পা বাড়ালেই অথৈ পানি...(০৬)

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: বুধ, ০৮/১০/২০০৮ - ৩:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(০৯)
তীব্র কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলে আমি কোথায় কেন কীভাবে, কিছুই মনে করতে পারছি না। হ্যাবলার মতো ছাদের দিকে তাকিয়ে আছি। ধীরে ধীরে স্মৃতি ফিরে আসছে। হাঁ, মনে পড়ছে। রাতে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়েছিলাম ! লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। আশ্বস্ত হলাম যে আমি ঘরেই আছি। ঝট করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আহা, এ কী দেখছি আমি ! ধ্বংশস্তুপ ! এই প্রলয়ের বর্ণনা দেয়া কি সম্ভব !

কোথাকার কী এসে কোথায় কীভাবে পড়ে আছে দুমড়ে মুচড়ে। এগুলো বাঁচিয়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা বুঝি আকাশের থাকে না। নইলে কয়েক ঘণ্টা আগের তুলকালামের পর এমন পরিষ্কার আকাশ হয় কী করে ! নদীও এমন হতো, যদি তার পাড়গুলো সুনসান হতো। কিন্তু তা তো হবার নয়। তাকে আশ্রয় করেই যে গড়ে ওঠে মানুষের লোকালয়গুলো। তাই প্রকৃতির সংহারি স্মৃতি নদীকেও বইতে হয়। আর নদী বুঝি তা ধুয়ে মুছে আবারো তার অধিবাসীদেরকে প্রস্তুত করে তোলে সব কিছু নতুন করে শুরু করতে। গতকাল বিকেলে যে বিশাল বিশাল লঞ্চ আর মাল বোঝাই কার্গোগুলো এসে ভীড়েছিলো, যেতে পারেনি আর। নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে যে স্থানটাকে বেছে নিয়েছিলো, রাতের উল্টোঝড়ে নদীর পানি সরে যেতেই সেই যে কাত হয়ে পড়েছিলো, পানি ফিরে এলেও আর সোজা হয় নি। অর্ধেক পানির নীচে লেপ্টে আছে। চারদিকে গাছপালা একটাও অক্ষত নেই। বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড। যেগুলো খাড়া আছে, চাল নেই। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে যাই, মানুষগুলোর অস্বাভাবিক মনোবল দেখে ! এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ফের নিজেকে সারানো আর সাজানোর পালা। এখানেই জীবন-সংগ্রামী মানুষগুলোর সাথে আমাদের মতো অথর্ব মানুষের বিরাট তফাৎ।

ফিরে এসে দেখি সহকর্মীরা রেডিওতে বিশেষ বুলেটিন শুনছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে যে মহাপ্রলয় ঘটে গেছে তারই বিবরণ। পতেঙ্গা বন্দর থেকে তীব্র জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় ক্রেনবাহী জাহাজ কাগজের নৌকার মতো প্রায় উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে কর্ণফুলি দীর্ঘ ব্রীজে যেভাবে বাড়ি মেরেছে, সাথে সাথে এতো বড়ো সেতুর মাঝামাঝি গুড়ো হয়ে দুভাগ হয়ে গেছে ! পূর্ব সতর্কতা হিসেবে নিরাপদ অবস্থানে না নেয়ায় চট্টগ্রামে বিমানবাহিনীর বেশ কতগুলো বিমান ঘূর্ণিঝড়ে চুরমার হয়ে গেছে। এজন্য রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ কর্তৃক বিমানবাহিনী প্রধানকে তাৎক্ষণিক বরখাস্তের খবরও প্রচারিত হলো। চট্টগ্রাম কক্সবাজার ভোলা সন্দ্বীপ বিশেষ করে উড়ির চর ও আশেপাশের দ্বীপগুলোর সাথে সবধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার পরও যেসব খবর আসতে শুরু করেছে, তাতেই রক্ত হীম হয়ে যাবার অবস্থা। লক্ষ লক্ষ মানুষের হতাহতের পাশাপাশি অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতির যে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা সত্যি হলে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে ! একটা গরীব রাষ্ট্র তা সামলাবে কী করে ! বস্তুত তাই হয়েছিলো। সে তুলনায় আমাদের এখানে ক্ষয়ক্ষতি কিছুই হয় নি বলা যায়। একই উপকূলীয় বেল্টে থেকেও এ কীভাবে সম্ভব ? এটাই ঝড়ের প্রকৃতি।

বিচিত্র প্রকৃতির এ ভয়াবহ ঘূর্ণির যে বিশেষ কারণে কেয়ামত হয়ে গেলো উড়ির চর সন্দ্বীপ ভোলা কক্সবাজার এবং আশেপাশের দ্বীপগুলো, সেই একই কারণে এই পটুয়াখালী ঝালকাঠি বাগেরহাট খুলনা অঞ্চলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও রক্ষা পেয়ে গেলো লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন। বিশাল এলাকা জুড়ে প্রচণ্ড এ ঘূর্ণিঝড়ের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি বা মোচড়টা ছিলো এণ্টিক্লক ওয়াইজ। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের পশ্চিম অংশের ভয়াল বাতাস উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী বয়ে সমস্ত নদীনালার পানি সাগরে টেনে নিলেও উন্মত্ত সাগর দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী ধাক্কায় ঠিকই হামলে পড়ে পূর্ব অংশে। এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেকটি বিপর্যয়ের দিন হিসেবে অমোচনীয় দাগ রেখে গেলো। যদি এ ঘূর্ণি ঠিক উল্টো মানে ক্লকওয়াইজ হতো, তাহলেও হয়তো বিপর্যয়ের কোন হেরফের ঘটতো না। তখন পশ্চিম অংশে আমরাই মিশে যেতাম চির অজানায়...।

(১০)
মানুষের প্রকৃতিও এমন যে একসময় না একসময় পরিবেশের সাথে তাকে মানিয়ে যেতেই হয়। এটাই বোধ করি টিকে থাকার অনিবার্য সূত্র। আর এক মুহূর্তও নয় ভাবতে ভাবতে আরো ছ’টি মাস কেটে গেলো ঠিকই। অভিজ্ঞতার ঝুলিতেও জমা হলো আরো কতো বিচিত্র সম্ভার। বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাগত আঞ্চলিক ভিন্নতার পাশাপাশি জীবনধারা রীতিনীতির পার্থক্যও অনেক বৈচিত্র্য ধারণ করে। জন্ম মৃত্যু বিয়ে উৎসব পার্বণ সবকিছুই মূলানুগত হয়েও কতো ভিন্ন সুরের কতো বিচিত্র আবেদনময়। এগুলো দেখি আর ভাবি আহা, বাধ্য হয়েই হোক, এখানে না এলে কি এসব দেখতাম জানতাম আর ভাবতাম ?

প্রতিদিনের মতোই সূর্য পাটে যেতে বসেছে। অফিসের নিয়মিত ডাকগুলো হাতে নিয়ে বাই নেমে আসা অফিসিয়াল হলুদ খামটায় চোখ আটকে গেলো। আবার কোন্ পাতলা কাগজ এলো ? অফিসিয়াল কোন ব্যাখ্যা চাওয়া বা শাস্তিমূলক চিঠির জনপ্রিয় কোড নেম হচ্ছে পাতলা কাগজ। তখনো অফিসগুলোতে কম্পিউটারের পুরো প্রচলন ঘটেনি বলে সেই আদ্যিকালের ঠকাঠক টাইপরাইটারে প্রয়োজনীয় অনুলিপিসহ চিঠিপত্রগুলো টাইপ করতে থিন পেপারই ব্যবহার হতো। সব চিঠিপত্রের ক্ষেত্রেই এই কাগজ ব্যবহার হলেও বিশেষ চিঠিগুলোকেই এরকম পাতলা কাগজ নামে ডাকার একটা রেওয়াজ সহকর্মীদের মধ্যে ছিলো এবং এখনো আছে। যদিও এখন আর কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত অফসেট প্রিণ্টারে পাতলা কাগজ ব্যবহার হয় না। যাক্, খামটা হাতে নিয়ে একটু দ্বিধায় থেকেই ছিঁড়লাম। তখনো কি জানতাম, আমার সোনার হরিণটা ওখানেই পোরা ছিলো !

ধড়াশ করে বুকটা লাফিয়ে ওঠলো, বদলির অর্ডার ! এই অথৈ পানির তল্লাটে আর নয়, একেবারে চট্টগ্রামের মিরসরাই। আহ, কী আনন্দ ! এভাবে নদীর কূলে নিরূপায় বসে বসে আর হাহুতাশ করতে হবে না। সেই যে এখানে এসেছি কবে ! আসতে যেতে সাড়ে পাঁচদিনের দূরত্বে আর বাড়ি যাওয়া হয় নি। প্রিয়তম মুখটা দেখি না এক যুগ হয়ে গেছে ! সে কেমন আছে ? কতোকাল তাঁর কণ্ঠ শুনি না ! বুকের ভেতরটায় কোথায় মোচড়াতে শুরু করেছে। এমন বিচ্ছিন্নতা কী করে মানুষ সহ্য করে ! ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে ভাবছি, আমিই বা টিকে রইলাম কী করে ! নভেম্বরের পয়লা তারিখেই রিলিজ ডেট। কিন্তু এখনো তো তা আরো পনের দিন ! এতো দিন !

হঠাৎ করে দিনগুলো অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে গেলো। সাথে সাথে চারপাশটাকেও কেমোন যেনো ভালো লাগতে শুরু করেছে ! এই জোয়ার-ভাটা, এই তালের রসে তৈরি পাটালি গুড়, বাঁশের তালের খেজুরের সাঁকো, একটা মহিষের কাঁধে অধিবৃত্তাকার ডিমের মতো বাঁকানো বিশেষ ধরনের লাঙ্গলের সূত্র, মাটির লবণাক্ততা, নৌকার ভাঙা গলুই, কাধিভরা মর্তমান কলা, নারকেলে তরকারি মাখা মোটা ভাত, লঞ্চের সাইরেণ সবকিছু। সবকিছুই কেমন যেন আবেগে মোড়ানো, ভালো লাগায় অস্থির। আহারে, ক’দিন পর আর এগুলো থাকবে না ! কী চমৎকার লোনা প্রকৃতি। আসলে তো খারাপ ছিলো না কিছুই। কী মায়া লেগে আছে সব কিছুতেই ! এ সবই ছেড়ে যেতে হবে !

[আগামী পর্বে সমাপ্য...]

আগের পর্ব: [পর্ব-০১][পর্ব-০২][পর্ব-০৩][পর্ব-০৪][পর্ব-০৫]


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

হুম................ আপনার এই লেখায় আর মন্তব্য করার কিছু নাই কারণ আগের মতই দারুন ।
নিবিড়

রণদীপম বসু এর ছবি

আমারো নতুন করে বলার কিছু নাই।
ধন্যবাদ।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

মাহবুব লীলেন এর ছবি

চলে যাবেন?

রণদীপম বসু এর ছবি

হুঁম, তাই তো মনে হচ্ছে !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

রণদীপম বসু এর ছবি

হুঁম...?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

পরিবর্তনশীল এর ছবি

পড়ছি।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

রণদীপম বসু এর ছবি

ধন্যবাদ।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

কী মায়া লেগে আছে সব কিছুতেই ! এ সবই ছেড়ে যেতে হবে !

-কই যাইবেন? কইয়া যান!
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

রণদীপম বসু এর ছবি

শেষ পর্বেই কই ?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

ভাঙ্গা মানুষ [অতিথি] এর ছবি

আপনার এ লেখায় আমারো মায়া পড়ে গিয়েছে... চলে যাবেন??

রণদীপম বসু এর ছবি

এ যাওয়া তো যাওয়া নয়, ফিরে আসা...!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।