স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে

রোমেল চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন রোমেল চৌধুরী [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/০৯/২০১২ - ১০:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ বহুদিন পর ফজলুল করিম স্যারের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আমাদের এফ কে স্যার। বছরের শেষ দিকটায় তিন/চার দিন জুড়ে কলেজে যখন ক্রিকেটের ধুম মৌসুম, সে সময় আমরা এফ কে স্যারকে ব্যাটে-বলে মাঠে নেমে পড়তে দেখতাম প্রিয় ছাত্রদের সাথে। তাঁর চোখে-মুখে তারুণ্যের অরুণ আলোর ঝিলিক। তাঁর হৃদয়ে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ ভালোবাসার বন্যা। আমার সহপাঠীদের মধ্যে নাহিদ, সাব্বির, এনাম ক্ষুদে বয়সেই ছিলেন তুখোড় ব্যাটসম্যান। ফয়সালের ছিল চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া উড়ন্ত ঘুর্ণিবলের দুরন্ত গতি। সেসবের সুবাদে অনায়াসেই তারা স্যারের নিকট-সান্নিধ্য লাভ করেছিল। ব্যাটে, বলে, নেটে, উইকেটে সমর্থ শরীরের সবটুকু ঢেলে দিয়ে তারা স্যারের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সুবিচার করতে পেরে ধন্য হয়েছিল। আমার ছিল দুর্বল দেহ আর ভাঙ্গা শরীর। সর্বশক্তি দিয়ে সার্ভিস করেও ভলিবলের নেট অবধি বল পৌঁছুতে পারতাম না। খেলার মাঠে মাঠে সহপাঠীদের আনন্দ উল্লাস চোখ মেলে দেখাটুকুই ছিল আমার বিকেলের বিনোদন। একসময় আকাশের কপোল জুড়ে অনেক আবীর মাখিয়ে দিতে দিতে ধীরে ধীরে গোলাপি বরন গোধূলি নেমে আসতো। করুণ সুরে বেজে উঠতো বেলা শেষে পতাকা নামানোর দীর্ঘ বিউগল। সেই সময়টুকু আমাদের স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। সেই নিশ্চুপ সময়ে আমার দুচোখ গোধূলির ছায়াপথে হারিয়ে যাবার উদাস নেশায় বিভোর হয়ে উঠতো। মাঝে মাঝে আমিও তো ঐ চৌকশ মানুষটির কাছাকাছি পৌঁছুতে চাইতাম। কিন্তু নিজের অপারগতা নিয়ে আমার ছিল রাজ্যের দ্বিধা। তাই মোহন দৃষ্টিতে দূর থেকে তাঁকে শুধুই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম আর ভাবতাম রাতের আকাশের ঐ যে জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, সেও তো অনেক দূরে।

পাহাড় বোধকরি দূর থেকেই বেশি সুন্দর, সবুজ ও সজীব দেখায়! ফজলুল করিম স্যারের নজরে কাড়তে না পারলেও আমি খুব করে মনে রেখেছিলাম তাঁর মুখে শোনা 'সবুজ বিপ্লব' ও 'দি স্কারলেট লেটার'-এর কথা। ইতিহাসের ক্লাসে রাজনীতি কিম্বা সাহিত্যের কথাও যে কতটুকু প্রাসঙ্গিক হতে পারে তিনি সেটা অবলীলায় প্রমাণ করেছিলেন। আমার একটা বড়ই বদগুণ আছে। বড়বেশি আত্মমগ্ন হয়ে পড়লে মাঝে মাঝে আমি পুরনো বইয়ের দোকানে কাটিয়ে দিই একনাগাড়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা। পুরনো বইয়ের দোকান যেন জীবনানন্দের লাশকাটা ঘর। সেখানে কোন ক্লান্তি নেই। সংসারের গরল বিষ টেনে নিতে নিতে মানুষের মনে যখন একটু মোহন মেটামরফোসিসের আকাঙ্ক্ষা জাগে, তখন কাফকার বড়গল্পের ধরণে 'বই পোকা' হয়ে পুরনো বইয়ের দোকানে পড়ে থাকাই ভালো। সেদিন নীলক্ষেতের এমনই একটি পুরনো বইয়ের দোকানে ইতস্তত: ছড়িয়ে রাখা বইয়ের স্তূপ নেড়ে চেড়ে দেখছিলাম। হঠাৎ পেয়ে গেলাম গাদ্দাফীর সেই ‘সবুজ বিপ্লব’, মনে হলো বইয়ের মলাট থেকে উঁকি দিচ্ছে ফজলুল করিম স্যারের বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ। লিবিয়ার দুর্দশা দেখে দেখে চোখ দুটি বুঝি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

ভাবলাম ফিরতি পথে আজিজে একটু থেমেই যাই। কতদিন ‘পাঠক সমাবেশ’-এ যাওয়া হয় নি। অথচ ২৫ খণ্ড রবীন্দ্রসমগ্র বুকিং দেবার পর থেকে ফি মাসেই যাওয়া হতো ওঁদের ওখানটায়। ব্যস্ততা কি এভাবেই মানুষের মনের সুস্থতাকে হরণ করে ? মানুষকে আত্মমগ্নতার শুদ্ধতা থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে আত্মকেন্দ্রিকতার কালো কারাগারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়? নিজেকেই প্রশ্ন করি, মনের গহীন তলদেশ থেকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে ক্ষীণ আশার মতো কোন উত্তর উঠে আসে না। ‘পাঠক সমাবেশ’-এর বুক শেলফে আমার দৃষ্টি আটকে যায়। সেখান থেকে উঁকি দিচ্ছে, নাথানিয়েল হথর্নের লেখা ‘দি স্কারলেট লেটার’-এর বাংলা অনুবাদ ‘অসতী’, শেলফ থেকে নামিয়ে আনি সেটাকে। প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০১২ তে। আলতো করে চোখ রাখি ভেতরের পাতায়। ফজলুল করিম স্যারের মুখ থেকে 'দি স্কারলেট লেটার'-এর গল্প শুনবার পর পরই কলেজের লাইব্রেরী থেকে খুঁজে বের করেছিলাম বইটিকে। সেই ১৯৮৫ সালে। সিয়েরালিয়নের পথে পাড়ি জমাবার সময় পড়েছিলাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর 'ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন" বইটি। সেখানে "ত্রিভুজের প্রথম বাহু" প্রবন্ধটিতে হথর্ণের নায়িকা হেষ্টার প্রিনের চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন লেখক। মোটের উপর, অনুবাদের সতীত্বটুকু ছাড়া 'অসতী'-র কিছুই আমার কাছে নতুন নয়। তবুও বইয়ের পাতায় মন পাতি। শুনতে পাই, সেখান থেকে যেন ভেসে আসে ফজলুল করিম স্যারের কণ্ঠস্বর, “রোমেল, দেখো, কেমন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে নারী-পুরুষের সম্পর্ক। কোন বেনামী অজানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা ? কোন এলোমেলো গন্তব্যে ?”


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনার ফজলুল করিম স্যারের কথা বলে আমাদের মীজানুর রহমান স্যারের কথা মনে করিয়ে দিলেন। প্রায় ষাট বছর বয়সেও স্যার চমৎকার স্পিন বল করতেন। স্পিন বলের জন্য মীজান স্যার আর বোলিং-ফিল্ডিং-এর জন্য মাগলূব স্যারের (মাগলূব আল নূর) ফ্যাকাল্টি টিমে ভূক্তি অবধারিত ছিল। মীজান স্যার বল করতে নামলে মাঠের পাশ থেকে ছেলেরা চ্যাঁচাতো - স্যার! বলের মুভমেন্টের মেকানিক্সটা ব্যাটাগো হাড়ে হাড়ে বুঝায়া দেন!! পাকস্থলীর ক্যানসার তাকে আমাদের কাছ থেকে বহু আগেই কেড়ে নিয়েছে, তবু বুয়েটের ক্রিকেট মাঠটা দেখলে মনে হয় মীজান স্যার বল হাতে ছুটে আসছেন তাঁর স্পিনের জাদু দেখাতে - উইকেটের সামনে দুরু দুরু বুকে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে তাঁরই প্রিয় কোন ছাত্র।

দ্য স্কারলেট লেটারের কথা ও গল্প শুনেছিলাম মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়! ইংরেজীর শিক্ষক গোলাম মোস্তফা স্যারের কাছে। স্যার কী প্রসঙ্গে এই বইয়ের কথা বলেছিলেন সেটা যেমন মনে নেই, তেমন মনে নেই স্যারের ব্যাখ্যা - শুধু বইটার নাম মনের মধ্যে গেঁথে গেছে তার প্রথাবিরোধী গল্পের জন্য। আমরা এইটে ওঠার আগেই গোলাম মোস্তফা স্যার শিক্ষকতা করতে মধ্যপ্রাচ্য চলে যান, খুব অল্প দিন তিনি আমাদের পড়িয়েছিলেন। আর কখনো তাঁকে দেখিনি, কারো কাছে তাঁর কথা শুনিনি। দ্য স্কারলেট লেটারের গল্প বলার জন্য স্যার এখনো আমার মনে আছেন।

সবুজ বই পড়ার সুযোগ হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়। তখন লেখক কাম ধারণার প্রবক্তার কিছু কিছু ধারণা চমৎকৃত করেছিল। আরো পরে যখন এক-আধটু পড়াশোনা করার, জানা-বোঝার সুযোগ হয়েছে তখন সবুজ বই পড়ে বুঝেছি স্বল্প শিক্ষিত মানুষ কী বিপদজনক হতে পারে! বিশেষত তার হাতে যদি অ্যাবসলিউট ক্ষমতা থাকে।

অটঃ নীলক্ষেতে যান, আজিজে যান আর সে সময়ে ফোনে আমাকে একটু জিজ্ঞেস করতে পারেন না! আপনার বাসা থেকে বনানীর সামনে দিয়ে আসার সময় বিড়িখোরটাকে ধরেও তো আনতে পারেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

স্মৃতি বড় জ্বালাময়ী ও সর্বভূক, পাণ্ডব। সেখানে শুধুই ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস। তবুও আমরা স্মৃতির কাছেই ফিরে আসি।

অফিসের কাছে তুমি যা ব্যস্ত থাকো, তোমার কি সারাদিনের জন্য সময় হবে?

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

স্যাম এর ছবি

চলুক
আমাকে মনে করিয়ে দিলেন পিসিমনির কথা!
কোন বই না একেবারে প্রথম হাতে খড়িই তার কাছে - স্কুল এ যেতে চাইতাম না - শুধু পিসিমনি যতটুকু পড়াবে ততটুকু! তার কাছে তো পড়তে হতনা - শুধু গল্প শুনতাম! সবই রুপকথা বা মিথোলজি। কিন্তু গল্প বলার পর তার শর্ত ছিল যে চরিত্র পছন্দ ছিল তার নাম লিখে দেখানো হাসি এভাবে অ আ ক খ, আ বি সি ডি, ১ ২ ৩ ৪-----
একবারে ক্লাস টু তে ভর্তি হই তাও পিসির স্কুলে - ভর্তি হয়েই দেখলাম আমার আশঙ্কাই সত্যি ছিল -পড়ালেখা মানে অন্য জিনিস- পিসির মত কেউ পড়ায়না -আর সেই যে কঠিন জীবন শুরু হল - উফফ---

'দি স্কারলেট লেটার' মুভিটা কেমন লেগেছে?

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ঘরে ঘরে আপনার পিসিমনিদের মতো খালা-মাসী-ফুফুরা আছেন বলেই তো আমাদের শৈশব এত আনন্দ উচ্ছ্ল।
'দি স্কারলেট লেটার' মুভিটা দেখিনি ভাই।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ রাজাসাহেব।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

কল্যাণ এর ছবি

ভালো লেগেছে রোমেল ভাই। আপনি কেমন আছেন?

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ কল্যাণ ভাই,
আমি ভালো, তুমি ?

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

কল্যাণ এর ছবি

আমিও ভালো হাসি

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

এইতো মাত্র সেদিনের কথা। ভাল থাকুন।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ,
ঠিক বলেছেন, এইতো সেদিন।
আপনিও ভাল থাকুন।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তানিম এহসান এর ছবি

লেখাটা পড়ে মনে হলো বিষন্নতা গ্রাস করা সময় যাচ্ছে... ভালো থাকবেন ভাইয়া।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

না, কোথায়? এই তো হাসছি। হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তাসনীম এর ছবি

চমৎকার লাগলো রোমেল ভাই।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ, তাসনীম ভাই।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তিথীডোর এর ছবি

চলুক হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তারেক অণু এর ছবি

লেখা -গুড়- হয়েছে

বইমেলার জন্য হাতে সময় রেখেন, মোলাকাত হবে।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।