ফিরে ফিরে আসবো, তোর কাছে

রেশনুভা এর ছবি
লিখেছেন রেশনুভা (তারিখ: বুধ, ০২/১২/২০০৯ - ১০:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


প্রতিবার লিখতে বসার সময়ই মনে হয় তোকে নিয়ে লিখব। কোনবারই হয়ে ওঠে না। তোকে নিয়ে লিখে কী পুরোটা শেষ করা যাবে, তুইই বল? একবার লিখেছিলাম ও কিছুদূর। প্রথম প্যারা শেষ হতেই দেখি কী-বোর্ড ভিজে যাচ্ছে অনর্থক চোখের পানিতে। ওযাত্রায় আর লেখা হল না। আজ কী তবে শেষ করতে পারব?

তোকে দেখি না অনেকদিন। সাত মাসের বেশিই হয়ে গেল। শেষবার যখন তোকে দেখি কী করছিলি তোর মনে আছে? সিএনজিতে বসে আমার সাথে সে কী দুষ্টুমি। আর একটু পরপরই শব্দ করে হাসি। আচ্ছা তুই কী তখন জানতি ওটাই তোর সাথে আমার শেষ দেখা হবে? আমিই বা কী জানতাম? জানলে পরে আরো একটু সময় তোর সাথে থেকে যেতাম। ফেরার পথে তুই কিন্তু অনেক চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলি। তুই কী বুঝে গিয়েছিলি তখন?

তোকে যেদিন প্রথম দেখলাম সেদিনের কথাই বা বলি না কেন। কী অদ্ভূত সেই ক্ষণ! তোর মুখটার দিকেই তাঁকিয়েছিলাম অনেকক্ষণ ধরে। কেমন একটা আলো ছিল যেন চারপাশে। এক মায়াময় পবিত্রতা ছিল তোর চোখে-মুখে। মনে হচ্ছিল তোর চোখের দিকে তাঁকিয়ে আমার অন্ধকারগুলোও তখন সরে যাচ্ছিল। তুই জানিস, যখন তুই পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলি, চমকে উঠেছিলাম আমি। যেন আমার দু'টো চোখই দেখছিলাম ওখানে। কোন দুঃস্বপ্নেও কখনও ভাবিনি তোর ঐ বাদামী চোখজোড়া অনেক দূরে সরে যাবে একদিন। বহুদূরে।

মাগো তুই কেমন আছিস? অনেকদিন তোর ঐ ছোট ছোট হাত পা গুলো নিয়ে খেলি না মা। তুই তোর ঐ নরম হাতগুলো আমার মাথায় বুলিয়ে দিস না। রাগ হলে শক্ত করে মাথার চুলও চেঁপে ধরিস না। আমার নাকের উপর রাখা চশমাটা ছিল তোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। কোলে নিলেই ওটা নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিতিস। তারপর ওটা তোর হাতে চলে গেলেই এক কোণা কামড়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকতি। যেন অপেক্ষা করতি কখন তোকে ধমকে দেব আমি। অনেকদিন তোর মুখের মধ্যে আমার আঙ্গুল দিয়ে দিতাম। তুই কামড়ে ধরতি শক্ত করে। তখন তোর সবে দাঁত উঠি উঠি করছিল।

তখন প্রতি সপ্তাহান্তেই তোকে নিয়ে ঘুরতে বের হতাম। এমন একটা বয়স ছিল তখন তোর, তুই আবদারও করতে পারতি না। মাঝেমাঝে নিজ থেকেই তোকে বেলুন কিনে দিতাম। তুই ওটাও মুখে দিতি চাইতি; শুধু নিজের খাবারগুলো বাদে যাই কাছে থাকতো তোর, সবই ঐ মুখটার মধ্যে চালান করে দিতি। এখনও কী তুই বারান্দায় রাখা টবের মাটি খামচি মেরে মুখে পুড়ে দিস? এখন নিশ্চয়ই তুই বাইরে গেলেই অনেক আবদার করিস এর ওর কাছে। যার কাছে আবদার করবি সেই মানুষটাই আজ তোর কাছ থেকে অনেক দূরে পড়ে আছে রে। তুই কী টের পাস মা, আমি যে তোর কাছে নেই? তোর কী খুব রাগ হয় আমার উপর? না কী করুণা করিস আমাকে?

ঐ যে, ঐ লোকটাকে দেখ। নোংরা একটা লুঙ্গির উপর ছেঁড়া গেঞ্জি পড়ে আছে। ওর ও হয়ত তোর বয়সী একটা মা আছে। ওর অল্পকটা জমানো টাকায় ও প্রতিদিন ওর ঐ মা’টার জন্য হয়ত খুব সস্তা কিছু লজেন্স বা খেলনা নিয়ে যায়। তুই মা ঐ মানুষটার মেয়ের চেয়েও অভাগী। তোর বাবা এখন আর তোর জন্য কিছুই নিয়ে আসে না। হয়ত আর কোনদিন আনবে না। তুই কী অপেক্ষায় থাকিস আমার? আমি তোর চেয়েও বড় অভাগারে মা। মেয়ের ছোট্ট ছোট্ট আবদারগুলো শুনতেও পাই না বলে। আমার পুরো সামর্থ্যই আছে রে মা তুই যা চাইতি সবটুকু দেয়ার। আমি শুধু তোকে ফেলে চলে এসেছি। মা গো, এরকম কেন হয় জানিস?

তোর কথা লিখতে গেলেই বুকের ভেতরের সব কিছু মনে হয় গলার কাছে এসে দলা বেঁধে থাকে। ভেঙ্গে চুরে যায় ভেতরটা। অবোধ নোনা জলগুলো গড়িয়ে পড়ে যায়। তারপর একসময় ঝড় থেমে আসে। আমিও আবার নিত্যকার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিছুটা সময় আমার আর মনেই থাকে না যে তুই এখন হাঁটতে পারিস, আধো আধো বোলে পুরো ঘরটা মাতিয়ে রাখিস। শুধু আমার এ ঘরটাই একেবারে চুপচাপ রয়ে যায়। আলতো পা ফেলে কারো হাঁটার বা পড়ে যাওয়ার শব্দও এখানে পাওয়া যায় না। আছে শুধু তোর জন্য আমার বুকের চাপা কান্নার হাহাকার। আমার এখনকার প্রতিটা রাতই সাক্ষ্য দেবে সেই শব্দের, অতি নিঃশব্দ অশ্রুর। তোকে আমি এখন এ জিনিসটাই সবচেয়ে বেশি দিতি পারি মা।

নিজেকে খুব ছোট লাগে। আসলেই তো আমি অনেক ক্ষুদ্র একজন। বাবা হয়েও মেয়ের কাছে অপরিচিত থেকে গেলাম। দূরের মানুষ হয়েই রইলাম। একই রক্তের হয়েও অন্য ছায়াপথের অজানা একজন হয়েই থাকলাম। এমনকি এর পরে যখন আমাদের দেখা হবে তখন হয়ত অনেকদিনের অনভ্যাসে বুক ভরে 'মা' ডাকটাও দিতে পারব না। হবে কী কখনও আমাদের দেখা? চিনতে পারবি তুই আমাকে? না কী আমি পারব চিনতে তোকে দেখে। সময়ের কাছে প্রশ্ন করি। বড্ড খারাপ ঐ জিনিসটা। শুধু বয়ে যায় আর দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়; শত শত আলোকবর্ষের দূরত্ব।

বাবা ডাকটাই শোনা হল না মাগো এখনও আমার। আমি আসবো মা তোর কাছে; একটা বারের জন্য হলেও তোর মুখে ‘বাবা’ শুনতে। আমাকে কী দেখা দিবি তুই?


মন্তব্য

অনিকেত এর ছবি

রেশ্নুভাই,

মন কি বেশি খারাপ রে ভাই?

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই, আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি, সাথে অসম্ভব রকম আবেগে আক্রান্ত হলাম আমিও।
মধুবন্তী মেঘ (অতিথি)

নৈষাদ এর ছবি

তাড়াতাড়ি দেখা হোক এই প্রার্থনাই রইল।

আসাদ [অতিথি] এর ছবি

চোখে পানি চলে আসলো রে ভাই। ভালো থাকেন।

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

ভাইয়া, >দেঁতো হাসি< মন খারাপ

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ছুঁয়ে গেলো।

...........................

কেউ আমাকে সরল পেয়ে বানিয়ে গেছে জটিল মানুষ

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মন খারাপ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

প্রবাসিনী এর ছবি

মনটা খারাপ হয়ে গেল ভাইয়া। আশা করি, কিছুদিনের মধ্যেয় আপনাদের দুইজনের দেখা হবে।
________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

ভাইয়া, কল্পনায় ভবিষ্যতকালে বসে স্মৃতিকাতর হচ্ছেন বুঝি চিন্তিত
লেখা আবেগে টসটসে, বেশ তো হাসি

------------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি

সাইফ তাহসিন এর ছবি

বস, সকালে অফিসে ঢুকেই লেখাটা পড়লাম, জনসম্মুখে চোখের কোনা কড়কড় করতে লাগল, এই অনুভূতি গুলো আবার মাথাচাড়া দিল, অসংখ্য ধন্যবাদ আমার সেই স্মৃতিগুলো পুনরুজ্জীবিত করার জন্যে ইয়ে, মানে...
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- বস, শোনেন একটা টিপস দেই। জীবনেও কখনো বিবাহ করার কথা চিন্তা কইরেন না। বিবাহ করলে আপনের মেয়েটারে নিয়া আপনের বউ আৎকা নাই হইয়া যাবে। আর যদি আপনার বউরে আপনে বিবাহ না-ও করেন তাইলেও সে আপনের মেয়েটারে (একটা স্বপ্ন) ছিনতাই করে পালাবে।

মহিলা লুকগুলা বড়ই বেপর্দারে ভাই। বড়ই মায়াদয়াহীন। খালি ভোঁতা কোদাল দিয়া কোপায়! মন খারাপ
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধুগোদা,
আপ্নেতোরে ভাই ''কান্দনবলি'' অনেক আগেই দিছেন।
আর কান্দাইওনা আমারে আর রেশ্নুভাইরে।

-মজনু

কৃতী [অতিথি] এর ছবি

প্রায় বেশ কিছু দিন পর আপনার লেখা পেয়ে এক নিঃশাসে পরে ফেললাম.অসাধারণ বিষাদময় লেখা।

যেই মেয়ে কে তার বাবা এমন ভাবে ভালবাসেন সে অভাগী হতেই পারে না..শুধু প্রকাশ টা জানতে পারছে না.
বাবা যেন শীঘ্রই মেয়ের দেখা পান..এই কামনা.

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

চিন্তিত
..................................................................

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

এই লেখায় কি মন্তব্য করা উচিৎ আমার জানা নাই ... পড়েছি শুধু এইটুকু জানিয়ে গেলাম ...
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...

রায়হান আবীর এর ছবি

হুম

অতিথি লেখক এর ছবি

হয়তো কল্পগল্প,,কিংবা জীবন থেকেই নেয়া...
পড়েছি আগেই,বাবা-মেয়ে,,দু'জনের জন্যেই
আজ আবারো ভাললাগাটুকু জানিয়ে দিলাম!!

*তিথীডোর

রেশনুভা এর ছবি

যাঁরা পড়লেন, সবাইকে ধন্যবাদ।

তানবীরা এর ছবি

রেজা, মনটা পাথর হয়ে গেলো।
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

অতিথি লেখক এর ছবি

রেজা, তোমার লেখাটায় মন ছুয়ে গেল.........
তোমাকে নুতন করে জানার চেষ্টা করছি........। আশা করি তোমার মনের আশাটা আচিরেই পুরন হবে।

দুলাল।

অতিথি লেখক এর ছবি

রেজা, তোমার লেখাটায় মন ছুয়ে গেল.........
তোমাকে নুতন করে জানার চেষ্টা করছি........। আশা করি তোমার মনের আশাটা আচিরেই পুরন হবে।

দুলাল।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

কিছুই বলার নাই মন খারাপ

আনন্দ [অতিথি] এর ছবি

দ্বিতীয় প্যারা থেকে চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু করল। শেষে এসে আর থাকতে পারলাম নারে ভাই। হাউমাউ কান্না কাঁদলাম অনেকক্ষণ। এখনো গলার কাছটায় কষ্টগুলো জমাট বেঁধে আছে। মনে হচ্ছে রেশনুভার বাবা ভর করেছে ভেতরে।

জীবনের সেরা লেখাটা লিখে ফেললেন বোধহয়। আপনাকে কাছ থেকে জানি বলেই এমন মনে হচ্ছে কিনা জানিনা। তবে আমাদের রেশনুভা একদিন বড় হয়ে এই লেখাটা পড়ে গর্ব করে বলবে "আমার বাবা!"

খুব মনে পড়ছে ওর পৃথিবীতে আসার দিনগুলোর কথা। মনে পড়ছে কিভাবে কাগজে লিখে ইকুয়েশন দিয়ে আমাদের বুঝিয়েছিলেন রেশনুভা নামের মর্মার্থ। আবারও চোখ ভিজে যাচ্ছে। ভাল থাকেন এই কথাটাও বলতে পারছি না আপনাকে। খুব অর্থহীন মনে হচ্ছে শব্দ দুটো।

রেজওয়ান [অতিথি] এর ছবি

কী বলব তোমারে।
ভালো থাকো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।