কালাধুঙ্গির আতঙ্ক-শেষ পর্ব

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১৩/০৫/২০১৫ - ৬:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, কালাধুঙ্গির আতঙ্ক-৩
মতি সিং নামের বছর ত্রিশের এক যুবক চুরাইলের খপ্পরে পড়েছিল। সকালে জঙ্গলে কাজ করতে গিয়েছিল মতি। হঠাৎ এক সুন্দরি মেয়ে উদয় হয় কোত্থেকে। তার চোখে চোখ রেখে হাতছানি দিয়ে ডাকে। চুরাইলের গল্প জানে মতি। সন্দেহ হয় তার। মেয়েটার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে পায়ের দিকে নজর দেয়। সত্যিই মেয়েটার পায়ের পাতা পেছন দিকে ঘোরানো। মনে পড়ে যায় চুরাইলের কবল থেকে বাঁচার উপায়। সঙ্গে সঙ্গে দুহাত দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে ফেলে মতি। শুরু হয় চুরাইলের চিৎকার। তীক্ষ্ণ রক্ত হীম করা। ভয় পেলেও চোখ খোলেনি মতি। চুরাইল চিৎকার করতে করতে বনের গভীরে চলে যায়। এক ছুটে বাড়ি ফিরে আসে মতি।
জেনে নিলাম কোন্ জঙ্গলে মতি গিয়েছিল। আঙুল দিয়ে পশ্চিম দিকটা দেখাল।
কালাধুঙ্গির ফরেস্ট রেঞ্জে গিয়ে আমাদের পরিচয় দিলাম। পাণ্ডে একটা বন্দুক ধার চাইল। বন্দুক চালানোর কাজটা পাণ্ডে ভালোই পারে। বন্দুক দিল ওরা।
এরপর ধীর পায়ে আমরা পশ্চিম দিকে এগুলাম। পাহাড়ি পথ, ইচ্ছে করলেই জোরে হাঁটা যায় না। পশ্চিম দিকে কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম পথটা নেমে গেছে ৪৫ ডিগ্রি ঢালে। চড়াই ভেঙে নামতে শুরু করলাম। নীচে একটা নদী।
নদীর পাড়ে নরম বালির ওপর বাঘের পায়ের ছাপ রয়েছে। অবাক হলাম। গোটা উত্তরাখণ্ড জুড়েই কি বাঘগুলো বিচরণ করছে। পায়ের ছাপ ধরে এগোলাম কিছুদূর। হঠাৎ পায়ের ছাপ মিলিয়ে গেছে। যাবার অবশ্য কারণও আছে। তিনটি বিরাট বিরাট পাথর গোল হয়ে পড়ে আছে সামনে। বিরাট তিন পাথরের মাঝখান নদীর পানি আটকা পড়ে তৈরি হয়েছে একটা জলাশয়।
সামনের পাথরটা পেরিয়ে দেখি একটা লোক ছিপ হাতে বসে আসে জলাশয়ের ধারে। লোকটা ইউরোপিয়ান বলে মনে হলো। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানও হতে পারে। সাদা চামড়ার। হ্যাংলাটে শরীর। সাদা-কালো মোটা গোঁফ। চেহারা দেখে সুদর্শন বলা যাবে না। তবে উচ্চতায় বেশ। নিবিষ্ট মনে লোকটা মাছ ধরায় ব্যস্ত। হাঁকলাম লোকটাকে, ‘এই যে সাহেব। আপনি কি চুরাইলের চিৎকার শুনেছেন?’
জবাব দিল না লোকটা । যেন শুনতেই পায়নি আমার কথা। অগত্যা আমরা তার ভরসা বাদ দিয়ে এগোনোর কথা ভাবছি। তখনই ঝটপট শব্দ এলো জলাশয় থেকে। মাছ গেঁথেছে, বড়শিতে। হুইলের সুতো গুটিয়ে মাছটাকে ওপরে তুলল লোকটা। একটা মহাশোল। কেজি দেড়েক ওজন হবে। ভাবলাম এবার নিশ্চয়ই কিছু বলবে লোকটা। কিন্তু পাণ্ডের উত্তেজিত কণ্ঠ শুনলাম-- ‘জামিল দ্যাখো দ্যাখো!’ নরম বালির ওপর ইঙ্গিত করছে পাণ্ডে।
যা দেখলাম, বিস্ময়ে একেবারে ‘থ’! দুটো পায়ের ছাপ। মানুষের। খুব বড় নয়। মহিলার। কিন্তু আশ্চর্য এবং আতঙ্কের বিষয় হলো পায়ের পাতা পেছন দিকে ঘোরানো! নানুষের পায়ের ছাপ যখন ভেজা মাটিতে পড়ে তখন ডান পায়ের বুড়ো আঙুল বাঁদিকেই থাকে। সবার শেষে কড়ে আঙুল। আর বাম পায়ের একেবারে বাঁয়ে কড়ে আঙুল এবং সবার শেষে বুড়ো আঙুল। দুই পা পাশাপাশি রাখলে বুড়ো আঙুল দুটো পাশাপাশি থাকবে। ছাপের বাইরে দিকে থাকবে দুই কড়ে আঙুল। কিন্তু এখানে ঠিক তার উল্টো। দুটো ছাপ পাশাপাশি রাখলে হিসাবটা দাঁড়াবে কড়ে আঙুল দুটো পাশাপাশি আর বুড়ো আঙুল দুটো বাইরের দিকে।
শরীরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। সত্যিই তা হলে চুরাইল আছে! মাছ ধরা লোকটা কি দেখেছে তাকে। আবার জিজ্ঞেস করার জন্য পেছন দিকে ফিরলাম। কিন্তু নেই লোকটা! চারদিকটা ভালো করে দেখলাম। কোথায় গেল? এই পাহাড়ি পথে এক মিনিটে একটা লোক উধাও হয়ে যাবে! অসম্ভব? কী ঘটছে এসব!
পাণ্ডে বলল, ‘চলো এই পায়ের ছাপ ধরেই এগোই।’
‘ঠিক বলেছ,’ জবাবে বললাম।
পায়ের ছাপটা বালিয়াড়ী ধরে উঠে গেছে ঘাসে ভরা পাহাড়ি পথে। কিছুক্ষণ এগোনোর পর আর পেলাম না। তারপর আবার সেই চিৎকার। পাহাড়ি ট্রেইল ধরে উঠে গেলাম ৫০ ফুট ওপরে। চিৎকার আসছে দক্ষিণের এক উপত্যকার দিক থেকে। একটা মেঠো পথ। দুই-তিনশো গজ দূরে। চড়াই পথে দেড়শফুট নীচে। সেদিকে চুরাইলের কোনও চিহ্ন নেই। একদল কাঠুরে কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে চলেছে। সাহস বলিহারি এদের! একে তো মানুষখেকোর ভয়, তার ওপর চুরাইল।
হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। কাঠুরেরা পাহাড়ি পথের মোড় ঘুরছিল। সেখানে একটা বড় আখরোট গাছ। পথটার ওপরেই ঝুলে রয়েছে বড় একটা ডাল। একে একে সব কাঠুরে বাঁকের ও পাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু সবশেষের জনের ভাগ্য বোধহয় মন্দ ছিল। মোড় ঘোরার ঠিক আগ মুহূর্তে একটা চিতা লাফিয়ে পড়ল তাকে লক্ষ করে। চিতাটা আখরোট পাতার আড়ালে ঘাপটি মেরে ছিল। সুযোগ পেয়েই ডাল থেকে লাফিয়ে পড়েছে।
ভাগ্য বোধহয় মন্দ চিতাটারও। কাঠুরের মাথায় ছিল কাঠের বোঝা। চিতা লাফ দিল লোকটার ঠিক পেছনে। লাফ দেয়ার ওই সামান্য শব্দটাই পৌঁছে গেল সামনের লোকগুলোর কানে। চিতা সবে দুপায়ে ভর করে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে একেবারে সারির প্রথম জন মাথার বোঝা ফেলে তার কুঠারখানা ছুঁড়ে মারে চিতার বুক লক্ষ্য করে। এতেই ভয় পেয়ে যায় চিতা। লাফ দিয়ে হারিয়ে যায় বনের ভেতর। সেই সাথে ভোজবাজীর মত হারিয়ে যায় সেই পাহাড়ি পথ আর কাঠুরেদল। যেন সিনেমায় দৃশ্যপট পরিবর্তন হলো।
এ দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে গেলাম! ব্যাখ্যা কী এর। কেন এমন ঘটনা ঘটছে আর দৃশ্যপট উধাও হচ্ছে। উত্তরটা হয়তো ভাবলেই পেয়ে যেতাম। কিন্তু চুরাইলের চিৎকার সে অবকাশ দিল না। এবার উত্তর দিক থেকে এলো চিৎকারটা। একটা নারীমূর্তি যেন ক্ষণিকের জন্য উদয় হলো। মুহূর্তের মধ্যে আবার গেল উধাও হয়ে।
আমরা ছুটলাম উত্তরের জঙ্গলের দিকে। সামনে চড়াই। তারপরে আবার উৎরাই পার হলেই জঙ্গলটা।
চড়াই ভেঙে নামলাম। পানি ঝরার ঝর ঝর শব্দ কানে এলো। মানে কাছেই একটা ঝর্ণা। এগোলাম সেদিকে। ঝর্ণাটা নেমে গেছে পশ্চিমের দিকে। একটু আগে যে জলাশয় দেখে এলাম। এটা তারই উৎস।
ঝর্ণাধারার পাশে নরম বালির ওপর চুরাইলের পায়ের ছাপ। একেবারে টাটকা। পেছনেই আরেকটা ছাপ। বাঘের। আমরা এগোলাম। পাশে একটা বড় একটা পাথর। তার ওপাশেই বড় বড় গাছের সারি। নির্জন-নিস্তব্ধ জঙ্গল। হঠাৎ করেই যেন ভুতুড়ে রূপ ধারণ করে। পাণ্ডে কাঁধের রাইফেলে শক্ত করে হাত রাখল। চড়াই ভেঙে নামতে শুরু করলাম আমরা।
হঠাৎ একটা আধাকাটা পাইন গাছ চোখে পড়ল। গাছের গায়ে কুড়–ল এখনও গেঁথে আছে। দুজনে ছুটলাম সেদিকে। কাছে গিয়ে দেখি কুড়ুলের গায়ে রক্ত। মাটিতে ঘাসের ওপর রক্তের ছাপ। বেশ কিছু পিঁপড়ে ক্রমে জুটেছে রক্ত খাওয়ার লোভে। বুঝলাম, ঘটনাটা বেশি আগের নয়। কাঠুরেকে তুলে নিয়ে গেছে বাঘে।

থাবার ছাপ পাথুরে মাটিতে বেশিদূর অবধি পাওয়া গেল না। তবে ঘাস আর ঝোপঝাড়ের ওপর রক্তের চিহ্ন ধরে আমরা সন্তর্পণে এগিয়ে চললাম। বেশ কিছুটা পথ উৎরাই ধরে নেমেছে বাঘটা। তারপর আট-নয় ফুট উঁচু একটা পথর টপকে ওপারে চলে গেছে। আমরাও পাথর বেয়ে নেমে গেলাম। কিন্তু বেশিদূর যাওয়া হলো না। একটা ঘন ঝোপ আড়াআড়িভাবে আমাদের পথ রোধ করেছে। রক্তের ছাপ ঢুকে গেছে সেই ঝোপের ভেতর। দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাণ্ডে বলল, ‘বাঘ এই ঝোপের ভেতরেই আছে।’
কী করব, ভাবছি। গরগর শব্দ শুনতে পেলাম। পাণ্ডের অনুমানই ঠিক। ওই ঝোপের ভেতর থেকেই আসছে। তারমানে বাঘ মড়ি আগলে ওই ঝোপের ভেতরেই বসে আছে। কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতরেই ভুলটা ভাঙল।
পাণ্ডে ছিল আমার ঠিক ডান দিকে। ওর হাতে রাইফেল ধরা। সেফটি ক্যাচ তোলা রয়েছে। যেকোনো বিপদের মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। গজরানির শব্দে আমিও দাঁড়িয়ে পড়েছি। চোখের কোণে একটা নড়াচড়া লক্ষ্য করলাম। পাণ্ডের মাথার ওপর। বিশ-পঁচিশ ফুট উঁচুতে একটা আখরোট গাছের ডাল নড়ে উঠল। পাতার ফাঁকে দেখলাম হলুদ দুত্যি। একটা চিতা পাণ্ডের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করছে। চিতার শরীরের ভারে দুলছে ডালটা।
কী করি! চরম বিপদের মুহূর্তে নিজেকে রক্ষা করার একটা প্রস্তুতি থাকে সব প্রাণীর অবচেতন মনে। এখানেও তাই হলো। আগুপিছু না ভেবে পাণ্ডের রাইফেল ধরা কাঁধটা ধরে জোরসে দিলাম একটা ধাক্কা। সাথে সাথে অভাবিত কাণ্ড ঘটল। আমার ধাক্কার চোটে রাইফেলের ট্রিগারে টান পড়ল। বিকট শব্দ করে বেরিয়ে গেল গুলি। রাইফেল আর আমার দ্বিমুখি ধাক্কায় বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ল বেচারা পাণ্ডে। আমিও তাল হারিয়ে ফেললাম। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম মাটিতে। ঠিক সেই মুহূর্তে ঝোপের ভেতর থেকে আমার দিকে উড়ে এলো হলদে-কালো ডারাকাটা একটা মূর্তি। কিছই বুঝলাম না। কান ফাটানো একটা গর্জন কানে এলো।
ঘোর কাটার পর দেখি বনের সবচেয়ে শক্তিশালী আর সবচেয়ে ধূর্ত দুই মানুষখেকো দুর্ধর্ষ লড়াইয়ে মেতে উঠেছে। বিস্ময়ে আতঙ্কে বিমূঢ় হয়ে বরফের মতো জমে গেলাম। ওদের এ লড়াইটা আকস্মিক। দুজন একই সাথে আমাদের ওপর লাফিয়ে পড়েছিল। অবচেতন মনের সাড়া পেয়ে সরে না পড়লে এতক্ষণ আমাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। আমারা স্থানচূত্য হয়েছিলাম বলে বাঘ আর চিতা আমাদের বদলে পরস্পরের ঘাড়ে এসে পড়ে।
লড়াই দেখছিলাম হতভম্বের মতো। ঘোর কাটিয়ে উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করলাম। পিঠে পাণ্ডের হাতের টোকা। বিড়বিড় করে বলল, ‘নড়াচড়া করো না। ওদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে। তখন লড়াই ছেড়ে আমাদের ওপর চড়াও হবে।’
দুই দানবের গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠছিল মাটি। বাঘ শক্তিতে অনেক এগিয়ে। চিতা শক্তির ঘাটতিটা পুষিয়ে দিচ্ছিল তার স্বভাবসুলভ ক্ষিপ্রপতায়। নখ ও দাঁতের ব্যবহারও করে যাচ্ছিল সমানতালে। কিন্তু একজনকে হারতে হবেই। শেষ পর্যন্ত শক্তিরই জয় হলো।
চিতার ক্ষতবিক্ষত শরীরটা নিজের বিশাল দেহের নিচে ধরে রেখেছে কেঁদো বাঘটা। তারপর শ্বদাঁত দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে বসিয়ে দিল চিতার খুলিতে। মট করে শব্দ করে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। ছিটকে বেরিয়ে এলো চিতার একটা চোখও। চিতাটা সম্পূর্ণ নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত বাঘটা বসে রইল ওর পিঠের ওপর। গুলি করে বাঘের খুলি উড়িয়ে দেবার মোক্ষম সুযোগ। এনাইহিলিন গান চালালাম। কাজ হলো না। পাণ্ডের দিকে তাকালাম। অবাক চোখে দেখলাম, পাণ্ডের চোখ লড়াইয়ে ময়দানে নেই। তবে কি এই লড়াইয়ের চেয়েও বিস্ময়কর কিছু ওর চোখে পড়েছে?
পাণ্ডের দৃষ্টি অনুসরণ করে চোখ আটকে গেল ডানদিকের একটা বড় গাছের তলায়। বিরাট একটা ময়াল সাপ নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে বাঘটার পেছন দিকে। হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে আমার মাথায়। কিছু বলতে পারলাম না সে কথা। কী আকর্ষণ সম্মোহিত করে রেখেছে সামনের দৃশ্যের পানে। মš মুগ্ধের মতো দেখতে লাগলাম সাপটার গতিবিধি।
চিতাটা তখনও একেবারে নিথর হয়নি। গলার ভেতর থেকে ঘড়ঘড়ে একটা শব্দ বের হচ্ছে। বাঘও গর্জাচ্ছে। তাদের মিলিত শব্দে সাপের সরসরানি চাপা পড়ে গেছে। সাপটা বাঘের সাত আট ফুট কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াল। মাটি থেকে মাথাটা উঁচু করে তাকিয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে। লম্বা চেরা জিবটা লক-লক করে বার বার বের হচ্ছে মুখের ভেতর থেকে। স্থির ঠাণ্ড চোখ দুটো যেন কাচের মতো চকচক করে জ্বলে উঠল। তারপর চোখের পলক পড়তে যেটুকু দেরি। সাপের মাথাটা সপাটে আঘাত করল বাঘের পিঠে। চিতার পিঠ থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল মাটির ওপরে। তারপর একটা গড়াগড়ি। এরপর বনের রাজার আর দেখবার হাল নেই। চার পাঁচটা প্যাঁচে ময়লাটা তাকে জড়িয়ে ফেলেছে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মরণ পাঁকে সাপটা বাঘের বুকের দিক থেকে পেছন পর্র্যন্ত পেঁচিয়ে ফেলেছিল। বাঘের বুকের হাড়গুলো গুড়িয়ে যাবার যোগাড় হলো। একটু আগে বনের রাজা বিজয় গৌরবে মরণ কামড় বসিয়েছিল চিতার খুলিতে। এখন তারই আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত হয়ে উঠল গোটা বন। ক্রমেই নিস্তেজ হতে লাগল সে চিৎকার।
বুকের প্যাঁচটা শেষ করে সাপটা মাথাটা উঁচু করে রেখেছিল বাঘের ডানকানের ইঞ্চিখানেক ওপরে। বাঘ প্রাণপণে চেষ্টা করছিল থাবা বাড়িয়ে সেটার নাগাল পেতে। ময়ালকে নিতান্ত আলসে প্রাণী মনে হয়। কিন্তু প্রয়োজনের সময় সে কতটা ক্ষিপ্র হতে পারে তার নিদর্শন দেখে গেলাম একের পর এক। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ময়াল তার মাথাটাকে বাঘের থাবা থেকে রক্ষা করছিল।
বনের রাজা বলে কথা! মরার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল ছাড়ল না বাঘ। সফল হলো অবশেষে। কিন্তু ততক্ষণে গুড়িয়ে গেছে তার কোমরের ছাড়। তাতে কী! অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় বাগে আনল সাপের মাথাটা। মৃত্যু দুয়ারে দাঁড়িয়েও রেখে গেল হিংস্রতার শেষ স্বাক্ষর। ক্রোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলল ময়ালের মাথাটা। পরস্পর সাথে সাথে জড়িয়ে দুজনেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।
আমাদের মতো সৌভাগ্যবান মানুষ দুনিয়াই তৃতীয়জন আছে? যাত্রাপালার ইন্দ্রজাল একসময় বাংলার দর্শকদের একসময় যেমন মোহাবিষ্ট করে রাখত, আমারাও যেন এতক্ষণ তেমন এক জগতে ছিলাম। অবিশ্বাস্য, অবস্বরণীয় অভিজ্ঞতা। এমন অভিজ্ঞতা কখনও কী কারও ভাগ্যে জুটেছে? নাহ! নিজেকে কিন্তু বেশিক্ষণ সে ধারণা থাকল না। কারণ মনে পড়ে গেল জিম করবেটের এক অভিজ্ঞতার কথা। ‘পিপলপানির বাঘ’। হ্যাঁ সেই গল্পেই করবেট লিখেছিলেন, এমনই এক আশ্চর্য ঘটনার কথা।
খুঁটিয়ে ভাবতেই মনে পড়ল, আমরা আজ যা দেখছি, তা মোটেও ইউনিক অভিজ্ঞতা নয়। করবেট কুঁয়ার সিংকে নিয়ে যা যা দেখেছিলেন তারই পুনর্মাঞ্চায়ন ঘটল আজ। ‘দাঁড়াও’ দাঁড়াও, শুরু থেকে ভাবি।’ বিড় বিড় করে বললাম আমি।
‘বিড়বিড় করে কী বলছ,’ পাণ্ডে আমার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল। সামনে তাকিয়ে দেখ...’
চোখ তুলে দেখি, রণক্ষেত্রের মৃত চিতা, বাঘ, ময়াল কোনটাই নেই। সামনে ছায়া সুনিবীড় শান্ত জঙ্গল। যেন কিছুই ঘটেনি। পাণ্ডে অবাক গলায় বলছে, ‘আশ্চর্য, বড্ড আশ্চর্য!’
হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার মাথায়। চেঁচিয়ে বললাম, ‘পেয়েছি। সব এখন পরিষ্কার। পানির মতো।’
‘কী পরিষ্কার?’ পাণ্ডের কণ্ঠ থেকে অবাক স্বরটা যায়নি।
‘আরেকটু ধৈর্য ধরো, রহস্যের শেষটা দেখে নিই।’ বললাম আমি। পাণ্ডে আমার স্বভাব জানে। তাই আর কথা বাড়াল না।

সন্ধ্যায় বেরিয়েছিলাম গ্রামের দিকে। মানুষ দেখি ভয়ে দিশেহারা। ঘরের দরজা-জানালায় খিল এঁটে নীরব হয়ে গেছে। দূরে টিলার চূড়ায় একটা মন্দির। সেখানেই কেবল আলো জ্বলছে টিমটিম করে। পাণ্ডেকে বললাম চলো তো ওদিকে। পাণ্ডে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল। তারপর অনুসরণ করল আমাকে।
চার-পাঁচজন পুরোহিত ধূপধুনো জ্বালিয়ে প্রার্থনা করছে। আমাদের দেখে ইশারায় বসতে বলল। আধঘণ্টা পর ধ্যান ভাঙল ওদের। বয়স্ক একজন পুরোহিত এগিয়ে এসে বলল, ‘বাবু আপনারা বাঘ মারতে এসেছেন? কিন্তু এসব তো বাঘের কাজ নয়। চুরাইল আমাদের ওপর রুষ্ট হয়েছেন। মা নয়নাই ভরসা।’
‘ঠিক কবে থেকে আপনারা বুঝলেন চুরাইল রুষ্ট হয়েছেন?’ বললাম আমি।
‘তা ধরুন, আট-দশদিন আগের কথা। আমার ভাইপো রমানাথ গিয়েছিল উত্তর বনের ওধারে। মোষ চরাতে। ওর এক বন্ধু তারক ছিল সাথে। ওদিকে ভালো ঘাস আছে। এলাকাটা নির্জন। একদিন দেখে পাহাড়ে গুহার ভেতর কাপালিক ঢুকল। ভয়ঙ্কর চেহারা। ওরা প্রথমে একটু ডড়কে যায়। এরপর একটু ধাতস্ত হয়ে এগিয়ে যায় পাহাড়ের দিকে। গুহার মুখে গিয়ে একেবারে হতভম্ব। গুহার মুখটা খোলা অথচ ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কেমন একটা ভৌতিক ব্যাপার যেন। তারক বলে, জায়গাটা ভালো ঠেকছে না। চল ফিরে যাই। রমানাথ একটু সাহসী ছেলে। ও বলে তুই দাঁড়া আমি ভেতরটা দেখে আসি। বাবু কী আর বলব। রমানাথ সেই যে ভেতরে গেল আর ফেরেনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারক রমানাথের জন্য অপেক্ষা করে। হাঁকডাক দেয়। কিন্তু ফেরেনি। সন্ধ্যা হওয়ার আগে রমানাথ ফিরে আসে।’
‘কেউ যায়নি রমানাথের খোঁজে!’ পাণ্ডে অবাক হয়ে গেল।
‘ক্ষেপেছেন বাবুসাব। সেদিন রাত থেকেই তো চলছে চুরাইলের তাণ্ডব। কার বুকের পাঁটা অত বড়, রমানাথের খোঁজ নেবে!’
আমি বললাম, ‘ঠাকুর মশাই, আপনার ভাইপো যদি বেঁচে থাকে নিশ্চয়ই ফিরে পাবেন। কথা দিচ্ছি।’
পুরুত আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর দুহাত জোড় করে আবার চলে গেল মূর্তির দিকে। আমরা ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছিলাম। পেছন থেকে সেই পুরুতের হাঁক এলো, ‘বাবুসাব, বন্দুক আর বিজ্ঞানে কোনও কাজ হবে না। করবেট বাবু সাধু মানুষ ছিলেন। অলৌকিক শক্তি ছিল তাঁর। তাই রুদ্রপ্রয়োগের অপদেবতাকে মারতে পেরেছিলেন। আপনাদের সে ক্ষমতা কোথায়?’
‘চিন্তা করবেন না ঠাকুর মশাই,’ আমিও হেঁকে বললাম। ‘কিছুটা অলৌকিক শক্তি আমারও আছে।’
আমার কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হলো না।
রাতে উঠলাম বনবিভাগের বাংলোয়।
‘কী বুঝলে বলো তো?’ পাণ্ডে বলল, ‘এত আত্মবিশ্বাস হটাৎ কোত্থেক এলো তোমার?’ আমি ততক্ষণে অ্যান্টি-গ্রাভিটেশনাল ব্যাগটা খুলতে শুরু করেছি। বললাম, ‘দ্যাখোই না কী করি।’
ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করলাম একটা ছোট্ট বাক্স। ওর ভেতর ঘুমিয়ে আছে একটা রোবট মৌমাছি।
মৌমাছি দেখে অবাক হলো পাণ্ডে। বলল, ‘ওটা কী? এটা তুমি বাক্সে আটকে রেখেছিলে?”
বললাম, ‘আসল নয়, রোবট। এক কথায় মৌবট’
‘রোবট? বোঝাই তো যায় না!’ অবাক হলো পাণ্ডে।
বললাম, ‘কাপালিককে মৌমাছির কামড় খাওয়ালে কেমন হয়! জিনিসটা ক্ষুদে হলে কী হবে। এটা রাডারকে ফাঁকি দিতে পারে। স্যাটেলাইটেও এর সিগন্যাল ধরা পড়বে না। এখন দেখা যাক কাপালিকের তন্ত্র-মন্ত্র এড়াতে পারে কি-না?’
‘কী জানি বাপু। তোমার ভাবগতিক কিছু ধরতে পারছি না।’
ছোট্ট মৌবটকে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে চালু করে দিলাম। বসলাম ল্যাপটপের মনিটরের সামনে। মৌবটকে চালানোর একটা সফটওয়ার আছে।
রিমোট টিপে মৌবট ছেড়ে দিলাম। ষাট মাইল বেগে উড়তে পারে। বড় জোর ছ’মিনিট লাগবে সাধুবাবার আখড়ায় পৌঁছাতে। ওর চোখ দুটো আসলে মাইক্রো ক্যামেরা। তবে শক্তিশালী। সাধারণ রোবটের চেয়ে এর কিছু বড় গুন আছে এর। রেডিয়েশন ও চৌম্বকক্ষেত্র সনাক্ত করার ক্ষমতা আছে। আর লাইভ ছবি আলোর গতিতে ট্রান্সমিশন করতে পারে। এছাড়াও তৈরি করতে পারে বিভিন্ন মাত্রার টাইম হোল। ফলে এক মাত্রার জগত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রার জগতে চলে যেতে পারে।’
ল্যাপটপটা চালিয়ে দিলাম। বিশেষ একটা সফটওয়ার অ্যাপ বানিয়েছিলাম। মৌবটের সাথে সরাসরি যোগাযোগের জন্য। আরও কিছু টুলস যোগ করা আছে অ্যাপে। একটা হলো মৌবট যেখানে অবস্থান করছে সেখানকার তাপমাত্রা নির্দেশ করে। আরেকটা টুলস একটা বিদ্যুচৌম্বক তরঙ্গের নয়েজ সেন্সর করে। আরেকটা টুলস দেখায় রেডিও অ্যাক্টিভ নয়েজ।
জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে চলেছে আমার মৌমবোট। নিচের বাড়ি-ঘরগুলো প্লেন থেকে দেখা নিচের দৃশ্য মতো লাগছে। ঠিক তিন মিনিটের মাথায় হঠাৎ বিদ্যুৎচৌম্বক নয়েজটা বেড়ে গেল। আমি আর পাণ্ডে স্থির দৃষ্টি রেখেছি স্ক্রিনে। আমাকে অবাক হতে দেখে ওর ভেতরেও চঞ্চলতা দেখলাম। লাইভ টেলিকাস্টের দেখলাম একটা বাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে মৌবট। বাড়িটা ছবিতে দেখেছি বহুবার। অতএব নিশ্চিত হলাম ওটাই কারবেটের কালাধুঙ্গির বাড়ি। ‘কিন্তু এখানে চৌম্বকক্ষেত্রের নয়েজ এত বেশি কেন?’ বিড় বিড় করে বললাম আমি।

মাউস বাটনে চাপ দিয়ে মৌবটের দিক পরিবর্তন করলাম। সোজা নামিয়ে নিয়ে করবেটের বাড়ি আঙিনায়। একটা গাছের ডালে বসালাম। তারপর ক্যামেরার ফোকাসটা বাড়িয়ে ঘরের বারান্দার ছবি নিয়ে এলাম স্ক্রিনে। বন্দুক হাতে বসে আছে এক সাহেব। পাশে এক দাঁড়িওয়ালা ভারতীয়।
‘কাল একেই না মাছ ধরতে দেখলাম?’ মুখ খুলল পাণ্ডে।
‘হুম!’ জবাব দিলাম। মাথায় তখন রহস্যের শেষ ক্যালুকলেশন চলছে। বললাম, ‘লোকটাকে চিনতে পারছ না?’
‘নাহ’ বলল পাণ্ডে।
‘করবেট!’ বললাম আমি।
‘জিম করবেট!’ হতভম্ব হয়ে গেল পাণ্ডে। ‘কীভাবে সম্ভব?’
‘মানুষখেকোরা যেভাবে মানুষ মারছে, করবেটও সেভাবে বেঁচে উঠেছেন।
‘একটু ঝেড়ে কাশো তো ভাই!’ অনুনয়ের সুরে বলল পাণ্ডে।
‘ভিসিপির ক্যাসেট দেখেছো? কিংবা এ যুগের সিডি ডিস্কগুলো।’
‘না-দেখার কী আছে!’ অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলল পাণ্ডে।
বললাম, ‘সিডি বা ভিসিপির ক্যাসেটে ছবি সংরক্ষণ করা হয় কীভাবে।’
‘চৌম্বক তরঙ্গ হিসেবে ডিস্কে বা ক্যাসেটির ফিতেয় ছবি জমা করা হয়। তারপর প্লেয়ারে রিডার ওগুলো আমার আলোক তরঙ্গে কনভার্ট করে পর্দায় দেখানো হয়। অর্থাৎ ক্যাসেটের ফিতে বা ডিস্ক শক্তিশালি চৌম্বকক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে।’
‘একজাক্টলি তাই ঘটছে এখানে?’
‘মানে?’
‘ম্যানেটা খুব সহজ? পুরো উত্তরাখণ্ড জুড়ে যত ঘটনা ঘটেছে অতীতে। সেগুলো চৌম্বক তরঙ্গ হিসেবে আটকে পড়েছে কোনও ম্যাগনেটিক ফিল্ডে। পরে সেগুলোই দেখানো হচ্ছে একেকবার একেক জায়গায় একেক ঘটনার ছবি। তবে টিভির পর্দায় ছবি আমরা দ্বিমাতিক দেখি, এখানে পর্দা-ফর্দার বালাই নেই। খোলাস্থানটাকেই পর্দা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। থ্রিডি মুভির মতো।’
‘কিন্তু এত বাস্তব দেখাবে?’
‘কেন নয়? চৌম্বকক্ষেত্রটা অত্যন্ত শক্তিশালী। প্রতিফলিত আলোর প্রায় সবটুকুই হয়তো ধরে রেখেছিল।’
‘কিন্তু আমরা সেখানে উপস্থিত হচ্ছি কীভাবে?’
‘এটাই হচ্ছে আসল কথা! যে জায়গায় যেসব ঘটনা ঘটেছিল। ঠিক সেসব জায়গায় ঠিক একই সময়ের অতীত দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। তাই আমরা ওর ভেতরে ঢুকে যেতে পারছি। কিন্তু কোনও ঘটনায় প্রভাব ফেলতে পারছি না। যেমন করবেট কাল আমাদের কথায় সায় দেননি। আমাদের দিকে ফিরেও তাকাননি। কারণ উনি তো করবেট নন। তাঁর ছবি আমরা দেখেছি। ছবি কি আমাদের কথা শুনবে। বাঘ-হাতির লড়াইয়েও একই ঘটনা। আমার অ্যানাইহিলিন গানে কাজ করেনি একই কারণে।’
‘হুম বুঝলাম! কিন্তু বাঘ-চিতা-ময়ালের লড়াইয়ের ময়দানে আমাদের বদলে করবেট আর কুঁয়ার সিংয়ের থাকার কথা। কিন্তু তাঁদের তো দিখিনি!’ পাল্টা যুক্তি দিল পাণ্ডে।
‘সিনেমা বানাতে গিয়ে এডিটিং করা হয় জানো তো।’ জবাবে বললাম আমি। ‘এখানেও তাই করা হচ্ছে। করবেট আর কুঁয়ার সিংকে মুছে ফেলা হয়েছে ওই ঘটনা থেকে। হয়তো আমাদের ধোকা দেওয়ার জন্যে।’
পাণ্ডে গম্ভীর স্বরে করে বলল, ‘ম্যাগনেটিক ফিল্ডটা কোথায়? আর মুভিটা দেখাচ্ছেই বা কে?’
‘তার খোঁজেই মৌমবটকে পাঠিয়েছি।’ বললাম আমি। তার পরই মাউস বাটন টিপে উড়িয়ে দিলাম আবার মৌবটাকে বললাম, ‘ওই সাধুবাবাই কলকাঠি নাড়ছে।’

পাইনের বন পেছনে ফেলে পাহাড়ি এক গোচরণ ভূমির দেখা পেলাম পর্দায়। মাউস বাটন চেপে শ্লথ করে দিলাম মৌবটের গতি। একটা পাহাড় থেকে বড্ড বেশি নয়েজ আসছে। চৌম্বক তরঙ্গের নয়েজ। সাথে আরেকটা আরেকটা সিগন্যাল। এটা একেবারেই অপরিচিত। মহাজাগতিক রশ্মি থেকেও এখনও পর্যন্ত এধরনের ফোনও সিগন্যাল পাওয়া যায়নি। খুঁজে-টুজে একটা গুহামুখ দেখতে পেলাম। আশ্চর্য এক গুহামুখ। মৌবট একেবারে ওটার কাছে চলে এসেছে। গুহামুখের ভেতরের মাত্র একফুট অবধি দেখা যাচ্ছে। তারপর কীসের যেন প্রাচীর। অদৃশ্য প্রাচীর। ওপারের কিছু দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ এক সাধুবাবার চেহারা দেখতে পেলাম। মৌবটকে লাগিয়ে দিলাম তার পেছনে। সাধুবাবা ধীরে পায়ে এগুচ্ছেন গুহামুখের দিকে। তারপর ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেলেন অদৃশ্য দেয়ালের খুব কাছে। তারপর দুই পা বাড়াতেই একেবারে ভ্যানিশ! কী হলো! মৌবটকে পাঠিয়ে দিলাম গুহমুখ বরাবর। তারপরে আমাদের ল্যাপটপের পর্দা যেন বিস্ফোরিত হলো। কিছুক্ষণ আলোর বিচ্ছুরণ ছাড়া কিছু দেখতে পেলাম না। বিষম বিচ্ছুরণ। এরপর ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হলো একটা আলোর টানেল। এটাই কি তবে ওযার্ম হোল? না ম্যাগনেটিক হোল? নিজের মনেই প্রশ্ন জাগল। বিদ্যুৎগতিতে সেই টানেল পেরিয়ে গেল মৌবট। তারপর অন্য এক জগত। বিশাল এক ল্যাবরেটরি। কিন্তু পৃথিবীর কোনও ল্যাবরেটরিই এত উন্নত নয়। নাসা, বেল, সার্নের ল্যাবরেটরি আমি দেখেছি। কিন্তু এর সাথে কারও তুলনা চলে না।
মৌবট সাধুবাবার পিছু নিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর তাকে আবার পাওয়া গেল। কিন্তু সেকেন্ডের মধ্যেই সাধুবাবা মানুষ থেকে পরিবর্তন হয়ে গেল কিম্ভূত এক জন্তুতে! তারপর বিপবিপ কর প্রচণ্ড একটা শব্দ হলো ওখানে। সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক কিম্ভূত জন্তু এগিয়ে এলো।
অদ্ভুত গুঞ্জন উঠল। সাপের মতো হিসহিসে গুজ্ঞন। জন্তুগুলোর ধড়টা বুনো মোষের মতো। মাথাটা সাপের মতো। কিলবিল করে মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে লকলকে জিভ। মাথার দুপাশে দুটো শুঁড়। হাতের মতো ব্যবহার করছে শুঁড় দুটো। মৌবটের অস্তিত্ব টের পেয়ে গেছে। ওকে দেখেও ফেলল একটা জন্তু।
হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল। পারল না। এরপর একটা যন্ত্র তাক করল মৌবোটের দিকে।
‘ব্লাস্টার ট্রাস্টার হবে!’ বললাম আমি। সময় নেই। মৌবটের পেটের নিচে একটা ম্যাগনেটিক টিউব আছে। দ্রুত মৌবট সেখানে উচ্চমাত্রায় চৌম্বক বলয় তৈরি করল। মৌবটকে ঘিরে তৈরি হলো টাইম হোল। অন্যমাত্রার টাইম হোল। কিম্ভূত প্রাণীগুলো আর খুঁজে পেল না মৌবটকে। কিম্ভূত প্রাণীগুলোও টাইম হোল তৈরি করতে পারে। নইলে দূরগ্রহ থেকে আমাদের পৃথিবীতে আসতে পারত না। কিন্তু মৌবটকে ঘিরে যে মাত্রার টাইম হোল তৈরি হয়েছে তার হদিস ওরা পাবে না। অবশ্য একই মাত্রার টাইমহোল যদি তৈরি করতে পারে তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু মাত্রা বুঝে উঠতেই ওদের অনেক সময় পেরিয়ে যাবে। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে মৌবট কিম্ভুত প্রাণীদের দেখতে পাচ্ছে কিন্তু ওরা মৌবাটকে দেখতে পাচ্ছে না।
ল্যাপটপের মাউসে আঙুল চালিয়ে মৌবটকে সামনে এগিয়ে নিলাম। বিশাল এক করিডোর পেরিয়ে একটা প্রিজন সেলের মতো জায়গা। নিশ্চিদ্র। ওদের উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে প্রটেক্ট করা। তার ভেতরেই রয়েছে এক যুবক। এই কি রমানাথ? পুরুত মশাইয় রমানাথের চেহারার বর্ণনা দিয়েছিল। তার সাথে মিলে যায়। মৌবট যেহেতু অন্যমাত্রার টাইম হোলে রয়েছে, তাই প্রিজন সেলের ভেতরে ঢুকতে অসুবিধা হলো না। রমানাথ পিজনের একাকোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। বোকার মতো ঝিম মেরে। মৌবটকে ওর মাথার ওপর নিয়ে স্থির করলাম। টাইম হোলটা বড় হলো। অনেক বড়। একটা মানুষ ঢুকে পড়তে পারবে সহজেই। তারক কিছুই দেখাতে পারল না। হঠাৎ হোলটা ওকে ঘিরে ধরল। তারপর গিলে ফেলল রমানাথকে। ও এখন নিরাপদ। কিম্ভুত প্রাণীদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
‘এবার ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ করো।’ বললাম পাণ্ডেকে।
পাণ্ডে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার চোখে চোখ রাখল।
বললাম, ‘ডিনামাইট দিয়ে গুহাটা ধ্বংস করতে হবে।’
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এই সিরিজের অন্যগল্প : বিষ্ণুপদের বিড়াল, অন্য পৃথিবী, কিউপিড ব্যালান্স, জামিল ও অদৃশ্য মানব, ভিনগ্রহের পাণ্ডুলিপি-১, , , ,


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলেই এড়িয়ে গেছে চোখ..…পড়লাম.…বরাবরের মতই অসাধারণ ।আপনার জীব বৈচিত্র ভিত্তিক লিখা গুলো আমার পড়তে খুব ভাল লাগে। অজানা অনেক কিছু জানা যায়।কৃতজ্ঞতা জানায়।
এ্যানি মাসুদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।