তারিফ এক তরতাজা কিশোর, ঢাকার এক কলেজ থেকে সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা পেরুনো। বছর খানেক আগে ওর সাথে ইমেইলে আমার পরিচয়। বাংলা উইকিপিডিয়া নিয়ে বিস্তর ইমেইল চালাচালি, লেখালেখির পর মুনির ভাইয়ের কল্যাণে প্রথম আলোতে এই নিয়ে কিছু নিবন্ধ বেরিয়েছিলো ২০০৬ সালের মার্চ আর এপ্রিলে।
সেই লেখার দৌলতে বেশ কিছু উৎসাহী তরুণ যোগ দেন বাংলা উইকিপিডিয়া প্রকল্পে, বিপুল উদ্যমে কাজ শুরু করেন। আর বাংলা উইকিপিডিয়ার পাশাপাশি ইংরেজি উইকিপিডিয়াতেও বাংলাদেশের উপরে নিবন্ধের কাজ শুরু করেন অনেকে।
এর মধ্যেই একদিন তারিফ ইমেইল করে আমাকে। তখন কলেজে এইচএসসিতে পড়ুয়া তারিফ জানায় তার স্বপ্নের কথা, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দুনিয়ার সব মানুষের কাছে জানানোর স্বপ্ন। এই স্বপ্ন নিয়ে তারিফ কাজ শুরু করে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো সর্বত্র ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়েনি, তাই ওকে প্রশ্ন করেছিলাম ওর ইন্টারনেট সংযোগের কথা। ওর জবাব শুনে তো আমি তাজ্জব বনে গেলাম - তারিফের কোনো কম্পিউটার নেই। গ্রামীণের মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে মোবাইল ফোন দিয়েই ও ইন্টারনেট ব্যবহার, এবং উইকিপিডিয়াতে লেখালেখি করে থাকে। এতো প্রতিকূলতার পরেও নানা বইপত্র ঘেঁটে, অনেক তথ্য যোগ করে তারিফ কাজ করে চলে ইংরেজি উইকিপিডিয়ার ভাষা আন্দোলনের নিবন্ধটির উপরে। মাঝে টেস্ট পরীক্ষা, ও অন্যান্য ব্যস্ততার মধ্যে একটু বাঁধা পড়ে এই কাজে।
২০০৬ এর ডিসেম্বরে আমি দেশে যাই এক মাসের ছুটিতে। ঐ সময় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির আয়োজিত বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতামালায় উইকিপিডিয়ার উপরে বক্তব্য রাখি। অনুষ্ঠান শেষে এক তরতাজা কিশোর ছুটে আসে আমার কাছে। এতোদিন ইমেইলে পরিচয় ছিলো, সেদিন মুখোমুখি হলাম তারিফের। অনেক উৎসাহের
সাথে ও বলে গেলো, ভাষা আন্দোলনের নিবন্ধটিকে ইংরেজি উইকিপিডিয়ার ফীচার্ড আর্টিকলে উন্নীত করা।
এইচএসসি পরীক্ষা এগিয়ে আসলে আমিই তারিফকে বারণ করি, কিছুদিন পড়ার দিকে মন দিতে। পরীক্ষা শেষে মাস দুয়েক আগে, তারিফ আবার কাজ শুরু করে নিবন্ধটার উপরে। বাংলাদেশের অনেক নিবন্ধের উপরে কাজ করা ভারতীয় বন্ধু উইকিপিডিয়ান নীরব মৌর্যের চমৎকার সম্পাদনা, আর তারিফের তথ্য যোগাড় - এই দুই নিয়ে নিবন্ধটা তরতর করে আগাতে থাকে। নীরব মাঝে ডানপন্থী ভারতীয় ট্রোলবাহিনীর চরম আক্রমণে অভিমান করে উইকিপিডিয়া ছেড়ে যায়। তখন তারিফকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসি আমরা অন্যান্যরা। ঢাকার আদিত্য কবীর, কলকাতার দ্বৈপায়ন ও রিয়ানা, এবং খুঁটিনাটি সম্পাদনায় অভিজ্ঞ অনেক বিদেশী লেখক। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী ঘেঁটে অনেক জার্নাল ও অন্যান্য বইপত্রের রেফারেন্স বের করি। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় তারিফের চরম উৎসাহ, আর সারাদিন ধরে লেগে থাকা।
উইকিপিডিয়াতে ফীচার্ড আর্টিকেল হিসাবে নির্বাচিত হতে হলে কঠিন এক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। দাড়ি-কমা, বাক্য, তথ্যসূত্র - সবকিছুকেই যাচাই-বাছাই এর মধ্য দিয়ে পেরুতে হয়। প্রায় মাস খানেক ধরে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছিলো নিবন্ধটা। ২০০৭ সালের ১৬ই জুলাই সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি সুসংবাদ - নিবন্ধটা ফীচার্ড আর্টিকেলের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে - এখন ইংরেজি উইকিপিডিয়ার সেরা সব নিবন্ধের তালিকাতে এটাও যুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে, আমাদের ইতিহাস নিয়ে দুনিয়ার মানুষের কাছে তথ্য যায় খুব কমই। আমরা নিজেরা না জানিয়ে অন্য বিদেশীদের সেই দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকি, আর সত্যের বদলে অপপ্রচার, মিথ্যা সব কথা প্রচার করে এই সব বিদেশীরা। আমাদের ইতিহাস, আমাদের জীবন-ঐতিহ্যের কথা
প্রকাশের চেষ্টা করতে হবে আমাদেরকেই। তারিফ এজাজের মতো উদ্যমী তরুণেরা এগিয়ে আসবে, এসব সোনার ছেলেদের চেষ্টাতে আমাদের দেশের কথা
দুনিয়ার সব মানুষ জানতে পারবে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে তারিফের যেমন স্বপ্ন ছিলো, আমাদের দেশের সোনার ছেলেদের নিয়ে এটাও আমার নিজের স্বপ্ন।
(ইমেইল ঘেঁটে দেখলাম, ১৬ জুলাই ২০০৭ এর ঠিক এক বছর আগে, ১৫ই জুলাই, ২০০৬ তারিখে তারিফ তার ভাষা আন্দোলন প্রজেক্টের কথা বলেছিলো বাংলা উইকিপিডিয়ার মেইলিং লিস্টে)।
(তারিফ এখনো অবশ্য সেই মোবাইল ফোনে উইকিপিডিয়াতে লেখালেখি করে না, এইচএসসি পাসের পরে একটা কম্পিউটার পেয়েছে। আসলে চেষ্টা থাকলে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও অনেক কিছু করা সম্ভব।)
মন্তব্য
ঢাকায় উইকিপিডিয়ানদের এক ছোটখাট সম্মিলনে তারিফের সাথে আমারও দেখা হয়েছিল। কথা বলেই বুঝেছি কতটা উদ্যমী সে। বাংলা উইকিতেই একটি নির্বাচিত নিবন্ধ করতে যে কষ্ট করতে হল, সে তুলনায় ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় নির্বাচিত নিবন্ধ করতে যে কি করতে হবে তা ভাবাও যায়না। এই অসাধ্যই সাধন করেছে তারিফ। তারিফকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। আশা করবো একুশে ফেব্রুয়ারিতে পৃথিবীর সর্বাধিক ভিজিটেড এই সাইটের প্রধান পাতায় নিবন্ধটি স্থান পাবে। উল্লেখ্য, তারিফ এখন বাংলা উইকিতেও লিখে।
রাগিব হাসান এই ব্লগটি লিখে আমার মতে এক গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।
মুহাম্মদ২০১৭
হুম , বোকা মানুষজন এখনও জন্মায় তাহলে ।
ভালো ।
তারিফের মতো বোকাদের ঝাকে ঝাকে জন্মানো ভালো ।
রাগিব , তারিফের ইমেইল এড্রেসটা কি দয়াকরে দেয়া যায় ? একটা মেইল করে অভিনন্দিত করতে চাই ।
জ্বি, এটা আমি প্রায়ই বলি। দেশের জন্য আসলে স্বার্থপর গোছের ভালো ছাত্রের বাহিনীর দরকার নাই ... দরকার হলো ভালো মানুষের।
tarif.ezaz@gmail.com
----------------
গণক মিস্তিরি[
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com
----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম
ধন্যবাদ ।
তারিফের কথা বিস্তারিত জেনে ভালো লাগলো। উইকিপিডিয়ায় দু'একটি আর্টিকেল লিখতে গিয়ে যখনই সাহায্য চেয়েছি, রাগিব-বেলায়েতের মতো তারিফ এগিয়ে এসেছে।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
অভিনন্দন তারিফকে। অন্দরের অন্তস্থল থেকে। এখানে আরও উল্লেখ করছি রাগিবের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
আরিফ ভাইয়ের মত আমিও বলি, বোকাদের সংখ্যা বাড়ুক প্রতিদিন...
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
তারিফকে অভিনন্দন।
Man can do what he wants, But he can't want what he wants
সুখবর, ভাষা আন্দোলনের নিবন্ধটি ২১শে ফেব্রুয়ারি ইংরেজি উইকিপিডিয়ার প্রথম পাতায় ঐ দিনের নির্বাচিত নিবন্ধ হিসাবে আসছে...। সারাদিন ওখানে থাকবে। এই সংক্রান্ত যে আবেদন রেখেছিলাম, তা সফল হয়েছে।
----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com
----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম
জেনে খুশি হলাম
----------
মুহাম্মদ২০১৭
লেখাটির কথা মনে পড়ে গেলো আজ আবার। এরকম হাজারো তারিফের দরকার আমাদের, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্য।
----------------
গণক মিস্তিরি
মায়ানগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | টুইটার
----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম
দুঃখের বিষয়, ঠিক আজকেই এক লন্ডননিবাসী ট্রোলের হাতে এই নিবন্ধটা আক্রান্ত। আঞ্চলিকতাসঞ্জাত ঘৃণার বাড়াবাড়ি কী রকম ভয়াবহ হতে পারে, তা দেখে মনটা খারাপ হয়ে আছে এই একুশের সকালে।
----------------
গণক মিস্তিরি
মায়ানগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | টুইটার
----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম
ইন্টারেস্টিং। ওনাকে একটু বেশি সংবেদনশীল (ওভার সেন্সিটিভ) মনে হলো।
পিপিদা, আসলে এই লোক সংবেদনশীল না মোটেও। গত বহুদিন, প্রায় ৩ বছর ধরে চলছে এই ট্রোলিং। নিজের এলাকার বাইরে সবাইকেই গাল দেয় "ঢাকাইয়া" বলে, আর বাংলাদেশে বাংলা ভাষাভাষীরা নাকি সিলেটি ভাষাভাষীদের উপরে অত্যাচার চালাচ্ছে সাংস্কৃতিক ভাবে এইটাই তার থিওরি। জানিনা, সিলেটবাসীদের কতোজন এর সাথে একমত, কতোজন তাদের ভাষা বাংলা না তা নিয়ে গর্ব করেন এবং বাংলাকে অপছন্দ করেন।
----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম
নতুন মন্তব্য করুন