খামরঙা বড় বড় সব কার্টুন বাক্সগুলো বাইরের বারান্দায় রাখা হয়েছে। একে একে বাড়ির প্রায় সব মালামাল ওই কার্টুনে ভরে ফেলেছে বাবা আর মতিন কাকু। এখন চলছে টেপ ফিতে দিয়ে মুখ আটকানোর কাজ। ‘ক্যাঁচ ক্যাঁচ’ শব্দ করে মতিন কাকু ইয়া লম্বা একটা টেপ টেনে বের করলেন রোল থেকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আরে দূর, কাঁচিটা কই রাখলাম?’
বাড়ির একেকটা ঘরে গিয়ে পিউলি অবাক হয়। এত জায়গা ছিল তাদের ঘরগুলোয়? ছোট্ট একটা তালি দিলে কেমন অদ্ভুতভাবে তালির শব্দটা এই দেয়ালে ওই দেয়ালে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়! পিউলি ‘এই-এই’ বলে খানিকক্ষণ চেঁচায়। দেয়ালগুলো সেই শব্দও ফিরিয়ে দেয়। কী অবাক করা দেয়াল এই বাড়ির। কই, এত দিন তো এরা চুপ করেই ছিল। আজ চলে যাবার সময় এত কথা কেন বলছে?
সকাল বেলায় বাড়ির বাইরে একটা ট্রাক এসে থেমেছে। ট্রাক থেকে নেমেছে নোংরা সাদা গেঞ্জি পরা তিনজন লোক। রাস্তায় দাঁড়ানো এই ট্রাকটার জন্যে পিছনের গাড়ি আর রিকশা ঠিক মতো এগোতে পারছে না। ওদের মধ্যে মাথায় লাল গামছা বাঁধা লোকটা খুব উৎসাহ নিয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে লেগে গিয়েছে। জানালা দিয়ে সেটাই অনেকক্ষণ দেখল পিউলি, শেষে বাড়িওয়ালী দিদাকে ডেকে নিয়ে এলো দেখাবে বলে। দিদা আঁচল দিয়ে চোখমুখ মুছে পিউলিকে কোলে তুলে নিয়ে জানালায় দাঁড়ালেন। এই জানালা দিয়ে তিনি কত দিন পিউলিকে পাখি দেখিয়ে ভাত খাইয়েছেন। বৃষ্টি দেখিয়ে কান্না থামিয়েছেন। আজকে কি এটাই শেষ বার এক সাথে জানালায় দাঁড়ানো?
পিউলির জন্মের দেড় বছর আগে ওর বাবা-মা এই বাড়িটায় এসেছিলেন। বাড়িওয়ালী দিদাকে পিউলির বাবা-মা ডাকে ‘খালাম্মা’ বলে। আর সে ডাকে ‘দিদা’। পিউলির এই দিদা যে তাকে কী বলে ডাকে তা সে নিজেও জানে না। কখনও পাখি-কখনও সোনা-কখনও মানিক আবার কখনও গুলগুলি। আরও কত কী ! পিউলি সেই সব নাম শুনে হাসে। আগে যখন ছোট ছিল সে এত হাসত না। এখন কেবল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। কত কী বুঝতে শিখেছে। নিজের নাম ছাড়া অন্য নামে ডাকে কেউ? দিদাটা যে কি বোকা !
এই তো কালকেই পুরনো জামা-কাপড় সব গুছিয়ে বাক্সে তোলা হচ্ছিল। কত পুরনো, বাতিল কাপড় মেঝের ওপর এনে জড়ো করা হচ্ছে। ঘরের ভেতর ঝিম ধরা পুরনো একটা গন্ধ। ঠিক তখনই আলমারি থেকে বের হয়ে পড়ল কমলা রঙের এক জোড়া উলের মোজা। আরে, এটা কী? পুতুলের মোজা? এইটুকু কেন? পিউলি হেসেই গড়াগড়ি। ‘মা তুমিও কি পুতুল খেলতে?’
মাও হাসেন। ‘এটা তো তোরই মোজা বোকা! যে বার খুব শীত পড়ল ঢাকায় তোর দিদা বুনে দিয়েছিল। তুই জানবি কী?’
পিউলি সেই মোজা জোড়া হাতে নিয়ে দিদাকে দেখাতে নিয়ে গেল। তারপর ফিরে এলো খালি হাতে, ‘মা, দিদা মোজা দুটো রেখে দিয়েছে!’
মা একটু অবাক হলেন, তারপর বললেন, ‘থাক, ওই মোজা আর কী কাজে লাগবে তোর?’ তারপর একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন, ‘ইস, আর কটা দিন যদি থেকে যেতে পারতাম! এই ভাবে খালাম্মা একা একা থাকবে কীভাবে?’
‘মা, নতুন যারা আসবে তাদের কি ছোট বাচ্চা আছে? মোজা লাগবে?’
‘জানি না মা, আমি তো শুনেছি বাচ্চা আছে দুজন। তবে তারা বড়, স্কুলে পড়ে।’
‘ওদের কি ছেলেধরা ধরে নিয়ে যেতে পারবে না?’
মা হেসে ওঠেন, ‘তোর দিদা যে কী সব গল্প বলে তোকে ভাত খাওয়াত! ছেলেধরার গল্প তোর এখনও মনে আছে?’
কত কী গল্প বলতেন দিদা! তার একটা ছিল লোহার রাস্তার গল্প। সেই রাস্তা দিয়ে কেউ যেতে পারত না, গরমে পা পুড়ে যেত। তারপর একদিন এলো এক কাঠুরিয়া, সে কী বলল জানো? ‘কী বলচে দিদা?’ বলব সোনা, আগে এই দলা ভাতটুকু মুখে দাও! হ্যাঁ, এই তো। তারপর সেই কাঠুরিয়া...
‘খাতুরিয়া কী?’
‘ওহ হো, ভাত মুখে দিয়ে কেউ এত কথা বলে?’
দিদার পোষা বেড়াল শাদুমনিও গল্প শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ত। দিদা পিউলির চুল আঁচড়ে, ঝুঁটি বেঁধে, পাউডার মাখিয়ে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন। বারান্দার এ মাথা ও মাথা কোলে নিয়ে বার কয়েক ‘খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো’ গাইলেই পিউলি গভীর ঘুমে একদম কাদা। শুধু ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা মুখ থেকে ছাড়ানো যায় না!
সেই পিউলি দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। ভাত খাবার প্লেট-গ্লাস সব গেল পালটে। শাদুমনির দুটো বাচ্চা, তারাও কত বড় হয়ে গেল। পিউলি এখন নিজেই তাদের বানিয়ে বানিয়ে কত গল্প শোনায়। কাঠুরিয়ার গল্প, ডাইনি বুড়ির গল্প, চোরের গল্প... ওরা কিছু বোঝে কি না, কে জানে? দিদার কাছে শোনা গ্রামের বৃষ্টির গল্প শোনায় পিউলি। দিদাই তো একদিন বলেছিল, ‘খুব বৃষ্টির দিনে এক বার গ্রামে চলে যেও মানিক। সেখানে আকাশ থেকে মুক্তোর মতো ঝরে পড়ে পানির ফোঁটা। দূরের বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে থাকে ঘরবাড়ি। টিনের চালে কি সুন্দর শব্দ হয় নূপুরের, জানো? সেই শব্দ শুনে ছোটবেলায় আমাদের যে কী আনন্দ হতো! মনে হতো পরীরা নাচছে। বলে কী করে বোঝাই?’
‘দিদা, আকাশের পাখিগুলো ওই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যেত?’
‘গাছের ডালে, পাতার আড়ালে কত জায়গায় লুকাতো!’
জানালা দিয়ে হাত বাড়ায় পিউলি, ‘ওই যে পাখি গুলো কোথায় চলে যায়, আবারও ফিরে আসে?’
‘হ্যাঁ দাদু, যত দূরেই যাক না কেন একদিন ঠিক ফিরে আসে।’
খামরঙা বড় বড় সব কার্টুন বাক্সগুলো ট্রাকে তোলা হয়ে গেছে। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, খাট কিছুই বাকি নেই। অফিসের সাদা গাড়িটায় নিয়ে তোলা হয়েছে টিভি সেট। এঘরে ওঘরে পড়ে আছে শুধু এক রাজ্যের ধূলো। আশেপাশে ময়লা খবরের কাগজ আর পুরনো শিশি-বোতল।
বাবা আর মা এসে সালাম করল পা ছুঁয়ে, ‘খালাম্মা, আসবেন বাসায়। বেশি দূরে তো না।’
দিদা এক হাতে জড়িয়ে ধরে আছেন পিউলিকে। ‘তোমরাও এসো মাঝে মাঝে। আমার আর কোথায় যাওয়া হয়!’
মতিন কাকু ভীষণ শব্দ করে বাইরের দরজাটা টেনে আটকে দেয়। সিঁড়ির কোনে বসে থাকে শাদুমনি আর তার বাচ্চারা । গাড়িতে বসে পিউলি দেখে মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। বাবা গম্ভীর মুখে হাসি টেনে জানালা দিয়ে হাত নাড়ে। পিউলি মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আঙ্গুল ঠেকায় পেছনের কাচে, ‘দিদা আমরা আবার আসব।’
জানালার গ্রিল আঁকড়ে থাকে দিদার আঙ্গুল। অনেক দিনের স্মৃতি আটকে আছে এই জানালায়। কত ভোরের গল্প, কত পাখির গল্প, কত তারার গল্প। স্মৃতির আকাশে কত মেঘের আনাগোনা। আবারও ফিরে এসো ছোট্ট পাখি। তোমাকে কোলে নিয়ে আমি বৃষ্টিপরীর গল্প শোনাব।
মন্তব্য
খুব অলস কোন লেখকের নাম মনে করতে হলে অনায়াসে আমার নাম মনে করতে পারেন। শিশুতোষ এক পত্রিকার সম্পাদকের দাবড়ানিতে শেষ পর্যন্ত তড়িঘড়ি একটা গল্প লিখে হাতে দিলাম। তবে, আমি ভুলে যাইনি- গল্প লিখলেই সবার আগে চেখে স্বাদ পরখ করার অধিকার সচল পাঠকদের।
সায়েন্স ফিকশন গুলি মিস করছি। কিন্তু এই গল্পটাও খুব মায়া মাখা।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
আর মিস করবেন না। কথা দিলাম।
বাহ, নীড়পাতায় আজ দু-দুটো পিচ্চিতোষ গল্প!
ভালৈসে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ছোটবেলায় একেকবার বাসাবদল করতে কি যে কষ্ট লাগত!
কখনও কখনও বাড়ির সাথে স্কুলও বদলে গিয়েছিল।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল সেসব জায়গায়একবার যাবার যেখানে আমি ৮০ দশকের শেষটা আর ৯০ এর শুরুতে কাটিয়েছি।
হয়ে ওঠেনি আর সেটা।
থাকুক না হয় জায়গাগুলো স্মৃতির কোটরেই, রিফ্রেশ করলে হয়ত হতাশ হব একসময়ের প্রতিদিনকার খেলার মাঠের যায়গায় সুবিশাল অট্টালিকা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
শুভেচ্ছা
বছর দুয়েক আগে, আশির দশকের শেষটা ঢাকায় যে বাড়িতে কাটিয়েছিলাম সেই বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলাম।
সেই বাড়িটা প্রায় আগের মতোই আছে তবে এখন অফিস হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে।
বাইরে থেকে এক আধটু ঘোরাফেরা করে ফিরে এলাম
জীবন আসলে এমনই। শেষ পর্যন্ত সব ফেলে রেখে যেতে হয়।
খুব ভাল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ
ছোটবেলায় বাসা বদল আর মামা'র বাড়ি থেকে ছুটি শেষে নিজেদের বাসায় ফেরা এরচেয়ে দুখের কিছু আর ছিল না আমাদের। গল্প অনেক ভাল হইছে
বাসা বদল আর মামার বাড়ি থেকে ফেরা
এই দুটো ব্যাপারেই আপনার সাথে মিল আছে।
লেখাটা খুব ছুঁয়ে গেলো। মনটা খারাপ করে দিলেন কিছুটা।
---এবিএম।
শেষ দিকে এসে মনটা আমারও খারাপ হয়েছে কিছুটা।
মানুষের সাথে মানুষের এই যে বন্ধন - এর জন্যই আমরা মানুষ। মানুষ ছাড়া আর কে পারে এমন করে ভালোবাসতে? (ঘৃণা করতেও, কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ)। অচেনাকে নিমেষেই চেনা করে নেয়া, অথবা আত্মীয়তার বন্ধন ছাড়াও আত্মার আত্মীয় হয়ে যাওয়া, সুখ-দু:খ একসাথে ভাগ করে নেয়া - এই নিয়েই তো মায়ার বন্ধন।
মায়ার বন্ধন নিয়ে খুব মায়াকাড়া গল্প হয়েছে।
____________________________
মজার বেপার হোলো এই শুক্রবারে আমরা বাসা বদল করবো ,
গুড লাক
একজন উদার মনের বাড়িওয়াল যেন পান।
ভালৈচে
থ্যাঙ্কু দিচি !
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অনেক দিন আগের ১ টা স্মৃতি ভেসে উঠল মনের মধ্যে। আমিও ঠিক এই ভাবেই একবার বাড়ী বদলের শিকার হয়েছিলাম।
এখানেও ভুল করেছি। সরি দাদা।
---- ঋতম
কোথায় ভুল করলেন?
কিছু বুঝতে পারলাম না তো
আর বলেন কেন, নতুন নতুন এসেছি তো, খালি মন্তব্যের তলায় নাম লিখতে ভুলে যাচ্ছি। তবে গল্পটা দারুণ হয়েছে। চালিয়ে যান।
-- ঋতম
ঋতম, মন্তব্য করার সময়ে যেখানে গেস্ট রাইটার লেখা আছে সেখানে নিজের নাম দিয়ে নেবেন আর ই-মেইল অ্যাড্রেস দিয়ে দেবেন, তাহলে সুবিধা হবে।
____________________________
অসাধারণ !
বাড়ি ছেড়ে আসা মানে কেবল বাড়িটা ছেড়ে আসা তো নয়, অসংখ্য ছোট বড় স্মৃতিকে ফেলে আসাও!
হঠাৎ কোন খালি বাসায় হাজির হলে ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর টুকরো চিহ্নগুলোতে নিজেদের ছেড়ে আসাটুকু মনে পড়ে, আনমনা হতেই হয়।
আরো কত যে ছেড়ে যাওয়া বাকি জীবনে!
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
ভালো লাগলো গল্পটা। আর অভিনন্দন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ নজরুল ভাই
নতুন মন্তব্য করুন