প্রোগ্রামারের ডায়েরী: পতাকার ব্যক্তিগত গল্প

রিক্তা এর ছবি
লিখেছেন রিক্তা [অতিথি] (তারিখ: শনি, ৩০/০৩/২০১৩ - ২:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সোনালী ঝর্ণা থেকে রবিন যখন আলোর সংকেত দিচ্ছে ঠিক তক্ষুণি কলিং বেল বেজে উঠলো। বই বন্ধ করে চাবি হাতে নিচে গিয়ে দেখি আব্বু এসেছেন। ঘরে ঢুকে আব্বু হাতে নীল পলিথিন এর ব্যাগটা হাতে দিয়ে বললেন গামছাটা নিয়ে আসো তো বাপ। ব্যাগের বাইরে থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছে ভেতরে কমলা। আব্বুর হাতেও আর কিছু নাই। আব্বু কি ভুলে গেছেন? আব্বু ততক্ষণে হাত মুখ ধুয়ে, ভাত খেয়ে সকালের পত্রিকা খুলে বসেছে্ন। আমাকে ঘুর ঘুর করতে দেখে বলেন আমার প্যান্টের পকেটে দেখ। বেল্ট লাগানো প্যান্টের পকেট হাতড়েই পেয়ে গেলাম এক ইঞ্চি উঁচু বান্ডিলটা!

একশ কাগজের পতাকা। যদিও এরা একশ বলে বিক্রি করে। আসলে বড়জোর আছে বিরানব্বই কি পঁচানব্বইটা। দেরী না করে দ্রুত গুনে ফেললাম। বারান্দার গ্রিলে ঠিক কোনভাবে লাগালে necessary এবং sufficient হয় সেই অঙ্ক কষে ফেললাম। এখন শুধু আঠা বানানটাই বাকি। সেটাও শিখে ফেলেছি সেইদিন বুবুর কাছে। চায়ের পাতিলে আটা আর পানি মিশিয়ে চুলায় দিযে জাদু দেখার জন্য তাকিয়ে আছি। আটা গোলান পানি নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ২-৩ মিনিটের মাথায় আগ্নেয়গিরি মত ফুটতে শুরু করলো। অনেক রাত পর্যন্ত পতাকা লাগলাম। পতাকা গুলোর একপাশে আঠা দিয়ে গ্রিলে চেপে দিতেই উড়িয়ে দেওয়া পায়রার মত একটা একটা করে পতাকা গা ঝাড়া দিতে উঠতে লাগলো।

চোখের পাতার ভিতরে উষ্ণ লাল রঙের আলো পরছে। চোখ খুলতেই দেখি চারদিকে ঝকঝকে সকাল। একছুটে বারান্দা গিয়েই দেখি আমাদের পতাকার গায়ে রৌদ্র খেলা করছে। আর যতদুর রাস্তা চোখে পরে ছোট ছোট পতাকায় মোড়া। গরম চা রুটি দিয়ে নাশতা করতে করতে টিভিতে বিজয়দিবসের কুচকাওয়াজ দেখছি, এমন সময় আব্বু বাজার থেকে ফিরলেন। বাজারের ব্যাগ আমাদের হাতে দিয়ে বললেন ছুরি, পানি ভর্তি বড় গামলা, আর পুরনো খবরের কাগজ এনে দিতে। আব্বু ছুটির দিনে খিরা আর টমেটোর সালাদ নিজের হাতে বানাতে ভালবাসেন খুব।

পানিতে ভেজানো একটা খিরা তুলে যত্ন করে ছুলতে ছুলতে আব্বু বলতে শুরু করলেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। অবিশ্বাস্য গল্পসব। সেই অদ্ভুত ভাগ্যবান ভদ্রলোকের কথা যে কি আশ্চর্য উপায়ে তিনবার পাকিস্তানি মিলিটারির হাত থেকে বেঁচে গেছেন। অথবা সেই পরিবারটি যারা মাছেভরা পুকুর, ফলবতী গাছের বাগান, নিকানো চৌচালা ঘর ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে পারি দিয়েছে। এরপর রাজাকারেরা তাদের বাড়িকে কিভাবে ধবংসস্তুপে পরিনত করেছিল। বলে চললেন যশোরের প্রথম শহীদ চারুবালার লাশ নিয়ে মিছিলের কথা। ভাইদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়া, অজস্র মৃত্যু আর বিজয়ের গল্প। কুচানো সবুজ শসা আর লাল টমেটো মেশাতে মেশাতে হঠাৎ বলে ওঠেন আমরা তো কোনো ব্যক্তিগত প্রাপ্তির জন্য যুদ্ধে যোগ দেই নাইরে। আম্মু খোসা গুলোকে খবরের কাগজে মুড়িয়ে নিতে এসে গল্পে যোগ দেন। বলেন ঢাকা থেকে হেঁটে দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে পথে কেমন করে মানুষ মুড়ি আর পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নানা ভাইকে ধরেও কিভাবে মিলিটারীরা দাঁড়ি দেখে ছেড়ে দিয়েছিল।

রওশন জামিল থালাবাতি ছুঁড়ে ফেলছেন টিভির পরদায়। জীবন থেকে নেওয়া দেখতে দেখতে জীবনে প্রথম বার চুলে ফুল গুঁজতে থাকি। বিকালে রমনায় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে গান গাইতে যাব। রিক্সা ঠিক হওয়া মাত্র আমি সিটের উপরে উঠে বসি। আম্মু আর বুবু সিটে ঠিকঠাক হয়ে বসতে থাকেন। এই অবসরে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আমাদের বারান্দায় পতাকারা প্রজাপতির একশ পাখনার মত ঢেউ তুলেছে।

অনুষ্ঠান শেষ করে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে। আশেপাশের বাসায় বাতি নেভানো। রিকশা ধীরে ধীরে বাসার দিকে আগাতে থাকে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমাদের নিরানন্দ বারান্দার আশ্চর্য পরিবর্তন দেখি। ল্যাম্প পোস্টএর আলোয় আমাদের পতাকারা একশ প্রদীপের স্থির শিখার মত রাতকে পাহারা দিচ্ছে।

শীতের রাতে গরম পানিতে হাত মুখ ধোয়ার মত সুখ কমই আছে। এরপর ভাত আর এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে এক দৌড়ে লেপের নিচে ঢুকে বুবুর গলার জড়িয়ে ঘুম। জানালার ভাঙ্গা কাঁচ দিয়ে ঠান্ডা উত্তরে বাতাস আসছে। আর সেই হাওয়ায় আমার পতাকারা উড়তেই থাকে, উড়তেই থাকে।


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

চমৎকার চলুক

নির্বিঘ্নে উড়ুক পতাকা৷

..................................................................
#Banshibir.

রিক্তা এর ছবি

আমাদের পতাকা উড়বেই।

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

শাব্দিক এর ছবি

খুব ভাল লাগল।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

রিক্তা এর ছবি

ধন্যবাদ শাব্দিক।

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

ব্যঙের ছাতা এর ছবি

চলুক
চলুক

রিক্তা এর ছবি

ধন্যবাদ ব্যঙের ছাতা।

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

কৌস্তুভ এর ছবি

এহ, প্রোগ্রামারের ডায়েরি দেখে পড়তে এলাম কিন্তু প্রোগ্রামিং নিয়ে একটা কথাও পেলাম না?

রিক্তা এর ছবি

"প্রোগ্রামারের ডায়েরী" হোলো আমার আইলসামি আর ভুলোমনের ইলেক্ট্রনিক প্রমান। শিরোনাম আর ট্যাগে একটা কিওয়ার্ড থাকলে খুঁজতে আর মনে রাখতে বিশাল সুবিধা দেঁতো হাসি

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

মর্ম এর ছবি

পিচ্চি ছিলাম যখন, নানার ড্রয়ার থেকে পতাকা বের হত স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে। এরপর একটা বড়সড় বাঁশ খুঁজে ওর একদম মাথায় পতাকা টানানো।

আর একটু পরেই বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে গাছ আর বিল্ডিংযের ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে বাসার পতাকাটা দেখার চেষ্টা, যত দূর থেকে দেখা যায় তত আনন্দ!

ভাল লাগল পতাকা কথন।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

রিক্তা এর ছবি

নিজ হাতে পতাকা টাঙ্গায়ে তারপর দূর থেকে সেই জীবন্ত পতাকা দেখার মত আনন্দের কোনো তুলনাই নাই।

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

শিশিরকণা এর ছবি

খুব সুন্দর।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।