কালাধুঙ্গির আতঙ্ক-৩

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০৩/০৫/২০১৫ - ১০:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্

মতি সিং নামের বছর ত্রিশের এক যুবক চুরাইলের খপ্পরে পড়েছিল। সকালে জঙ্গলে কাজ করতে গিয়েছিল মতি। হঠাৎ এক সুন্দরি মেয়ে উদয় হয় কোত্থেকে। তার চোখে চোখ রেখে হাতছানি দিয়ে ডাকে। চুরাইলের গল্প জানে মতি। সন্দেহ হয় তার। মেয়েটার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে পায়ের দিকে নজর দেয়। সত্যিই মেয়েটার পায়ের পাতা পেছন দিকে ঘোরানো। মনে পড়ে যায় চুরাইলের কবল থেকে বাঁচার উপায়। সঙ্গে সঙ্গে দুহাত দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে ফেলে মতি। শুরু হয় চুরাইলের চিৎকার। তীক্ষè রক্ত হীম করা। ভয় পেলেও চোখ খোলেনি মতি। চুরাইল চিৎকার করতে করতে বনের গভীরে চলে যায়। এক ছুটে বাড়ি ফিরে আসে মতি।
জেনে নিলাম কোন্ জঙ্গলে মতি গিয়েছিল। আঙুল দিয়ে পশ্চিম দিকটা দেখাল।

কালাধুঙ্গির ফরেস্ট রেঞ্জে গিয়ে আমাদের পরিচয় দিলাম। পাণ্ডে একটা বন্দুক ধার চাইল। বন্দুক চালানোর কাজটা পাণ্ডে ভালোই পারি। তা বন্দুক দিল ওরা।
এরপর ধীর পায়ে আমরা পশ্চিম দিকে এগুলাম। পাহাড়ি পথ, ইচ্ছে করলেই জোরে হাঁটা যায় না। পশ্চিম দিকে কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম পথটা থেমে গেছে ৪৫ ডিগ্রি ঢালে। চড়াই ভেঙে নামতে শুরু করলাম। নীচে একটা নদী।
নদীর পাড়ে নরম বালির ওপর বাঘের পায়ের ছাপ রয়েছে। অবাক হলাম। গোটা উত্তরাখ- জুড়েই কি বাঘগুলো বিচরণ করছে। পায়ের ছাপ ধরে এগোলাম কিছুদূর। হঠাৎ পায়ের ছাপ মিলিয়ে গেছে। যাবার অবশ্য কারণও আছে। তিনটি বিরাট বিরাট পাথর গোল হয়ে পড়ে আছে। বিরাট তিন পাথরের মাঝখান নদীর পানি আটকা পড়ে তৈরি হয়েছে একটা জলাশয়।

সামনের পাথরটা পেরিয়ে দেখি একটা লোক ছিপ হাতে বসে আসে জলাশয়ের ধারে। লোকটা ইউরোপিয়ান বলে মনে হলো। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানও হতে পারে। সাদা চামড়ার। হ্যাংলাটে শরীর। সাদা-কালো মোটা গোঁফ। চেহারা দেখে সুদর্শন বলা যাবে না। তবে উচ্চতায় বেশ। নিবিষ্ট মনে লোকটা মাছ ধরায় ব্যস্ত। হাঁকলাম লোকটাকে, ‘এই যে সাহেব। আপনি কি চুরাইলের চিৎকার শুনেছেন?’
লোকটা কোনও জবাব দিল না। যেন শুনতেই পায়নি আমার কথা। অগত্যা আমরা তার ভরসা বাদ দিয়ে এগোনোর কথা ভাবছি। তখনই ঝটপট শব্দ এলো জলাশয় থেকে। মাছ গেঁথেছে, বড়শিতে। হুইলের সুতো গুটিয়ে মাছটাকে ওপরে তুলল লোকটা। একটা মহাশোল। কেজি দেড়েক ওজন হবে। ভাবলাম এবার নিশ্চয় কিছুস বলবে লোকটা। কিন্তু পাণ্ডের উত্তেজিত কণ্ঠ শুনলাম-- ‘জামিল দ্যাখো দ্যাখো!’ নরম বালির ওপর ইঙ্গিত করছে পাণ্ডে।

যা দেখলাম, বিস্ময়ে একেবারে ‘থ’! দুটো পায়ের ছাপ। মানুষের। খুব বড় নয়। মহিলার। কিন্তু আশ্চর্য এবং আতঙ্কের বিষয় হলো পায়ের পাতা পেছন দিকে ঘোরানো! নানুষের পায়ের ছাপ যখন ভেজা মাটিতে পড়ে তখন ডান পায়ের বুড়ো আঙুল বাঁদিকেই থাকে। সবার শেষে কড়ে আঙুল। আর বাম পায়ের একেবারে বাঁয়ে কড়ে আঙুল এবং সবার শেষে বুড়ো আঙুল। দুই পা পাশাপাশি রাখলে বুড়ো আঙুল দুটো পাশাপাশি থাকবে। ছাপের বাইরে দিকে থাকবে দুই কড়ে আঙুল। কিন্তু এখানে ঠিক তার উল্টো। দুটো ছাপ পাশাপাশি রাখলে হিসাবটা দাঁড়াবে কড়ে আঙুল দুটো পাশাপাশি আর বুড়ো আঙুল দুটো বাইরের দিকে।
শরীরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। সত্যিই তা হলে চুরাইল আছে! মাছ ধরা লোকটা কি দেখেছে তাকে। আবার জিজ্ঞেস করার জন্য পেছন দিকে ফিরলাম। কিন্তু নেই লোকটা! চারদিকটা ভালো করে দেখলাম। কোথায় গেল? এই পাহাড়ি পথে এক মিনিটে একটা লোক উধাও হয়ে যাবে! অসম্ভব? কী ঘটছে এসব!
পাণ্ডে বলল, ‘চলো এই পায়ের ছাপ ধরেই এগোই।’
‘ঠিক বলেছ,’ জবাবে বললাম।
পায়ের ছাপটা বালিয়াড়ী ধরে উঠে গেছে ঘাসে ভরা পাহাড়ি পথে। কিছুক্ষণ এগোনোর পর আর পেলাম না। তারপর আবার সেই চিৎকার। পাহাড়ি ট্রেইল ধরে উঠে গেলাম ৫০ ফুট ওপরে। চিৎকার আসছে দক্ষিণের এক উপত্যকার দিক থেকে। একটা মেঠো পথ। দুই-তিনশো গজ দূরে। চড়াই পথে দেড়শফুট নীচে। সেদিকে চুরাইলের কোনও চিহ্ন নেই। একদল কাঠুরে কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে চলেছে। সাহস বলিহারি এদের! একে তো মানুষখেকোর ভয়, তার ওপর চুরাইল।

হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। কাঠুরেরা পাহাড়ি পথের মোড় ঘুরছিল। সেখানে একটা বড় আখরোট গাছ। পথটার ওপরেই ঝুলে রয়েছে বড় একটা ডাল। একে একে সব কাঠুরে বাঁকের ও পাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু সবশেষের জনের ভাগ্য বোধহয় মন্দ ছিল। মোড় ঘোরার ঠিক আগ মুহূর্তে একটা চিতা লাফিয়ে পড়ল তাকে লক্ষ করে। চিতাটা আখরোট পাতার আড়ালে ঘাপটি মেরে ছিল। সুযোগ পেয়েই ডাল থেকে লাফিয়ে পড়েছে।
ভাগ্য বোধহয় মন্দ চিতাটারও। কাঠুরের মাথায় ছিল কাঠের বোঝা। চিতা লাফ দিল লোকটার ঠিক পেছনে। লাফ দেয়ার ওই সামান্য শব্দটাই পৌঁছে গেল সামনের লোকগুলোর কানে। চিতা সবে দুপায়ে ভর করে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে একেবারে সারির প্রথম জন মাথার বোঝা ফেলে তার কুঠারখানা ছুঁড়ে মারে চিতার বুক লক্ষ্য করে। এতেই ভয় পেয়ে যায় চিতা। লাফ দিয়ে হারিয়ে যায় বনের ভেতর। সেই সাথে ভোজবাজীর মত হারিয়ে যায় সেই পাহাড়ি পথ আর কাঠুরেদল। যেন সিনেমায় দৃশ্যপট পরিবর্তন হলো।
এ দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে গেলাম! ব্যাখ্যা কী এর। কেন এমন ঘটনা ঘটছে আর দৃশ্যপট উধাও হচ্ছে। উত্তরটা হয়তো ভাবলেই পেয়ে যেতাম। কিন্তু চুরাইলের চিৎকার সে অবকাশ দিল না। এবার উত্তর দিক থেকে এলো চিৎকারটা। একটা নারীমূর্তি যেন ক্ষণিকের জন্য উদয় হলো। মুহূর্তের মধ্যে আবার গেল উধাও হয়ে।
আমরা ছুটলাম উত্তরের জঙ্গলের দিকে। সামনে চড়াই। তারপরে আবার উৎরাই পার হলেই জঙ্গলটা।

চড়াই ভেঙে নামলাম। পানি ঝরার ঝর ঝর শব্দ কানে এলো। মানে কাছেই একটা ঝর্ণা। এগোলাম সেদিকে। ঝর্ণাটা নেমে গেছে। পশ্চিমের দিকে। একটু আগে যে জলাশয় দেখে এলাম। এটা তারই উৎস।
ঝর্ণাধারার পাশে নরম বালির ওপর চুরাইলের পায়ের ছাপ। একেবারে টাটকা। পেছনেই আরেকটা ছাপ। বাঘের। আমরা এগোলাম। পাশে একটা বড় একটা বড় একটা পাথর। তার ওপাশেই বড় বড় গাছের সারি। গাছের ঘনপাতায় মৃদু হাওয়ার টোকা লেগে ফিসফিসানির মত শব্দ হচ্ছে। নির্জন-নিস্তব্ধ জঙ্গল। হঠাৎ করেই যেন ভুতুড়ে রূপ ধারণ করে। পা-ে কাঁধের রাইফেলে শক্ত করে হাত রাখল। চড়াই ভেঙে নামতে শুরু করলাম আমরা।
হঠাৎ একটা আধাকাটা পাইন গাছ চোখে পড়ল। গাছের গায়ে কুড়–ল এখনও গেঁথে আছে। দুজনে ছুটলাম সেদিকে। কাছে গিয়ে দেখি কুড়–লের গায়ে রক্ত। মাটিতে ঘাসের ওপর রক্তের ছাপ। বেশ কিছু পিঁপড়ে ক্রমে জুটেছে রক্ত খাওয়ার লোভে। বুঝলাম, ঘটনাটা বেশি আগের নয়। কাঠুরেকে তুলে নিয়ে গেছে বাঘে।

থাবার ছাপ পাথুরে মাটিতে বেশিদূর অবধি পাওয়া গেল না। তবে ঘাস আর ঝোপঝাড়ের ওপর রক্তের চিহ্ন ধরে আমরা সন্তর্পণে এগিয়ে চললাম। বেশ কিছুটা পথ উৎরাই ধরে নেমেছে বাঘটা। তারপর আট-নয় ফুট উঁচু একটা পথর টপকে ওপারে চলে গেছে। আমরাও পাথর বেয়ে নেমে গেলাম। কিন্তু বেশিদূর যাওয়া হলো না। একটা ঘন ঝোপ আড়াআড়িভাবে আমাদের পথ রোধ করেছে। রক্তের ছাপ ঢুকে গেছে সেই ঝোপের ভেতর। দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাণ্ডে বলল, ‘বাঘ এই ঝোপের ভেতরেই আছে।’
কী করব, ভাবছি। গরগর শব্দ শুনতে পেলাম। পাণ্ডের অনুমানই ঠিক। ওই ঝোপের ভেতর থেকেই আসছে। তারমানে বাঘ মড়ি আগলে ওই ঝোপের ভেতরেই বসে আছে। কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতরেই ভুলটা ভাঙল।
পাণ্ডে ছিল আমার ঠিক ডান দিকে। ওর হাতে রাইফেল ধরা। সেফটি ক্যাচ তোলা রয়েছে। যেকোনো বিপদের মােকাবেলা করতে প্রস্তুত। গজরানির শব্দে আমিও দাঁড়িয়ে পড়েছি। চোখের কোণে একটা নড়াচড়া লক্ষ্য করলাম। পাণ্ডের মাথার ওপর। বিশ-পঁচিশ ফুট উঁচুতে একটা আখরোট গাছের ডাল নড়ে উঠল। পাতার ফাঁকে দেখলাম হলুদ দুত্যি। একটা চিতা পাণ্ডের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করছে। চিতার শরীরের ভারে দুলছে ডালটা।

কী করি! চরম বিপদের মুহূর্তে নিজেকে রক্ষা করার একটা প্রস্তুতি থাকে সব প্রাণীর অবচেতন মনে। এখানেও তাই হলো। আগুপিছু না ভেবে পাণ্ডের রাইফেল ধরা কাঁধটা ধরে জোরসে দিলাম একটা ধাক্কা। সাথে সাথে অভাবিত কা- ঘটল। আমার ধাক্কার চোটে রাইফেলের ট্রিগারে টান পড়ল। বিকট শব্দ করে বেরিয়ে গেল গুলি। রাইফেল আর আমার দ্বিমুখি ধাক্কা বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ল বেচারা পাণ্ডে। আমিও তাল হারিয়ে ফেললাম। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম মাটিতে। ঠিক সেই মুহূর্তে ঝোপের ভেতর থেকে আমার দিকে উড়ে এলো হলদে-কালো ডারাকাটা একটা মূর্তি। কিছই বুঝলাম না। কান ফাটানো একটা গর্জন কানে এলো।
ঘোর কাটার পর দেখি বনের সবচেয়ে শক্তিশালী আর সবচেয়ে ধূর্ত দুই মানুষখেকোর দুর্ধষ লড়াইয়ে মেতে উঠেছে। বিস্ময়ে আতঙ্কে বিমূঢ় হয়ে বরফের মতো জমে গেলাম। ওদের এ লড়াইটা আকস্মিক। দুজন একই সাথে আমাদের ওপর লাফিয়ে পড়েছিল। অবচেতন মনের সাড়া পেয়ে সরে না পড়লে এতক্ষণ আমাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। আমারা স্থানচূত্য হয়েছিলাম বলে বাঘ আর চিতা আমাদের বদলে পরস্পরের ঘাড়ে এসে পড়ে।

লড়াই দেখছিলাম হতভম্বের মতো। ঘোর কাটিয়ে উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করলাম। পিঠে পাণ্ডের হাতের টোকা। বিড়বিড় করে বলল, ‘নড়াচড়া করো না। ওদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে। তখন লড়াই ছেড়ে আমাদের ওপর চড়াও হবে।’
দুই দানবের গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠছিল মাটি। বাঘ শক্তিতে অনেক এগিয়ে। চিতা শক্তির ঘাটতিটা পুষিয়ে দিচ্ছিল তার স্বভাবসুলভ ক্ষিপ্রপতায়। নখ ও দাঁতের ব্যবহারও করে যাচ্ছিল সমানতালে। কিন্তু একজনকে হারতে হবেই। শেষ পর্যন্ত শক্তিরই জয় হলো।
চিতার ক্ষতবিক্ষত শরীরটা নিজের বিশাল দেহের নিচে ধরে রেখেছে কেঁদো বাঘটা। তারপর শ্বদাঁত দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে বসিয়ে দিল চিতার খুলিতে। মট করে শব্দ করে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। ছিটকে বেরিয়ে এলো চিতার একটা চোখও। চিতাটা সম্পূর্ণ নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত বাঘটা শেষ পর্যন্ত বসে রইল ওর পিঠের ওপর। গুলি করে বাঘের খুলি উড়িয়ে দেবার মোক্ষম সুযোগ। এনাইহিলিন গান চালালাম। কাজ হলো না। পাণ্ডের দিকে তাকালাম। অবাক চোখে দেখলাম, পাণ্ডের চোখ লড়াইয়ে ময়দানে নেই। তবে কি এই লড়াইয়ের চেয়েও বিস্ময়কর কিছু ওর চোখে পড়েছে?
----চলবে-----

এই সিরিজের অন্যগল্প : বিষ্ণুপদের বিড়াল, অন্য পৃথিবী, কিউপিড ব্যালান্স, জামিল ও অদৃশ্য মানব, ভিনগ্রহের পাণ্ডুলিপি-১, , , ,


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।