে, সাদা বাংলায় রুটি-রোজগারের টানে। নোংরা, প্রাণহীন জাদুর শহর, ব্যস্ত, ধূলিধূসরিত শহর ঢাকার ক্লান্ত, বিমর্ষ রঙচটা আকাশ আমাকে এখনো টানে না, বোধহয় কখনো টানবেও না...

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নাদির জুনাইদ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনার প্রশংসার জন্য।

আমি ঢাকা শহরের অন্য একটা রূপ দেখেছি আমার স্কুল, কলেজ জীবনে। আশির দশক পুরোটা আর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। তখন ঢাকাকে আসলেই বিবর্ণ, কলুষিত, অসহনীয়, প্রাণহীন লাগতো না। তখন পথ, রোদ, আকাশ, রাতের আমেজ, রাজপথের মিছিল সবই আকর্ষণ করতো। কেবল কয়েকজনকে নয়, বহু মানুষকেই। কিন্তু এখন সেই সব আর নেই। তাই পুরনো দিন মনে করি। আর চেষ্টা করি যেন শহরটা আবার প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সামনের দিনগুলিতে।

মন মাঝি এর ছবি

বুড়োবয়সে ঢাকাবাসী হয়েছি

হায় হায়, আমার কি হপে গো? আমি কি তাহলে পরকাল থেকে সচলায়তনে লগইন করেছি???
গড়াগড়ি দিয়া হাসি

****************************************

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।