সবকিছু নষ্টদের অধিকারে ...

রায়হান আবীর এর ছবি
লিখেছেন রায়হান আবীর (তারিখ: মঙ্গল, ২০/০৭/২০১০ - ১২:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাড়ে পাঁচটা পার হয়ে গেলেই মনে হয়, সব শেষ।

মিরপুরে এসেছিলাম আজ থেকে ষোল বছর আগে। তখন পীরজঙ্গী মাজারের আইডিয়াল স্কুলে আসতাম যেতাম বিআরটিসির দোতলা বাসে। ভাঙ্গাচুরা বাসগুলোতে চড়লেই মনে হতো এই বুঝি সব খসে পড়লো। ষোল বছর পর সেই একই বাস আবার আমার বাসায় ফেরার ভরসা। ষোল বছরে তাকে যৌবনদানের জন্য লালের উপর সাদা রং করা হয়েছে, নেইমপ্লেটে লাগানো হয়েছে চৈতালী, বৈশাখী কিংবা ক্ষণিকা নাম। বাস চলা শুরু করলে মনে হয় ইঞ্জিনটার প্রাণ আছে, জীবনের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে সে চিৎকার করছে একটু বিশ্রামের জন্য।

তারপরও সেই আমার ভরসা এখন। এক বাস ভর্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সবাই সমীহ করে। তাই জ্যামের শহর ঢাকা শহরে এই বাস রাস্তার যেকোন সাইড দিয়ে মর্জিমত চলে। কেউ তাকে কিচ্ছু বলার সাহস পায়না। আমরা দুই ঘন্টার বদলে এক ঘন্টায় কাংখিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি।

তাই ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। আমার প্রিয় শেষ চৈতালীটি চলে গিয়েছে গর্জন করতে করতে। এখন আমাকে দুই ঘন্টা কিংবা তিন ঘন্টা ধরে বিশ মিনিটের রাস্তা পেরোতে হবে। এই তিন ঘন্টায় আমি সামনের ও পেছনের লোকদের সাথে জানলা খোলা অংশের দখলদারিত্বে মেতে উঠবো, একফোঁটা বাতাস পাওয়ার জন্য নিজেকে যতোটা সম্ভব নীচে নামাবো। তিন ঘণ্টা পেরিয়ে ঘর্মাক্ত হয়ে আমি বাসায় ঢুকবো। সেখানে অবধারিতভাবে থাকবেনা বিদ্যুৎ। এক ঘন্টা অন্তর আমরা আধাঘন্টার বিদ্যুত পাই, সরকারের বদান্যতায়। সেইসময় আমরা টয়লেটে ঢুকে প্রাকৃতিক কাজ শেষ করে ফেলার চেষ্টা করি, কেননা আর আধাঘন্টা পরেই আমরা কাজ করতে পারবো ঠিকই কিন্তু হয়তো ঠিক ঠাক পরিষ্কার করতে পারবোনা। প্রাকৃতিক কাজ না থাকলে আমরা আধাঘণ্টা সময় কাটাই, অপেক্ষা করতে করতে। কখন আবার সব স্বাভাবিক হবে, হবে অন্ধকার।

জীবনের অনেক কিছু যুক্তিতে বেঁধে ফেলতে পারলেও একটা জিনিসে আমি এখনও কূল-কিনারা করতে পারিনাই। সেটা হলো দেশপ্রেম। সারাজীবন শুনেছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির কথা। শুনেছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি কতোটা 'বস' তার কথা। আমরা শুনেছি, দেশ এমন একটা জিনিস যে আমি এটা ছেড়ে যেখানেই যাবো, আমি সুখ পাবোনা, আমার বারবার ফিরে আসতে ইচ্ছে হবে এইখানে। এইখানে থাকতে ইচ্ছা হবে। এইখানে?

হিসেবে মেলাতে পারিনা। কেন থাকতে ইচ্ছে হবে? কি আছে এইদেশে? আমাদের নেতারা ব্যস্ত একে অন্যকে দোষারোপে। আমাদের ছাত্রনেতারা ব্যস্ত সামনের বিলবোর্ডের চাঁদা তুলতে। আমাদের মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ ব্যস্ত আমাদের ডিপার্টমেন্টের বুয়া নিয়োগে নিজেরে পছন্দের বুয়ার জন্য সুপারিশ করতে।

আমি জানি এইসব হতাশার কথা বলা একদম উচিত না। নেতা নয়, বরঞ্চ আমাদেরই দায়িত্ব এই দেশকে ঢেলে সাজানোর। আমাদের হতাশ হলে চলবেনা। আমাদের লড়াই করে যেতে হবে। হ্যাঁ! লড়াই! আমরা লড়াই করবো। তারপর পাঁচ বছর ঘুরে এক চোর থেকে আরেক চোরের কাছে দেশ যাবে, অল্প কিছু দুষ্ট লোক সম্পদের পাহাড় জমাবেন আমাদের লড়াই বেঁচে। আমাদের বাকি কারও মৌলিক চাহিদা পূরণের কথাও তাদের ভেবে দেখার দরকার নেই। গত পাঁচ বছরের লুটপাটের দোহাই দিয়ে তারা আমাদের আরেকটু ধৈর্য্য ধরে লড়াই চালিয়ে যেতে বলবেন। আমরা লড়াই করবো, করতেই থাকবো। আমাদের আর্তনাদে তাদের কিছু আসবে যাবেনা। আমাদের চিৎকার তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমের বদ্ধ দরজা- জানালা ভেদ করে কোনদিন ভেতরে ঢুকবেনা।

আমরা কেবল এমন একটা লেখা লিখে ফেলার জন্য মনে মনে লজ্জিত হবো ...


মন্তব্য

সবজান্তা এর ছবি

হা হা হা হা হা ...

(হাসি ছাড়া আর কিছু কি বলার আছে? হাসি )


অলমিতি বিস্তারেণ

রায়হান আবীর এর ছবি

কষ্টগুলা উপভোগ করার অবস্থাও নাই মন খারাপ কোন ধরণের কাম হইতেছেনা। কিছু একটা শুরু করতে গেলেই মনে হয়, এই তো যাইবো এখন।

আবির আনোয়ার এর ছবি

চলুক

স্পর্শ এর ছবি

হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতাংশ-

আমার সন্তান আজো জন্মেনি। যদি জন্মে
সে কি জন্মেই পাবে স্বাধীনতা? আমার বাবার
স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়েছিল আমার জীবনে।
আমার স্বাধীনতা কী রকম হবে আমার সন্তানের জীবনে
নাকি তাকেও বলতে হবে আমার মতোই কোনদিন
‘এতদিনে স্বাধীন হলাম।’

অনেকদিন পর লিখলে আবার। ভালো লাগলো। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

রায়হান,
কষ্টগুলো ছুঁয়ে গেলো। অনুভুতিগুলো খুব চেনা। লেখাটা অসাধারণ!

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

রায়হান অনেকদিন পর এলে।
সবকিছুর পরও আমরা টিকে থাকি ভাল কিছুর আশায়।
আশাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
লেখা বরাবরের মতোই খুব ভাল লাগল।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

চলুক

দারুণ লাগলো লেখাটা। আমি লজ্জিতও হবো না, লজ্জা হারিয়ে গেছে...
_________________________________________

সেরিওজা

ধুসর গোধূলি এর ছবি
সাফি এর ছবি

চমৎকার লাগলো লেখাটা

তিথীডোর এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি

খুব শক্তিশালী লেখা। আরো শুনতে চাই এরকম শব্দ ক্ষেপনাস্ত্রের আওয়াজ।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনি,নইলে কোন দিন নয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

অনেকদিন পর রায়হানাবীর...
লেখা নিয়ে কিছু বলার নাই
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সিরাত এর ছবি

একটা মন্তব্য হারিয়ে গেল। মন খারাপ

*

যাহোক, বাধ্যতামূলক লিবারটারিয়ানিজম বাংলাদেশে উপকারী। হাসি

*

আমি আপনার লেখার মূল মেসেজ পেয়েছি, তবে:

এক ঘন্টা অন্তর আমরা আধাঘন্টার বিদ্যুত পাই, সরকারের বদান্যতায়।

আমরা ভাসানটেক লাইনের, ওয়ান অফ দ্য ওর্স্ট। এখানেও কিন্তু দুই ঘন্টায় এক হয়, সহজে এর বেশি হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিন বা আড়াইয়ে এক। উইকেন্ডে বেটার। আপনাদের লাইন কি?

এখন আমাকে দুই ঘন্টা কিংবা তিন ঘন্টা ধরে বিশ মিনিটের রাস্তা পেরোতে হবে।

আমার দেখা সবচেয়ে খারাপ হল গুলশান-বসুন্ধরা স্ট্রেচ, আর কচুক্ষেতের ওদিকটা, ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে। জাহাঙ্গীর গেটের দিকে পিএম অফিসও। কিন্তু কোনখানেই ১:৬ বা ১:৯ হয় না। আমার মনে হয় আপনি একটু বাড়িয়ে বলেছেন।

ক্রিয়েটিভ লিবার্টি সেটা মানি। হাসি

*

অনেকগুলি অনুভূতিগুলোর সাথে মিল পেয়েছি।

রায়হান আবীর এর ছবি

হে হে হে। আমি থাকি মিরপুর এক এ। আধাঘন্টা অন্তর কারেন্ট যাওয়াটা এইখানে অন্তত কমন ব্যাপার। এটলিস্ট এক ঘন্টা কারেন্ট থাকবে এইটাও ... তারপরও বাড়িয়ে বলার একটু লেখকের স্বাধীনতা নিলাম।

তিন ঘন্টার ব্যাপারটা একেবারেই সত্য। ক্ষেত্র বিশেষে আড়াই ঘন্টা। মঙ্গলবার ছাড়া মিরপুর রোডের অবস্থা ভয়াবহ। এইখানে তাই বাড়িয়ে বলার অবকাশ নেই। কারণ-

ইউনিভার্সিটির বাসে উঠি কার্জন হলের গেট থেকে। আর বাস মিস করলে যেতে হয় আজিমপুর। ভার্সিটি থেকে আজিমপুরের রিকসা পাওয়া, সেখানে যেয়ে বাসে উঠা। তারপর আমার বাসা মিরপুর এক থেকে আরও ভেতরে। বুদ্ধিজীবি কবরস্থান। এক নাম্বার থেকে গত ছয় মাস ধরে সুয়ারেজ লাইনে একপাশের রাস্তা বন্ধ। আর ঐ রাস্তাটা ব্যাপক ভীড়ের। কারণ আশুলিয়া থেকে আসা গাড়ি, ট্রাক সব ঐখান দিয়ে ঢাকায় ঢুকে। এইটুকু পেরোতে আমার চল্লিশ মিনিট লাগে, কম করে হলেও আধাঘন্টা। এবং জ্যাম হয় বিধায় কোন রিকসায় যেতে চায়না। হাতে পারে ধরে লাগে দেঁতো হাসি শরীরের সকল শক্তি শেষ হয়ে যায়।

আর পানির কথা তো বললামই না!

উদ্ভ্রান্ত পথিক এর ছবি

বহুদিন পর লেখা পাইলাম তোর!
পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল মন খারাপ
---------------------
আমার ফ্লিকার

---------------------
আমার ফ্লিকার

বাউলিয়ানা এর ছবি

হে হে হে...বিদ্যুত যায় না, মাঝে মধ্যে আসে!!

নিবিড় এর ছবি

স্যার, চৈতালী বাসে চড়েই এই অবস্থা। এইটা হল ভার্সিটির সবচেয়ে ভাল লাইন হাসি আমি শুরুতে দেড় বছরের মত শ্রাবণে (মুগদা) যেতাম। একদিন ইচ্ছে হলে উঠে দেখতে পারেন হয়ত লেখার এই অংশটা আবার লিখতে ইচ্ছে করবে।
আর কারেন্ট থাকবে না এইটা মেনে নিয়েছি অনেক আগেই, শুধু পানির কষ্ট মানতে একটু কষ্ট হয় হাসি
স্যার, ঘুড়ি কি আর আকাশে উড়বে না?


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লেখা ভাল্লাগলো।

------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

পড়লাম ...

আর কি কমু?
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...

মর্ম [অতিথি] এর ছবি

চৈতালী নিয়ে একটা কিছু লেখার ইচ্ছা অনেক দিনের, লেখাটা পড়ে পুরোন ইচ্ছেটা আবার মাথাচাড়া দেবে বোধ হয়!

লেখার মূল বক্তব্য নিয়ে আসলে বলার কিছু নেই- আমরাই বলি, সময়ে আমরাই গা বাঁচাই- এ চক্রেরও শেষ নেই, বোধ হয় আমাদের বোধেরও উদ্ধার নেই..................।

অতিথি লেখক এর ছবি

শুনেছি, দেশ এমন একটা জিনিস যে আমি এটা ছেড়ে যেখানেই যাবো, আমি সুখ পাবোনা, আমার বারবার ফিরে আসতে ইচ্ছে হবে এইখানে। এইখানে থাকতে ইচ্ছা হবে। এইখানে?

সুখে থাকতে মানুষ টের পায় না যে কত সুখে আছে। সুখ যখন উড়াল দিয়ে যায় গা, তখন মনে হয়, অ! সুখেই তো আছিলাম অ্যাদ্দিন!
সত্যি বলব? আমার বিদেশে এসে কেমন জানি খালি খালি লাগে। যেন বিরিয়ানীতে লবন বাদ পড়ছে, এইরকম।
-শিশিরকণা-

স্বপ্নাহত এর ছবি

হে হে । আমিতো শুরুতে ভাবসিলাম পুরান দিনের আর্কাইভ পড়তেসি। তারিখ খিয়াল কৈরা দেখি নতুন লেখা। দেঁতো হাসি

এত দু:খু কইরা লাভ নাই। আল্লাহর কাছে শুকর কর বাসের ড্রাইভার না হয়ে যাত্রী হইসস। নইলে তো সারাদিনই বাসে থাকতে হইতো চোখ টিপি

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

তাপস শর্মা এর ছবি

অসম্ভব সব অনুভূতি। কেন যে এইসব লেখকের লেখা এতদিন মিস করেছি মন খারাপ । কিন্তু উনাকে তো দেখিনা??

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।