কখনো লাল কখনো কালো...

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: বুধ, ২৪/০৬/২০০৯ - ৮:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(০১)
ঝনঝন করে মোবাইলটা বেজে ওঠলো অসময়ে। আচমকা গভীর কাচা-ঘুম ভেঙে স্থান-কাল-পাত্র সচেতন হতে হতে কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। ফোনটা বেজেই চলছে।
সকাল আটটা হয় হয়। শুক্রবার। ‘অফ ডে’-তে নরমালি দেরীতেই বিছানা ছাড়ি। মফস্বলের কর্মময় শাখা-জীবনে ‘অফিস ডে’-তে ভোর ছ’টা বা তারও আগে থেকেই গোটা দিনের ঘড়ি-ধরা যান্ত্রিক রুটিনেই অভ্যস্থ আমরা। ‘ন্যাচার অব জব’টাই এমন যে, তার ব্যত্যয় হওয়ার কোন উপায় নেই, সুযোগও নেই। কিন্তু আমরা তো যন্ত্র নই। রক্ত-মাংশের এই শরীরটা যে মেশিন বা যন্ত্র নয়, তা তাকে বুঝিয়ে দিতে হয় মাঝে মাঝে। তাই ছুটির দিনগুলোকে ব্যক্তিগত জীবনাচারে অনিয়মের কারখানা বানিয়ে সেটা দেখিয়ে দিতে কখনোই কার্পন্য করি নি আমি। হয়তো আগের দিন রাত তিনটে বা চারটে পর্যন্ত পড়াশোনা লেখালেখি করলাম, ঘুম থেকে ওঠলাম সাড়ে এগারোটা বাজিয়ে, সকালের নাস্তা সারলাম দুপুর সাড়ে বারোয় (যদি তা নসিবে থাকে) ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই অনিয়মের সুযোগও কি সব সময় জুটে? কখনো বা পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রামে আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকি, আবার কখনো কখনো অনির্ধারিত প্রোগ্রাম এসে হামলে পড়ে, সব গড়বড় করে দেয়।

দূর্গোৎসবের দশমীর সরকারি ছুটিটা রোববার হওয়ায় উইক-এণ্ডে তিনটে দিন হাতে পেয়ে একেবারে মুক্তকচ্ছ। বেশ রিলাক্স মুডে ছিলাম। ইতিপূর্বে কখনোই যা বাস্তবায়নের সুযোগ হয় নি, পরিকল্পনা নিলাম, এবার সত্যি সত্যি স্ত্রী সন্তানকে কাছে কোথাও পূঁজো দেখাতে নিয়ে যাবো। অতএব রিলাক্স মুড তো বটেই। আর আমার রিলাক্স মুড মানেই অনিয়মের আখড়াটাকে চলমান করে দেয়া। নির্ঘাৎ সাড়ে এগারোর আগে চোখের পাতা ফাঁক হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তীব্র রিং-টোনের ধাক্কায় একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আচ্ছন্ন হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা টেনে ঘুম-জড়িত চোখে মনিটরে তাকাতেই সচকিত হয়ে ওঠলাম। নিভা-জ্বলা আলোয় কলার আইডি ভেসে ওঠছে, ইংরেজি হরফে- ‘যোনাল অফিস নোয়াখালী’। যোনাল ম্যানেজারের নম্বরটা এভাবেই সেভ করা ছিলো। ঘুমের রেশ কেটে গেছে ততক্ষণে। খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে এই অফ-ডে তে একজন যোনাল ম্যানেজার এরিয়া ম্যানেজারকে বাদ দিয়ে তাঁর অধীনস্থ কোন ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে এভাবে সরাসরি কল করার কথা নয়। ‘ও-কে’ বাটন চেপে কানে ধরতেই আমার সালাম সম্ভাষণের মাঝেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, বাবু, আপনি কোথায় ? ‘এই তো স্যার আমি বাসায়।’ আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই সেই উদ্বিগ্নতা নিয়েই বললেন, আপনি এক্ষুনি রাজাপুর শাখায় যান; আপনার এরিয়া ম্যানেজারকে ফোনে পাচ্ছি না; গিয়েই আমাকে ফোন করতে বলবেন। আমি ‘জ্বী স্যার’ বললাম ঠিকই; মনে হলো তার আগেই ফোনটা কেটে গেছে।

আকস্মিক অস্বাভাবিক অভিঘাতে তাৎক্ষণিক সচেতন-বোধ ঠিক থাকে না। আমার অবস্থাও খানিকটা সে রকমই। কয়েক মুহূর্ত থিতু হয়ে ভাবতে লাগলাম। কিন্তু সবকিছুই হেঁয়ালির মতো মনে হলো। ছুটির দিনের এই সাত-সকালে এরিয়া ম্যানেজারকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না; আমাকে রাজাপুর শাখায় গিয়ে এরিয়া ম্যানেজারকে কল ব্যাক করার জন্য বলতে হবে ! একেবারে এলোমেলো অবস্থা। মাথায় ততক্ষণে যুক্তিবোধের বারোটা বেজে গেছে। যাক্ কী আর করা। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। যোনাল ম্যানেজারের নির্দেশ; অতএব বিছানা ছেড়ে টুথব্রাশ মুখে চেপে বাথরুমে ঢুকলাম।

আমার জন্যে এই অসময়ে নাস্তা রেডি থাকার কথা নয়। হয়তো মিনিট দশেক পেরিয়েছে। নাস্তার তাড়া দিয়ে গোসলে ঢুকবো, আবার ফোন বেজে ওঠলো- যোনাল ম্যানেজার নোয়াখালী। ‘বাবু, কোথায় ?’ ‘এইতো বেরুচ্ছি স্যার।’ ‘এখনো যান নি !’ ফোন কেটে গেলো। বুঝলাম, অবস্থা গুরুতর। কীসের নাস্তা, কীসের গোসল ! ঝটপট পোশাক পাল্টে মটর সাইকেলে স্টার্ট নিলাম। পেছন থেকে রূপা, অর্থাৎ আমার নিরূপায় স্ত্রী, কী সব তেল নুন সব্জী মাছের ফর্দ আওড়ে যাচ্ছে। কে শোনে কার কথা! একশ’ সিসি হোণ্ডার স্পীডোমিটার পারলে এক মোচড়ে হান্ড্রেড-টেন’এ উঠিয়ে দিই।

(০২)
রাজাপুর শাখাটি তখনো নোয়াখালী যোনের আওতায় দাগনভূঁইয়া এরিয়ার অন্যতম শাখা। আমার কর্মস্থল জায়লস্কর শাখার পার্শ্ববর্তী। সমস্যাবহুল শাখা হিসেবে একই এরিয়াধীন পার্শ্ববর্তী শাখাসমূহের ম্যানেজারদেরকে বিশেষ প্রোগ্রামে প্রায়ই যেতে হতো ওখানে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে। তাই ওখানকার রাস্তাঘাট এলাকার পরিবেশ আমার অত্যন্ত পরিচিত এবং শাখার সহকর্মীদের সাথে অন্তরঙ্গতাও অনেকটা ঘনিষ্ঠ। নিজস্ব বিল্ডিং শাখা। অফিসের গেটে গিয়ে হোন্ডায় ব্রেক কষেই টের পেলাম পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে, ভারাক্রান্ত। শাখার সহকর্মী যারা কর্মস্থলে রয়েছেন তাদের সাথে কুশল সম্ভাষণের মধ্যে খবরটা শুনেই একেবারে হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম- কী ! কী বলছে এরা ! ইউছুফ সাহেব খুন হয়েছে ! এরকম খবরের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত নই। লম্বাচূঁড়া শক্তসমর্থ কালো শরীরের হাসিখুশি মায়াবী তরুণ মুখের তুখোড় সহকর্মী সেই ইউছুফ, খুন হয়েছে ! কোথায়, কীভাবে, কেন ? এতো সব প্রশ্নের উত্তর শাখার জীবিত সহকর্মীরাও জানে না তখনো। শুধু এটুকুই বললো- গতকাল অর্থাৎ বৃহষ্পতিবার অফিস টাইম শেষে ইউছুফ পূর্বানুমতি নিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি তার চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার চর আলগি ইউনিয়নে। মেঘনার প্রত্যন্ত চর এলাকা। কিন্ত ভোর বেলা বিভিন্ন মাধ্যম হয়ে শাখায় খবর এলো- নরসিংদীর কাছে কোথায় যেন তার লাশ পাওয়া গেছে। একেবারে ভিন্ন দিগন্তে ! ‘এরিয়া স্যার কই ?’ উত্তরে সহকর্মীরা জানালেন, কর্মচারি সমিতির নেতা তৈয়ব সাহেবকে নিয়ে যোনাল অফিসে গেছেন। এরই মধ্যে আবার ফোন বেজে ওঠলো; এরিয়া ম্যানেজার দাগনভূঁইয়া- ‘এই বাবু, আপনি কোথায় ?’ অবস্থান জানালাম তাঁকে। ‘শাখায় চলে আসেন; দ্রুত রেডি হন, নরসিংদী যেতে হবে। দশ মিনিটের মধ্যে রওয়ানা দিচ্ছি আমরা।’ আবার রিটার্ন ব্যাক, আমার শাখার উদ্দেশ্যে; সিলোনীয়ায়। যেখানের আমার ব্র্যাঞ্চ অফিস, জায়লস্কর শাখা।

মাথায় অস্থিরতা। হোন্ডার হ্যান্ডেল রাস্তা ছেড়ে পাশের ঢালের দিকেই নজর টানছে বেশি। সতর্ক হতে চেষ্টা করলাম। বাসায় ফিরে ঘরে হোন্ডাটা ওঠাতে না ওঠাতেই আবার এরিয়া ম্যানেজারের ফোন- ‘বাবু, আমরা আপনার অফিসে; এক্ষুনি আসেন, সময় নাই।’ যুগপৎ অস্থিরতা আর বিভ্রান্তি। রূপা’র বাড়িয়ে দেয়া নাস্তার প্লেটটা কখন কীভাবে মুখে ঢুকিয়েছি বলতে পারবো না। হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ছি। তাঁর অসহায় মুখের দিকে চেয়ে খুব কষ্ট হলো। শুধু বঞ্চিতই করে গেছি তাঁকে; কথা দিয়ে কোন কথাই রাখা হয় নি আমার। তাঁর নিজের প্রিপেইড মোবাইলটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললো- এটা নাও, অফিসেরটা রেখে যাও। তখনও মাথায় কাজ করছিলো না যে, পল্লীফোনের রোমিং-বার অনুযায়ী নরসিংদীতে অফিসের এই ফোন আদৌ কার্যকর থাকবে না । গোটা দেশে গ্রামীণের পল্লীফোনের রোমিং সুবিধা নিশ্চিৎভাবেই এই ঘটনার সন অর্থাৎ ২০০৪ সালের পরেই চালু হয়েছে। আউলা মাথায় অফিসের ফোন নিয়ে বেরুলে মাঝপথে সম্পূণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে কী যে মহা ফাপড়ে পড়তে হতো, তা ভাবতেই শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠলো ! লাইফ-পার্টনার হিসেবে আবারো কৃতজ্ঞ হলাম তাঁর প্রতি।

(০৩)
অফিসে ঢোকার আগেই এরিয়া ম্যানেজার বোরহান আলী বেগ এবং কর্মচারি সমিতির সভাপতি তৈয়ব উল্লাহ বেরিয়ে এলেন। তখন প্রায় এগারোটা। সিলোনীয়া বাজার থেকে একটা চলতি গাড়িতে উঠে গেলাম তিন জন। ঢাকার অদূরে কাচপুরে নেমে ফের নরসিংদীর গাড়িতে উঠতে হবে। দীর্ঘ ভ্রমন। এই ভ্রমনকালীন সময়ে যোগাযোগের জন্য যোনাল ম্যানেজারকে নতুন কনটাক্ট নাম্বারটা জানিয়ে রাখলাম ফোনে। একে তো রমজান মাস, পথের ভোগান্তি তো আছেই; শেষ বিকেলে নরসিংদীর শিবপুর শাখার ম্যানেজার সাহেবের কনটাক্ট মোতাবেক নরসিংদী হাসপাতালে পৌঁছলাম। এমনিতেই স্নান খাওয়া বিশ্রাম নেই, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি ব্যবস্থাপনার কথা আর না-ই বা বললাম। ওদিকটা সামলেছেন শিবপুরের ম্যানেজার সাহেব, তাঁর ব্যক্তিগত পারদর্শিতা দিয়েই বলা যায় (এ মুহূর্তে তাঁর নামটা মনে নেই)। লাশবাহী পিক-আপ ভ্যান ভাড়া ও কফিন ক্রয় করে অন্যান্য ফর্মালিটিজ সেরে হাসপাতাল মর্গে গেলাম- লাশ বুঝে নিতে হবে।

সরকারি নথিপত্রে যদিও তখনো অজ্ঞাত-পরিচয়, তবু দেখেই চিনে ফেললাম- এইতো দুরন্ত আত্মবিশ্বাসী যুবক মোঃ ইউছুফ শুয়ে আছে! কিন্তু নির্জীব। পোস্টমর্টেম-উত্তর সেলাই করা মানুষের লাশ, তাও যদি হয় অতি পরিচিত কারো, তার দিকে অভাবিত চেয়ে থাকা, এ কী চাট্টিখানি কথা! মুহূর্তেই বুঝে গেলাম, এরকম দৃশ্য আমার জন্য নয়, এতে মোটেও অভ্যস্ত নই আমি। বেরিয়ে এলাম। চোখ থেকে এমন বীভৎস লাশের ছবি তাড়াতে পারছি না কিছুতেই। দূরে গিয়ে হাসপাতাল চত্বরেই ঘাঁসের উপর মাথা গুঁজে বসে রইলাম থ হয়ে। সাদা কাফনের কাপড়ে গোটা লাশটাকে ভালোভাবে মুড়িয়ে কশে বেঁধে কফিন বন্দী করে বরফ আর চাপাতার গুড়ো দিয়ে প্যাক করে ফেলা হলো। ধারেকাছে ঘেষার অবস্থাও নেই আমার। এ দৃশ্য দেখার মতো মানসিক অপ্রস্তুত আমি, তবু দূর থেকে বারে বারে চোখ তুলে দেখছিলামও তা। এদিকে ইফতারের টাইম আসন্ন। সেই সকালের পর থেকে এক ফোঁটা পানিও মুখে পড়ে নি। সে সুযোগ, রুচি বা অবস্থাও ছিলো না। তবু লাশবাহী গাড়ির স্টার্ট নেয়া হলো। কীভাবে কত দ্রুত এ লাশ যথাযথ হস্তে গছিয়ে দেয়া যায় কেবল সে চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। তারপর পরবর্তী বারোটি ঘণ্টা, খাওয়া নেই ঘুম নেই বিশ্রাম নেই, এক অবিচ্ছিন্ন ঘোরের মধ্যেই কাটতে লাগলো। কাদের সাথে যেন ইফতারিতে কিঞ্চিৎ ভাগ বসিয়েছিলাম, এতটুকুই।

(০৪)
ড্রাইভারের পাশে এরিয়া ম্যানেজারকে বসিয়ে কফিন-বদ্ধ লাশ ঘিরে খোলা পিক-আপ ভ্যানে আমরা দু’জন। সন্ধ্যার বাতাস কেটে শা শা ছুটছে গাড়ি। বাতাসের কানতালি শব্দের সাথে ঠাণ্ডাও টের পাচ্ছি বেশ। কুয়াশার আর্দ্রতা আর ধূলো-বালিতে শরীরের অনাবৃত অংশে চামড়ায় একটা আঠালো ভাব চেটচেটে হয়ে ওঠছে। চারপাশের গুঞ্জন কোলাহল ইত্যাদির মধ্যেও কেমন একটা গভীর নির্জনতার উপলব্ধি সব কিছুকে ছাপিয়ে ওঠছে। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষের ভাবনাগুলো বোধ হয় মৃত্যুচিন্তার গভীর উপলব্ধিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। আহা মৃত্যু, এর কাছে কত অসহায় মানুষ! কোথাকার কোন্ মানুষ কোথায় যে পড়ে থাকে!

কাঁচপুরে এসে ব্রেক কষলো গাড়ি। মোবাইল কনটাক্টের মাধ্যমেই এখানে এসে ইউছুফের ক’জন আত্মীয় এবং তাঁর বাড়ির পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর শাখার ম্যানেজার সাহেব আমাদের সঙ্গী হলেন। খবর পেয়ে বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে পথেই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। এরাই মূলত পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন আমাদের। সবার চোখে মুখেই এক বিপণ্নতা, বিষাদের ছায়া। আবার ছাড়লো গাড়ি। সওয়ারি আমরা ক’জন জীবিত মানুষ আর একজন মৃতের অসময়ে ফেলে যাওয়া প্রিয়তম শরীরটা। গাড়ি ছুটছে। অপেক্ষায় আছে ইউছুফের প্রিয়জনেরা। একদিন আগেও যাকে ঘিরে এদের কত চাওয়া পাওয়া মান অভিমান স্বপ্ন কষ্ট, এখন এ সবই বাহুল্য; এক চিরায়ত অতীতের গর্ভে। সব ঠিকঠাক থাকলে কুমিল্লার কচুয়ার পেট কেটে আড়াআড়ি ছুটে চাঁদপুরে ইছলি ফেরী পেরিয়ে মধ্যরাতের ভ্রমন শেষ হবে চর আলগির কোন এক নিঝুম গ্রামে। রাত দু’টোয় তাঁকে শেষবারের মতো শুইয়ে দেয়া হবে মাটির প্রিয় গভীর কোলে।

আজ যে ইউছুফকে নিয়ে গাড়িটা ছুটে যাচ্ছে তাঁর বাড়ির দিকে, গতকালও ঠিক এ সময়ে সে গাড়িতেই ছিলো। অন্য কোন গাড়িতে। অন্য কোন লক্ষ্যে। কী ছিলো লক্ষ্যটা তাঁর? আমরা কেউ কি জানি? না কেউ জানতো? হয়তো ইউছুফও জানতো না তাঁর গন্তব্য। ফেনীর মহিপালে ইফতার শেষে যে গাড়িটাতে চড়েছিলো, সেটাই নরসিংদীর শিবপুরের কাছাকাছি এসে ডাকাতের কবলে পড়ে। এ গাড়ি তো তার বাড়ি যাবার সঠিক গন্তব্যের গাড়ি ছিলো না ! এটাতে কেন উঠলো সে ! কোথায় যাচ্ছিলো ? কর্তব্যরত পেট্রোল পুলিশ রাস্তার পাশে পড়ে থাকা যে অজ্ঞাত পরিচয় লাশটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়, দেখতে নাকি অনেকটাই ইউছুফের মতো। লাশবাহী রিক্সাভ্যান চালক, দৈবক্রমে যিনি ইউছুফকে চিনতেন, থানায় লাশ নামিয়ে রেখে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেছেন শিবপুর শাখায়, তাঁর বাড়ি ওখানেই। তিন চার মাস আগেও ইউছুফ এ শাখায় কর্মরত ছিলো। চিৎকার চেচামেচিতে শাখার ম্যানেজার সাহেব বেরিয়ে এসে বিস্তারিত শুনেই তড়িঘড়ি থানার দিকে ছুটলেন প্রাক্তন সহকর্মীকে সনাক্ত করার জন্যে, সত্যিই ইউছুফ কি না। অতঃপর নিশ্চিৎ হওয়ার জন্য তিনিই যোগাযোগ করলেন নোয়াখালীতে। আর তাঁরই তৎপরতায় সেই অজ্ঞাত পরিচয় লাশের পরিচিতি পুনঃস্থাপন হতে হতে ছুটে চলছে প্রিয় জন্মভিটার পাশে, হয়তোবা আবাল্যের প্রিয় গাছটার নীচে।

(০৫)
পদ্মা আর মেঘনার চাঁদপুর সঙ্গম পেরিয়ে মধ্যরাতের অন্ধকার ছিঁড়ে ফেঁড়ে গাড়িটা তীব্রবেগে ছুটছে নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে। তারই মধ্যে অন্ধকারে একটা মৃতদেহের গভীর নীরবতা ঘিরে জনা কয়েক আপাত জীবিত মানুষ অনিশ্চিৎ চেয়ে আছে নিজ নিজ কাল্পনিক দূরত্বের দিকে- অনিবার্য গন্তব্যে...


মন্তব্য

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

কেন জানি রহস্য উদ্ঘাটনের একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল। ঘটনার বিবরনে চলুক

সাইফ তাহসিন এর ছবি

রণদা, কী ভয়ংকর, ইউসুফ সাহেবের আত্মা শান্তি পাক, আর অপরাধী যেন ধরা পড়ে।

পোস্টমর্টেম-উত্তর সেলাই করা মানুষের লাশ, তাও যদি হয় অতি পরিচিত কারো, তার দিকে অভাবিত চেয়ে থাকা, এ কী চাট্টিখানি কথা! মুহূর্তেই বুঝে গেলাম, এরকম দৃশ্য আমার জন্য নয়, এতে মোটেও অভ্যস্ত নই আমি।

রণদা পেশাগত ভাবে এ দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে অনেকবারই, হয়তো সে কারনে মনুষত্যও হারিয়ে ফেলেছি অনেকটা, এজন্য হয়তো এখন আর বিকার হয় না, কিন্তু প্রথম বারের অভিজ্ঞতাটা এখনও মনে আছে। আপনার জন্যে সমবেদনা রইল মন খারাপ ইয়ে, মানে...

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

মামুন হক এর ছবি

মসৃন লেখা রণদা, খুব ভালো লাগল।

শামীম রুনা এর ছবি

যদিও আপনার লেখা মসৃন তারপরও মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

(দীর্ঘশ্বাস)

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পোস্টের শেষে যেহেতু আপনি শেষে কী হল বলেননি তাই ধরে নেয়া যাচ্ছে এই ১৫ বৎসরে ব্যাপারটার মীমাংসা হয়নি। আমি গোটা ব্যাপারটায় নোংরা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। যাকগে, মরহুম ইউসুফের শান্তি কামনা করি।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রণদীপম বসু এর ছবি

মৃত্যুই বোধ করি ভয়ঙ্কর এক মীমাংসার নাম।

নাইট-কোচে ডাকাত পড়েছিলো। যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করা হয়। এবং ইউছুপ কিছু গাইগুই করায় ডাকাতরা তাকে ধরে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে তাদের আরেকটা পিকআপে তুলে নিয়েছিল, এটুকু খবর উদ্ধার করা গেছে।
তবু কিছু জিনিসের কখনোই মীমাংসা হয় না। এই যেমন ইউছুপ সাহেব সামনে তিনদিন ছুটি পেয়ে কাউকে না জানিয়ে কেন প্রাক্তন কর্মস্থলের দিকে গিয়েছিলেন। এটা কি কোন প্রেম ঘটিত বিষয় ? অথবা কোন দেনা-পাওনার বিষয়-আশয় জড়িত ? কিংবা অন্য কিছু ?

এরপর পৃথিবীতে আরো বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে বহুভাবে, বহু শিশুর জন্ম হয়েছে বিচিত্র কায়দায়। জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে আমিও ছিটকে গেছি অন্য কোথাও। কেউ ভুলে গেছে, কেউ হয়তো মনে রেখেছে। আবার কারো কারো মনে হয়তো কোন নস্টালজিক মুহূর্তে কাঁটার মতো চিন চিন করে ওঠে দূরবর্তী কোন স্মৃতির এলবামে নাড়া খেয়ে।

এই তো জীবন পাণ্ডব দা' ! এতে অভ্যস্ত হোন বা না হোন, জীবনের এতে কিছুই এসে যায় না !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

বিপ্লব রহমান এর ছবি

বিষন্নতা!


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।