রসূল মিয়া'র গানের দল

পরিবর্তনশীল এর ছবি
লিখেছেন পরিবর্তনশীল (তারিখ: শুক্র, ২৮/০৩/২০০৮ - ১:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একঃ

একেই বোধহয় লোকে ''মায়াবতী রাত্তির'' বলে।
কাঁচুলী না পরা চাঁদের বুড়ি... ঐ যে ভরা চোখে তাকিয়ে আছে- একপাশে একটু কাটা চাঁদটার ঠিক মাঝখান থেকে। ঐ যে...তার দিকে তাকিয়ে ফোকলা দাঁতে হাসছে। এর চেয়ে মায়াবতী আর কি আছে?
এদিকে আবার- ঝিঁ ঝিঁ পোকা এবং ব্যাঙের দল মিলে একসাথে গান ধরেছে। কেমন অদ্ভুত সেই গান! ঠিকমত শুনলে মানুষের ঠিক বুকের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। চোখ জ্বালা করে ওঠে।

দুনিয়ার কী আজব নিয়ম!- রসূল মিয়া ভাবলেন। সকাল গান গাইবে পাখিরা। আর ঠিক সন্ধ্যা নামলেই ঝিঁ ঝিঁ দের পালা- পাখিদের তখন ছুটি হবে।
ভারী কঠিন সে নিয়ম। একটু এদিক ওদিক হবে না... রসূল মিয়া গত পঞ্চাশ বছর ধরে দেখে আসছেন।

রসূল মিয়া- উঠোনের এক কোণে পড়ে থাকা- দোতারা'টার দিকে তাকালেন। বড় ইচ্ছে করল তার... দোতারা হাতে নিতে। এই চোখ জ্বালা করা রাতে- অবহেলায় পড়ে থাকা দোতারাটার জন্য বড় মায়া হল তার!
কিন্তু রসূল মিয়া জানেন দোতারা আর তিনি হাতে নেবেন না। টিনের চালে ঝপঝপ করে বৃষ্টি পড়া... কোন রাতে বৃষ্টির সাথে সাথে তার দোতারা বেজে উঠবে না।
তিনি যে মনোয়ারাকে কথা দিয়েছিলেন!

মনোয়ারা!
আহা! নামটা মনে আসলে বুকের ভেতরটা এমন করে কেন?
এখনো কেন মনে হয়... এই এক্ষুণি মনোয়ারা এসে তার পাশে বসবে। পান খাওয়া...রাঙা ঠোঁটে বলবে...
- খাইতে আসেন।

মনোয়ারা কখনো তাকে তুমি করে বলল না। কত চেষ্টা! কত হুমকি! মনোয়ারা তুমি করে বলল না কোনদিন!
- বউ আমারে তুমি কইরা কওনা ক্যান?
- যা! কী যে কন? আপনে না আমার মুরুব্বী।
এত লজ্জা পেতে জানত মনোয়ারা! রসূল মিয়া যখন তার চুলে হাত রাখতেন... লাল মুখটা আরো লাল হয়ে যেত...
- আমি তো তোমার জামাই! জামাইরে বুঝি তুমি কইরা কইলে পাপ হয়?
- হ...আমার হয়।
মনোয়ারা ছুটে পালিয়ে যেত। সেই পালিয়ে যাওয়া-ও বড় মধুর ছিল। বড় মধুর ছিল!
রসূল মিয়া চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। কয়েক ফোঁটা চোখের জল... উঠোনের ওপর পেতে রাখা পাটিতে গিয়ে পড়ে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার দল গান গেয়েই চলে। বড় কষ্টের সেই গান!

দুইঃ

- ওস্তাদ! কান্দেন ক্যান।
- তরে কতবার কইছি... আমারে ওস্তাদ ডাকবি না। রসূল মিয়া কারো ওস্তাদ না...
তরে কতবার কইছি????
ওসমান তার ওস্তাদের খেপে যাওয়া দেখে... ভয় পেয়ে যায়। চাচী মারা যাওয়ার পর থেকে ওস্তাদের যে কী হল। আর দোতারা বাজায় না। পাগলের মত গান গেয়ে ওঠে না। ওসমান রসূল মিয়ার কাঁদে হাত রাখল।
- একটু শান্ত হন ওস্তাদ।
রসূল মিয়া কোনদিকে যেন তাকিয়ে থাকে। চোখের সামনে জমে থাকা পানির জন্য সেটা ঠিক বোঝা যায় না। হয়তবা বুড়িয়ে যাওয়া সেই চাঁদের মাঝে...তিনি তার মনোয়ারাকে দেখতে পান।

ওসমান চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। ওস্তাদের জন্য তার মন ভারী খারাপ হয়। ঠিক এই মুহুর্তে- শিশুর মত কাঁদতে থাকা মানুষটাকে দেখলে বোঝা যায় না- এই মানুষটাই একদিন কত হাসত। গ্রাম থেকে গ্রামে গান গেয়ে বেড়াত। তার কাঁধে হাত রেখে বলত...
- মরণের পরে বেহেশতে গিয়া...খোদাতালা'র কাছে আমি কি চামু, জানস? দোতারা রে পাগলা...দোতারা।

ওসমানের নীচু কণ্ঠ শোনা যায়...
- ওস্তাদ... আইজ লুৎফা'র বিয়া।
রসূল মিয়া দুর্বল গলায় চেঁচিয়ে ওঠে।
- লুৎফার বিয়া... আমি কী করুম?
- ওস্তাদ। আপনে জানেন না?... আপনে গান না গাইলে লুৎফা কবুল কইব না... আপনে দোতারা না বাজাইলে আমরা গান করুম না!
রসূল মিয়া কঠিন কিছু বলতে গিয়ে থেমে যান। শুধু গলায় জমে থাকা অনেক কথার মাঝে- খুব আস্তে করে বলেন...
- এসব কথা কইস না রে...ওসমান।

তিনঃ

সাত মাস পূর্বেঃ

শুক্রবার।
রসূল মিয়ার গানের দল- তিন দিন পর গ্রামে ফিরল। নোয়াপাড়ার জমিদার বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল। চেয়ারম্যান সাহেব গান শুনে খুব খুশি হয়েছেন। চার হাজার টাকার বায়নার উপর আরো একহাজার টাকা বখশিস দিয়েছেন। তাছাড়া তিনদিনই ভরপেট খাওয়া-দাওয়া। একেবারে রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার।
জমির আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওসমান ফূর্তির ভঙ্গিতে বলল...
- যা খেলা দেখাইলেন না ওস্তাদ।
রসূল মিয়া তৃপ্তির হাসি হাসলেন। আজ তার মনে আনন্দ। ওসমানের মাথায় পরম মমতায় হাত রাখলেন...
- তরা না থাকলে আর হইত রে পাগলা।
এরপর লুৎফার দিকে তাকালেন। মেয়েটার হারমোনির বাজনা শুনলে তিনি ধাঁধায় পড়ে যান। একটা মানুষের পক্ষে এমন সুন্দর বাজানো সম্ভব। তিনি বললেন...
- লুৎফা মা। তুই কী মানুষ না পরী ক তো?
লুৎফা লজ্জায় মাথা নীচু করল। বলল...
- ওস্তাদ। নতুন গীতটা ধরেন না!

'' মানুষ বলে ডাকি তরে
মানুষ বলে কোলে লই...
সোহাগ মাখা নিশি রাইতে
তর লাইগা জেগে রই...
মানুষ কান্দায় মানুষের
বোঝেনি এই পাগল মন...
তবু রেখেছি এই বুকের মইধ্যে
তরে সর্ব ক্ষণ...''
ওস্তাদের গান শুনে এই ভরা দুপুরেও লুৎফার চোখে জল নেমে আসে। ওসমানের মনটা কেমন হয়ে যায়। আজিজের বুকে কিছু একটা আটকে যায়।

বাড়িতে ঢুকেই রসূল মিয়া বউয়ের নাম ধরে ডাকলেন। নোয়াপাড়ার হাট থেকে মনোয়ার জন্য তিনি একটা লাল শাড়ী এনেছেন। পাগলীটা লাল শাড়ি এত পছন্দ করে!
- মনোয়ারা... ও মনোয়ারা।
মনোয়ারা কোন সাড়া দিল না। রসূল মিয়া ঘরে ঢুকে দেখলেন... তার রাঙা বউ... মাটির উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। রসূল মিয়ার হাত থেকে শাড়ি পড়ে গেল। কাঁপা হাতে তিনি মনোয়ারাকে কোলে তুলে নিলেন...
- মনোয়ারা... তোমার কী হইছে... মনু সোনা। মনু সোনা!
- আপনে আমারে থুইয়া গীত করতে চইলা গেলেন...

নতুন লাল শাড়ীটা মনোয়ারা পরতে পারল না। রসূল মিয়া তার নতুন গান মনু সোনাকে শোনাতে পারলেন না। সেই রাতেই মনোয়ারা মারা গেল। রসূল মিয়া অনেক কাঁদলেন সেদিন। গ্রামের সবাই রসূল মিয়ার কান্না দেখে থমকে গেল। কাফনে ঢাকা মনোয়ারার দিকে তাকিয়ে রসূল মিয়া কথা দিয়েছিলেন...
- তোমারে থুইয়া আমি আর কোনদিন গান করুম না...মনোয়ারা।

চারঃ

লুৎফার বাবা রহমত আলী বিশাল ঝামেলায় পড়েছেন। মেয়ে নাকি খুব কান্নাকাটি করছে। তার ওস্তাদ গান না করলে সে কবুল বলবে না। ছেলেপক্ষ ওদিকে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। তিনি নিশ্চয় ছেলের বাবাকে গিয়ে বলতে পারেন না...
- রসূল মিয়া গান না গাইলে... আমার মাইয়া বিয়া করব না।
মেয়ের মনেও এমন একটা দিনে তিনি কষ্ট দিতে পারবেন না। লোক পাঠিয়েছেন রসূল মিয়ার বাড়িতে। দরকার হলে তিনি নিজে যাবেন। রসূল মিয়া নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বললে শুনবে।
এসব গান বাজনা করা লোকদের ভাব একটু বেশি বেশি। আরে ব্যাটা তুই গানের লোক... গান না কইরা তুই আর কী করবি?
অবশ্য তার নিজের মেয়েও গানের দলে ছিল। গানের দলের মেয়ের জন্য যে পাত্র পাওয়া গেছে- এটাই অনেক বেশি।
- ওস্তাদ আইব না।
ওসমান এসে বলল। রহমত আলীর মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি রসূল মিয়ার বাড়ির দিকে ছুটলেন। শিয়ালের কান্না শোনা যাচ্ছে। গ্রামে শিয়াল বেড়ে গিয়েছে। রাত দুইটায় শিয়ালের কান্নায় ঘুম আসে না।
রসূল মিয়ার বাড়িতে ঢুকেই চিৎকার শুরু করলেন...
- রসূল ভাই... রসূল ভাই বাড়িত আছেন?? রসূল ভাই...
কোন সাড়া পাওয়া গেল না। রসূল মিয়ার ছোট্ট বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। তিনি আবার নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। রহমত আলী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন- মেয়েকে দরকার হলে মারদোর করতে হবে। মেয়ের ভালোর জন্যই করা।

নিজের বাড়িতে ঢুকেই রহমত আলী এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন। রসূল মিয়া, তার গানের দল মঞ্চে বসে আছে। হাতে একটা দোতারা নিয়ে...রসূল মিয়া কাঁদছে।

গ্রামবাসী অনেকদিন পর ওস্তাদ রসূল মিয়াকে দেখল। ওস্তাদ রসূল মিয়ার গান শুনল। দোতারার শব্দের সাথে রসূল মিয়ার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে...প্রেমের মরা জলে ডোবে না...

চাঁদের বুড়ি যেন তার ভালোবাসার সব জানালা খুলে দিয়েছে। গ্রামের এখানে ওখানে পড়ে থাকা নিশি অতিথরা যেন রসূল মিয়ার গান শুনছে।
রাত বাড়ছে। রসূল মিয়া একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছেন... মন তুই পিরিত করিস না... নিজের ঘরের উঠোনেতে... সাগরের জল আনিস না...

গ্রামবাসী চোখ মুছল... লুৎফা চোখ মুছল...হয়ত হাজার হাজার মাইল দূরে জেগে থাকা কোন নক্ষত্রও...


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আমিও চোখ মুছলাম......।এভাবেই গান গেয়ে যান।
-নিরিবিলি

পরিবর্তনশীল এর ছবি

তাই নাকি??
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

তাসিফ আহসান দীপ্ত এর ছবি

মনোয়ারা ছুটে পালিয়ে যেত। সেই পালিয়ে যাওয়া-ও বড় মধুর ছিল। বড় মধুর ছিল!

বড় ভালো লাগলো।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ধন্যবাদ
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

তারেক এর ছবি

বেশ লাগলো গল্পটা হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

পরিবর্তনশীল এর ছবি

থ্যাংকু ফিঙে ভাইয়া
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

শিক্ষানবিস এর ছবি

চরম হইতেছে। আরও গল্পের অপেক্ষায়।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

অপেক্ষায় থাকা ভালো কাজ দেঁতো হাসি
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- মাইয়াবতি রাত্তিরের গল্পটা ঐরকমই কোনো সময়ে পড়ার ইচ্ছে ছিলো, মাহুত বন্ধুর সঙ্গে নানা কথোপকথনে চোখের কোণা ভেজানোরও শখ জেগেছিলো মনে!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

পরিবর্তনশীল এর ছবি

হে হে...
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

শেখ জলিল এর ছবি

অপূর্ব কথন। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

পরিবর্তনশীল এর ছবি

জলিল ভাইয়ের মন্তব্য সবসময় আরো ভালো লিখতে উৎসাহ যোগায়...
ধন্যবাদ
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

রায়হান আবীর এর ছবি

তোর হাতে আসলেই জাদু আছে...অতি সুন্দর হয়েছে গল্পটা...
---------------------------------
এভাবেই কেটে যাক কিছু সময়, যাক না!

কনফুসিয়াস এর ছবি

গল্পটা ভালো লাগলো।
রসুল মিয়ার গানটা কি তোমার লেখা? অনেক সুন্দর।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

পরিবর্তনশীল এর ছবি

জ্বী ভাইয়া... এই অধম মাঝে মধ্যে গানটানও লিখে ফেলে...ধন্যবাদ
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

গানটার জন্য অবশ্যই জাঝা ।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আপনেকেও অবশ্যই ধন্যবাদ
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

সুপ্রিয় দেব শান্ত এর ছবি

এই লেখাটা আগে চোখে পড়েনি। অদ্ভুত লাগলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।