একটুখানি মজা, একটুখানি স্মৃতি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৭/০৮/২০১১ - ৯:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইউনিভার্সিটি জীবনের তিন বছর শেষ করে চার বছরে পা দিলাম, কিন্তু আজকের আগে কখনো 'ডি ইউ' বিখ্যাত লাল বাসগুলোতে চরা হয়নি। আজকে আমার ভাইয়ের বদৌলতে এই অভিজ্ঞতাটা হল, আর বুঝলাম, জীবনের এক বিশাল মজা থেকে এতদিন নিজেকে বঞ্চিত করেছিলাম। এই অসাধারণ অভিজ্ঞতাটা ছাড়াই যদি আমার ভার্সিটি জীবনটা শেষ হয়ে যেত, তাহলে এই আফসোস করার মত সুযোগও মনে হয় পেতাম না।

আমার গন্তব্য ছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট । মিরপুর হয়ে আসতে হবে এখানে, সময়টা একটু বেশি লেগে গেছে ঠিক, কিন্তু ভীষণ মজায় মুহূর্তগুলো কেটে গেছে, বুঝতেই পারিনি। বিশাল রাস্তা আর ঢাকার ট্রেডমার্ক জ্যাম পার হয়ে যখন বাসার কাছে এসে পৌঁছুলাম, ততক্ষণে দেড়ঘণ্টার মত সময় চলে গিয়েছে। আশ্চর্য, টেরই পাইনি একদম।

কার্জন হলের সামনে থেকেই তো প্রতিদিন এই টকটকে লাল রঙের বাসগুলো ছাড়ে। তাই জায়গা পেতে হলেও ওখান থেকেই বাস ধরতে হবে। কিন্তু আমরা বাসে উঠলাম টিএসসি এর সামনে থেকে, তাই যা হওয়ার তাই হল, "no seat vacant."যাই হোক, মিথ্যা বলবনা, প্রথমে খুব হতাশ হয়েছিলাম, এত বিশাল রাস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে চিন্তা করে। পরিচিত দুই একজনের সাথে দেখাও হয়ে গেল, যাদের সাথে শুধু হয়তোবা ফেসবুকেই কথা হয়, এছাড়া দিনের পর দিন দেখা কথা কিচ্ছু হয়না। অথচ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, প্রায় একিসাথেই যাতায়াত, অথচ কখনো দেখা হয়নি এর আগে। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত লাগল নিজের কাছে।

যা হওয়ার তাই। জায়গা পেলামনা, আমার ভাইটাও না। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রওনা দেয়া। বাসটা দ্বিতল, জায়গাও প্রচুর, কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণকে সমর্থন করে এত বড় বাসটাতে তিল ধারণের জায়গা নেই। পড়ার বইতে পড়েছি, ছোট্ট একটু জায়গায় অনেকগুলো মানুষ থাকলে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটা হয়, তা অক্সিজেনের অভাব বা অন্য কোন কারণে হয়না, হয় তাপমাত্রা আর আর্দ্রতার জন্য। আজকে তা ব্যবহারিকভাবে আবিষ্কার করলাম। আবহাওয়াটা তেমন গুমোট ছিলনা, তবু মনে হচ্ছিল আর্দ্রতার জন্যই দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।

ঝুলতে ঝুলতে রওনা দিয়েছি, দোতলায় উঠে যাওয়ার সিঁড়িটাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমার ভাইটা একদম দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে , ওর সাথে কথা বলার কোন সুযোগ হচ্ছেনা। আমি আর আরেকটা মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়ানো, অনেকটা চিরে চ্যাপ্টা অবস্থা, বাস ব্রেক করলেই একজন আরেকজনের গায়ের উপর পড়ে যাচ্ছি। তবে এই পাশাপাশি দাঁড়ানোটাই আমাদের ঠিক মত দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করছে। সিঁড়ির একেবারে কাছে দাঁড়ানোতে কোন স্টপেজ আসলেই সবচেয়ে বেশি ভুগছি আমি, বারবার একবার এইপাশে, আরেকবার ওইপাশে করে জায়গা করে দিচ্ছি বের হওয়ার জন্য।

তবে এটাও ঠিক কিছুক্ষণের মধ্যেই এই খারাপ লাগা ব্যাপারটা চলে গেল, আর এজন্য ধন্যবাদ দেব বাসে ওঠা কতগুলো অপরিচিত মুখকে,পুরো সময়টা যারা নিজেদের কথাবার্তায় আমাকে নির্মল আনন্দ দিয়ে গেছে , তারা নিজেরাও সেটা জানেনা। আর বুঝতে পারলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আসলে কতটা "মহা ট্যালেন্টেড"। কত রকম কথাবার্তা যে কানে আসল, হেন কোন বিষয় নেই যেটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া হয়নি। কখনো কমিউনিজম, কখনো ডান বাম রাজনীতি, আবার হঠাৎ করে আলোচনা ঘুরে যায় ৭১ এর দিকে।বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বোকামি, বার্সেলোনার খেলা পর্যালোচনা,ক্ষণে ক্ষণে বিষয় বদলাতে থাকে। নানা মুনির নানা মত, আলোচনা চলতেই থাকে। সত্যি হোক আর মিথ্যা হোক, ওদের কথাবার্তার গভীরতা দেখে মাঝে মাঝে হাসি পাচ্ছিল, আবার মাঝে মাঝে অবাক লাগছিল। এই অদ্ভুত আলোচনার নীরব দর্শক হয়ে ছিলাম আমি আর ওই মেয়েটি , ঝুলতে ঝুলতে পুরো রাস্তাটা আসলাম যার সাথে।

একসময় পথ ফুরিয়ে আসে, একে একে কানায় কানায় ভরা বাসটার মানুষগুলো নিজের নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে থাকে। একটা ব্যাপার যেটা না বললেই নয়, আমার খুব ভাল লেগেছে। দেখলাম, পরিচিত হোক অপরিচিত হোক একজন আরেকজনকে নিশ্চিন্ত মনে নিজের পোটলাখানা ধরিয়ে দিচ্ছে, নামার সময় শুধু একটা আওয়াজ দিয়ে নিয়ে নেমে যাওয়া। পাবলিক বাসগুলোতে চরতে চরতে এমনটা চিন্তাই করতে পারিনা। এই নির্ভরতা ভাল লাগল খুব।

সবচেয়ে শেষের গন্তব্যটা ছিল আমার। ততক্ষণে পুরো বাসটা ফাঁকা হয়ে গেছে। ভাইটার সাথে গল্প করতে করতে বাকি রাস্তাটুকুও পার হয়ে আসলাম। এই দাঁড়িয়ে নিয়ে আসা, অসুবিধায় ফেলে দেয়া এসবের জন্য আমার কাছে দুঃখিত বলল অনেকবার করে। কিন্তু আসল কথাটা হল, আমি আসলে এই "জার্নি বাই বাস" উপভোগ করেছি। ভীষণ।

তাই ধন্যবাদ জানাব আমার কাজিন ভাইটাকে, আমাকে ধরে বাসে উঠানোর জন্য। নাহয় এমন মজার আর অদ্ভুত অনুভূতি আমার কখনই পাওয়া হতোনা।

- আফরিনা হোসেন


মন্তব্য

শ্রীকৃষ্ণ এর ছবি

আমি আমার ইউনিভার্সিটির বাসের হেল্পার হইতাম, যখনই বাসে উঠতাম... পুরান দিনের কথা মনে করায় দিলেন... হাসি

বন্দনা এর ছবি

ভালো লাগলো, আফরিনা। আমরা সেই হিসেবে বেশ আরামেই ছিলাম, ছাত্রীদের জন্য আলাদা সিট সংরক্ষিত ছিলো বুয়েট বাসে। জায়গা না পেলে কতদিন গরম ইঞ্জিনের উপর বসে ও গেছি। পুরানো দিনগুলো মেলা মিস করি।

ওয়াসিক  এর ছবি

আমার ইউনিভার্সিটি লাইফ এর সবচেয়ে মজার স্মৃতি ভার্সিটির বাস। প্রতিদিন কিঞ্চিতের দরজায় না ঝুললে ক্যামন যান খালি খালি লাগে। কখনোই বসে যাই না, বাসের দরজায় যে ভাবেই হোক দাড়াইতেই হবে। আর রাতের বেলা সবাই মিলে বাসের ফেসবুক গ্রুপে আড্ডা চোখ টিপি । বাসের কোন সমস্যা হইলে ক্লাস মিস দিয়ে পর্যন্ত চলে যাই।

আমরা কিছু ফ্রেন্ড যখনই ক্লাস শেষ হোক একটা নির্দিষ্ট ট্রিপে একসাথে যাইতে চেষ্টা করি। চিৎকার-চেচামেচি,আড্ডা, গান গাওয়া, রাস্তার উল্টো দিক দিয়া যাওয়া যাতে জ্যামে পড়তে না হয়, বড় ভাইদের সাথে দুঃষ্টামি , আপুদের সাথে চোখ টিপি কত কিছু বলে শেষ করা যাবে না।

সেদিন বাসের ইফতার পার্টি ছিল এক আপু দাড়াইয়া বলল আমাদের জন্য নাকি তারা বাসের "বারান্দায়" দাড়াইতে পারে না!! এর পরের দিন ওই আপুও আমাদের সাথে দরজায় ঝুলছে !

ভার্সিটির বাস যে কত মজার এইটা যারা চরছে তারাই শুধু বুঝবে, আর যারা বাস এর বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে ভাল ভাবে জড়িত , বাসের দরজায় নিয়মিত দাঁড়ায় বাস নিয়া তাদের অনুভুতি বলে বুঝান সম্ভব না !

নিবিড় এর ছবি

কিঞ্চিতের কথা আসায় বহু পুরান কথা মন পরল। আচ্ছা রনি কি এখনো কিঞ্চিতের হেলপার হিসেবে বহাল তবিয়তে আছে?

ওয়াসিক  এর ছবি

রনিরা যজয দুই ভাই , আগে রনি ছিল এখন জনি আছে কিন্তু কিঞ্চিতের সবাই এখন জনিকেই রনি ডাকে !! আর জনি বেটা এমন ফাজিল ব্যাপারটা ফাস করে না খাইছে

guest_writer এর ছবি

চৈতালী আর কিঞ্চিত দুটোতে ঝুলেছি...খুবি মজার একটা সময় যেন বাসে চড়া...অনেক আলোচনা সমালোচনা তর্ক-বিতর্ক সব মিস করি খুব...
nawarid nur saba

MS.DHONI এর ছবি

আপ্নার উপর খুব হিনং্শে হচ্চে

রুমঝুম এর ছবি

আমাদের ভার্সিটির (চট্টগ্রাম) সবচাইতে জনপ্রিয় বাহন ছিল শাটল ট্রেন। আপনার লেখা পড়ে মনে পরে গেল সেই ট্রেন ভ্রমনের কথা। বগিতে জায়গা না পেলে বসতাম পাদানিতে...এত মজা লাগত যে পরে আর জায়গা পেলেও পাদানিতে না বসে পারতামনা...আমাদের বন্ধুরা শাটল ট্রেনের দেয়াল পিটিয়ে গলা ফাটিয়ে যে গান গুলা গাইত, তা হয়ত খুব উচ্চ শ্রেণীর সংগীত হতনা।।কিন্তু খুবই মজা লাগত। মনে আছে হায়দার হুসেনের "মন কি যে চায় বল" গানটা গাওয়ার সময় "চোখে চোখে" কে কতবার একদম এ বলতে পারবে তার কম্পিটিশন হত...।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

জীবনে এমন এক ভার্সিটিতে পড়েছি যার কোনওকালে কোনও বাসই ছিলোনা।

লেখা ভালো লেগেছে।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

অদ্রোহ এর ছবি

হলে থাকার সুবাদে বাসে চড়া হয়েছে কদাচিৎ। তাই অনেকটুকু কল্পনাই করে নিতে হল হাসি

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চলুক

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

নিবিড় এর ছবি

একদা শ্রাবণ (মুগদা) বাসের যাত্রী ছিলাম। তা সেই প্রথম শ্রাবণ যাত্রার কাহিনি মোটেই ভুলবার নয়। তখন মোটে ইউনিতে ভর্তি হইছি কয়েকদিন, ভার্সিটির বাস আছে জানি কিন্তু ঠিক কোন রাস্তা দিয়ে কখন যায় এইটা জানি না। একদিন বাসা থেকে ক্লাসে যাওয়ার জন্য মাত্র বের হইছি তখন দেখি লাল রঙের সবচেয়ে ভাঙ্গাচুরা শ্রাবণ বাস একটু দূরে দাড়ানো। দৌড় দিয়ে কোন রকমে বাসে উঠার আগেই দিল বাস ছেড়ে এবং একদম শেষমূহুর্তে কোন রকমে বাসের পাদানিতে পা দিলাম কিন্তু এরমধ্যে আমার কাধে ঝুলানো ব্যাগ বাবাজি কেমনে জানি বাসের হ্যান্ডেলের সাথে আটকে গেল এবং ফলাফল স্বরূপ আমি অর্ধেক শরীর বাসের ভিতরে আর অর্ধেক বাহিরে লটকে গেলাম। এরমধ্যে বাসের বাকিরা চিতকার শুরু করল মামা বাস থামান, বাস থামান। শ্রাবণ বাসের মামা ছিল পুরাই পাগল এবং তাকে কখনো থামতে বললে আর জোরে টান মারত। সেই নিয়ম অনুযায়ী আমাকে অর্ধেক ঝুলন্ত অবস্থায় মামা ফুল স্পীডে টেনে খিলগাও ফ্লাইওভারে উঠে গেল। আর বাসের দরজার কাছে থাকা বাকীরা আমাকে টেনে ভিতরে আনার চেষ্টা করতে করতে বারবার মামাকে থামতে চিতকার করার মাঝে হঠাত মামার হুশ হল। ওভারব্রিজের উপর বাস থামানোর পর সেই অর্ধেক ভিতর আর অর্ধেক বাহির অবস্থা থেকে উদ্ধার পাইলাম। তবে এই পুরা ঝুলন্ত সময় মনে হচ্ছিল মেধাবী ছাত্র হিসেবে পত্রিকার পাতায় নাম উঠার বুঝি আর বেশি দেরী নাই হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।