সাম্রাজ্যবাদের কি হল? (প্রথম পর্ব)

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৩/১০/২০০৮ - ১১:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(প্রভাত পাটনায়েকের “Whatever Happened to Imperialism” শীর্ষক রচনাটি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত “Monthly Review”-এর Volume: 42 No: 6-এ ১৯৯০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। রচনাটির আমার অনুবাদ ইতিপূর্বে মাসিক “সংস্কৃতি”র ২৭ বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা, অগাস্ট ২০০০-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৯০ সালের লেখাটি ২০০০ সালে যেমন প্রাসঙ্গিক ছিল তার আট বৎসর পরে আজও তার প্রাসঙ্গিকতা একই প্রকার রয়ে গেছে। প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে অনুবাদটি ঈষৎ পরিবর্তন করে এখানে পোস্ট করা হল।)

একজন বহিরাগতের চোখে গত এক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মার্কসীয় আলোচনায় যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে তা নজরে না পড়ে পারে না। আজকাল খুব কম লোকেই সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে কথা বলেন। ১৯৭৪ সালে আমি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপণা ছেড়ে যাই। পনের বৎসর আগে আমি যখন পশ্চিম ছেড়ে গিয়েছিলাম তখন মার্কসবাদ সম্পর্কিত যে কোন আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল সাম্রাজ্যবাদ। তখন যুক্তরাষ্ট্রে সাম্রাজ্যবাদ এত বহুল আলোচিত বিষয় ছিল বা এর উপর এত বেশি লেখালেখি হত যে ইউরোপের মার্কসবাদীরা যুক্তরাষ্ট্রের মার্কসবাদকে ‘তৃতীয় বিশ্ববাদ’গ্রস্থ বলত। হার্বার্ট মার্কাস লিখেছিলেন যে, “প্রাগ্রসর পুঁজিবাদ তার অন্তঃস্থিত শ্রেণী সংগ্রামকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছে যেখানে তার বিরূদ্ধে একমাত্র কার্যকর চ্যালেঞ্জ কেবলমাত্র (ছাত্র ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলো ছাড়া) একমাত্র প্রান্ত থেকেই হতে পারে”।

“Monthly Review”-র অবস্থান মোটামুটি একই রকম ছিল। সে সময় তৃতীয় বিশ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের প্রবন্ধ আর বইয়ের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। এসব বই বা প্রবন্ধের অধিকাংশ ছিল সন্দেহাতীতভাবে অজ্ঞতাপূর্ণ এবং সেসব নানা রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উপস্থাপণ করত। কিন্তু সেগুলো ছিল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, এবং সারা বিশ্বের মার্কসবাদীরা সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক প্রকাশনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকত।

আজকের আলোচ্য বিষয় অবশ্য সেসব নয়। ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি উচ্চারিত হলে আজকের তরুণ মার্কসবাদীরা বিমূঢ় হয়ে পড়েন। এখনকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় - পূর্ব ইউরোপ বা পেরেস্ত্রয়কা আলোচিত হয় সাম্রাজ্যবাদের উল্লেখ ছাড়াই। পানামায় মার্কিন অনুপ্রবেশ বা নিকারাগুয়া ও এল সালভাদরে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ প্রভৃতি বিষয়ে যখন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয় তখনো তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাগুলো সাম্রাজ্যবাদকে স্পর্শ করে না। বস্তুতঃ ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বিষয়টি মার্কসীয় জার্নালগুলো থেকে, বিশেষতঃ সাম্প্রতিককালের জার্নালগুলো থেকে, উধাও হয়ে গেছে।

আশ্চর্যের বিষয়, ব্যাপারটি কিন্তু একারনে ঘটেনি যে কেউ সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে নয়া তত্ত্ব পেশ করেছেন। সাম্রাজ্যবাদের ব্যাপারে নিরবতা কোন তীব্র বিতর্কে হেরে যাবার ফল নয়। এটি তাত্ত্বিকভাবে সচেতন নিরবতাও নয়। ব্যাপারটা এমনও নয় যে গত দেড় দশকে বিশ্ব এতটাই পালটে গেছে যে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ একটি বাতিল বিষয়ে পরিনত হয়েছে।

মাত্র পনের বৎসর পার হয়েছে যখন পাঁচ লাখ মার্কিন সেনাকে ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে। সেই মাত্রার আর কিছু এখন হচ্ছে না। কিন্তু মার্কসবাদীরা যুদ্ধের বাস্তবতা থেকে সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ত্ব আবিষ্কার করে না। পক্ষান্তরে, যুদ্ধের কারনসমূহ সাম্রাজ্যবাদের আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়। কেন এখনো দ্বিতীয় একটি ভিয়েতনাম তৈরী হয়নি তা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু যে তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে আমরা ভিয়েতনাম যুদ্ধকে দেখি তা একটি মৌলিক প্রশ্ন। এবং একে কখনোই এই যুক্তিতে বাতিল করা যায় না যে গত পনের বৎসরে দ্বিতীয় কোন ভিয়েতনাম তৈরী হয়নি।

যদিও এরপর থেকে ভিয়েতনামের সমতুল কোন ঘটনা ঘটেনি, তবুও এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে যা থেকে বলা যায় বর্তমান বিশ্বের মৌলিক চরিত্রে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। গ্রানাডায় এবং সাম্প্রতিককালে পানামায় মার্কিন অনুপ্রবেশ প্রমাণ করে যে মার্কিন আদালতের হাত ভিনদেশ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। মার্কিন তরুনদের মাদকাসক্তির মত যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন সমস্যাগুলোর দোহাই দিয়ে তারা গোটা লাতিন আমেরিকার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে। এমনকি উৎপাদন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে লাতিন আমেরিকার কৃষকদের মতামতের বিপক্ষে তারা লড়াই শুরু করেছে। যদিও কোকোর পরিবর্তে উৎপাদিত অন্য ফসলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এই ধারনাটি প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়া হচ্ছে যে, যদি যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী কোন বিদেশী নাগরিক দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে তাকে অপহরণের (যেমন, পানামার জেনারেল নরিয়েগা) বা হত্যার (যেমন, লিবিয়ায় বিমান হামলা) আইনত অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাখে। মার্কিন এটর্নি জেনারেল কিছুদিন আগে একজন মেক্সিকান ডাক্তারকে অপহরণ করাকে এই যুক্তিতে সমর্থন করলেন যে, ঐ ডাক্তার একজন ড্রাগ বিরোধী কর্মীর হত্যায় সহযোগিতা করেছিল। মার্কিন এটর্নি জেনারেলের যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে, ‘মার্কিনীদের জীবনের মূল্য সর্বাগ্রে’। ভেবে দেখুন কি ঘটত যদি ভারত সরকার ইউনয়ন কার্বাইডের বোর্ড সদস্যদের একই ধরনের যুক্তিতে অপহরণ করত যে তাদের চরম অবহেলায় ভুপালে মিথাইল আইসো-সায়ানাইডের বিষক্রিয়ায় সহস্রাধিক মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে? কি ঘটত যদি নিকারাগুয়া বা এল সালভাদরে গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর ব্যাপারে মার্কিনীদের দায়ী করা হত? এপ্রসঙ্গে কিউবার বিরুদ্ধে দীর্ঘ যুদ্ধের উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।

এগুলো নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক ঘটনা। আন্তর্জাতিক চাতুরী সাম্রাজ্যবাদের লক্ষণ, তার মর্মবস্তু নয়। সাম্রাজ্যবাদ, মৌলিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে চরিত্রায়িত এখনকার বিশ্বে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। বিশেষতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের চেয়ে তো বটেই। কয়েক বৎসর আগেও নয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলা হত। তখন অনুন্নত দেশগুলো তাদের মধ্যকার অনেক গভীর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও নানা রকম ফোরামে মিলিত হয়ে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত দাবি-দাওয়া তুলত। এসব দাবি-দাওয়া প্রায়শঃই খুব সামান্য ধরনের হত। কিন্তু এখন ওগুলো সবই পরিকল্পিতভাবে গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে।

তৃতীয় বিশ্বের সংস্থা জি-৭৭ এখন ভেঙ্গে পড়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো প্রাগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোর সংস্থা জি-৭ এর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হতে পারছেনা। পণ্যের মূল্য ভয়াবহভাবে হ্রাস পেয়েছে। এতে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো তাদের মুদ্রাস্ফীতি সাফল্যের সাথে নিয়ন্ত্রন করতে পেরেছে। তারা তৃতীয় বিশ্বের বৃহদাংশে, বিশেষতঃ আফ্রিকায়, এমন সময় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে পেরেছে যখন বিশ্বে খাদ্যের সঞ্চয় রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। আফ্রিকাতে ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটকে কিন্তু বিশ্বব্যাংক বা অনুরূপ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আফ্রিকান দেশগুলোর অভ্যন্তরীন নীতির বিপর্যয় হিসাবে চিহ্নিত করেছে। সন্দেহ নেই যে আফ্রিকান দেশগুলোর অভ্যন্তরীন নীতির বিপর্যয় ঘটেছে, কিন্তু একথা কেউ বলছেন না যে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের পণ্যের মূল্যহ্রাস আফ্রিকান দেশগুলোর ক্রয়ক্ষমতাকে হ্রাস করেছে। তদুপরি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তাদের শুধু পণ্যালয় ও সেবা বাজার উন্মূক্ত করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনুন্নত দেশগুলো গ্যাট প্রস্তাবে সেবা খাত অন্তর্ভূক্তির যে বিরোধী ভূমিকা নিয়েছিল মার্কিনী চাপে তাও প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)


মন্তব্য

যুধিষ্ঠির এর ছবি

লেখাটা আগে পড়িনি। ভালো লাগছে, সমাপনী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

দিনমজুর এর ছবি

ধন্যবাদ- চমৎকার অনুবাদের জন্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।