যোগজাকার্তার পথে পথে (২)

রেজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন রেজওয়ান (তারিখ: রবি, ০২/০৫/২০১০ - ৪:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পূর্বের পর্ব - বড়বুদুর বৌদ্ধমন্দির

সমগ্র ইন্দোনেশিয়াতে প্রায় ১৫০টি আগ্নেয়গিরি রয়েছে যার মধ্যে ১৩০টি সুপ্ত এবং প্যাসিফিক রিংস অফ ফায়ারের উপরে অবস্থিত। কাজেই যে কোন পর্যটন স্থানে অবধারিতভাবে একটি আগ্নেয়গিরির সন্ধান পাওয়া যায়। বড়বুদুর দেখা হয়ে গেল সকাল এগারটার মধ্যে এবং আমাদের পরবর্তী গন্তব্য প্রামবানান মন্দির। ড্রাইভার বেশ ভাল ইংরেজী বলে - সেটি এক বিস্ময় ছিল, কারন জাকার্তাতেও অনেক ট্যাক্সি ড্রাইভারই ইংরেজী বলতে পারে না। তো তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে প্রামবানান যাবার পথে কি কি দেখা যায়। সেই মেরাপি পাহাড়ের আগ্নেয়গিরির কথা বলল। অত:পর আমাদের পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু হল।

২০০৬ সালে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট খালগুনুঙ মেরাপি মানে হচ্ছে আগুনের পাহাড় - নামকরণ এমন কেন হয়েছে বুঝতেই পারছেন। ১৫৪৮ সাল থেকে এটি নিয়মিত লাভা উদগিরণ করে আসছে। স্থানীয় জাভানীজরা পাহাড়কে শান্ত রাখতে বিভিন্ন ধরনের পুজো/ভেট দিয়ে থাকে সুলতানের রাজত্ব গ্রহণের বার্ষিকীতে। বছরে প্রায় ৩০০ দিনই এর চূড়ায় ধোঁয়া দেখা যায়। তাদের সর্বশেষ এখানে উদগিরণ হয়েছে ২০০৬ সালে যোগজাকার্তার ভূমিকম্পের পূর্বে। সে সময় ২ জন মারা গিয়েছিল। আমাদের ড্রাইভারই গাইডের কাজ করল - সে গিয়ে দেখাল পাহাড়ের কাছে একটি শেল্টার আছে - সেখানে অনেক লোক আশ্রয় নিলেও দুজন পর্যটক ছাত্র পৌঁছুতে পারে নি শেষ পর্যন্ত। তবে আমাদের কপাল খারাপ। মেঘে ঢাকা চূড়ার কারনে উপরে কিছুই দেখা গেল না। মূল পাহাড়টিতে ওঠা নিষিদ্ধ - পথও নেই। আমাদের সামনে ছিল শুধু লাভা উদগিরণে তৈরি হওয়া একটি খালের মত যায়গা। এটি দেখেই দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হল। অথচ কয়েক মাস আগে বান্দুং এর কাছে তাংকুবান পেরাহু আগ্নেয়গিরিতে গিয়েছিলাম যেখানে বিশাল এক জ্বালামুখ ছিল - দেখার মত জিনিষ।

প্রামবানান মন্দির কমপ্লেক্সএরপর আমরা দুপুরের খাবার সেরে প্রামবানান মন্দিরে পৌঁছালাম। এটি ত্রিমূর্তিকে (শিব, ব্রহ্মা, আর বিষ্ণু) উৎসর্গকৃত নবম শতাব্দীতে নির্মিত একটি মন্দির কমপ্লেক্স যেখানে আদিকালে ২৩৭টি মন্দিরের স্থাপনা ছিল। ইন্দোনেশিয়ার এই সর্ববৃহৎ হিন্দু মন্দিরকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করা হয়েছে। ২৩৭টি মন্দির স্থাপনার একটিশৈলেন্দ্র সাম্রাজ্যের প্রভাবে পদানত হিন্দু সন্জয় সাম্রাজ্য আবার ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং বড়বুদুরের জবাবে তারা প্রামবানান মন্দির তৈরি করে। এটি মাতারাম রাজ্যের রাজকীয় মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই মন্দিরের অসম্ভব সুন্দর কারুকার্য সেই সাম্রাজ্যের অর্থবল ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে।

চান্দি মানে বাহাসায় মন্দিরতবে ৯২৯ সালে মাতারাম সাম্রাজ্যের শেষ রাজা মপু সিন্দক সাম্রাজ্যটিকে পূর্ব জাভার দিকে সরিয়ে নেন (মেরাপি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের কারণে)। তবে সেটাই মন্দিরটির পতনের কারণ হয়ে দাড়ায় - এটি পরিত্যক্ত হয়। ১৬ শতাব্দীতে মেরাপি পাহাড়ের অগ্নুৎপাত ও ভূমিকম্পে মন্দিরটির প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়।

প্রামবানান মন্দির কমপ্লেক্স১৮ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ শাসনের সময় কলিন ম্যাকেন্জি নামক একজন সার্ভেয়ার মন্দিরটি আবিষ্কার করেন। ১৮৮০ সালে ডাচ নৃতত্ত্ববিদদের দ্বারা খননের সময় বেশ অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ চুরি যায় মন্দির থেকে। এরপর ১৯৩০ সাল থেকে আবার এটি পুনর্নিমাণ শুরু হয় এবং ১৯৫৩ সালে প্রধান মন্দিরটি পূর্বাবস্থায় আসে। চমৎকার সব টাওয়ারগুলো - প্রতিটি আলাদা মন্দিরএরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে এটির উপর আরও কাজ হলেও চুরি যাওয়া পাথরের অংশগুলির অভাবে অনেক অংশেরই পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় নি।

নান্দি মোষ - শিব ঠাকুরের বাহন
মন্দিরের ভেতরে দেবতা মূর্তি

মন্দিরের চারিদিকে কারুকার্যখচিত পথতবুও যা দেখলাম তাতে আমরা অভিভূত। ২০০৬ সালের ভূমিকম্পে এর বেশ ক্ষতি সাধন হলেও পাথরের গাঁথুনি কত মজবুত চিন্তা করেন - যে বড় কোন কাঠামোগত ক্ষতি হয় নি ২৩৭টির মধ্যে যে কয়টি চুড়া দাড়িয়ে আছে সেগুলোর।

মন্দিরের দেয়ালের কারুকার্য
পাথরের কারুকার্য

চুড়া পর্যন্ত কারুকার্যখচিতমাঝখানের বড় শিব মন্দিরটি পুনর্নির্মাণের জন্যে বন্ধ ছিল সেখানকার সিকিউরিটি গার্ড আমাদের জিজ্ঞেস করতে লাগল যে আমরা দেখতে চাই কি না। অর্থাৎ ঘুষ দিলে সেখানে যাওয়া যাবে। অন্ধকার নির্জন যায়গায় গেলে নিরাপত্তাজনিত কি সমস্যা হতে পারে চিন্তা করে আর গেলাম না। মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ - এককালে এগুলো দাড়িয়ে ছিল।তবে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেবার ব্যাপারটি ভাল লাগল না। এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য।

আমরা আছি গুটি কয় দাড়িয়ে - বাকি সব ঝরে গেছে। কমপ্লেক্সের অনেক যায়গা জুড়ে মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ, সেগুলো হয়ত কোনদিন পশ্চিমা অর্থসাহায্যে মাথা তুলে দাড়াবে দুর্নীতিগ্রস্তদের উদর পুরে বা হয়ত এভাবেই থাকবে। তবে বিদেশীদের কাছ থেকে টিকেট নেয়া হয় জনপ্রতি ১৩ ডলার করে - যে পরিমাণ অর্থ আসে সেটা দিয়ে নিশ্চয়ই রক্ষণাবেক্ষণ ভালভাবেই করার কথা।

যোগজাকার্তার ট্রেডমার্ক রিক্সাএর পরদিন আমরা যোগজাকার্তার ট্রেডমার্ক রিক্সায় চড়ে তামান সারি ওয়াটার ক্যাসল দেখতে গেলাম। এটি রাজপ্রাসাদ বা ক্রাতোন এর দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। ১৮ শতাব্দীতে সুলতানের জন্যে তৈরি এই স্থাপনাটিকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি বিশ্রামাগার, একটি অস্ত্রাগার, লুকানোর জায়গা ইত্যাদি। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে এর মধ্যে একটি ঝর্ণার জলে পূর্ণ পুকুর আছে যাকে সুলতান তার স্নানঘর বা হারেম হিসেবে ব্যবহার করত। মূল কম্পাউন্ডে অনেক সঙ্গীতশিল্পী সুর তুলত এবং নর্তকীরা নাচত। এরপর তারা বড় পুকুরে স্নান করে তাদের বিশ্রামাগারে চলে যেত এবং রাজা সেখান থেকে তার রাতের সঙ্গিনীদেরকে পছন্দ করতেন। এরপর তারা একটি ছোট পুকুরে সুলতানকে গোসল করাত এবং সেখানে বিশ্রামাগারে রাজার শয্যসঙ্গিনী হত।

মূল কম্পাউন্ডের বাইরে এই এলাকাটিতে এখন সুলতানদের চাকরবাকরদের পরিবারদের বিশাল একটি সমাজ থাকে। তারা বিভিন্ন বাটিকের কাপড় তৈরি করে ও পর্যটকদের কাছে বেচে।

যোগজাকার্তা হস্তশিল্প ও বাটিকের জিনিষপত্রের জন্যে খুব প্রসিদ্ধ। সেটি নিয়ে লিখতে গেলে আরেকটি পোস্ট হবে। তাই এখানেই শেষ করছি।

* প্রথম ছবিটি মেরাপি পাহাড়ের - উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে। বাকিগুলো আমার তোলা।

* কোটা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় তামান সারির ছবিগুলো দেয়া গেল না। পরবর্তীতে যোগ করে দেব।


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

জ্বালামুখ দেখার বড় ইচ্ছে ছিল। দেখা হলোনা মন খারাপ

ছবিগুলো এখানে না আপলোড করে ফ্লিকারে তুলে এখানে এমবেড করলে মনে হয় দৃষ্টিনন্দন হবে। ৫০০পিক্সেলের ছবি না ক্লিক করেও তখন সুন্দর দেখা যাবে। আপনার ছবিগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে রোদহীন দিনের ছবি এগুলো। তবে রোদ না থাকাতে ঘোরাঘুরি নিশ্চয়ই আরামে হয়েছে।
...............................
নিসর্গ

রেজওয়ান এর ছবি

আমার প্রতিটি ছবি দুই মেগাবাইটের উপরে। বাংলাদেশের পাঠকদের কথা চিন্তা করে সেটাকে কমিয়ে ১০০ কেবি করেছি পিক্সেল কমিয়ে। সেটার কোয়ালিটি আবার সচলে তোলার পরে কমেছে। এছাড়া পোস্ট প্রসেসিং ও করা হয়নি। তাই এই দুরবস্থা।

ফেসবুকে এর চেয়ে ভাল আসে - যদিও নেটা ৭২০ কেবিতে লিমিটেড তাই আশানুরুপ না। আপনি যদি আমার ফেসবুকে থাকেন তাহলে জ্বালামুখের ছবি দেখতে পাবেন
ভবিষ্যৎে এমবেড করে ছবি দেব।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগছে। চলুক সিরিজ।

একটা প্রশ্ন - স্থানীয় ভাষায় কি উচ্চারণ যোগজাকার্তা নাকি অন্য কিছু?

কৌস্তুভ

রেজওয়ান এর ছবি

স্থানীয়ভাবে একে যোগজা বলে, ইংরেজীভাষীরা হয়ত অন্যভাবে উচ্চারণ করে।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

ওডিন এর ছবি

চমৎকার! আগেরটা বাদ পড়ে গেছিলো- এই সুযোগে পড়ে ফেললাম।
তবে বস পিপিদা যেইরকম বললেন- ছবিগুলো ফ্লিকার দিয়ে এমবেড করে দিলে দেখতে আরাম হতো। তবে এখানে যা দেখলাম তাতেই অবশ্য আমি মুগ্ধ!

কয়েকদিন আগে গোপন পারিবারিক সূত্রে খবর পেলাম আব্বাহুজুর নাকি সম্মেলনসূত্রে ইন্দোনেশিয়া যাইতে পারেন। তাই সামনের কয়েকটা মাস খুব ভালো ছেলে হয়ে থাকতে হবে। চিন্তিত
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

রেজওয়ান এর ছবি

ধন্যবাদ পড়ার জন্যে। এখানে ছবির কোয়ালিটি যেমন আসছে সেটা দেখে আমি ভারী হতাশ। এগুলো ফেসবুকে তোলা আছে - তার কোয়ালিটি অনেক ভাল। আমার ফ্লিকার একাউন্টটায় ২০০ ছবি হয়ে গেছে। প্রফেশনাল একাউন্টটি কিনতে হবে।

ওহ আর আপনার আব্বা আসার পূর্বে জানাবেন।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

শরতশিশির এর ছবি

আমার বাবা একসময় সরকারী আমলা ছিলেন। কয়েকবার গেছেন ইন্দোনেশিয়ায় - বড়বুদুর, যোগ যাকার্তা, বালি, কালিমান্তান, জাভা, গাড়ুর, বাটিক - সব চেনা নাম। আমার নিজের কয়েকজন ইন্দোনেশিয়ান ফ্রেন্ড আছে। ভাল লাগলো।

আমার এক বান্ধবী আছে জাকার্তায়, ওর নরওয়েজিয়ান হাসবেন্ড টেলেনর-এ স্পেশালিস্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে। আপনি কি আগ্রহী হবেন যোগাযোগ করতে? আমি তাহলে ওকে বলি - ওরা বেশিদিন হয়নি গেছে।

ভাল থাকবেন। ও হ্যাঁ, গ্লোবাল ভয়েসেস-এ আপনার লেখাটা একটা ভাল সামারি ছিল, আমি অনেককেই পাঠিয়েছি। হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি দেখতে চাই না বন্ধু তুমি
কতখানি হিন্দু আর কতখানি মুসলমান
আমি দেখতে চাই তুমি কতখানি মানুষ।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি দেখতে চাই না বন্ধু তুমি
কতখানি হিন্দু আর কতখানি মুসলমান
আমি দেখতে চাই তুমি কতখানি মানুষ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।